গল্প :- বড্ড ভালোবাসি
পর্ব :- ৫১
Writer :- Labiba Islam Roja
:
:
:
-: একরাশ অভিমান নিয়ে বসে আছি আমি।রাফিকে সেই হসপিটালে দেখেছিলাম আমি এ কদিনে আর একবারও ওকে ছুঁয়ে আদর করার সৌভাগ্য হয়নি আমার।এই নিয়ে উনাকে অনেকবার বলেছি আমি ওকে দেখতে যাওয়ার কথা।কিন্তু আমার কথা কখনো কানেই নেন নি উনি।যদিও ভিডিও কলে কথা বলি কিন্তু তাতে মন ভরে না আমার।আজকে উনার সাথে কথা বলবো না আমি।যেখানে আমি উনার সব কথা মেনে চলি সেখানে একটা কথাও শুনবেন না উনি তা তো হতে পারেনা।আজকে উনাকে আমার কথা শুনতেই হবে।হঠাৎ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে আমার ভাবনায় ছেদ ঘটলো।অলস হাতে ফোনটা হাতে নিয়েই দেখালম কল দিয়েছেন উনি।কিন্তু আজকে রিসিভ করবো না আমি।সকালে কতবার বললাম ও বাড়িতে যাবো কথাগুলো যেন কানেই গেলো না উনার।তাহলে এখন কলটাও কানে আসেনি আমার দারুন অজুহাত।এই ফোন বন্ধ হওয়ার নয় একের পর এক বেজেই যাচ্ছে বেজেই যাচ্ছে উফ অসহ্য এর আওয়াজকে এখন বিরক্তি লাগছে আমার। এবার ফোন হাতে নিয়ে রিসিভার বাটনে চাপ দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো উনার চিন্তিত মিষ্টি মাখা আদর জড়ানো কন্ঠ।যেই কন্ঠ শুনে আর রাগ করে থাকার কথা নয় আমার।কিন্তু আমি আজ রাগ করবো খুব বেশি রাগ করবো আমি…
.
রোজ তুমি ঠিক আছো তো..?কোথায় ছিলে এতক্ষণ।আমি সেই কখন থেকে তোমাকে কল দিয়ে যাচ্ছি জানো টেনশনে মাথা কাজ করছিলো না আমার।পরে আম্মুর কাছ থেকে জানতে পারলাম তুমি ঠিক আছো।দুপুরে খাবার খেয়ে মেডিসিন খেয়েছো তো…?আজকে বমি হয়েছে আর…?কি হলো কথা বলছো না কেন……ঘুম ধরেছে নাকি।
.
একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে চলেছেন আমার দিকে উনি আর আমি নীরব শ্রোতার মতো উনার কথাগুলো শুনে যাচ্ছি।যে লোকটা আমাকে নিয়ে সারাদিন এত ভাবে এতটা চিন্তায় থাকে তার উপর কি রেগে থাকা যায়। না থাক রাগটা না হয় বাড়িতে এলেই দেখাবো।এখন রাগ দেখালে অহেতুক টেনশনে থাকবেন কাজে মন বসবেনা উনার।
.
রোজজ তুমি শুনতে পাচ্ছে!!
.
হুমম!!
.
যাক বাবা!!ফাইনালি তোমার কন্ঠটা শুনতে পেলাম।জানো এতক্ষণ কতটা টেনশনে ছিলাম আমি।এখন যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।এতক্ষণ কথা বলছিলে না কেন…?
.
এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করলে কটা প্রশ্নের জবাব দেবো আমি।আমাকে কিছু বলার স্পেস দিয়েছেন আপনি।একনাগাড়ে প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন।নিশ্বাসও ছাড়ছেন না তাহলে আমি কি করে কথা বলবো।একটু নিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললে আমি কিছু বলতে পারতাম।
.
কি করবো বলো বউকে যে বড্ড ভালোবাসি।আমার বউটা খুব দুষ্টু কিনা তাই সারাক্ষণ খুব চিন্তায় থাকি।কখন কি করে কেউ জানেনা।আচ্ছা খেয়েছো তুমি…?
.
হুমম এইতো একটু আগেই খেয়েছি।আপনি বাসায় আসবেন কখন…?
.
আজ কি হলো বরকে মিস করছো বুঝি!!
.
সেরকম কিছুনা এমনি জানতে ইচ্ছা হলো।
.
আজকে আসতে দেরি হবে দুইটা মিটিং আছে। আমার জন্য বসে না থেকে তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পরো কেমন।আচ্ছা রাখছি টেইক কেয়ার বাই।
.
হুম…!!
.
রাতে খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছি আমি।উনার অপেক্ষায় অনেক্ষণ জেগে ছিলাম কিন্তু উনি আসেননি কখন চোখ লেগে গেছে জানিনা।হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার।দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি পানির জগ হাতে রুমে ঢুকছেন উনি।হয়তো অনেক্ষণ আগেই এসেছে কিন্তু আমি টের পাইনি।আপনি কখন এসেছেন…?
.
আমার গলা পেয়ে বিছানায় তাকালেন উনি।অনেক্ষণ হলো এসেছি।তুমি ঘুম থেকে উঠছো কেন…?ঘুমিয়ে পরো।
.
আপনি খেয়েছেন….?
.
মুচকি হেসে আমার পাশে এসে বসলেন উনি।হুম খেয়েছি এবার শুয়ে পরো আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি।
.
আপনি ঘুমাবেন না…?
.
হুম ঘুমাবো তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে আমার কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরেই ঘুমিয়ে পরবো।ঠিক আছে আর কথা বাড়িও না এবার চোখ বন্ধ করো।
.
না আমি এখন ঘুমাবো না।আপনি কাজ করুন আমি আপনার কাছে বসে কাজ দেখবো।(কাঁধে মাথা রেখে)।
.
কেন কিচ্ছু দেখার দরকার নেই। রাত জাগা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এখন ঘুমাও।
.
তাহলে আপনিও ঘুমান!!আপনারও তো শরীর খারাপ করবে।আপনি না ঘুমালে আমিও ঘুমাবো না।সারাদিন তো শুয়ে বসেই কাটাই তাহলে এখন একটু আপনার কাছে বসি না প্লিজ!!(করুন কন্ঠে)
.
ওর মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলাম না আমি।ল্যাবটপ নিয়ে কাজে বসে গেলাম।আমার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে।আজকে এতটা বাচ্চামো করছে কেন বুঝতে পারছিনা আমি।এভাবে জেগে থাকলে ওর ক্ষতি হবে ভেবে নিজের কাজগুলো তাড়াহুড়ো করে শেষ করলাম আমি।আমার কাজ শেষ এবার লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পরো।
.
নো নেভার(কলার টেনে ধরে)এবার আপনি আমায় আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যাবেন।
.
এখন আইসক্রিম কিছুতেই না!!এমনি আইসক্রিম খাওয়া বারণ তবুও দিনের বেলায় হলে ভেবে দেখতাম কিন্তু এখন কিছুতেই হবেনা।
.
আপনি একটা ফকির বউকে আইসক্রিম খাওয়ানোর টাকাও আপনার কাছে নেই।না ফকির না ফকিরের থেকে ছোট লেভেলের হুম হয়তো মিসকিন হবে।ভ্যাঁ ভ্যাঁ করো কেঁদে দিলাম আমি।
.
কি করবে গরীবের বউ হয়ে যখন এসেছো এইটুকু তো এডজাস্ট করতেই হবে।
.
আমি এক্ষুণি আমার ভাইয়াকে কল দিচ্ছি ভাইয়া আমাকে কখনও না করবেনা।এক্ষুণি আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যাবে বলে ফোনটা হাতে নিতেই খপ করে হাত থেকে কেড়ে নিলেন উনি।কিছুতেই না এই রাতের বেলায় তুমি ভাইয়াকে ডিস্টার্ব করতে পারবেনা।আমিও আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যাবো না চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো।
.
না আমি ঘুমাবো না!!আমি আইসক্রিম খাবো(ন্যাকা কান্না করে)।আজকে যদি আইসক্রিম খেতে না নিয়ে যান তাহলে কালকেই বাপের বাড়ি চলে যাবো আমি।
.
তাই নাকি বলেই আমাকে জরিয়ে শুয়ে পরলেন উনি।এটা খুব ভালো হয় আমিও তাই ভাবছি।কবে যাবে কালকে সকালে নাকি বিকালে প্যাক করে দিবো নাকি নিজেই পারবে।
.
উনার কথা শুনে সেই লেভেলের শক খেলাম আমি।কি বলছেন উনি যেখানে আমাকে একদিনের জন্য নিয়ে যান না সেখানে আমাকে ওখানে রেখে আসার জন্য এত তাড়া।আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি।
.
আমিও সিরিয়াসলি বলছি।
.
আমি চলে গেলে আপনার খারাপ লাগবেনা….?
.
না!!খারাপ লাগবে কেন আমিও তোমার সাথে ওখানে গিয়ে থাকবো।তোমার সাথে থাকতে আমার খারাপ নয় ভালোই লাগে।
.
আমি আপনাকে আমাদের বাড়িতে নেবো না।আমি একাই যাবো।
.
তুমি আমাকে নেওয়া না নেওয়ার কে…?আমার শ্বশুর+আপুর বাড়ি আমার যখন ইচ্ছা তখন যাবো।তুমি আমাকে না কিছু বলতে পারো আর না আটকাতে পারো।(নাক টিপে)।এখন ঘুমাও প্লিজ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
.
লোকটার কথা শুনে কিছুটা মায়া হলো সত্যি সারাদিন অফিস করে এখন আমাকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে যাওয়া উনার জন্য কষ্টকর থাক লাগবেনা।আমিও চুপ করে ঘুমিয়ে পরার চেষ্টা চালাচ্ছি।একটু পর আমাকে ছেড়ে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি।কিছুক্ষণ পর রুমে এসে আমাকে ডেকে তুলে বিছানায় বসালেন উনি।
.
কি হলো আমাকে এভাবে তুললেন কেন….?
.
কারণ আছে এই নাও(আইসক্রিম দিয়ে)খাও।
.
আপনি না তখন বললেন আপনার খারাপ লাগছে তাহলে এখন আবার আনতে গেলেন কেন…?
.
আমার বউ আমার কাছে সামান্য আইসক্রিম চেয়েছে আর আমি দেবো না তা কি হয়।আমার বউয়ের জন্য আমি সব করতে পারি আর এটা তো কিছুনা।
.
আমাকে নিয়ে গেলেন না কেন?আমি হেঁটে হেঁটে আইসক্রিম খেতাম।
.
তোমাকে নেবো না বলেই তো তখন না করেছি।এখন তোমাকে নিয়ে হাঁটা অনেক রিস্কি তাই নেইনি।আচ্ছা তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পরো কালকে আমরা সবাই ও বাড়িতে যাবো।
.
সত্যি বলছেন আপনি…?
.
হুম মহারাণী!!আইসক্রিম খেয়েই শুয়ে পরলাম আমি।আমাকে উনার বাহুডোরে আবদ্ধ করে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন উনি।কখন চোখে ঘুম নেমে এলো বুঝতে পারিনি।
.
সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে ও বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি সবাই।আজকে অনেক হ্যাপী আমি।কতদিন পর ও বাড়ি যাচ্ছি আজ।একটু পর আমাদের নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন উনি।বাড়িতে গিয়েই রাফিকে কোলে নিয়ে বসে আছি আমি আর আমার পাশে বসে আছেন রিহান।পিচ্চিটা পিটপিট করে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে।একটু পর পর হেসে উঠছে।আমি ওর ছোট ছোট আঙ্গুল ধরে খেলা করছি।পিচ্চির ওই ছোট হাত ধরে অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার।ওর হাসিটা কেমন মায়া জরানো।হাত পা ছড়াছড়ি করছে অনবরত।রিহান আমার আর রাফির এসব দুষ্টুমি মুগ্ধ নয়নে দেখে চলেছে…!!
.
.
চলবে………..
.গল্প :- বড্ড ভালোাসি
পর্ব :- ৫২
Writer :- Labiba Islam Roja
:
:
:
-: ও বাড়িতে দুদিন কাটিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছি আমরা। রিহানের কড়া শাসনের মধ্যে কেটে গেছে সাত সাতটি মাস।রাফি এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে।তিশাও তিন মাসের প্রেগন্যান্ট এখন।আবির ভাইয়া আর তিশা প্ল্যানিং করেই বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এখন ড্রয়িংরুমের পাশের রুমটায় থাকি আমরা। রিহানের ধারণা উপরনিচ করলে প্রিন্সেসের কষ্ট হবে আর আমিও কেয়ারলেস তাই কিছু একটা অঘটন ঘটাতে পারি।সেই ভেবেই এই সিদ্ধান্ত তার।তাই সবকিছু চিন্তা করে নিচের তলাই আমার জন্য একদম সেইফ।এই সাত মাসে নিজের শরীরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে আমার।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখছি আমি।আজ আমি একা নই একটা প্রাণ বেড়ে উঠেছে আমার মাঝে।কদিন পরই এক চিলতে খুশী নিয়ে আমার কোল আলো করে আসবে সে।তার অপেক্ষায় আছে সবাই।এই কয়েকমাস অনেক জ্বালিয়েছি রিহানকে।মাঝরাতে এটা চাই ওটা চাই কিন্তু কোনো কিছুতেই বিরক্তি দেখিনি উনার মধ্যে।হাসিমুখে আমার সব আবদার পূরণ করে চলেছেন উনি।সবকিছুর পরে একটাই চাওয়া উনার প্রিন্সেস যেনো ভালো থাকে।সুস্থভাবে যেন পৃথিবীতে আসতে পারে।কিন্তু এত খুশীর মধ্যেও আজকাল ভয় হয় যদি বাচ্চাটাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমি চলে যাই।অনেক মেয়েরাই তো বাচ্চা জন্মানোর সময় মারা যায় তাদের মতো যদি আমিও মারা যাই তাহলে।এরপরও একটা খুশী থেকেই যায় তাতে কি আমাদের প্রিন্সেস তো থাকবে উনার চাওয়াটাকে তো পরিপূর্ণ করতে পারবো আমি।আয়নায় নিজেকে দেখে আজ খুব সাজতে ইচ্ছা করছে আমার।অনেকদিন শাড়ি পরিনা সাজগোজের ধারে কাছেও নেই আমি।আজ একটু নিজের মতো করে সাজে রিহানকে সারপ্রাইজ দেবো আমি।রিহান অফিসে একটু পর ফিরে আসবেন উনার আসার আগেই সাজ কমপ্লিট করতে হবে আমার।
.
আলমারি থেকে একটা কফি কালারের শাড়ি বের করে পরে নিলাম আমি।ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক চোখে কাজল কানে ছোট একটা কানদুল হাতে চুড়ি।সেজেগোজে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসলাম আমি।মা মুখে হাসি নিয়ে কাছে বসলেন আমার।হাসিমুখে বললেন খুব দারুন লাগছে আমার মেয়েটাকে।ভালোই করেছিস অনেকদিন সাজতে দেখিনি তোকে।আমাদের কথার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো।মা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন রিহান ড্রয়িংরুমে এসেই হা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমার জন্য খাবার আনতে রান্নাঘরে গেলেন মা।কিছুক্ষণ আমাকে দেখে মুখে হাসির রেখা টেনে আমার পাশে এসে বসলেন উনি।
.
কি হলো ব্যাপারটা আজ এত সাজগোজ কেন..?(ভ্রু নাচিয়ে)
.
এমনি আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই।
.
কিন্তু আমার তো অন্যকিছু মনে হচ্ছে(গালে হাত দিয়ে)
.
অন্যকিছু মানে!!
.
বরকে ইমপ্রেস করতে চাইছো।
.
এ্যাহ বরকে ইমপ্রেস করার কি আছে বর তো এমনি আমার উপরে ফিদা।
.
তাই নাকি আচ্ছা শাড়ি পরেছো ঠিক আছে কিন্তু সাবধানে হাঁটবে!!
.
হুমম!!আমাদের কথার মাঝেই আবারও কলিং বেল বেজে উঠলো।মা আমাকে খাবার দিয়ে দরজা খুলতে গেলেন।উনি ফ্রেশ হওয়ার জন্য নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরালেন।পেছন থেকে আবির ভাইয়ার গলা পেয়ে দাঁড়িয়ে পরলেন উনি।ভাইয়ার সাথে তিশাও এসেছে আমাকে দেখতে।
.
কিরে দোস্ত তোরা কেমন আছিস…?
.
তুই!!দুজনে কোশল বিনিময় করলেন। আমি আর তিশা একজন আরেকজনকে পেয়ে এতদিনের জমানো সব গল্পের ঝুলি নিয়ে বসে পরলাম।কিছুক্ষণ আমাদের কথা শুনে রুমে গেলেন উনি।ফ্রেশ হয়ে আবারও যোগ দিলেন আমাদের আড্ডায়।আবির ভাইয়া আর তিশাকে মা অনেকবার বলে খেতে বসিয়েছেন।রিহানও খেতে বসে গেলেন আমি একটু আগেই খেয়ে নিয়েছি তাই সোফায় বসে আছি।সোফায় বসে বসে বোর হচ্ছি তাই উঠে টেবিলের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম আমি তখনই টেবিল থেকে রিহান বলে উঠলেন তুমি উঠছো কেন দাঁড়াও আমি এসে নিয়ে যাচ্ছি।
.
না আপনি খেতে থাকুন আমি একাই পারবো।
.
ওকে সাবধানে এসো!!
.
মুচকি হেসে সামনের দিকে এগুচ্ছি আমি হঠাৎ শাড়ির সাথে পা পেঁচিয়ে উবু হয়ে ফ্লোরে পরে গেলাম আমি।মুহূর্তেই পুরো দুনিয়া ঘুরে গেলো আমার।আমার একটা ভুল পদক্ষেপ পাল্টে দিলো রিহানের এতদিনের আগলে রাখা প্রিন্সেসের স্বপ্ন সব শেষ।ব্যাথায় চটপট করছি আমি।এই অসহ্য যন্ত্রণার থেকে মরে গেলে হয়তো ভালো হতো।নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এখন।নড়াচড়া শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি আমি।রিহান রোজ বলে ছুটে চলে এলেন আমার কাছে।আমাকে তুলে উনার কোলে মাথা রাখলেন আমার।মা তিশা আবির ভাইয়াও বসে আছেন আমার কাছে।।কোনো হুশই যেন নেই উনার অবুঝের মতো তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।আবির ভাইয়া ক্রমাগত বলে চলেছেন হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু কথাগুলো যেন কানেই পৌছাচ্ছে না উনার।উনার কাধঁ ঝাকিয়ে আবারও একই কথা বললেন ভাইয়া।মুহূর্তেই কোলে তুলে নিয়ে দৌড় লাগালেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে।উনার কোলেই জ্ঞান হারালাম আমি।
.
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে রোজ।ডাক্তার চেকআপ করছেন তাকে।এতক্ষণে রোজের বাবা মা রাহাত রাহা সবাই পৌছে গেছে হসপিটালে।সবার মধ্যে নীরবতা সাথে ভয়ও কাজ করছে।রোজকে দেখে ডক্টর বেরিয়ে এলেন বাইরে।সবাই জড়ো হলো তার সামনে।
.
পেসেন্টের হাজবেন্ড কোথায়…? আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই।
.
জ্বী ডক্টর বলুন আমিই ওর হাজবেন্ড!!
.
দেখুন মিঃরিহান ভালো মন্দ সবকিছুর জন্যই আমাদের সবসময় প্রিপেয়ার থাকতে হয়।আপনিও নিজেকে দুটো মেনে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।আমি জানি এখন যে কথাটা বলবো তাতে আপনি ভেঙ্গে পরবেন কিন্তু এখন আপনার ভেঙ্গে পরার একদম উচিৎ নয়।বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে।
.
কি হয়েছে ডক্টর সরাসরি বলে ফেলুন।আমি শোনার জন্য প্রস্তুত।
.
দেখুন মিঃরিহান আপনার ওয়াইফের প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে এই অবস্থায় উনার সার্জারি অনেক রিস্কি হবে।আর যদি সার্জারি না হয় তাহলে আপনার ওয়াইফ বা বাচ্চা কাউকেই বাঁচাতে পারবো না আমরা।এখন আমরা যেকোনো এজনকে বাঁচাতে পারবো হয় বেবি না হয় মা।যেকোনো একজনকে বেঁচে নিতে হবে আপনাদের।
.
ডক্টরের কথা শুনে থমকে গেলো আমার পৃথিবী।আজ যদি আমি ঠিকমতো রোজের দেখাশুনা করতে পারতাম তাহলে এরকম কিছুই হতো না।না রোজের কিছু হতো না আমার প্রিন্সেসের।আরেকটু সতর্ক কেন হলাম না আমি।সবার মাঝে শুনশান নীরবতা।রাহাতের একটাই কথা তার পরীর কিচ্ছু হতে দেবেনা।কিছুক্ষণ ভেবে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো রিহান। এবার সেই কঠিন ডিসিশন টা নিয়েই নিলো।বাচ্চা নয় রোজকেই চাই তার সবারও এটাই মত।
.
ঠিক আছে আধঘন্টা পর অপারেশন শুরু করবো আমরা।আপনি হসপিটালের সব ফর্মালিটি কমপ্লিট করে নেন।উনার একটু পর জ্ঞান ফিরে আসবে চাইলে আপনারা দেখা করতে পারবেন বলে ডক্টর চলে গেলো।
.
আবিরকে সাথে নিয়ে হসপিটালের ফর্ম ফিলআপ করছে রিহান।সাইন দেওয়ার সমন হাত কাঁপছে ওর।এই একটা সই ওর প্রিন্সেসকে মেরে ফেলবে।সরি প্রিন্সেস তোর বাবা খুব খারাপ স্বার্থপর আমার যে তোর মাকেই বেশি প্রয়োজন।আজ আমার স্বার্থের জন্য তোকে হারিয়ে তোর মাকে বেচে নিলাম আমি।পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।চোখ থেকে টুপটাপ পানি পরছে চোখ থেকে।আবির কাধেঁ হাত দিয়ে ভরসা দিলো।কাঁপা কাঁপা হাতে ফর্ম ফিলাপ করে আবিরকে জরিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেছে সে।
.
জ্ঞান ফিরেই নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম আমি।মাথাটা ভারী হয়ে আছে।খুব কষ্ট হচ্ছে এখন।সামনে দুজন নার্স দাঁড়িয়ে আছেন আমার।এতক্ষণ কিছু মনে না হলেও এখন মনে পরলো কি হয়েছিলো আমার।বেবির কথা মনে হতেই আপনাআপনি পেটে হাত চলে গেলো আমার।নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম আমার বেবি ঠিক আছে তো।
.
আসলে এরকম লাস্ট স্টেজে উবু হয়ে পরায় আপনার আর বাচ্চার কন্ডিশন ভালো না।আপনাদের দুজনকে বাঁচানো সম্ভব নয়।তাই ডক্টর আপনার বাড়ির লোকেদের দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেঁচে নিতে বলেছেন।আর সেখানে আপনার হাজবেন্ড আপনাকেই বেঁচে নিয়েছেন।একটু পর আপনার অপারেশন শুরু হবে।ওই তো আপনার হাজবেন্ড এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে।নার্সের কথায় দরজার দিকে তাকালাম আমি। উনার চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে আছে অনেক্ষণ কান্নার পর যেমন হয়।ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে।পাশে থাকা চেয়ার টেনে আমার সামনে ডান হাত ধরে বসলেন উনি।
.
সরি রোজ আজ আমার জন্য তোমাকে এতটা কষ্ট পেতে হচ্ছে।আমি যদি তখন তোমার পাশে থাকতাম তাহলে এরকম কিছু হতো না।কিন্তু তুমি চিন্তা করো না খুব শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবে তুমি।
.
আপনি এভাবে বলবেন না।সব দোষ আমার আমি কেয়ারলেস নিজের বেবিকে দেখে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি।আচ্ছা আপনি আমার একটা কথা রাখবেন।
.
হুমম বলো কি চাই তোমার।
.
আমার প্রিন্সেসকে!!প্লিজ রিহান আপনি আপনার ডিসিশন পাল্টে নিন।ওকে ঘিরে তো আমরা কত স্বপ্ন দেখেছি বলুন প্লিজ আমার জায়গায় ওকে পৃঘিবীতে আসার পারমিশন দিন রিহান প্লিজ।
.
সরি রোজ ইম্পসিবল!! একবার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেলে আরও বাচ্চা নিতে পারবো কিন্তু তেমাকে হারাতে পারবো না আমি।হ্যাঁ ওকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিলো আমার কিন্তু তোমাকে হারিয়ে কখনও ওকে চাই না আমি।আমার বেঁচে থাকার জন্য তেমাকে চাই।এসব নিয়ে একদম টেনশন করবে না।(চোখ মুখ শক্ত করে)
.
প্লিজ রিহান আমার এই কথাটা রাখুন প্লিজ!!
.
সরি রোজ আমি পারবো না এতটা স্বার্থপর হতে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য তোমাকে বলি দিতে পারবো না আমি। ক্ষমা করো আমায় বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি।
.
জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি।এক দিকে আমার সন্তান অন্যদিকে নিজের জীবন।আজ আমার একটা ভুল পদক্ষেপ পাল্টে দিয়েছে তিন তিনটি জীবনের মোড়।যদি আরেকটু দেখে পা ফেলতাম তাহলে এভাবে আমার প্রিন্সেসকে হারাতে হতো না আমার।প্রথমবার মাতৃত্বের সুখ থেকে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করতে যাচ্ছি আমি।যেটা কখনও ভাবতেও পারিনি আজ সেটার সম্মুখীন আমি।এমনই এক মা যে নিজের অনাগত সন্তানের জীবনের বিনিময়ে বাঁচার পথ খুঁজচ্ছে।কিন্তু আমার সন্তানের আয়ু নিয়ে বাঁচতে পারবো না আমি।এতটা স্বার্থপর মা হতে চাই না।এই সন্তানই রিহানের সব আশা ভরসার প্রতীক ছিলো।ওকে এভাবে মেরে ফেলতে পারিনা আমি।হুম ওকে বাঁচাতে হবে আমার ওর কিচ্ছু হবে না।সব বাধা বিপওি কাটিয়ে পৃথিবীতে আসতেই হবে ওকে।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে হবে।অনুভব করতে হবে এই পৃথিবীর আলো বাতাসকে।
.
কিছুক্ষণ আগে অপারেশন শুরু হয়েছে রোজের।বাইরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে রিহান সহ সবাই।যদিও ওরা রোজকে বেঁচে নিয়েছে তবুও রোজের প্রাণ সংশয়ের ভয় রয়েছে।রিহানকে সান্ত্বনা দিচ্ছে আবির।আর রাহাত পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।সবাই দোয়া দুরুদ পরছে রোজের ভালো হওয়ার আশায়।রিহানকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর প্রণটা কেড়ে নিচ্ছে।
.
সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ডক্টর বাইরে বেড়িয়ে এলেন।তার পিছু পিছু একজন নার্স টাওয়ালে মোড়ানো একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসছে।ডক্টর বেড়িয়ে এসেই মুখে হাসির রেখা টেনে বলে উঠলেন….কনগ্রেচুলেন্স রিহান আপনার ওয়াইফ একটা ফুটফুটে মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছেন।এই কথাটা শুনে যেখানে সবার খুশী হওয়ার কথা সেখানে আজকে সবার মুখে রোজকে হারানোর কালো ছায়া নেমে এসেছে।রিহান চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো বাচ্চা মানে!আমি তো আমার ওয়াইকে চেয়েছিলাম তাহলে এখন বাচ্চা এলো কোথা থেকে।আমার ওয়াইফ কোথায় কেমন আছে ও…?
.
ডক্টর মাথা নিচু করে বললেন আই এম সরি!!
.
এই একটা কথা কেড়ে নিলো সবার মুখের হাসি রোজের মা শব্দ করেই ভেঙ্গে পরলেন কান্নায়।তিশা কেমন পাগলের মতো করছে ওকে সামলানো যাচ্ছে না।রাহাত সেখানেই হাঁটু বাজ করে বসে পরেছে।রিহান রেগে ডক্টরের কলার ধরে জোরে চিৎকার করে বলতে থাকে….আমি চেয়েছিলাম এই বাচ্চাকে চাইনি তো তাহলে কেন আপনি আমার রোজকে আমার থেকে কেড়ে নিলেন।আপনার কাছে রোজকে বাঁচানোর জন্য নিয়ে এসেছিলাম আর আপনি ওকে মেরে দিলেন।পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে রিহান।প্রিয়জনকে হারানের কষ্ট কিছুতেই সহ্য করতে পারছেনা।রিহান এখন নিজের মধ্যে নেই।আবির তিশাকে শান্ত করে রিহানকে এসে থামায়।ডক্টরকে ছেড়ে আবিরের গলা জরিয়ে কাঁদতে থাকে রিহান।
.
.
(