বন্ধ দরজা পর্ব- ২
ফরহাদ সাহেবের কথার মাঝে কেমন যেনো বিয়ে বিয়ে গন্ধ পাচ্ছে সাবা। একরাশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
-” আংকেল আপনার কি বিয়ের উপযুক্ত ছেলে আছে?”
” হুম আছে।”
-” ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন তাইনা?”
-” হ্যাঁ খুজছি।”
-” আমার বোনকে আপনার পছন্দ হয়েছে তাই না আংকেল?”
-” তুমি তো দেখছি খুব ট্যালেন্ট।”
-” হুম আমি অসম্ভব রকমের ট্যালেন্ট। এটা সবাই বলে। সুহাও ট্যালেন্ট। ও খুব ভালো মেয়ে। যে বাড়িতেই বউ হয়ে যাবে সে বাড়ির লোকেদের কপাল খুলে যাবে। ওর মতো মেয়ে পাওয়া যায় নাকি আজকাল? মানুষ হাজার খুঁজেও এমন মেয়ে পায়না। রুপে গুনে কোনো দিকে কম না আমার বোন।”
ফরহাদ সাহেব মুখ টিপে হাসছেন। সুহায়ল া যেমন লজ্জা পাচ্ছেতেমনি বিরক্তও হচ্ছে।
-” কি শুরু করেছিস সাবা? তুই কি চুপ করবি?”
-” দেখ সুহা তোর বিয়ে না হলে আব্বা আমাকে ইমরানের সাথে বিয়ে দিবে না।”
-” তো কর তুই বিয়ে না করেছে কে? আব্বাকে আমি বলে রাজি করাই।”
-” হয়েছে, থামো তোমরা দুজন। বাচ্চাদের মতো আর কত ঝগড়া করবে? সুহায়লা চলো তোমার বাবার কাছে যাই।”
সুহায়লা ফরহাদ সাহেবের সাথে ওর বাবার দেখা করিয়েই সেখান থেকে সরে আসলো। দূর থেকে দেখছে ফরহাদ সাহেব বেশ হেসে হেসে তার মা বাবার সাথে কথা বলছে।
পরদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় সুহায়লার বাবা তিন ছেলে মেয়ের উদ্দ্যেশে বললেন
-” সুহার জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। পাত্র তোর ফুপার বন্ধুর ছেলে।”
-” প্রস্তাব কে দিয়েছে আব্বা?”
-” গতকাল ছেলের বাবা আমাকে আর তোর আম্মাকে সুহার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। আজ ভোরে আবার তোর ফুপা ফোন করেছিলো বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। তোর ফুপা ফুপু দুজনই খুব জোর দিচ্ছে এখানে বিয়ে দেয়ার জন্য।”
-” ছেলে কি করে আব্বা?”
-” বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করে।”
-” কিসের ব্যবসা?”
-” ফরহাদ ভাইয়ের দুইটা গার্মেন্টস আছে।”
-” ছেলেরা তো তাহলে অনেক পয়সা ওয়ালা।”
-” হুম। বনশ্রীতে ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে ছেলেদের। উত্তরার দিকে তিন চারটা জমি আছে। গ্রামে তো সম্পত্তির কোনোহিসাবই নেই। ছেলে বিদেশ থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে এসেছে।”
-” আব্বা একটা কথা বলি। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। আপনার ছোটখাটো একটা বেকারীর দোকান আছে আর আমি মাসে ত্রিশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করি। আপনার আর আমার কামাই মিলিয়ে মাস শেষে ৫০-৬০ হাজার টাকা হয়। আর ছেলের প্রতি মাসের কামাই হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। কোটি টাকার সাথে কি আর হাজার টাকার মিল হয়? তাছাড়া ছেলের হচ্ছে বনশ্রীতে ডুপ্লেক্স বাড়ি। আর আমরা দাদার তৈরী করে যাওয়া এই দোতলা বাড়িটায় থাকি। তাও এত দিনের পুরোনো। অত বড়লোকের কাছে আমাদের বাড়িটা ভাঙাচোরা মনে হবে।”
-” প্রস্তাব তো আমি দেইনি। ছেলের বাবা দিয়েছে। তোর ফুপু ছেলের বাবাকে আমার অবস্থা খুলে বলেছে। সব জেনেও ছেলের বাবা সুহাকে বউ করার জন্য পাগল হয়ে আছে।”
-” ছেলের বয়স কত?”
-” ৩৩ বছর”
বাবার মুখে পাত্রের বয়স শুনে খাওয়া বাদ দিয়ে বাবার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সাদমান।
-” আব্বা সুহার মাত্র বিশ বছর। আর ছেলের তেত্রিশ। তেরো বছরের পার্থক্য। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা? ছেলে আমার চেয়েও ছয় বছরের বড়।”
-” সমস্যা কোথায়?”
-” পুরো একটা জেনারেশন গ্যাপ আব্বা। আর আপনি বলছেন সমস্যা কোথায়?”
-” সাদি, তোর আম্মার সাথে আমার আঠারোবছরের পার্থক্য। আমরা কি সংসার করছি না?”
-” আপনাদের সময়ের কথা ছিলো ভিন্ন। আজকাল এত পার্থক্যে বিয়ে হয় নাকি? তাছাড়া সুহার নিজেরও তো একটা মতামত আছে।”
সুহায়লা এতক্ষন কোনো কথা বলেনি। সাদমানের কথা শুনে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো
-” আব্বা বয়স নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু উনারা এত টাকা পয়সার মালিক। আমাদের সাথে তো উনাদের স্ট্যাটাস ম্যাচ হয়না।”
-” শোন এসব স্ট্যাটাস নিয়ে কথা শোনায় শ্বাশুড়ি ননদরা। ঐ বাড়িতে শুধু তানভীর আর ওর বাবা থাকে। আর কয়েকজন কাজের লোক দারোয়ান আছে। ওর মা নেই। আর কোনো ভাই বোনও নেই। সংসারে কোনো ঝামেলাই পোহাতে হবেনা তোকে। ছেলেকে আমি ছোট থাকতে দেখেছিলাম। বেশ ভদ্র ছিলো ও। ওর বাবাও খুব ভালো মানুষ।তোর ফুপা তো বলছে ছেলে নাকি হীরার টুকরা।”
-” ছেলে সম্পর্কে কি খোঁজ নিবো?”
-” নাহ্। খোঁজ নিয়ে কি করবি? তোর ফুপা ফুপু তো আর মিথ্যা কথা বলবে না। ফরহাদ ভাই আসবে ঘন্টাখানেক পর। তোর ফুপা ফুপুও আসবে। উনি আজই কথা পাকা করতে চাচ্ছেন।”
-” এত জলদি? বিয়ে শাদীর বিষয়ে এত তাড়াহুড়ো করছেন কেনো?”
-” আমি না। ছেলের বাবা করতে চাচ্ছে। ফরহাদ ভাই খুব অসুস্থ থাকেন। তাই উনি চাচ্ছেন ছেলের বিয়েটা জলদি শেষ করে ফেলতে। তানভীরের তো মা বোন নেই। শুধু বাবাই আছে। উনি চলে গেলে তো তানভীরের আর কেউই থাকবে না।”
-” আচ্ছা ছেলের মা মারা গেছে কিভাবে?”
-” মারা যাননি। তানভীরের মা অন্য লোকের হাত ধরে চলে গেছে যখন তানভীর ১২ বছরের।”
-” ওহ্। দেখেন কি হয়। আংকেল আসুক বাসায়। আজ তো অফিস ছুটি। আমি ঘরেই আছি।ছেলেও তো বোধহয় আসবে?”
-” বোধহয় আসবে।”
-“ছেলে আর সুহা একসাথে কথা বলুক। ওদেরও তো পছন্দের একটা ব্যাপার আছে।”
-” হ্যাঁ তা তো আছেই।”
সাবা বেশ উৎফুল্ল কন্ঠে সুহায়লাকে বললো,
-” চল তোকে সাজাই। পাত্র চলে আসবে কিছুক্ষনের মধ্যে।”
ঘন্টা দুয়েক পর বাসার কলিংবেল বাজলো। সাদমান গেট খুলেই প্রথমে পাত্রকে খোঁজা শুরু করেছে। কিন্তু পাত্রকে দেখা যাচ্ছে না।
-” কি রে কাকে খুঁজিস? ঘরে ঢুকতে দিবি না?”
-” ওহ্ ফুপু আসো। ভিতরে আসো।”
সবাই ঘরে ঢুকেছে। ফুপাতো ভাই বোনগুলোও সাথে এসেছে। ড্রাইভার মিষ্টির প্যাকেটগুলো ঘরে নিয়ে ঢুকছে। যাক এতক্ষনে পাত্রকে খুঁজে পাওয়া গেলো ড্রাইভারের পিছন পিছন সে আসছে। সাদমান পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছেলেকে নিংড়ে নিংড়ে দেখে নিচ্ছে। আকাশি রঙা একটা ফুলহাতা শার্ট আর জিন্স পড়ে এসেছে। খুব সাধারনভাবে এসেছে কিন্তু ছেলেটাকে দেখতে বেশ ক্লাসি মনে হচ্ছে। গায়ের রঙটা উজ্জল শ্যামলা। যথেষ্ট লম্বাও বটে। ৫-১১” অথবা ছয় ফুট তো হবেই। ছেলেটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে সাদমানের। তবে ছেলের সাথে সে কিছুক্ষন কথা বলতে চায়। তার মন মানসিকতা সম্পর্কে জানতে চায়। শুধু বাহির দেখে তো আর বোন বিয়ে দেয়া যাবে না। ছেলের ভিতর সম্পর্কেও তো জানতে হবে। ছেলের সাথে সুহায়লার বাবা মা কথা বলছে। সাথে তানভীরের বাবাও এটা সেটা বলছেন। তানভীরের বাবা বেশ রসিক মানুষ। কথা বার্তা শুনেই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু তানভীরকে তেমন হাসিখুশি দেখা যাচ্ছে না। সে ঘরের এদিক সেদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। সাদমান মোটামোটি আন্দাজ করতে পারছে যে পাত্রের তাদের এই পুরোনো আমলের বাড়ি পছন্দ হয়নি। তবে তার ধারনা ভুলও হতে পারে। খানিকটা দ্বিধা দ্বন্দে আছে সাদমান। সাদমানকে তার মা ডেকে বললো,
-“সুহার ঘরে যেয়ে বল যে ওকেএখানে আসতে ”
সাদমান সুহার ঘরে ঢুকতেই দেখে সাবা আর সুহায়লা পর্দার আড়াল থেকে উঁকিঝুকি মারছে। ওকে দেখামাত্রই সাবা বললো,
-” সাদি তুই ছেলেকে দেখেছিস?”
-” হুমম।”
-” কেমন রে ছেলেটা?”
-” আমার তো ভালোই লাগলো। সুহার সাথে বেশ মানাবে। আর ছেলের বয়স অতটা বুঝাও যায়না।”
-” সাদি, তুই ছেলের সাথেকথা বলেছিস?”
-” না রে সুহা। এখনও বলিনি। আব্বা আম্মা কথা বলছে ছেলের সাথে। আচ্ছা বাহিরে চল। আম্মা তোকে ডেকেছে।”
সুহায়লাকে সবার সামনে নিয়ে যাওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় কোন ক্লাইন্টের ফোন আসলো তানভীরের ফোনে। কলটা কেটেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে চলে এলো তানভীর। তানভীরের এমন আচরন সাদমানের বিশেষ পছন্দ হলো না। এটা কেমন আচরন? মেয়েকে ঠিকমতো না দেখেই পাত্র চলে গেলো। এত ব্যস্ততা নিয়ে কে আসতে বলেছে তাকে? তানভীরের বাবাও লজ্জা পেয়ে গেলেন ছেলের এমন কান্ডে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ছেলের প্রচন্ড ব্যস্ততাকে অযুহাত দেখালেন। ঘরের সবাই মেনে নিলেও সাদমানের মনে খোঁচাখুঁচি চলছেই।(চলবে)