#বন্ধ_দরজা
পর্ব-২১
লেখা-মিম
বাসার কাছাকাছি এসে নিশাত তানভীরকে মেসেজ করলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে সুহায়লা বাসায় ঢুকবে। এক এক করে খুব দ্রুত তানভীর সবকয়টা ক্যান্ডেল জ্বালাচ্ছে। ক্যান্ডেল জ্বালানো শেষে দরজায় মাত্র এসে দাঁড়িয়েছে সে। ঠিক তখনই দেখতে পেলো সুহায়লা মেইন গেইট দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে আসছে। পুরো বাসা অন্ধকার। সুহায়লা খানিকটা চমকে গেলো। কাছাকাছি যেতেই ড্রইংরুমে মোমবাতির আবছা আলো দেখতে পাচ্ছে সে। দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। শরীরের গঠনে বুঝা যাচ্ছে এটা তানভীর। লাইট কেনো অফ করে রেখেছে ও? বাসার দরজায় পা রাখা মাত্রই তানভীর সুহায়লাকে কোলে তুলে নিলো।
-” সমস্যা কি? কোলে নিয়েছো কেনো?”
সুহায়লার কথা কানে না তুলে এক পা দুপা করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে তানভীর।
-” কি বলি? কানে যাচ্ছে না?”
-” ………….”
-” তানভীর আমি হাঁটতে পারি। নামাও আমাকে।”
-” …………..”
-” বাসার সমস্ত লাইট অফ করে মোম কেনো জ্বালিয়ে রেখেছো?”
-“……………”
-” মুখে তালা লাগিয়েছো নাকি? কথা বলো না কেনো?”
-” ……….”
-” আরে, কথার উত্তর তো দাও।”
-” এই যে তোমার উত্তর।”
ঘরে ঢুকে সুহায়লা থ মেরে গেলো। এসব কি? পুরো ঘর এত সুন্দর করে সাজানো কেনো? আজ তো কোনো স্পেশাল ডে না। তাছাড়া স্পেশাল ডে হলেও তো তানভীরের এমন ঘর সাজানোর কথা না। এসব ভাবতে ভাবতেই সুহায়লা দেখতে পেলো তানভীর ওর দুহাত ধরে হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছে। ওর চোখে চোখ রেখে তানভীর বলতে শুরু করলো,
-” তুমি আমার কে সেটা কি জানো? তুমি আমার আকাশের চাঁদ। যে চাঁদ তার স্নিগ্ধ শীতল আলোয় আমার পৃথিবীর অমাবস্যাটা কাটিয়ে দিয়েছে। আমি মানুষটাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আমার প্রতিদিন প্রতিরাত প্রতিমূহূর্তে ভালোবাসার রঙ লেপ্টে দিয়েছে। তুমি আমার আগুন ঝড়া রোদের দিনের ছায়া। তুমি পাশে থাকলে পুুরো শরীর জুড়ে শীতল বাতাসের স্পর্শ পাই। মনে হয় এটা যেনো বৈশাখীর বিকালের মাতাল হাওয়া। তোমাকে দেখলে কেমন যেনো সুখ সুখ লাগে। অকারন সুখ। ইচ্ছে হয় এই অকারন সুখে সারাদিন সাঁতরে বেড়াই। মাঝে মাঝে ডুব দেই। তোমাকে আমার প্রয়োজন সুহায়লা। শুধুমাত্র রাত কাটানোর জন্য না। আমার প্রতিমূহূর্তের জন্য। আমার মৃত্যু পর্যন্ত। সকালে তোমার স্পর্শে ঘুম ভাঙানোর জন্য। গোসল শেষে তোমার মুখে আমার চুলের পানি ঝেড়ে ফেলার জন্য। সকালে হালকা রোদগায়ে মেখে তোমার সঙ্গে কফি খেতে খেতে গল্প করার জন্য। সারাদিন ফোন করে করে তোমাকে বিরক্ত করার জন্য। ঝুম বৃষ্টিতে আমার পায়ের পাতার উপর তোমাকে দাঁড় করিয়ে একসাথে ভেজার জন্য। শীতের রাতে একটা ব্ল্যাংকেট গায়ে পেঁচিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরে সারারাত ছাদে বসে খোলা আকাশের নিচে কাটানোর জন্য। আজকাল তোমার স্পর্শ আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমানোর বদ অভ্যাস হয়েছে। তোমার হাত পা আমার গায়ের উপর না পড়লে আমার ঘুম আসতে চায়না। আমার ঘুমের জন্য তোমাকে প্রয়োজন। অনেক অনেক প্রয়োজন। তোমাকে আজীবন বেঁধে রাখতে চাই। ছায়ার মতো তোমার পিছনে লেগে থাকতে চাই। তোমার আঙুলে আমার আঙুল পেঁচিয়ে বাকি জীবনটা পাড়ি দিতে চাই। তোমাকে ভালোবাসি সুহায়লা। খুব বেশিই ভালোবাসি।তুমি ছাড়া এই তানভীর অচল। আমাকে আগের মতো আঁকড়ে ধরো প্লিজ। তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনিনা আজ দুমাস। কথাটা শোনার জন্য আত্মাটা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার। প্লিজ সুহায়লা একটাবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলো আই লাভ ইউ তানভীর। প্লিজ……. ”
সুহায়লা এতক্ষন খুব মনোযোগ সহকারে তানভীরের কথা শুনেছে। তানভীরের কথা শুনে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছ্যিল্যের হাসি এনে সুহায়লা বললো
-” কি ব্যাপার তানভীর? আমার বয়স বেড়ে গেছে নাকি তোমারটা কমে গেছে?”
-” মানে?”
-” ও মা, তুমিই না বলেছিলে তেরো বছরের পার্থক্যে আর যাই হোক ভালোবাসা সম্ভব না। তার মানে বয়সের পার্থক্যটা কমে গেছে।”
-” দেখো সুহায়লা, আমি এতদিন যা করেছে যা কিছু বলেছি সেসব অন্যায় ছিলো। খুব খারাপ আচরন করেছি তোমার সাথে। না বুঝে করেছি।”
-” না বুঝে? তুমি কি বারো তেরো বছরের বাচ্চা তানভীর যে একজন মানুষ তোমাকে ভালোবাসে সে কথা লাগাতার তোমাকে বলা সত্ত্বেও তুমি বুঝোনি?”
-” আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি সুহায়লা। চোখে পর্দা পড়ে ছিলো আমার। আমার অতীত তুমি জানো। আমার বিশ্বাস উঠে গিয়েছিলো মেয়ে মানুষের উপর থেকে।”
-” উহুম, মেয়ে মানুষ না। বলো যে মধ্যবিত্ত মেয়ে মানুষ। আমি আজও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েই আছি। আমার বাবা এখনও কোটি টাকার মালিক হয়নি যে এখন তুমিআমাকে বিশ্বাস করছো।”
-” তোমার বাবা রাস্তার ফকির হয়ে গেলেও আমার কিছু আসে যায় না। কারনএখন তুমি আমার ওয়াইফ। এখন তুমি মিডেল ক্লাস হও আর স্লাম গার্ল হও এতে তো আর এই সত্যিটা বদলে যাবে না।”
-” কে তোমার ওয়াইফ? আমি? কক্ষনো না। তোমার সাথে আমার যাস্ট একটা ডিল হয়েছে মাত্র। বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কের সাথে এই ডিল নামক ব্যাপারটা জড়িও না তো। তোমার সাথে আমার যে ডিলটা হয়েছে সেটা নেহায়েৎই বাজে একটা ব্যাপার।”
-” সুহায়লা এসব বাজে কথা বলছো কেনো?”
-” এখন কেনো এগুলোকে বাজে মনে হচ্ছে? কথাগুলো তো বিগত দেড় বছরে তুমি আমাকে শোনাতে শোনাতে আমার কান পঁচিয়ে ফেলেছো।”
-” সুহায়লা আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি ফর এভরিথিং। ভুল হয়ে গেছে আমার। পাস্টের জন্য আমার মেন্টালিটি টোটালি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।”
-” থামো। এক পাস্টের দোহাই আর কত দিবে? বিশ বছর পুরোনো একটা ঘটনাকে মনে পুষে রেখে নিজের মেন্টালিটি নিজে নষ্ট করেছো। বিশ বছর আগে তুমি ছিলে তেরো বছর বয়সের। বিশ বছরে কি তুমি বড় হওনি? জ্ঞান-বুদ্ধি কি বাড়েনি? এডুকেটেড ছেলে তুমি। সাকসেসফুল বিজনেসম্যান। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াও। এত মানুষের সাথে উঠা বসা কর। এরপরও কি তোমার মেন্টালিটি চেইন্জ হয়নি? মেন্টালিটি চেইন্জ করার অনেক সুযোগ তুমি পেয়েছো। কিন্তু তোমার নিজেরই কোনো নিয়ত নেই চেইন্জ হওয়ার। তুমি তোমার এক অতীত নিয়েই ডুবে থাকতে চেয়েছো।”
-” এখন তো নিজেকে বদলেছি। তোমার জন্য বদলেছি আমি।”
-” হ্যাঁ বদলে গিয়েছো। আমাকে শেষ করে দিয়ে এখন তুমি বদলেছো। তুমি আমাকে একবারে মারোনি তানভীর। একটুএকটু করে বিষ দিয়ে মেরেছো। প্রতিনিয়ত ছটফট করেছি আমি। সে ছটফট তুমি দেখোনি। তুমি আমাকে মেরে ফেলেছো তানভীর। এমন কিছু বাজে স্মৃতি মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছো যে এখন তোমাকে তালাক্ব দিলেও সেসব স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়াবে। আর সাথে আত্মীয়-স্বজনের খোঁটা তো আছেই। আমি তো শুনবোই। বাপ মা কেও শুনতে হবে। বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেইইসাইড করতাম সেই কবেই। আত্মহত্যা মহাপাপ তাই করিনা। দিনরাত এক দোয়া করে যাচ্ছি আমাকে যেনো আল্লাহ এই দুনিয়া থেকে মুক্তি দেয়। এখন শুধু ভিতর থেকে নিঃশ্বাসটা বের হওয়া বাকি। অপেক্ষায় আছি কবে নাগাদ এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবো।”
তানভীরের অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে সুহায়লার কথায়। এতটা কষ্ট দিয়েছে সে মেয়েটাকে যে এখন সে আর বেঁচেই থাকতে চায় না। ওর কিছু হলে তানভীরের কি হবে? ওর দোয়া যদি আল্লাহ সত্যিই কবুল করে ফেলে তখন কি হবে? কলিজায় মোচড় কাটলো তানভীরের। সুহায়লার দু হাত চেপে ধরে বললো
-” কেমন কথা বলো তুমি? মরে যাবা মানে? তুমি মরলে আমার কি হবে?”
-” কিছুই হবে না। নতুন কারো সাথে আবার ডিল করবা। সেই মেয়ের গায়ের গন্ধে আমার গায়ের গন্ধ ভুলে যাবে তুমি। একটা রাতের ব্যাপার মাত্র। এক রাতের ব্যবধানে সব বদলে যাবে।”
-” আমাদের সম্পর্কটাকে তুমি এত নিচে নামাচ্ছো কেনো?”
-” সম্পর্কটা শুরু থেকেই নিচে নামানো। সেই প্রথম দিন থেকে। তুমি নামিয়েছো। আমি না।”
-” আমি সব কিছু ঠিক করতে চাচ্ছি।”
-” আমিও চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। তোমাকে বদলাতে যেয়ে নিজেই বদলে গেছি। একটা সময় স্বপ্ন দেখতাম রাজপুত্র আসবে। জীবনটা বদলে যাবে। একদম রুপকথার মতো। রাজপুত্র এসেছে। জীবন বদলেছে। কিন্তু যেমনটা ভেবেছিলাম তেমন না। নরকের মতো খারাপ হয়েছে আমার জীবন। জীবনে কত শত প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি। একটাও এক্সেপ্ট করিনি। শুধুমাত্র আমার রাজপুত্রের আশায়। ভুল করেছি আমি। তখনই কারো সাথে প্রেম করতাম তাহলেই ভালো ছিলো। তোমার সাথে বিয়ে হতো না। এই দেখো, সাবার কথাই বলি। ভালোবেসে ইমরান ভাইকে বিয়ে করেছে। দুজনের বয়সে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তবু ওদের ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। আজ যদি আমিও প্রেম করতাম তাহলে আমার দিনগুলোও সাবার মতোই ভালো যেতো।”
-” আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি। আমি তো চাচ্ছিই আমাদের সম্পর্কটা সুন্দর হোক।”
-” যে সম্পর্কের শুরুটাই ভালো না সেটার শেষটা ভালো হবে কিভাবে?”
-” হবে। তুমি চাইলেই হবে। তুমি একটাবার স্বাভাবিক ভাবে আমার সাথে মিশে দেখো।”
-” এক্স্যাক্টলি এ কথাটাই তোমাকে বলেছিলাম দেড় বছর আগে। তুমি তখন শুনো নি। সম্পর্কটাকে টেনে হিঁচড়ে খারাপের দিকে নিয়ে গেছো। সম্পর্কটা পঁচে গেছে তানভীর। আমার অন্তরটা শুকিয়ে গেছে। চাওয়া গুলো না পেতে পেতে শুকিয়ে গেছে।”
-” তোমার সব ইচ্ছা পূরন করবো আমি। কোনো অভিযোগের সুযোগ আমি দিবো না। ট্রাস্ট মি।”
-” দেড় বছর ফেরত দিতে পারবে?”
-” সেই কথা বাদ দাও সুহায়লা প্লিজ। আমি তোমার কাছে মাফ চাচ্ছি। নতুন করে আমরা শুরু করবো।”
-” বিশ বছর আগের একটা ঘটনা তুমি এত বছরেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারোনি। আর তুমি তো বিনা দোষে এতগুলো দিন আমাকে শাস্তি দিয়েই গেছো। তাহলে আমি কিভাবে এতগুলো ঘটনা ভুলে যাই?”
সুহায়লার সাথে কথায় পেরে উঠছে না তানভীর। রাগে কান গরম হয়ে যাচ্ছে ওর। নিজের উপর তুমুল রাগ হচ্ছে এই মূহূর্তে। কি প্রয়োজন ছিলো এই মেয়েটাকে এত কষ্ট দেয়ার? বাজে দুইটা মেয়ের জন্য সে এই নির্দোষ মেয়েটাকে শাস্তি দিয়েছে কতটা দিন। যে রাগ মেয়েটা মনে পুষে রেখেছে সেটা কাটাতে কতদিন যে সময় লাগবে সেসব ভাবতেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। সুহায়লার মতো এত ধৈর্য্যশক্তি তার নেই। কিভাবে সহ্য করবে সে সুহায়লার ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়া?
-” এক কাজ করো। আমার মাথাটা নিয়ে দেয়ালে ঠুকতে থাকো। যতক্ষন না রাগ মিটে ততক্ষন ঠুকবে। আসো।”
-” তোমাকে মারলে যদি আমার যন্ত্রনা মিটতো তাহলে সেই কবেই তোমাকে কুটি কুটি করে ফেলতাম। তোমাকে মারলে আমার যন্ত্রনা তিল পরিমানও কমবে না। বরং বাড়বে। কারন আমি নিজের সুখের জন্য অন্যকে কষ্ট দিচ্ছি। এমন সুখ পাওয়ার চেয়েে নিজে একটু একটু করে মরে যাওয়া ভালো।”
-” বারবার মরার কথা টানছো কেনো? আমার কিন্তুএই কথাটা একদম পছন্দ হচ্ছে না।”
-” একটা কথা বলি। আর কোনো কথা বলাবলির প্রয়োজন নেই। আমার এসব আর ভালো লাগছে না। টায়ার্ড লাগছে প্রচন্ড। মাথা ঝিমঝিম করছে। আমি একটু রেস্ট নিতে চাই। প্লিজ আমাকে আর বিরক্ত করো না।”
কথাটা বলেই সুহায়লা অন্য রুমের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো। তানভীর হাত টেনে ধরে বললো,
-” এখানে শোও। অন্যরুমে যাচ্ছো কেনো?”
-” আমার এখানে ভালো লাগছে না।”
-” এখন কি তুমি বেডরুমও সেপারেট করে ফেলবে?”
-” তোমার এসব ফুল , লাইটিং দেখে মনে হচ্ছে আমার কাঁটা ঘায়ে কেউ লবনের ছিটা দিচ্ছে। অসহ্য লাগছে এসব। এজন্য চলে যাচ্ছি। এসব খুলে ফেলো। নয়ন আপাকে দিয়ে ঘর পরিষ্কার করাও। পরে এখানে এসে থাকবো।”
-” তুমি কি আমাকে মাফ করবে না?”
সুহায়লা আর কোনো উত্তর দিলো না। তানভীরের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো অন্য রুমে।
(চলবেn__