#বন্ধ_দরজা
পর্ব-৩
সামনের মাসের ১৩ তারিখ বিয়ে ঠিক হয়েছে। গুনে গুনে মাত্র একুশ দিন সময়। বলতে গেলে ফরহাদ সাহেব আর সুহায়লার ফুপার জোরাজুরিতেই বিয়েটা এত জলদি ঠিক হয়েছে। সাদমান বাঁধ সাধতে চেয়েছিলো। কিন্তু ফুপু আর মায়ের ইশারাতে চুপ মেরে গেছে সাদমান। সুহায়লার মনেও কেমন যেনো লাগছে।ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না? লোকটা তো তার ভালো মন্দ লাগা কিছুই জানালো না। অথচ উনার বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।
রাতে সাদমান আর তার বাবা বসে লিস্ট করছে কাকে দাওয়াত করবে, কত টাকা খরচ পড়বে। লিস্ট করার এক পর্যায়ে সাদমান বললো
-” আব্বা আমরা কি খুব তাড়াহুড়ো করে ফেলছি না?”
-” কিসের তাড়াহুড়া?”
-” আরও কিছুদিন সময় নিয়ে যাচাই করলে ভালো হতো না?”
-” তোর কি ছেলে পছন্দ হয়নি?”
-” হয়েছে। কিন্তু ছেলেকে তো কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। তাছাড়া সুহার সাথেও তো কোনো কথাই বললো না। সুহার দিকে আমি ছেলেকে ঠিকমতো তাকাতেও দেখিনি। তার উপর আমাদের স্ট্যাটাসের বিশাল ফারাক নিয়ে মনের মধ্যে খচখচ চলছেই।”
-” বাজে চিন্তা যত করবি তত মন অশান্ত হবে। সবকিছু ভালোভাবে দেখার চেষ্টা কর সাদি।”
-” কি জানি আব্বা! বাজে চিন্তা করছি নাকি ঠিক চিন্তা করছি সেটা আল্লাহই ভালো জানে।”
-” আল্লাহর উপর ভরসা রাখ সাদি। তোর বোন সুখী হবে তুই দেখিস।”
সুহায়লার মা ফোনে কথা বলছে তার বোনের সাথে। আর সুহায়লা সাবা নিজেদের রুমে শুয়ে গল্প করছে।
-” সুহা তুই অহেতুক চিন্তা করছিস। ছেলে কথা বলেনি তো কি হয়েছে? দিন তো আর চলে যায়নি। এখনো একুশদিন বাকি আছে। দেখবি কাল পরশু দুলাভাই ঠিকই তোকে ফোন করবে।”
-” লোকের মনে কি চলছে আল্লাহ মালুম।”
-” জানিস তুই চলে যাবি মনে হলেই খুব কষ্ট লাগছে। তোকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?”
-” তুই ই তো এতদিন লাফিয়েছিস আমার বিয়েটা যেনো জলদি হয়ে যায়।”
-” তখন তো বুঝিনি তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে এত কষ্ট পাবো।”
-” আমার তো পুরো বাসাই খালি থাকবে। তুই যাবি সেখানে। আমার বাসায় ঘুরে আসবি কিছুদিন।”
-” হুম তা ঠিক বলেছিস। আমার এখন বেড়ানোর একটা জায়গা হবে।”
একদিন দুদিন করে দেখতে দেখতে একুশ দিন চলে গেছে। আজ রাতে সুহায়লার বিয়ে। এই একুশদিনে তানভীর একবারের জন্যও সুহায়লার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি। স ুহায়লার বারবার একই কথা মনে হচ্ছে যযে তানভীর বিয়েতে রাজি না। সাদমান আর বাবাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। কথাটা শুধুমাত্র সাবা সুহায়লা আর তাদের মায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাবা ভাইকে কিছু না জানানোর সিদ্ধান্তটাও মায়েরই। তার ধারনামতে ছেলে বড় ব্যবসায়ী। হতে পারে ব্যস্ত আছে তাই যোগাযোগ করতে পারছে না। তাছাড়া এত বড় ছেলেকে তো আর যাইহোক জোর করে বিয়ে করানো সম্ভব না । বিয়েতে ছেলের মত আছে তাইতো বিয়ের কথা পাকা করেছে তানভীরের বাবা। সুহায়লার মা মিতা মেয়েকে এই কথাগুলো বলে বুঝিয়ে যাচ্ছেন বিগত পনেরো দিন যাবৎ। তিনি মেয়েকে বুঝাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু উনার নিজের মনেও খচখচ চলছে এ ব্যাপারটা নিয়ে। তিনি বেশ চিন্তিতো আছেন। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ হতে দিচ্ছেন না। সুহায়লা মুখ গোমড়া করে বসে আছে জানালা ধরে। তার মা পিছন থেকে কাঁধে হাত রেখে বললো,
-” দেরী হয়ে যাচ্ছে তো। পার্লারে যাবি না?”
-” আম্মা, উনি তো এখনও আমাকে ফোন করলো না।”
-” তুই কি রে? সেই কবে থেকে ফোন করলো না ফোন করলো না বলেই যাচ্ছিস। আর তো কয়েক ঘন্টাই আছে। এরপর মন খুলে তানভীরের সাথে কথা বলিস
-” আম্মা আমিতো সেটা বুঝাইনি। আমি বুঝাতে চেয়েছি……”
-” হয়েছে আর বুঝাবুঝি করে লাভ নেই। সাবা রেডি হয়ে বসে আছে। বাহিরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।কাপড়টা পাল্টে পার্লারে যা।”
রুম থেকে উনি বেরিয়ে আসার সময় সুহায়লা বললো,
-” আম্মা উনি যদি আমাকে না মেনে নেয় তাহলে? যদি বিয়ের রাতেই বলে তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি?”
-” মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি? পছন্দ হয়নি! পছন্দ না হলে বিয়ে করবে কেনো? এইদেখ সুহা এসব উল্টাপাল্টা কথাবলে আমার মাথা খারাপ করিস না তো। এমনিতেই তোকে নিয়ে চিন্তায় আছি।”
-” কি চিন্তা আম্মা?”
-” কিছু না। তুই গিয়ে কাপড় পাল্টা। আর শোন যদি তানভীরের কথা বা আচরনে এমন কিছু বুঝিস যে ও তোকে মেনে নিতে চাচ্ছেনা তাহলে কিন্তু তুই একদম ভেঙে পড়বি না। শক্ত হাতে নিজের স্বামী সংসারের হাল ধরবি। একটা কথা স্মরনে রাখবি তুই ওর প্রেমিকা না। তুই ওর বিয়ে করা বউ। নিজের জায়গা নিজে দখল করে নিবি। ওর মন কিভাবে জয় করবি সেটা তোর ব্যাপার। ও যতই দূরে সরাতে চাক না কেনো ওর পিছনে সবসময় লেগে থাকবি। ছেলে মানুষের মন। কতক্ষন তোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে?”
-” কিন্তু আম্মা…..”
-” আর কোনো কথা না সুহা। প্লিজ আমাকে ঠান্ডা মাথায় থাকতে দে।”
সুহার মা আর এক সেকেন্ড দাঁড়ালেন না। মেয়ের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। কি করবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। সাদমান অথবা তার স্বামীর সাথে একবার ব্যাপারটা বলে দেখবেন? আশেপাশে চেয়ে দেখলেন একবার। কতমেহমান এসেছে বাসায়। সবাই জানাজানি হয়ে গেছে সুহায়লার আজ বিয়ে। সাদমান যদি এসব জানে তাহলে নিশ্চিত কোনো না কোনো প্যাচ লাগাবে। বিয়েটাই সে হতে দিবে না। না, না… এখন বিয়ে ভাঙা সম্ভব না। এর চেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখাই শ্রেয়।
রাত সাড়ে আটটা বাজে। বরযাত্রী কমিউনিটি সেন্টারে এসে বসে আছে আধাঘন্টা আগেই। কিন্তু বরের আসার কোনো খবর নেই। সাদমান বারবার ফরহাদ সাহেবকে এক কথা জিজ্ঞেস করছে,
-” তানভীর ভাই কোথায়?”
ফরহাদ সাহেব প্রতিবারই এক উত্তর দিচ্ছেন বাবা ও আসছে। একটু অপেক্ষা করো।সাদমানকে খুব চিন্তিতো দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যে সেখানে তানভীরের দেরীকরে আসা নিয়েকানাঘষা শুরু হয়ে গেছে। সুহায়লার মা বাবাকে আত্মীয়রা বার বার জিজ্ঞেস করছে বর কোথায়?এক ঘন্টা অতিক্রম হবার পর সাদমান ফরহাদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
-” আংকেল আপনার ছেলে কি বিয়েতে রাজি না?”
ফরহাদ সাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ছেলে বলে উঠলো,
-” কি বলো এসব? তানভীর রাজি হবে না কেনো? সে অবশ্যই বিয়েতে রাজি।”
-” আপনি তানভীর ভাইয়ের কি হোন?”
-” আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড ফাহিম। বলতে গেলে আমি ওর ভাই। ওর পেটের সমস্ত খবর আমি জানি। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো প্লিজ।”
-” লোকজন বিভিন্ন কথা শুরু করেছে। সবাই চলে এসেছে শুধু পাত্র ছাড়া। ব্যাপারটা কেমন দেখাচ্ছে না?”
-” আসলে ও গতকাল রাতে চিটাগাং গিয়েছিলো। কাজ শেষ করে আসতে লেট হয়ে গিয়েছে। তারউপর ফ্লাইট টাইমও ডিলে হয়েছে। ও ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছে আমরা যেনো বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ও যাস্ট বাসা থেকে কাপড়টা পাল্টেই চলে আসবে।”
-” রাত পোহালেই উনার বিয়ে। আর উনি কিনা বিয়ে বাদ দিয়ে আগেরদিন চিটাগাং চলে গেলেন? এটা কেমন কথা হলো ভাইয়া?”
-” তানভীর একটু কাজ পাগলা মানুষ তো তাই……..”
-” তাই বলে কি নিজের বিয়েরদিনটাও উনি……”
-” ঐ তো তানভীর চলে এসেছে।”
সাদমান ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জামাই এসে পড়েছে। সুহায়লার ছোট ভাই বোন, বান্ধবীসবাই মিলে গেটে আটকেছে তানভীরকে। তানভীরের বন্ধুরাও দৌড়েযেয়ে তানভীরের সাথে দাঁড়ালো। তুমুল চেঁচামেচি হচ্ছে গেইটে। তানভীরের মেজাজ ভয়ানক রকমে বিগড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই তার মাথা ঝিমঝিম করছেে। হালকা জ্বর আছে গায়ে। তারউপর আবার এই চেঁচামেচি। সব মিলিয়ে তানভীরের বিরক্তির পরিমান তুঙ্গে উঠেছে। ফাহিমের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
-” আমার অসহ্য লাগছে ফাহিম। এদেরকে টাকা দিয়ে বিদায় কর শিগগির। যা চাচ্ছে তাই দিয়ে দে।”
-” সবাই মজা করছে। একটু করুক না?”
-” তুই কি চাস আমি চলে যাই?”
-” আচ্ছা টাকা বের কর। আমি দিচ্ছি।”
ফাহিমের হাতে টাকা গুঁজে দিলো তানভীর। ফাহিম সাবার দিকে টাকাটা বাড়াতেই অন্যান্য বন্ধুরা তাকে বকা শুরু করে দিলো। ফাহিমের বউ নিশাত ফাহিমকে বললো,
-” এটা কি করলে ফাহিম? কত মজা হচ্ছিলো।”
-” হয়েছে মজা আর করতে হবে না। তানভীরের মুখ দেখছো না কিভাবে ক্ষেপে আছে। কখন আবার বিয়ে রেখে চলে যায় তার ঠিক নেই।”
-” উনি এমন করছে কেনো? বিয়ে করার ইচ্ছা না থাকলে উনি বিয়ের জন্য হ্যা বললো কেনো? এসব ঢং দেখলে গা জ্বলে যায় একদম।”
তানভীর আবার ফাহিমের কানে কানে বললো,
-” তোদের খাওয়া দাওয়া কমপ্লিট হয়েছে?”
-” হ্যাঁ”
-” জলদি বিয়ের পর্ব শেষ করতে বল। আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না। বিয়েটা সেড়েই আমি চলে যাবো। কেমন কমদামী কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করেছে। এখানে আমার কত বন্ধুবান্ধব এসেছে। সবাই কি বলবে ভেবে দেখতো?
কাল সকালেই কানাঘষা শুরু হবে তানভীরের শ্বশুড়বাড়ির স্ট্যাটাস তেমন ভালো না।”
-” এমন মানুষের সাথে মিশার প্রয়োজনটা কি যে কিনা তোকে তোর স্ট্যাটাস দেখে বিবেচনা করবে? তাছাড়া তুই যেভাবে কথা বলছিস এটা কিন্তু তোর বউ আর তার বাড়ির লোকদের অপমান করা হচ্ছে। উনারা এখন তোর আপনজন উনাদের নিয়ে এভাবে বলাটা ঠিক না তানভীর।”
-” রাখ তোর বউ। আমি এসব বউ টউ মানি না। বাবা আর তোর চাপাচাপিতে বিয়েতে রাজি হয়েছি। আর নয়তো বিয়ে করতাম নাকি? তারউপর আবার এমন মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েকে?”
(চলবে