বন্ধ দরজা-৭
সুহায়লার এক পাশে নিশাত আর অন্য পাশে ফাহিম বসে আছে। তার মুখোমুখি টুল নিয়ে বসেছেন ফরহাদ সাহেব।
-” আম্মু তুমি নাকি চলে যেতে চাচ্ছো?”
-” আপনি জোর করে কেনো আমার সাথে উনার বিয়ে দিয়েছেন আব্বা?”
-” কারন ছিলো মা।”
-” আপনারা হাই সোসাইটির মানুষ। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। আপনার ছেলে মধ্যবিত্ত লোকদের মানুষ ভাবে না। উনি ভাবে আমরা অমানুষ, টাকার ভিখারী। কি এমন কারন ছিলো যে উনার সাথে এই মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন? আপনি মুরুব্বি মানুষ তাই আপনাকে সব কথা বিস্তারিত বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। আপনার ছেলে গতরাতে আমাকে যা শুনিয়েছে আর যা করেছে এতে মনে হয়েছে আমি তার বউ না, রাস্তার কোনো বাজে মেয়ে যে কিনা টাকার বিনিময়ে শরীর……”
কথাটা বলতে যেয়েই গলায় আটকে গেলো সুহায়লার। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে সে। ফরহাদ সাহেব কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। কিছুক্ষন কেঁদে সুহায়লা আবার বলা শুরু করলো,
-” হতে পারে আমার বাবা ছোট ব্যবসা করে, হতে পারে আমার ভাই কম টাকা বেতনের জব করে। যা করে হালাল উপায়ে করে। হারাম কোনো কাজ তো করেনা। উনিকিভাবে পারলো আমার বাবা ভাই তুলে কথা বলতে? আমরা কি মানুষ না?”
-” মা আমার ছেলেটা এমন ছিলো না। যথেষ্ট লক্ষী একটা ছেলে ছিলো ও। বিশ বছর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিলো। এরপর থেকেই তানভীর এমন হয়ে গেছে।”
-” বিশ বছর আগের ঘটনার সাথে আমার কি সম্পর্ক আব্বা? আমি তো উনাকে কিছু করিনি। অন্যের রাগ উনি আমার উপর মিটাবে কেনো? আর আমার আব্বা, ভাই? ওরা কি দোষ করেছে?”
-” সুহায়লা তুমি আংকেলের কাছে শুনো আগে। আংকেলকে পুরো ঘটনা বিস্তারিত বলার সুযোগ দাও।”
সুহায়লা ফাহিমের কথা শুনে চুপ করে বসে আছে। শ্বশুড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কখন উনি বলতে শুরু করবেন। কিছুক্ষন থেমে এরপর তিনি বলতে শুরু করলেন।
-” আমার বাসা তখন মগবাজারে ছিলো। তানভীরের মা তনু….. ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম ওকে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো। আমার ফ্যামিলি রাজি ছিলো না। ওর ফ্যামিলি স্ট্যাটাস আমার সাথে ম্যাচ হয় না তাই। নিজেই ওকে নিয়ে পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করে ফেলি। অন্য জায়গায় বাসা নেই নিজের মতো করে সংসার শুরু করি। তুমি জানো সে মূহূর্তে মনে হতো ঘরের প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে ভালোবাসা লেপ্টে আছে। এর মাস দুয়েক পর বাবা আমাকে আর তনুকে বাসায় ফিরিয়ে নিতে আসেন। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম তাই বেশিদিন দূরে সরিয়ে থাকতে পারেনি। এত এত প্রপার্টির একমাত্র ওয়ারিশ আমি ছিলাম। বাসায় ফিরিয়ে আনার পনেরো দিনের মাথায় বাবা আমার নামে সমস্ত প্রপার্টি ট্রান্সফার করে দিলেন। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরই বাবা মারা গেলো। বাবা মারাযাওয়ার পর মা সংসারের সব হাল ছেড়ে দিলো। সংসারের দায়িত্ব পড়লো তনুর উপর। পাশাপাশি সোসাইটি মেইনটেইন করে চলা, পার্টিতে এটেন্ড করা এসব কিছুই ও করতো। বাবা মারা যাওয়ার চার মাস পর মা ও চলে গেলো। আমি তখন ব্যবসা নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকতাম। তনু কখন কোথায় যেতো সেসব আমি ঠিক জানতাম না। কখনো জিজ্ঞাসাও করতাম না। কারন ওকে আমি বিশ্বাস করতাম। এর মাঝে তানভীর এলো পৃথিবীতে। দিন যাচ্ছিলো আর তনুরসাথে আমার দ্বন্দ বাড়ছিলো। আমি যত চাইতাম সমস্যার সমাধান করতে ততবেশি তনু ঝামেলা লাগানোর চিন্তা করতো। তানভীর ছোট থেকে আমাদের ঝগড়া দেখে দেখেই বড় হয়েছে। প্রায়ই ও দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের ঝগড়াদেখতো আর কাঁদতো। মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করতো, বাবা মামনি তোমার সাথে এমন করে কেনো? আমি কোনো উত্তর খুঁজে পেতাম না ওকে বলার মতো। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে থাকতাম। একদিন বিকেলের ঘটনা। তখন তানভীরের তেরো বছর বয়স। বাসার সামনে ফাহিম তানভীর আরো কয়েকজন বন্ধু খেলছিলো। তানভীরের এক বন্ধু পানি খাওয়ার জন্য একাই বাসায় এসে ঢুকলো। কিছুক্ষন পর সে অন্য বন্ধুদের ইশারা দিয়ে বাসায় ডেকে নিলো। তানভীর আর ফাহিম ব্যাপারটা তখন খেয়াল করেনি। কিছুক্ষন পর ওরা লক্ষ্য করলো ওদের সাথের একটা ছেলেও নেই। সবকয়টা বাসায় যে গিয়েছে পানি খাওয়ার নাম করে অনেকক্ষন সময় যাওয়ার পরও আসছে না। তখন তানভীর ফাহিম দুজনই ঘরে যেয়ে দেখে……..
-” কি দেখে আংকেল?”
-” তনু…… তনু একটা লোকের সাথে আমার বেডরুমে…….”
কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো ফরহাদ সাহেব,
-” তানভীরের বন্ধুরা খুব আনন্দ নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যাপরটা উপভোগকরছিলো। তানভীরের তখন তেরো বছর। তেরো বছরের একটা ছেলে পুরোপুরি না বুঝলেও কিছুটা হলেও বুঝে তার মা অন্য লোকের সাথে বেডরুমে এতটা অন্তরঙ্গ হয়ে কি করছে। একজন সন্তানের পক্ষে নিশ্চয়ই এটা মেনে সম্ভব না যে তার চোখের সামনে তারই মা অন্য কোনো লোকের সাথে বিছানা পর্যন্ত চলে গিয়েছে। একবার ভেবে দেখো তো আমার ছেলেটা ঐ ধাক্কা কিভাবে সামাল দিয়েছে ঐ মূহূর্তে?”
সুহায়লার কেমন যেনো গা ঘিনঘিন করছে এসব শুনে। এই জাতের মানুষও হয় দুনিয়াতে? নিজের স্বামী রেখে অন্য পুরুষের সাথে? ছিঃ ছিঃ….
-” সেদিন থেকে পুরো এলাকা রটে গেলো তানভীরের মা উলঙ্গ হয়ে অন্য লোকের সাথে শুয়ে ঘেষাঘেষি করছিলো। এই কথা ওর স্কুল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। ওকে দেখলেই ছেলেরা বিভিন্ন ভাবে ওর মাকে নিয়ে নোংরা কথা বলতো। ছেলেটা ঘরবন্দি হয়ে পড়ে থাকতে শুরু করলো। কতদিন শুনেছি ছেলেটা দরজা আটকে চিৎকার করে কেঁদেছে। শেষমেষ এমন অবস্থা হয়েছিলো যে তানভীর নিজের চুল ধরে টানতো ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতো। দেয়ালে নিজের মাথা নিজেই ঠুকতো। শেষমেষ দিশেহারা হয়ে ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাই। ছয়মাস ঐ ডক্টরের কাছে ট্রিটমেন্ট করিয়েছি ওকে। এরপর আমার ছেলেটা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।”
-” আর উনি? উনাকে জিজ্ঞেস করেননি উনি এমন কেনো করলো?”
-” কে তনু?”
-” জ্বি।”
-” যার সাথে ওর এ্যাফেয়ার ছিলো তিনি আমার চেয়ে আরও বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তনু টাকা আর স্ট্যাটাসেরনেশায় ডুবে গিয়েছিলো। ওকে সেদিন ঘরে ফিরে যখন জানতে চাইলাম তুমি এমন কেনো করলে তখন ও বলেছিলো তোমার চেয়েও আমার প্রেমিক আরও বেশি রিচ। ওর স্ট্যাটাস তোমার চেয়ে আরো বেশি হাই। তোমার চেয়ে আরও দ্বিগুন বেশি খরচ আমার প্রেমিক আমার পিছনে করে। তো এখন তুমিই বলো আমার কার পিছনে ছুটা উচিত?
তানভীর ওর মায়ের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। দুচোখ গড়িয়ে পানি ঝড়ছিলো ছেলেটার। ওর মা কথাগুলো বলেই আলমারীর সমস্ত কাপড় বের করে লাগেজে ভরে চলে গেলো। যাওয়ার সময় তানভীর ওর মায়ের হাত ধরে জিজ্ঞেস করেছিলো, মামনি তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে? তনু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে উত্তর দিলো , তোমার জন্য তো আর আমি নিজের ফিউচার নষ্ট করবো না তানভীর। ছেলেটা পাল্টা ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তনুর কোনো কিছুর অভাব আমি রাখিনি। এমনকি ওর বাবার ফ্যামিলির খরচ আমিই চালাতাম। এত কিছু করেও ওকে আমি ধরে রাখতে পারিনি। পরের মাসেই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। একটা বাচ্চার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হচ্ছে তার মা। বাচ্চা যখন মায়ের কাছ থেকে এধরনের ধাক্কা খায় তখন সেই বাচ্চার মনটা আর নরম থাকে না। শক্ত পাথর হয়ে যায়। আমার তানভীরেরও তাই হয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে ওর মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল করতে পারলেও ওর মন থেকে পাথর সরাতে পারিনি। পাথরটা বিশ বছর ধরে জেঁকে বসে আছে মনে। পাথরটা ওর মনে আরো শক্ত অবস্থান করে নিয়েছিলো যখন ফাহিম তমার কাছ থেকে ধাক্কা খেলো।”
-” তমা কে?”
-” বলছি….. ফাহিমের সাথে তানভীরের সম্পর্ক কতটা গভীর তা তুমি চিন্তা করতে পারবে না। একদম আপন ভাইয়ের মতো। ফাহিমের সাথে ঐ ঘটনা ঘটার পর ওর ধারনা আরও পাকাপোক্ত হয় যে মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েরা ভালো না। তেরো বছর আগে ফাহিমের এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক হয়। সে মেয়েটাও মধ্যবিত্ত পরিবারেরই ছিলো। ওর যাবতীয় খরচ সব ফাহিম চালাতো। তিন বছর সম্পর্ক ছিলো ওদের। কত যে ভালোবাসতো ফাহিম ওকে। তিন বছর পর সে মেয়েটা একদিন দুম করে ওর চেয়ে বাইশ বছরের বড় এক বয়স্ক লোককে বিয়ে করে নিলো। তমা হচ্ছে সেই লোকের দ্বিতীয় বউ। তমার বয়সী একটা মেয়ে আছে ঐ লোকের।”
-” সে এমন করলো কেনো?”
-” সেইলোক দেশের একজন প্রভাবশালী শিল্পপতি। আমাকে ফাহিমের বাবাকে আরও পাঁচবার কিনে নিতে পারবে।”
-” টাকার জন্য মানুষ এত নিচে নামতে পারে? তমা যেমন তেমন আমি ভাবছি আমার শ্বাশুড়ির কথা। একজন মা কিভাবে টাকার সন্তানকে টাকার জন্য দূরে ঠেলে দিতে পারে?”-”
-” আসলে সুহায়লা, তুমি তো শুধু শুনেছো তাই তুমি হয়তো ঐ কষ্টের গভীরতা আন্দাজ করতে পারছো না। সে মূহূর্তে আমি আর আংকেল দেখেছি তানভীর প্রতিটা মূহূর্তে কতটা ভুগেছে। তানভীর এমন ছিলো না। পরিস্থিতি ওকে এমন বানিয়েছে।”
-” মা বহু আশা নিয়ে আমি তোমাকে ছেলের বউ বানিয়েছি। আমার ছেলেটাকে এভাবে ছেড়ে চলে যেও না। তানভীর তোমার, এই সংসার তোমার। এটাকে গুছিয়ে নেয়ার দায়িত্ব তোমার। ভালোবাসা দিয়ে সব জয় করা সম্ভব। তানভীরের উপর পুরো অধিকার আছে তোমার। ও তোমাকে বউয়ের অধিকার না দিতে চাইলে জোর করে হলেও সেটা আদায় করার অধিকার তোমার আছে। কতদিন সে তোমাকে দূরে ঠেলে রাখতে পারবে? তুমি ওর বউ। ও তোমাকে কাছে টানতে বাধ্য হবেই। তুমি একমাত্র অবলম্বন যেটা দিয়ে ছেলেকে বুঝাতে পারবো দুনিয়াতে সবাই এক না। খারাপ মানুষ ছাড়াও ভালো মানুষ আছে। সুন্দর একটা জগৎ আছে। প্লিজ আমাকে এভাবে মাঝসমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যেও না। ”
সুহায়লা কতক্ষন ঝিম মেরে বসে থাকলো। এরপর মুখ তুলে শ্বশুড়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” আমি কোথাও যাবো না আব্বা। এখানেই থাকবো। আপনার ছেলেকে ভালোভাবে লাইনে আনার চেষ্টা করবো। না আসতে চাইলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসবো।”
সুহায়লার কথা শুনে ফাহিম আর নিশাত হাসছে। নিশাত বললো,
-” একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। সোজাভাবে ভালো না হলে কানে ধরে টেনে হিঁচড়ে লাইনে নিয়ে আসবা।”
ফরহাদ সাহেব ছেলের বউয়ের কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মনে হচ্ছে তার বুকের উপর থেকে এক মণ ওজনের পাথর সরানো হয়েছে।
.
.
পরবর্তী পর্ব. পড়তে চাইলে কমেন্ট করে জানান
.
.
.
১ম পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/387990565374737?__tn__=K-R
৬ষ্ঠ পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/389052605268533?__tn__=K-R
৮ম পর্বের লিংক : https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/389818158525311?__tn__=K-R