বন্ধ দরজা পর্ব ৮

#বন্ধ_দরজা
পর্ব-৮

সেই দুইঘন্টা যাবৎ ওরা চারজন মিলে গল্প করছে। তানভীর এর মাঝে একবার সেখানে উঁকি দিয়ে চলে আসলো। ঘরের ভিতর সে ঢুকেনি। নিজের রুমে বসে সে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছে আর কিছুক্ষন পরপর তার অফিসের ম্যানেজারের সাথে বকবক করছে। অনেকক্ষন গল্প করার পর নিশাত বললো,
-” সুহায়লা অনেকক্ষন তো হলো। তুমি নাহয় এখন একটু তানভীর ভাইয়ার সাথে সময় কাটাও। দুঘন্টা বাদেই তো লাঞ্চ সেড়ে আবার পার্লারে ছুটতে হবে।”
-” যাচ্ছি আপু।”
-” হ্যাঁ আমিও যাই। রফিককে একটা ফোন করি। ওখানে অনুষ্ঠানের আয়োজন কেমন চলছে তা জানা দরকার।”
সুহায়লা তার বেডরুমে এসেছে। তানভীর ওর দিকে একবার তাকিয়েই টিভির দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সুহায়লা গুটিগুটি পায়ে এসে তানভীরের পাশে বসেছে। তানভীরের মনোযোগ টিভির দিকেই। কিছুক্ষন সে তানভীরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো এই আশায় যে তানভীর তাকে কিছু বলবে। তানভীরকে কিছু না বলতে দেখে সুহায়লা নিজেই বলতে শুরু করলো
-” কি করছেন?”
-” সানি লিওনের আইটেম সং দেখছি।”
-” মিথ্যা কথা বলছেন কেনো? আমি তো দেখতে পাচ্ছি আপনি খেলা দেখছেন।”
-” দেখতেই যখন পাচ্ছো তখন জিজ্ঞেস করছো কেনো?”
-” আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো। কি দিয়ে কথা শুরু করবো সেটা বুঝে পাচ্ছিলাম না। তাই আরকি……..”
-” ……………..”
-” আচ্ছা আপনি তো আমাকে একবারও বললেন না আপনাকে তুমি করে বলতে। আমার সব কাজিনদের হাজবেন্ডরা বিয়ের রাতেই বলেই দিয়েছে উনাদের তুমি করে বলতে। অথচ আপনি এখনও বললেন না।”
-” এখন তুমি কি চাচ্ছো তোমাকে আমি বলবো, আমাকে তুমি করে বলো লক্ষ্মীটি?”
-” হ্যাঁ চাচ্ছি।”
-” এত ঢঙ কোথায় পাও সুহায়লা? আমাকে তুমি করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তো সোজাসোজি বলা শুরু করলেই তো পারো। এটা আবার আমার মুখ থেকে শোনার কি আছে?”
-” অবশ্যই আছে। আর ঢঙ আপনার সাথে করবো না তো কার সাথে করবো? আমার কি দশ বারোটা হাজবেন্ড আছে নাকি? হাজবেন্ড তো আমার একটাই। সেটা হচ্ছেন আপনি। আমি সারাদিন আপনার সাথে ঢঙ করবো। আর আপনাকে এসব সহ্য করতে হবে।”
সুহায়লার কথা শুনে কাছে এগিয়ে যাচ্ছে তানভীর। ধীরে ধীরে সুহায়লা খাটের উপর শুয়ে পড়লো। দু হাতে সুহায়লার কাঁধ চেপে ধরলো তানভীর।
-” কি ঢঙ করবে আমার সাথে তুমি?”
গতরাতে মতো সুহায়লা এখনও ভয় পাচ্ছে। তবে সেটা প্রকাশ হতে দিচ্ছে না। কোনোভাবেই প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না। তানভীরের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে তাকে। লজ্জা, ভয়, জড়তা ব্যাপারগুলো কোনোভাবেই তাদের মাঝে আনা যাবে না। লাজ লজ্জার বালাই ছেড়ে তানভীরকে আঁকড়ে ধরতে হবে তার। তানভীরের চোখ বরাবর চোখ রাখলো সুহায়লা। ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো,
-” অনেক ধরনের ঢঙ করবো। এখনই তো সব বলা যাবে না। আস্তে আস্তে একটা একটা করে ঢঙ দেখাবো। তোমার সাথে আহ্লাদ করে কথা বলবো। তোমাকেও আমার সাথে আহ্লাদ কররতে হবে।”
তানভীর সুহায়লার কথা শুনে হাসছে।
-” তোমরা মিডেল ক্লাস মেয়েরা পারো বটে। তোমাদের অভিনয় এত্ত নিঁখুত!”
-” আমার চোখ দেখে কি মনে হচ্ছে আমি অভিনয় করছি।”
– একদমই না। এজন্যই তো বললাম তোমাদের অভিনয় খুব নিঁখুত। বুঝার কোনো উপায় নেই যে তোমরা অভিনয় করছো।”
-” বুঝা যায় না বলছো, তাহলে তুমি বুঝলে কিভাবে?”
–” এমন অনেককেই দেখেছি তোমার মতো মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির।”
-” সবার সাথে আমাকে মিলাচ্ছো কেনো? আমি তো ওদের মতো না। গতরাতেই তুমি আমার সাথে প্রথম কথা বলেছো। আরও কিছুদিন যাক। আমার সাথে কিছুদিন মন খুলে মিশে দেখো। এরপর নাহয় আমাকে বিচার করো যে আমি ভালো না খারাপ।”
-” তোমার সাথে সম্পর্ক শুধুমাত্র বিনিময়ের। গতরাতে যে ডিল তোমার সাথে করেছি সেভাবেই আমাদের সম্পর্ক থাকবে।এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করো না।”
– ” মনটা আমার। এই মনে আমি কি আশা পুষে রাখবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। এখানে তোমার হস্তক্ষেপ চলবে না তানভীর।।”
-” তোমার খুশি। যা ইচ্ছা করতে পারো। পরে আশা পূরন না হলে ধাক্কা তুমিই খাবে। আমি না।”
কথাটা বলেই সুহায়লাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তানভীর। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ওয়ালেট হাতে নিলো তানভীর। সেটার ভিতর থেকে একটা ক্রেডিট কার্ড বেরকরে সুহায়লকে দিলো।
-” এটা রাখো।”
-” কি করবো এটা দিয়ে?”
-” এটাতে পাঁচ লাখ আছে। আরো বেশিও থাকতে পারে। প্রতিমাসে আমি কার্ডে টাকা জমা করে দিবো। যতখুশি খরচ করো। আলমারিতে পনেরো লাখ ক্যাশ আছে। ইন্সট্যান্ট ক্যাশ প্রয়োজন হলে সেখান থেকে খরচ করো। আর যদি মাস শেষ হওয়ার আগে আলমারী বা কার্ডের টাকা শেষ হয়ে যায় তাহলে আমাকে বলো।”
-” এত টাকা দিয়ে কি করবো আমি?”
-” নিজের খরচ করবে, বন্ধু বান্ধবের পিছনে খরচ করবে। নিজের ফ্যামিলিতে কিছু দিবে। ”
-” ফ্যামিলিতে দিবো কেনো? আমার বাবা ভিখারি না। আলহামদুলিল্লাহ আমার বাবা ভাই যা কামাই করে তা থেকে খরচ করেও আমার আম্মা প্রতি মাসে বিশ হাজার টাকা জমায়। অতএব তোমার কাছ থেকে নেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া আম্মা আমাকে শিক্ষা দিয়েছে অপব্যয় না করার। এত টাকা আমার লাগবে না। আমার যখন প্রয়োজন হবে তা আমি তোমার কাছে তখন চেয়ে নিবো।”
-” তোমাকে যা দিচ্ছি তা নিয়ে নাও। এত নীতিবাক্য শোনার ইচ্ছা নেই আমার।”
কথাটা বলেই তানভীর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সুহায়লাকে পাল্টা কিছু বলার সুযোগ দিলো না তানভীর। রুম থেকে তানভীর বের হওয়া মাত্রই সাবা ফোন করলো সুহায়লার নম্বরে। ফোনেকথা বলছে তারা দুই বোন। তানভীরের বাবা, ফাহিম আর নিশাত ড্রইংরুমে বসে কথা বলছে।
-” ঐ তো তানভীর এসেছে। বস এখানে। তোর সাথে কথা আছে।”
-” কি ব্যাপারে?”
-” আজ রাতে বৌ ভাত শেষে সুহায়লাকে নিয়ে তুই তোর শ্বশুড়বাড়ি যাবি।”
-” কেনো?”
-” আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। এটা নিয়ম। তাই যাবি। তোর সাথে ফাহিম আর নিশাতকেও পাঠাবো।”
-” আমি যাবো না ঐ বাড়িতে। আর কিসের নিয়ম শুনি? যেখানে বিয়েটাকেই আমি বিয়ে মানছি না সেখানে তো এত ফালতু নিয়ম মানার কোনো প্রশ্নই আসে না।”
-” তুই এমন চেঁচাচ্ছিস কেনো? আংকেল তো তোকে খারাপ কিছু বলে নি।”
-” অবশ্যই বলেছে। বাবা জানে আমি ঐ টাইপ মানুষ পছন্দ করি না। তারউপর ওদের বাড়ি আমার একদম ভালো লাগেনি। তবু বাবা বলছে ওখানে যেতে। ওখানে আমি থাকতে পারবো না।”
-” ওদের বাড়ি নিয়ে তোর কি সমস্যা”
-” সুন্দর না। কেমন যেনো। ভাঙা চোরা টাইপ। জঙ্গল জঙ্গল মনে হয়েছে আমার কাছে।”
-” তুই সুহায়লাদের বাড়িতে গিয়েছিসই একদিন। তাও আংকেল বললো তুই নাকি যাস্ট দশ মিনিট বসে ছিলি। এই সময়ের মধ্যে তুই আবিষ্কার করে ফেললি সুহায়লাদের বাড়ি জঙ্গল?”
-” দেখেন তানভীর ভাইয়া, এসব হচ্ছে আপনার ঐ বাড়িতে না যাওয়ার ধান্দা।ওদের বাড়ি পুরোনো, জঙ্গল টাইপ এগুলো কোনো যুক্তি না।”
নিচ থেকে চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সুহায়লা ফোন রেখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে। তানভীরকে বলতে শুনছে
-” আমি সুহায়লাদের বাসায় যাবো না ব্যস।”
সুহায়লা পিছন থেকে বললো,
-” কেনো যাবে না তুমি? কি সমস্যা আমার বাসায়।”
-” তোমার বাসা ভাঙা চোরা। পুরাই একটা জঙ্গল। আমি যাবো না সেখানে।”
-” হা হা হা……… তোমার তো খুশি হওয়ার কথা তানভীর। তোমাকে কষ্ট করে জঙ্গল দেখার জন্য সুন্দরবন যেতে হবে না। তোমার শ্বশুড়বাড়িটা নিজেই একটা জঙ্গল। ২০-৩০ মিনিট সময় ব্যয় করলেই তুমি জঙ্গল থেকে ঘুরে আসতে পারবে।”
-” জঙ্গল দেখার কোনো ইন্টারেস্ট আমার নেই। তোমার মন চাইলে তুমি যেতে পারো।”
-” আমি তো যাবোই । সাথে করে তোমাকেও জঙ্গলে নিয়ে যাবো।”
তানভীর মেজাজ খারাপ করে উপরে চলে গেছে। ফরহাদ সাহেব ছেলের পিছনে ফাহিমকে পাঠালেন ওকে বুঝানোর জন্য। ফাহিমকে অসম্ভব ভালোবাসে তানভীর। ও বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাজি হবে। নিশাত ফরহাদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো,
-” আংকেল বাড়ি আবার জঙ্গল হয় কিভাবে?”
-” জানি না আমি। যে এই কথা বলেছে তাকেই জিজ্ঞেস করো।”
-” আসলে আপু আমাদের বাড়িটা অনেক পুরোনো। কম করে হলেও ৩৫ বছর তো হবেই। আমাদের বাড়ির আশে পাশে অনেকটুক খালি জায়গা আছে। যখন বাড়িটা করা হয় তখনই আমার দাদা বিভিন্ন গাছ লাগিয়েছিলো। প্রতিটা গাছ এই পয়ত্রিশ বছরে বিশাল সাইজের হয়ে গেছে। রাতের বেলা অনেকটা দেখতে ভুতুড়ে মনে হয়।”
” তানভীর ভাইয়া তো গিয়েছে সকালে। তাহলে তো ভুতুড়ে মনে হওয়ার কথা না।”
-” সকালে গিয়েছে বলেই তো বলছে যে বাড়িটা জঙ্গল। রাতে গেলে তো বলতো ওটা একটা ভূতের আড্ডাখানা।”
-” হা হা হা…… ঠিক বলেছো।”
-” শোনো আপু মূল কথা হচ্ছে তানভীর আমাকে পছন্দ করে না। তাই ওর কাছে আমার সবকিছুই খারাপ লাগে।”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here