বসন্ত এসে গেছে পর্ব ২

#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ২
,

,

,

—এখনো নাস্তা তৈরী হয়নি?আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো আমরা?

তাড়াতাড়ি হাত চালাতে চালাতে বললো অপু,

—এইতো ভাবি,এক্ষুনি হয়ে যাবে।

—এই কথাটা তো ১০বার শোনা হয়ে গেলো আমার।তোমার ভাইটা যে খেয়েদেয়ে অফিসে যাবে সে খেয়াল কি আছে?প্রতিদিন এমন ভাবে দেরি করে অফিসে গেলে যে বস অফিস থেকেই বের করে দেবে,তখন খাবার জুটবে কোথা থেকে?

—এখনো তো ৮টায় বাজেনি ভাবি।

অপুর কথা শুনে তার ভাই অনিক বলে উঠলো,

—৮টা বাজেনি তো কি হয়েছে,তাই বলে কি আরও দেরি করবি?তোর ভাবির মুখে মুখে আবার কথা বলিস?বড়দের সম্মান করতে জানিস না?

অপুর ভাবি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো,

—দেখেছো তো,এভাবেই কথা বলে ওরা মা মেয়ে আমার সাথে।আমার কথার কোন দামই দেয়না।আমাকে একেবারে ফেলনা ভাবে এরা।
আর তোমার মা টার কথা আর কি বলবো সে তো ঘুম থেকেই ওঠে ১০ টায়।উঠে নবাবের মতো খেয়েদেয়ে আবার শুয়ে পরে।

অনিক মাথা দুলিয়ে বলে,

—ঠিকই বলেছো,মা টাও যে কি হয়েছে না?গাধার মতো খাটনি করে কামাই করি আমি আর এরা সব শুয়ে বসে উড়ায়।

—হুমমম, সত্যি তাই।

অপু নাস্তা তৈরী করে টেবিলে নিয়ে আসে।ভাইয়ের সামনে প্লেট এগিয়ে নাস্তা দেয়।আড়চোখে একবার তাকায় ভাইয়ের দিকে।চোখ ছলছল করে।
বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।
মনে হয় এই কি তার সেই ভাই?সেই আগের ভাই?যে বোনের সাথে সারাদিন খুনসুটি করে বেড়াতো।মাকে মাথায় করে রাখতো?এই কি সে?
যে কিনা বোনের চোখের একফোঁটা পানি সহ্য করতে পারতোনা?
তার ভাইয়ের কি মনে নেই মা অসুস্থ? হার্টের অপারেশন করাতে হবে তাকে?বিছানা থেকে উঠতেও যে পারেনা তাকে কথা শুনাচ্ছে ভাই?মায়ের অপারেশন করা দুরে থাক ডাক্তার দেখাতেও যে ভাই কার্পন্য করে সে অপুর ভাই হতে পারনা।কিছুতেই না।
আচ্ছা হতে পারে এটা অন্য কেউ,শুধু চেহারাটাই অনিকের মতো?তার ভাই হয়তো অন্যকোথাও আছে?অপু আর তার মাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে? হতে পারেনা?হতেও তো পারে।

—খাওয়ার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কি খাওয়া যায় নাকি?

অনিকের কথায় অপুর ধ্যান ভাঙে।
আবার রান্নাঘরে গিয়ে দাড়ায়।
চোখের পানি বাধ ভাঙে।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক বানায়।একটা প্লেট এ খাবার নিয়ে মায়ের রুমে এগোয়।
মাকে খাইয়ে ভার্সিটি যেতে হবে তাকে।
কিছুদিন পরেই ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষা আছে তার কিন্তু পড়াশোনার সময়ই পায়না।বাড়িতে থাকলে অসুস্থ মায়ের সেবা আর বাড়ির সকল কাজকর্ম করতে করতে দিন যায়।তাছাড়া কিছু টিউশনিও করায় অপু।টিউশনির টাকা দিয়েই তো নিজের পড়ার খরচ চালায়।ভাই তো পড়াশোনা করাতে একেবারেই রাজি ছিলোনা।সে তো চায় যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব অপু কে বিয়ে দিয়ে এ বাড়ি থেকে বিদেয় করতে।

,মায়ের পাশে চৌকিতে ধীরে ধীরে বসে অপু।এতো সাবধানতার পরও চৌকি মড়মড় করে ওঠে।ভাঙা চৌকির মলিন বিছানা ওপর শুয়ে চোখ পিটপিট করে তাকান আলেয়া বেগম।বয়স তার খুব বেশি না হলেও অসুখের জন্য বেশি দেখায়।
হাত পায়ের চামড়ার সাথে মুখের চামড়াও কুঁচকাতে শুরু করেছে ইদানীং।
খাট থেকে উঠে চলাফেরা করার মতো শক্তি খুব একটা পাননা তিনি।চোখ পিটপিট করে অপুর দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করেন আলেয়া বেগম।
অপু দেখে তাড়া দিয়ে বলে,

—চোখটা একটু খোলো তো মা,চোখে মুখে জল দিয়ে খাবারটুকু খেয়ে নাও।

আলেয়া বেগম চোখ বুজেই হাসেন।বেদনার হাসি হাসেন।

—খাবার খেয়ে কি আর হবে?

—কি হবে মানে?খাবার না খেলে তো তুমি আরও অসুস্থ হয়ে পরবে।

—এমনিতেও তো অসুস্থই।সুস্থ আর হচ্ছি কোথায়?

—হবে সুস্থ, ঠিক একদিন সুস্থ হবে।আবার হেসেখেলে বেড়াবে তুমি মা,আমি কোন ভুল করলে শাসন করবে,লাঠি নিয়ে মিথ্যা মারার নাটক করবে।

আলেয়া বেগম আবার হাসেন।মেয়ের মন তিনি বুঝতে পারেন।তিনি ছাড়া যে অপুটার কেউ থাকবে না সেটাও বোঝেন।কিন্তু মিথ্যা আশা বেধে কি কোন লাভ আছে?আলেয়া বেগম তো জানেন তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না।নিজের শরীরের খবর তো তিনি বোঝেন।

,

🌻🌻

,

,

—বাবার কথা মনে পরলো তোমার নোমান?

আরমান খানের কথায় উত্তর দেয়না নোমান।
সে বাবার পাশে বসে বাবার হাত মুঠো করে বসে আছে।সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।কিছু চুল কপালে এসে পরেছে।একহাত দিয়ে চুলগুলো পিছে ঠেলে দেয় নোমান।হাতের দামী ঘরিতে একবার চোখ বুলায়।

বাবার উপর তার অনেক রাগ জমানো,অনেক বছরের রাগ।ভালভাবে কখনো কথাও বলা হয়নি তার বাবার সাথে।ওপরে ওপরে গম্ভীর ভাব ধরে কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে সে।অথচ ভেতরে তার বাবার জন্য এক আকাশ সম ভালবাসা আছে।পুরো পৃথিবীতে আপন বলতে এই বাবাটাই তো শুধু আছে তার।

ছেলের উত্তর না পেয়ে আরমান খান আবার বলেন,

—কথা বলবা না?

নোমান গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়,

—হুমমম বলছি।

আরমান খান দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
ছেলের এই রাগী বদমেজাজি হয়ে ওঠার পেছনে পুরো অবদানটা তারই।
নোমানের ছোটবয়সে মা মারা যাওয়ার পর মায়ের অভাব পুরন করতে যখন নতুন মা আনা হলো তখন থেকেই তার পরিবর্তনের সূচনা।সৎ মায়ের অত্যাচারে অবহেলায় নোমান বদলে যেতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি আরমান খান। কিন্তু যতোদিনে বুঝতে পেরেছে ততোদিনে খুব দেড়ি হয়ে গিয়েছিলো।
নোমানের কঠোরতা,জেদ ফুটে উঠেছিলো তার চরিত্রে।
তারপরেই তো পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমালো বিদেশে।
আর ফিরে এলো সম্পুর্ন অচেনা এক নোমান হয়ে।বাবার বিজনেসে না বসে নিজে বিজনেস চালু করে।অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজের কোম্পানীকে নিয়ে যায় দেশের প্রথম সারির কোম্পানীর কাতারে।নোমান খান যাকে দেখলে প্রত্যেকটা কর্মচারীর হাটু কাপে,যার সামনে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে গেলেও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়।

,

,

,

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here