#বাসন্তীগন্ধা
|১৬| [কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
লাবিবা ওয়াহিদ
—————————–
প্রতিদিনের মতোই সকলে একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে বসলো। গতকাল দুপুরের খাবার সেরেই রোজার মা এবং ভাই চট্টগ্রামে চলে গেছে। সারিম এবং মেহের পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। সারিম কিছুক্ষণ পরপর এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে মেহেরকে। যা মেহেরের খুব ভালো লাগছে। নতুন অনুভূতি হৃদয়ে জম্মালে বুঝি নিত্যদিনকার অভ্যাসও নতুন মনে হয়? সাইয়ান খেতে খেতে সারিমের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ আগেই আইয়ুব সাহেব এবং সোহেল সাহেব খেয়ে উঠে পরেছেন। বর্তমানে তাদের মা রোকসানার সাথে হলরুমে বসেছে। সাইয়ান খাবার মুখে পুরে সারিমের উদ্দেশ্যে বললো,
–“তোর ওই বান্ধুবীটা কী করে যেন আমার বিয়ের খবর জেনে গেছে!”
সারিম খাওয়া বন্ধ করে সাইয়ানের দিকে তাকালো। ভ্রু কুচকে বললো,
–“কোন বান্ধুবী?”
–“ইলিরা!”
“ইলিরা”-র নাম শুনে মেহেরের খাবার গলায় আটকে গেলো। যার ফলে হেঁচকি উঠলে দ্রুত সামনে থাকা পানির গ্লাসটি হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। জ্যুতি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন। মেয়ের কান্ডে তিনি কঠিন গলায় বললেন,
–” এত বড়ো হয়েছিস তাও তোর স্বভাব বদলালো না মেহের! খাওয়ার মাঝে অন্যদিকে ধ্যান দিস কেন? তোকে নিয়ে আর পারা গেলো না!”
মেহেরকে বকতে বকতেই তিনি হলরুমে চলে গেলেন। মেহের মুখটা ছোট করে বসে রইলো। মেহেরের পাশে বসা রোজা মেহেরের গাল টেনে বলে,
–“মায়েদের কথায় অভিকান করতে নেই। সন্তানের জন্যে মায়ের চিন্তা সবার থেকে ভিন্ন এবং বেশি হয়!”
রোজার কথায় মেহের ম্লান হাসলো। সারিম এবার সাইয়ানকে প্রশ্ন করলো,
–“তাতে কী হয়েছে?”
–“তোকে বিয়ে করতে চায় তোর ওই বান্ধুবী। এতদিন কল কর, করে কান খেয়েছে আমার বিয়ের জন্যে। যাতে তোর লাইন ক্লিয়ার হয়ে যায়। মেয়েটার নাকি বাসা থেকে বিয়ের চাল দিচ্ছে। কী মনে হচ্ছে, করবি নাকি বিয়ে?”
সাইয়ানের কথা শুনে মেহেরের ভেতরটা দুমড়ে – মুচড়ে গেলো। হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়ে গেলো মুহূর্তে-ই। গলায় আটকে থাকা কান্নার দলাকে দমিয়ে রইলো মেহের। সারিমের কোনোরূপ উত্তর না শুনে মেহের হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। শব্দ করে উঠে দাঁড়ানোর ফলে সকলেই অবাক নয়নে চেয়ে রইলো মেহেরের দিকে। মেহের কোনো রকমে নিজেকে সামলে মাহিমের উদ্দেশ্যে বললো,
–“কলেজের জন্যে দেরী হয়ে যাচ্ছে মাহিম। চল!”
মাহিম খাওয়া ভুলে বিস্ময়ভরা চাহনিতে চেয়ে আছে মেহেরের দিকে। সারিম মুখ খুলে মেহেরকে কিছু বলার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু মেহের সারিমকে কোনরকম সুযোগ না দিয়ে হতভম্ভ মাহিমের হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দাঁড় করালো। অতঃপর কারো দিকে ফিরে না তাকিয়ে হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। সাইয়ান মেহেরের যাওয়ার দিকে অবাক নয়নে চেয়ে বললো,
–“ব্যাপারটা কী হলো? কিছুক্ষণ আগেও ঠিক ছিলো। এখন হঠাৎ কী এমন হলো যে এভাবে হনহনিয়ে চলে গেলো? আশ্চর্য!”
রোজাও সাইয়ানের কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবলো। অতঃপর কী মনে করে একপলক সারিমের দিকে চাইলো। সারিমও বেশ চমকে গেছে মেহেরের এমন অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে। তবে রোজা কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। পরমুহূর্তে কী ভেবে নিজেকে গাল-মন্দ করে ভাবলো,
–“ধুর। কীসব ভাবছি? এটা তো সম্ভব না।”
—————–
মাহিমের পিঠের শার্ট খামচে নাক টেনে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেহের। মাহিম বাইক চালানোর পাশাপাশি গোমড়া মুখ করে লুকিং গ্লাসে মেহেরকে দেখছে। মেহেরের নাক লাল হয়ে গেছে। চোখের আশেপাশে রক্তিম আভা। মাহিমের একদমই ভালো লাগছে না মেহেরের এরকম কান্না। সারাজীবন ঝগড়া, মা*পিট যাই হোক না কেন, অন্যের জন্যে বোনের এমন কান্না মাহিমের সহ্য হচ্ছে না। বেশ কয়েকবার জানত চেয়েছে মেহেরের কান্নার কারণ। কিন্তু মেহের তো মাহিমের কোনো প্রশ্নের জবাব-ই দিচ্ছে না। এজন্যে মাহিম একপ্রকার বাধ্য হয়ে চুপ মেরে গেলো।
মেহের ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,
–“মাহিম, সারিম ভাইয়া যদি ওই ইলিরা আপুকে বিয়ে করে তাহলে আমি সেদিনই বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে যাব। আমার কথা তুই মিলিয়ে নিস!”
মেহেরকে স্বাভাবিক করতে মাহিম রসিক সুরে বললো,
–“মজা নিস না। তুই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবি কই? শ্বশুরবাড়ি?”
–“দরকার পরলে তাও জুটিয়ে নেব। তবুও আমি ওই বাড়িতে থাকবো না!”
–“এর মানে এতক্ষণ সারিম ভাইয়ের জন্যে কান্না করা হচ্ছিলো?”
মেহের কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“যার জন্য-ই কাঁদি না কেন, তাতে তোর কী?”
–“আমার অনেক কিছু। সাহস কত বড়ো আমাকে চোখ রাঙাস? আমি তোর দেড় মিনিটের বড়ো মেহের।”
মেহের মাহিমের পিঠে চিমটি কাটলে মাহিম চেঁচালো। বললো,
–“খবরদার যদি আমাকে এই চিমটি আর খামচি দিস তো! নইলে তোকে চলন্ত বাইক থেকে ফেলে দিবো বেদ্দপ!”
–“তুই বেদ্দপ! জলদি বাইক চালা।”
–“কলেজে কী তোর বর বসে আছে?”
–“তোর বউ বসে আছে। যা ফুট!”
মাহিম যখন বুঝলো মেহেরের কান্না থেমে গেছে তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মাহিম। এর হেস্তনেস্ত তো আজ বাড়ী গিয়ে করাই লাগবে! মাহিমের সকল আশায় পানি ঢেলে মেহের বলে ওঠে,
–“মাহিম, আমি যে এতক্ষণ কেঁদেছি তা যদি কারো কানে যায় তাহলে তোর সকল ফ্লার্টিং কাজ – কারবার আমি আব্বুর কানে পৌঁছে দিবো। বি কেয়ারফুল!”
—————-
রোজা রান্নাঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে জ্যুতির ব্যস্ততস দেখছে। জ্যুতি রোজাকে খেয়াল করতেই মুচকি হাসলো। উত্তরে রোজাও মুচকি হাসলো। জ্যুতি বললো,
–“কী ব্যাপার রোজা? এই গরমে এখানে কী করছো?”
রোজা আলতো হেসে বললো,
–“আপনাকে দেখছি। এখনো কারো সাথে সেভাবে পরিচিত হলাম না!”
–“এ বাবা তা কেন বলছো? সকলেই কম-বেশি ব্যস্ত বুঝলে? তবে চিন্তা করো না, ধীরে ধীরে সবার সাথে মিশে যাবে। শুধু একটু সময়ের ব্যাপার!”
রোজা মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। রোজা বললো,
–“একটা প্রশ্ন ছিলো।”
–“কী প্রশ্ন বলো!!”
–“প্রশ্নটা আসলে আপনার ছেলের কাছেই করা যেত তবে সে ভুল বুঝবে কী না এজন্যে আমি প্রশ্নটা করার সাহস পাইনি!”
–“আচ্ছা, আমাকে নাহয় বলো। আমি তোমার মায়ের মতোই!”
–“না মানে, আপনাকে সকলে ছোট মা বলে ডাকে..”
জ্যুতি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ম্লান হেসে বলে,
–“সাইয়ানের মা মা* যায় আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে। সেই থেকে আমি ওদের মা হয়ে গেলাম!”
রোজা ব্যথিত নয়নে চাইলো জ্যুতির দিকে। জ্যুতি রান্নাঘরে থাকা কাজের মেয়েটাকে অন্য কাজের বাহানায় রান্নাঘর থেকে বের করে দিয়ে ধীর, সুস্থে সবকিছু খুলে বললো রোজাকে। রোজা সব শুনে কিছুটা স্তব্ধ। এতদিন সাইয়ানের ব্যবহারে বোঝাই যায়নি সাইয়ান মা হারা। কতটা প্রাণচঞ্চল সাইয়ান। সারিম এবং সামিরার বেলাতেও একই ব্যাপার খেয়াল করেছে। মাকে ছাড়া এতটা স্বাভাবিক থাকা আদৌ সম্ভব? হয়তো মায়ের মতো কাউকে পেয়ে ওরা ওদের বেদনা কিছুটা ভুলতে পেরেছে। এই পরিবারটা অদ্ভুত সুন্দর। দারুণ তাদের মোলায়েম নিবিড় সম্পর্ক।
জ্যুতি হঠাৎ প্রশ্ন করলো রোজাকে। রোজার ধ্যান ভাঙলে জ্যতি প্রশ্ন করে,
–“তুমি কী মানসিক চাপ সহ্য করতে পারো না?”
রোজা বেশ চমকালো জ্যুতির প্রশ্ন শুনে। আমতা আমতা করে বললো,
–“এমন কে..কেন হলো ছোট মা?”
–“নাহ। প্রথমদিন যেভাবে জ্ঞান হারালে তাই প্রশ্ন করলাম!”
রোজা মাথা নিচু করে লাজুক স্বরে বললো,
–“বিয়ের পরিস্থিতিটা খুব অস্বাভাবিক ছিলো। আপনাদের হঠাৎ এরকম আচরণে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো আপনারা মেনে নিবেন না, কঠোর মানুষজন।”
জ্যুতি হেসে বলে,
–“এমনটা ভাবা স্বাভাবিক। তবে এই তুচ্ছ বিষয়ে কেউ এত ভয় পায়? ভয়কে জয় করতে শিখো। তোমার জীবনের গল্প কীরকম তা আমার জানা নেই। তবে এইটুকু বলতে চাই, আমরা হাজার বার ভাঙি হাজার বার নতুন করে গড়ে ওঠার জন্যে। পা পিছলে গেলেও কিন্তু উঠে দাঁড়াতে হয়। পা পিছলে সেখানে কারো অপেক্ষায় বসে থাকাটা বোকামী বৈ কিছু নয়।”
–“কিন্তু ছোট মা। আমার জীবনে আমি খুব খারাপ পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি যার প্রভাব এখনো কাটেনি!”
–“মনোবল শক্ত করো। তবেই তুমি সেই প্রভাব থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে পারবে। বুঝেছো?”
রোজা ম্লান হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়ালো।
———————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।