বাসন্তীগন্ধা পর্ব -২০

#বাসন্তীগন্ধা
|২০|
লাবিবা ওয়াহিদ

মেহের এবং সোহা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই দেখলো সারিম গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ঠিক রেস্টুরেন্টের সামনে। সারিমকে এখানে এভাবে দেখে মেহের বেশ চমকালো। সে তো জানায়নি ও রেস্টুরেন্টে এসেছে৷ তাহলে সারিম জানলো কী করে? সারিমকে দেখে সোহা মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করলো। যা সারিমের চোখে পরলে ভ্রু কুচকে গেলো। তবে ব্যাপারটা ঘাটলো না সে। মেহেরের উদ্দেশ্যে বললো,
–“রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখবি?”

সারিমের কথায় মেহের হকচকিয়ে উঠে বললো,
–“না, না। আপনি গাড়িতে বসুন। আমি সোহাকে বিদায় দিয়ে আসছি।”

সারিম একপলক সোহার দিকে চেয়ে বললো,
–“তুমিও আসতে পারো আমাদের সাথে। তোমাকে বাড়ী পৌঁছে দিচ্ছি। নিশ্চয়ই তোমার বাবা-মা চিন্তা করছে!”

সোহাও অপ্রস্তুত হলো। পরমুহূর্তে এক গাল হেসে বলে,
–“ধন্যবাদ ভাইয়া। আমারও ইচ্ছা করছিলো না বাসে ঝুলে বাড়ী ফিরতে।”

সারিম আর কোনো কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সোহাকে মেহেরকে খোঁচা দিয়ে বললো,
–“বাহ! সাহেবের বউয়ের প্রতি এত টান? তুই না বলতেই চলে এলো।”

মুহূর্তে-ই মেহেরের গাল জোড়ায় লাল আভা ছড়িয়ে গেলো। লাজুক স্বরে বলে,
–“ভাইয়া এখন অবধি জানে না দাদী ইলিরা আপুর বাবা-মাকে কী বলে বের করেছে। জানলে কী হবে আমি তো তাই ভাবছি!”

–“সত্যি মেহের। তোর অনেক সাহস। নয়তো দাদীকে সরাসরি কীভাবে বলে দিলি?”

মেহের কিছু বলার আগেই সারিম হর্ণ বাজাতে শুরু করে। বিকট শব্দে থাকতে না পেরে দুজন একসাথেই গাড়িতে উঠে বসলো। মেহের সামনে আর সোহা পেছনে। সোহা সিটে আরাম করে হেলান দিলো। কী আরাম, কী শান্তি। এরকম গাড়ি বান্ধুবীর বরের হলে মন্দ হয় না। শালিকা হিসেবে রোজ আরাম করে বাড়ি ফিরতে পারতো।

কারো মুখে কোনো কথা নেই। তিন জনই নীরব। মেহের লুকিং গ্লাসে সোহাকে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। তাই পিছে ফিরে চাইলো। সোহা হাতে ফোন নিয়ে কিছু একটা করছে। ঠিক তখনই মেহেরের ফোনে টোন বেজে ওঠে। মেসেজের টোন। মেহের ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই দেখলো সোহার মেসেজ। মেহের চুপ করে মেসেজ চেক করলো। সোহা লিখেছে,

–“এত আরাম দোস্ত। ইচ্ছা করতাছে এখনই তোর ভাইকে দুলাভাই বানিয়ে ফেলি। অন্তত এসি গাড়িতে করে বাড়ী ফিরতে পারবো!”

মেহের রিপ্লাই করলো,
–“তোকে বলাটা ভুল হয়েছে। এক কথা বারবার বলছে!”

–“তো কী করতাম? পছন্দ-ই করলি এমন মানুষকে। যার গান না গাইলে আমার পেটের খাবার হজম হচ্ছে না। আচ্ছা মেহের সারিম ভাইয়ের তোর প্রতি অনুভূতি কী রকম?”

মেহের আড়চোখে সারিমের দিকে তাকালো। সারিম ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিয়েছে। মেহের রিপ্লাই করলো,
–“কনফউজড!”

–“কনফিউশনের কিছু নাই। যে তোর গন্ধ শুকে রেস্টুরেন্ট অবধি আসতে পারে সে অবশ্যই ঘাপলাযুক্ত মানুষ!”

মেহের চিন্তিত হয়ে রিপ্লাই করলো,
–“ওনার মনের খবর জানার উপায় নেই।”

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ফোনে ফোনে আলাপ হলো দুজনের। সারিমের অগোচরে। এর মাঝে সারিম সোহার সঠিক এড্রেস জেনে নিতে ভুললো না। সোহাকে ড্রপ করে গাড়ি ঘুরাতেই সারিম বললো,

–“দুই বান্ধুবী ফোনে এত কী পটরপটর করলি যা মুখে মুখে করা যায় না? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক যে আমাকে বলা যাবে না?”

সারিমের প্রশ্নের পিঠে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লো মেহের। বললো,
–“আমি রেস্টুরেন্টে ছিলাম সেটা আপনি কী করে জানলেন? নজর রাখছিলেন আমার উপর?”

সারিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিয়ে বলে,
–“কয়েকজন স্টুডেন্ট আমার পরিচিত। যাদের আমি তোর খবরা-খবর দিতে বলেছিলাম। ওরাই জানিয়েছে তুই কোথায় আছিস।”

মেহের আলতো হাসলো। অতঃপর কাচ ভেদ করে বাহিরে তাকিয়ে আনমনে বলে ওঠে,
–“আমি যার সাথে যেখানেই যাই না কেন, আপনি কেন এত চিন্তিত থাকেন?”

সারিম আশেপাশে চেয়ে সোজা-সাপ্টা বললো,
–“তুই বুঝবি না।”

মেহের বুঝেও বললো,
–“আমি বুঝতে চাই!”
–“পটরপটর না করে চুপ করে বস। দ্রুত বাড়ি চল, সামিরাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।”

——————
রোজা রুমে একা একা বসে আছে। সাইয়ান নেই। অফিসে। রোজার হাতে একটা ল্যাপটপ। সে ঘরে বসেই অফিসের কাজ করছে। এবং রেগুলার ওষুধ নিচ্ছে। রোজা এখন সাইয়ানের বউ হলেও তার একটা পরিবার আছে। সে ছাড়া তার পরিবারে উপার্জন করার মতো কেউ নেই। এছাড়া পরিবারের খরচ সাইয়ানের থেকেও নেওয়াটাও কেমন লজ্জাজনক। এজন্যে রোজা একপ্রকার জেদ করেই এই চাকরিটা করছে। সে চট্টগ্রামের অফিসেরই কাজ করছে। সাইয়ান সপ্তাহে এক দুই দিন গিয়ে অফিস দেখে আসে। যেতে আসতে দুই – তিন ঘন্টা লাগলেও সাইয়ানের সেরকম কোনো সমস্যা হয় না। সে কোনো রকম অভিযোগ ছাড়াই এই পরিশ্রম করছে। সে ভালোবাসে তার কাজকে।

রোজা ক্লান্ত হয়ে পিছে হেলান দিলো। ল্যাপটপটা পাশে রাখলো। ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলে খোলা জানালার তাকালো। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে তার অতীত মনে করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এখনো অল্প অল্প অস্বস্তি হচ্ছে তার। তবে আগের মতো তীব্র অস্থিরতা নয়। রোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাইরে হাওয়া বাতাস পাওয়া জরুরি। এছাড়া এটা শ্বশুরবাড়ি। সারাদিন রুমের মধ্যে পরে থাকলে তো চলবে না। তাদেরও সময় দিতে হবে। রোজা বেরিয়ে আসলে দেখলো মাহিম করিডরের এক কোণে দাঁড়িয়ে খেঁজুরে আলাপে ব্যস্ত। রোজা বুঝতে পারে মাহিম ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছে। এই কয়েক মাসে বাড়িতে থাকতে থাকতে মাহিমের স্বভাব সম্পর্কে সে জানতে পেরেছে।

মাহিমকে না ঘেটে রোজা নিচে নামতেই দেখলো তার শ্বশুর আব্বা দাদী শ্বাশুড়ির রুম থেকে বেশ গম্ভীর মুখে বের হচ্ছেন। মুখ-ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে মা-ছেলের মধ্যে কঠিন ঝগড়া লেগেছে। আইঁয়ুব সাহেবের নজরে রোজা পরতেই রোজা হাসি-মুখে সালাম দিলো। রোজাকে দেখে অপ্রস্তুত হলেও পরমুহূর্তে জোরপূর্বক হেসে একপ্রকার পালিয়ে চলে যায়। যেন রোজার সামনে সে বেশিক্ষণ থাকতে পারছিলো না। মুখখানা লুকাতে চাইলো।

রোজা রান্নাঘরে যেতেই দেখলো কাজের মেয়েকে এটা সেটা বলতে বলতে জ্যুতি রান্না করছে। রোজা জ্যুতিকে ডাকলো ‘মা’ বলে। জ্যুতি রোজার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বললো,
–“কিছু বলবে?”

–“তোমাকে সারাদিন রান্নাঘরে পরে থাকতে দেখি। একটু রান্নাঘর থেকে বের হলে কী হয় শুনি?”

জ্যুতি আলতো হেসে বললো,
–“এরকম কিছু না৷ বের হই তো।”

–“কিন্তু আমি কেন বের হতে দেখি না? যাইহোক বাদ দাও। আজকে আমি রান্না করি?”

জ্যুতি পুণরায় হেসে বললো,
–“নাহ। অন্য একদিন রেঁধো। আজকে মেহমান আসবে, তাই ব্যস্ততা বেশি!”
–“তাহলে তো সাহায্য করতে-ই পারি। একা হাতে সব সামলানো তো আপনার পক্ষে সম্ভব না।”

জ্যুতি দ্বিরুক্তি করলো। কিন্তু রোজা রাজি হলো না। সে একপ্রকার জেদ করে জ্যুতিকে হাতে হাতে সাহায্য করতে লাগলো। কাজের ফাঁকে প্রশ্ন করলো,
–“কে আসছে মা?”

–“সারিমের বন্ধু। সামিরার জন্যে প্রস্তাব নিয়ে আসবে। সারিম বললো তোমাদের রিসিপশনের পরপর-ই আসবে কিন্তু আশিফের বাবা-মা এখনই আসতে চায়। এজন্যে আর না করতে পারেনি। তুমি এসব কাজ না করে সামিরাকে গিয়ে দেখো। পারলে রেডি করিয়ে দিও।”

রোজা মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে রোজা তার অতীতটা আবার ভাবতে লাগলো। এভাবে ঘনঘন ভাবছে সেই অতীতকে। যাতে সে বুঝতে পারে তার অস্বাভাবিক আচরণের মাত্রা কমেছে নাকি বেড়েছে। তবে আগের মতো সেই অস্বাভাবিক আচরণ নেই। এত ভালো ভালো মানুষ পেয়ে সে স্বার্থক।

গেটের দিকে তাকাতেই দেখলো সারিম এবং মেহের ফিরেছে। ওদের দেখে রোজা দাঁড়িয়ে গেলো। অধরে লেপ্টে আছে তার মুচকি হাসি। সারিম কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলতে বলতে উপরের দিকে চলে গেলো। মাহিম সারিমকে দেখে তৎক্ষণাৎ কল কেটে মোবাইল পকেটে পুরে ফেললো। অতঃপর মিনমন করব বলতে লাগলো,
–“কানে ফোন দেখলে না জানি সারিম ভাইয়া আমার ফোন নিচে ফেলে দেয়। ভাইয়াকে ভরসা নেই।”

বলেই চুল হাত দিয়ে ঠিক করে কেশে-কুশে ভালো মানুষের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। সারিম একপলক মাহিমের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। তা দেখে মাহিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

রোজা মেহেরের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললো,
–“পরীক্ষা কেমন দিলে?”
মেহের মুচকি হেসে বললো, “ভালো ভাবী।”
–“অবশেষে কলেজ জীবনের ইতি টানলে?”
–“প্রেক্টিক্যাল শেষ হলেই ইতি টানতে পারবো।”

রোজা হেসে বলে,
–“চিন্তা করো না। আর মাত্র কয়েকটা দিন। যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও যাই সামিরার কাছে।”

মেহের ইতিবাচক মাথা নাড়ালো। একসাথে-ই উপরে উঠলো। মেহের চলে গেলো নিজের রুমে আর রোজা সামিরার রুমে চলে গেলো। সামিরার রুমে যেতেই রোজা অবাক। সামিরার চোখ জোড়া ফুলে লাল টকটকে হয়ে গেছে। রোজাকে নজরে এলে সামিরা অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। জোরপূর্বক হেসে বললো,

–“আরে ভাবী তুমি? ভেতরে আসো।”

রোজা ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বিছানার দিকে তাকালো। একটা শাড়ি পরে আছে। মনে হয় না সামিরা হাত লাগিয়েছে। রোজা থাকতে না পেরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“চোখ এমন ফোলা কেন সামিরা? কাঁদছিলে? কিন্তু কেন?”

সামিরা হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“আর বলো না ভাবী, স্যাড এন্ডিং মুভি দেখে এ অবস্থা হয়েছে। চোখের অবস্থা দেখে আমিও ভাবছি, কেন যে এই অসময়েই দেখতে গেলাম!”

রোজা সামিরার কথা শুনে আশেপাশে পরখ করে নিলো। বিছানার উপর ল্যাপটপটা অগোছালো ভাবে পরে আছে। স্ক্রিন চালু। এর মানে সামিরা মিথ্যে বলছে না। সত্যি দেখেছিলো। ব্যাপারটাকে বেশি না ঘেটে রোজা বললো,
–“তাহলে রেডি হয়ে নাও। শুনলাম ছেলেপক্ষ কিছুক্ষণের মধ্যে-ই চলে আসবে।”

সামিরা ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। মেহের ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই সামিরার এই করুণ অবস্থা দেখলো। মেহেরের কাছে মোটেও স্বাভাবিক লাগলো না। সে গভীর ভাবে সামিরার চোখের দিকে লক্ষ্য করছে। সেও কাঁদতো সারিমের জন্যে। অনেকক্ষণ কেঁদে আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার চোখও এরকম ফুলে যেত। এজন্যে ব্যাপারটা মোটেও সুবিধার লাগছে না মেহেরের। সামিরা কী এই বিয়েতে রাজি না? কই, এমন তো মনে হচ্ছে না। সামিরা তো দিব্যি হাসছে। কিন্তু মেহেরের খটকা যে লেগেই রইলো।

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here