বাসন্তীগন্ধা পর্ব -২৬

#বাসন্তীগন্ধা
|২৬|
লাবিবা ওয়াহিদ

মেহের কাঁচুমাচু হয়ে সারিমের রুমে বসে আছে। বঁধু সাজে। ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে গত পরশু সাইয়ানের রিসিপশন হলো আর আজ সারিমের রিসিপশন। সারিম মেহেরের বর। মানুষের জীবনের মোড় কখন কোন দিক ঘুরে যায় সেটা কেউ-ই কল্পনা করতে পারে না। অতি রঞ্জিত কিছু ঘটলে তো সেই ঘোর কাটানোই যায় না।

ফুলের ঘ্রাণ মেহেরের নাকে এসে বিঁধছে। মেহেরের কেন যেন ভয় করছে। ভয়ের কারণ হয়তো নিজের চোখে দেখেছে তাই? মেহের দেখেছে আমিন স্টেজের পেছনে ওই ছাঁইপাশ গুলো এনে রেখেছে। মেহেরের অপছন্দের শীর্ষে আছে এই জিনিসটা। তাও কী করে তারই বিয়ের রিসিপশনে এগুলো আনে? যদি সারিম খায়? মেহেরের কেমন গলা শুকিয়ে আসছে। ছাঁইপাশের গন্ধে মেহের বমি করে দিবে। সাথে তার এত সুন্দর বাসরঘরের পরিবেশ দূষণ হবে। ফুলগুলো সুরভী অনুভব করা যাবে না। এখন কী হবে? সারিমও তো দেরী করছে।

মেহের দুশ্চিন্তায় খেয়াল করলো না তার হাত-পা, গলা ভীষণ চুলকাচ্ছে। হঠাৎ হাতের দিকে তাকাতেই চমকে গেলো। লালচে দাগ ফুটে উঠেছে। মেহের কিছু একটা আঁচ করতে পারলে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে চুড়িসহ গায়ের সব গয়না খুলতে লাগলো। খুব তড়িঘড়িতে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বেশ কয়েক অংশে ছিলে গেলো। কোনো রকমে সব খুলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গলা, ঘাড়, হাত-পা চুলকালো। সারা শরীরে কেমন লাল লাল এলার্জির মতো হয়েছে। বিদঘুটে লাগছে দেখতে। মেহেরের মনে পরেছে চিংড়ি মাছে তার ভীষণ রকম এলার্জি। তাও মেহের সবার থেকে লুকিয়ে এক টুকরো নয় বরং দুই টুকরো মাছ খেয়েছে। যার ফলাফল স্বরূপ এই ভয়াবহ এলার্জি। মেহের শাড়ির কুঁচি ধরে তাড়াতাড়ি সারিমের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝড়ছে। বেরিয়ে এসে দেখলো মেহেরের রুম লক করা। মেহের উপায়ন্তর না পেয়ে জোরে জোরে কড়াঘাত করলো। সর্বাঙ্গ কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথা ধরে আছে। ভয়ানক অবস্থা তার। এলার্জির ওষুধ না খেলে কিছু না কিছু হবেই। মেহের তার রুম থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আবারও সারিমের রুমে চলে গেলো। রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। পাগলের মতো ঘাড়, গলা, হাত চুলকাচ্ছে। এবার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার।

–“মেরু!”
মেহের পিছে ফিরে তাকালেই দেখলো সারিম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখে তার বিস্ময়। মেহের কিছু বলার আগেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলো। সারিম এত জোরে চিৎকার দিলো সে পাশের ঘরের কয়েকজন ছুটে এলো। আর সারিম ছুটেছে মেহেরের কাছে।

মেহের যখন চোখ খুললো তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলো। আশেপাশে তাকাতেই দেখলো পশ্চিম দিকে মুখ করে সারিম নামাজ পড়ছে। মেহের অবাক চোখে চেয়ে রইলো সারিমের দিকে। সারিমের অল্প অল্প অধর নাড়ানো। এক মনে জায়নামাজে চেয়ে থাকা, মাথার টুপি সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। এখন সময় কত সেটা মেহের বুঝতে পারছে না। সারিম সেজদাহ শেষ করে সালামে ফিরলো। তখনো সারিমের চোখ বন্ধ ছিলো। মেহের পিটপিট করে দেখলো শুধু। মুগ্ধ চোখে। সারিমকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। এর কারণ কী নামাজে দাঁড়িয়েছে বলে? হয়তো তাই। ওযুর পরপর সবাইকেই অদ্ভুত সুন্দর লাগে। চেহারায় যেন স্বচ্ছ নূর ভাসা ভাসা থাকে।

মোনাজাত শেষ করে মেহেরের দিকে তাকালেই দেখে মেহেরের জ্ঞান ফিরেছে। সারিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার সিজদাহ্ দিলো। মেহের চেয়েই রইলো। নামাজ শেষ করে সারিম মেহেরের কাছে চলে আসলো। সারিমকে কাছে পেয়ে মেহেরের হৃদপিন্ডের ওঠা-নামা বেড়ে যায়। মেহের চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলে,
–“আমি হসপিটালে কেন?”

সারিম হঠাৎ মেহেরের কপালে অধর ছোঁয়ালো। মেহেরের পা জোড়া সাপের মতো মুঁচড়ে উঠলো। দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা মেহেরের। সারিম সেভাবেই মিনিটখানেক রইলো। মেহেরের নিঃশ্বাস বেড়ে গেলো। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। অদ্ভুত অনুভূতি। সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে কেমন। বহু কষ্টে সারিমের গলায় হাত রাখলো না। শক্ত করে চোখ বুজে সারিমকে সরানোর চেষ্টা করলো। পারলো না। পরমুহূর্তেই সারিম মেহেরের কপালে কপাল ছোঁয়ালো। মেহেরের কপাল যে বরফের মতো জমে গেছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। সারিম চোখ বুজে খুব কাতর গলায় বললো,
–“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে মেরু। খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!”

মেহের নির্জীব হয়ে বিছানায় পরে রইলো। সারিমের কথা মন-প্রাণ দিয়ে অনুভব করলো। মেহের কম্পিত কন্ঠে বললো,
–“এলার্জির ওষুধটা রুমে ছিলো। আমার রুমে যারা ছিলো কেউই দরজা খুলেনি। আমিও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো সুখ ছোঁয়ার আগেই হারিয়ে যাচ্ছি!”

সারিম কিছুই বললো না। বকলোও না মেহেরকে। মেহের ভেবেছিলো খুব বকবে। কিন্তু সারিমের নিত্যদিনকার বকাবকির স্বভাবটা আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে৷ সারিম এবার মেহেরের গালে অধর ছুঁয়ে বললো,
–“কিছু হয়নি। সব ঠিকাছে৷ এখন কেমন লাগছে?”
মেহের কথা বলতে পারলো না কিছুক্ষণ। সারিমের ছোঁয়ায় নেতিয়ে গেছে। সারিম মেহের চোখের দিকে চেয়ে বললো,
–“কিছু বলবে না? খারাপ লাগছে?”

মেহের চট করে চোখ মেলে নেতিবাচক মাথা নাড়ায়। আবদার করে বললো,
–“বাড়ি যাবো আমি!”

সারিম মাথা নাড়িয়ে বললো,
–“আচ্ছা। ডাক্তারকে ডেকে আনছি।”

বলেই সারিম বেরিয়ে গেলো। সারিম বের হওয়ার পরপর জ্যুতি, মেহেরের বাবা, রোজা তিনজন ছুটে এলো ভেতরে। জ্যুতি তো মেয়েকে আলতো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে খুব বকলো। কেন যে চিংড়ি খেয়েছিলো? জ্যুতি কে মেহেরের বাবা থামিয়ে দিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে নরম গলায় বললো,
–“সকলে খুব ভয় পেয়েছিলাম মা। তুমি সুস্থ আছো, এতেই আল্লাহ্’র দরবারে শুকুরিয়া। আর এভাবে চিন্তায় ফেলবে না ঠিকাছে?”

মেহের ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। যার অর্থ বাবার কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। নিজে নিজে কখনোই পাকামো করবে না।

মেহের একদিন পর বাড়ি ফিরলো। লাল মেহেদীতে রাঙানো বাম হাতের উলটোপিঠে স্যালাইনের ক্যানেল। অদ্ভুত লাগছে দেখতে। নতুন বউ বিয়ের প্রথম রাতেই হাসপাতালে চলে গেছে। বিষয়টা আরও বেশি অদ্ভুত। মেহের রেস্টে থাকলেও সকলে তার রুমে গিজগিজ করছিলো। পুরোদিন সবাই এক ঘরে ছিলো। বিছানা, চেয়ার, সোফা কোথাও জায়গা না পেলেও কার্পেট বিছিয়ে সকলে আড্ডা দিয়েছে। মেহেরের কাছে খুব রঙিন লাগছে সবকিছু। এত আপন কেন সবাই? রোকসানাও মেহেরের পাশ থেকে সরছে না। কিছুক্ষণ পরপর দোয়া-দরুদ পড়ে মেহেরের মাথায় ফুঁ দিচ্ছে। মেহেরের গায়ের লাল লাল ফোলা অংশগুলো স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।

সারিম মেহেরের থেকে দূরে থাকলেও মেহের ঠিকই খেয়াল করেছে সারিম মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকতো। অপলক নয়নে। যখন সকলে খেতে চলে যেত তখন সারিম এক প্লেটে খাবার এনে নিজে খেত আর মেহেরকেও খাইয়ে দিতো। খাওয়া শেষ হলে নিজেই মেহেরের মুখে ওষুধ পুরে দিতো। একদিনেই সারিমের এত যত্ন দেখে মেহের সিক্ত। সন্ধ্যার পরপর কাজিন’রা সবাই চলে গেলো। আশিফও চলে যায়। বাড়িটা পুরোপুরি মেহমান বিহীন হয়ে যায়। রোজা এবং সাইয়ানের রোজার মায়ের বাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও মেহেরের অসুস্থতার জন্যে ওরা যায়নি। তবে যাওয়াও উচিত। বিয়ের পরপর সাইয়ানের রোজার বাড়ি গিয়ে থাকা হয়নি। এ নিয়ে রোজার মায়েরও তাও মন খারাপ হয়। এজন্য আইঁয়ুব সাহেব বেশ জোর দিয়েই বললো যেন ওরা আগামীকালের মধ্যেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

রাতে মেহের চোখ বুজে শুয়ে ছিলো তখনই অনুভব করে কেউ তার পাশে শুয়েছে। মেহের চট করে চোখ মেলে তাকালো। তাকাতেই দেখলো সারিম এক হাতে ভর দিয়ে কাত হয়ে মেহেরের দিকে ঝুঁকে আছে। মেহের তাকাতেই লহু কন্ঠে বললো,
–“ঘুমাওনি?”

মেহের চোখ নামিয়ে বললো,
–“ঘুম আসছিলো না!”
থেমে গিয়ে গলার স্বর আরও নামিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
–“আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম!”

সারিম হাসলো। সৌভাগ্যক্রমে তখনই মেহের সারিমের মুখের দিকে চেয়েছিলো। সারিম হঠাৎ মেহেরকে বুকে টেনে নিলো। মুহূর্তে-ই সর্বাঙ্গ জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। বরফের মতো জমে গেলো মেহের। সারিম খুব ভালোবাসায় মেহেরকে আগলে নিয়ে নিলো,
–“এবার চোখ বন্ধ করো। ঘুম আসবে!”

বলেই অন্য হাত দিয়ে খুব আলতো করে মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এতে মেহেরের আবেশে চোখ বুজে এলো। মিশ্র অনুভূতিতে ভাসছে সে। নিজের অজান্তেই অধর প্রসারিত হয়ে রইলো। আহ্! একেই বুঝি বলে পবিত্র ভালোবাসার সুখ! এই ভালোবাসা পাওয়ার জন্যেই বুঝি মেহের এতদিন ব্যাকুল ছিলো?

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here