বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব -০১

” মা, তোমার মাথা ঠিক আছে! তুমি এমন একটা মেয়ের সাথে তোমার ছেলের বিয়ে ঠিক করতে পারলে! তাও আবার আমাকে না জানিয়ে! তোমার ছেলে মেডিকেল স্টুডেন্ট, তার জন্য অন্তত একটা যোগ্য মেয়ে খুঁজতে পারতে। তা না করে তুমি এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছে এমন মেয়ে পছন্দ করলে! ” কুঞ্জছায়া’র ড্রয়িংরুমের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে তাহমিদ রাশেদিনের রাশভারী গলার আওয়াজে।
” তুই এত হাইপার হচ্ছিস কেন বাবু? আমরা তোর খারাপ চাইনা। তাছাড়া কুহু যথেষ্ট ভালো মেয়ে। আমাদের সবার ওকে পছন্দ। ”
” তোমাদের সবার পছন্দ হলে তো হবেনা। বিষয়টা ঘটছে আমাকে নিয়ে এখানে আমার পছন্দ-অপছন্দেরও বিষয় আছে। আর তোমাদের কোন দিক থেকে এই মেয়েকে আমার যোগ্য মনে হচ্ছে! আমাদের সোসাইটি, আমার বন্ধুমহলে এই মেয়ের দাঁড়ানোর যোগ্যতা আছে? তাছাড়াও আমি সবেমাত্র প্রথম বর্ষের ফাইনাল দিব। এখনই তোমরা আমার বিয়ের কথা চিন্তা করছ কেন! ”
” তাহমিদ নিজেকে সামলে কথা বলতে হয় সেটাও কি ভুলে বসে আছিস? কুহু তোর বড়মার ভাইয়ের মেয়ে। তোর বড়মারও ইচ্ছে তোর সাথে কুহুর বিয়ে হোক। এখন সব ঠিকঠাক করে শুধু পারিবারিকভাবে বিয়েটা হবে। বাইরের কেউই এখন জানবেনা। তিন বছর পর যখন কুহুর বয়স আঠারো হবে তখন সবাইকে জানিয়ে নতুনভাবে আয়োজন করা হবে। ”
” বাহ্ দারুণ! এটাও ঠিক করে ফেলেছ! আমি তোমাদের যতই দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে তোমরা নিজেদের সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দিবে! হোকনা সে বড়মার ভাইয়ের মেয়ে তাতে আমার কি? বড়মা আমাকে ভালোবাসে বলেই যা ইচ্ছে তাই করবে? অধিকারের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাকে জোর করার অধিকার বড়মার নেই। আজকের এই দিনটা নষ্ট না করলেই কি হতোনা মা? ”
তাহমিদের কথা শুনে ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। আর কুহু সেতো লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। এত অপমানও ওর ভাগ্যে ছিল! দু-চোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে।
কুহুর ফুপু এ বাড়ির বড় বৌ আফরোজা নাজনীন সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। সে কি তবে ভুল করেছে! তাহমিদ তো তার কাছে নিজের সন্তানের ন্যায়। সেই অধিকার থেকেই উনি চেয়েছিলেন এই মা মরা মেয়েটাকে নিজের কাছে এনে রাখবেন। তবে তিনি কি সত্যিই অধিকারের অপব্যবহার করেছেন! তাহমিদের কথায় তো অন্তত তাই মনে হচ্ছে। তবে কি ভালোবাসার কোন মূল্যই নেই! তার এতদিন তাহমিদকে ভালোবাসা ভুল ছিল!
” চুপ কর তাহমিদ। অনেক বলেছ । আর একটা কথাও বলবেনা তুমি। কাকে কি বলছ তা তোমার মাথায় আছে? তোমার বড়মার সম্পর্কে বলছ তুমি। যে তোমাকে ছোট থেকেই নিজের সন্তানের মত ভালোবেসেছে। যার বুকের দুধ পান করেছ তুমি। আজ তাকে এসব বলতে তোমার বাঁধছেনা! ” এতটা নিচে নেমে গেছ তুমি? ” আফরোজা নাজনীনের স্বামী সানাউল রাশেদিনের গলায় রাগের ছটা। তিনি কিছুতেই তার স্ত্রীর অপমান সহ্য করতে পারছেননা৷
বড় চাচ্চুর রাগ দেখে তাহমিদের গলার স্বর মিইয়ে যায়।
” বড় চাচ্চু প্লিজ, আমার বিষয়টা একবার ভেবে দেখ। ঐ মেয়ে আমার সাথে কিভাবে যায় বলত। আমিও বড়মাকে খুব ভালোবাসি কিন্তু তাই বলে এই নয় যে আমার ভবিষ্যৎ অন্যকেউ নির্ধারন করবে। ” তাহমিদের গলায় অনুনয় ঝরে পরে।
” তাহমিদ বড্ড বেশি বকছ তুমি। তোমার কুহুকে পছন্দ না হলে ভালোভাবে বলতে পারতে কিন্তু তা না করে তুমি সবাইকে অপমান করছ। তোমার কাছে এটা আশা করিনি আমি। এখন মনে হচ্ছে একজন বাবা হিসেবে তোমাকে সুশিক্ষা দিতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। ” তাহমিদের বাবা শফিউল রাশেদিনের কন্ঠ ব্যর্থতায় মোড়ানো। তিনি ভাবতেই পারছেননা তার ছেলে এমন উদ্ধতভাবে কারও সাথে কথা বলতে পারে! চিরচেনা সেই ভদ্র, শান্ত, গুরুগম্ভীর ছেলেটা এক লহমায় এ কোন রূপ দেখাল!
ততক্ষণে কুহু ড্রয়িংরুম থেকে নিজের জন্য নির্ধারিত রুমে এসেছে। অনেক অপমানিত হয়েছে আর কোন অপমান নেয়ার অবস্থায় নেই সে৷ বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পরে কুহু। ও নিজের বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানতনা। ফুপু যে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিলনা ওর। আজ তার জন্য ফুপু তাহমিদ ভাইয়ার কাছে অপমানিত হল ভাবতেই দু-চোখ ফেটে জল আসছে৷ আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। যেখানেই যায় সেখানেই কেন এত অপমান সইতে হয়! তবে ছোটমা যে ওকে অপয়া বলে সেটা কি সত্যি! ‘তোর ছায়া যেখানে পরে সেখানেই আঁধার নামে’ ছোটমার বলা কথা কুহুর কানে বাজছে। অনাদরের জীবনে এই ফুপুই ছিল সকল সুখের উৎস, কুহুর আশ্রয়স্থল। আজ থেকে বুঝি এই আশ্রয়ও হারাল সে!
” ও মা তুমি আমাকে একা রেখে কেন চলে গেলে? তুমি যাওয়ার আগে একটাবারও আমার কথা কেন ভাবলেনা মা? আমার যে ভিষণ কষ্ট হয়। আজকের পর থেকে আমার এই বাড়িতে আসার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল। ” ডুকরে কেঁদে উঠে কুহু। কান্নার দমকে পিঠ থেকে থেকে ফুলে উঠছে।
মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মুছে ফিরে তাকায়। ওর ফুপু দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে পানি। চোখ মুছতে মুছতে মুখ খোলেন তিনি।
” আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। আমি পারলামনা তোর পায়ে সুখ এনে লুটাতে। আমি বুঝতেই পারিনি তাহমিদ কবে যে এত বড় হয়েছে। ” কান্নায় ভেঙে পরেন আফরোজা নাজনীন।
” ফুপু আমি বাড়ি যাব। তুমি কাল সকালেই আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। ভেবনা ফুপু, সুখ নামক অলীক বস্তু সবার কপালে ধরা দেয়না। আমার মত অপয়ার কপালে তো কখনোই নয়। তুমি আমার জন্য সুখ খোঁজার বৃথা চেষ্টা আর করনা। ”
” এভাবে বলিসনা মা। দেখিস তুই একদিন সুখী হবিই। মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর। রেজাল্ট দিলেই তোকে আমি এখানের কোন ভালো কলেজে ভর্তি করিয়ে দিব। তুই হোস্টেলে থাকবি। এ বাড়িতে তোর আর আসতে হবেনা। ” আফরোজা নাজনীন নিজেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেননা।
সেই রাতে আর কারোরই খাওয়া হলনা। সবার মন খারাপ হয়ে গেছে।

” তাহমিনা, আমার ছেলে যে এতটা বড় হয়ে গেছে তা আমরা টেরই পাইনি! সবার সামনে বড় ভাবিকে এভাবে বলতে পারল! বড় ভাবি ওর জন্য কি করেনি! আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে তাহমিনা। ” মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন শফিউল রাশেদিন।
তাহমিনা আক্তারেরও একই অবস্থা। তিনি ভাবতেই পারছেননা তার ছেলের এমন অধঃপতন। তার ছেলে তো এমন ছিলনা!

রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বসে আছে তাহমিদ। দখিনা বাতাসে ঘনকালো চুলগুল উড়ছে। ওর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। যে বড়মা ওকে প্রানের থেকে বেশি ভালোবাসে আজ সেই বড়মাকে রাগেরবশে অপমান করেছে ভাবতেই কেমন পাগল পাগল লাগছে। এমন নয় যে ও বড়মাকে ভালোবাসেনা। বড়মাও ওর প্রান। কিন্তু মাঝখানে কুহু মেয়েটা এসে সব তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে। কুহুর কথা মনে আসতেই ওর ভেতর বিরক্তির উদ্রেগ হচ্ছে। ও এই মেয়েটাকে কেন যেন সহ্য করতে পারেনা। মাথায় সব সময় বিনুনি করা থাকে, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা আর তাহমিদকে দেখেই কোন কারন ছাড়াই কুঁকড়ে যাওয়া এসব নিতান্তই অসহ্য লাগে তাহমিদের কাছে। তাহমিদ এত দিনেও বুঝতে পারেনি কুহু ওকে দেখলে কুঁকড়ে যায় কেন? ভয়ে না লজ্জায়? এককথায় কুহুকে ওর কারন ছাড়াই বিরক্ত লাগত প্রথম থেকেই। সেই কুহুর সাথে বিয়ের কথা শুনেই ওর ভেতরে জ্ব*ল*ন্ত আ*গ্নে*য়*গি*রি*র লা*ভা বেরিয়ে আসে। আর আজকেই বা কেন সবাই বিয়ের কথা তুলল! কত প্ল্যান ছিল আজকের দিনে। ঐ মেয়েটার জন্য সব মাটি হয়ে গেল। মা আজকেই কথা তুলল কেন? তারা তো জানত আজ ওর জন্মদিন ছিল। সে উপলক্ষ্যে বন্ধুরা বাসায় আসতে চেয়েছিল আড্ডা দিতে। কিন্তু এসব ঝামেলায় তাদের মানা করে দিতে হল। তাহমিদের কিছুই ভালো লাগছেনা। আজ ওর জন্য বাড়ির সবাই কষ্ট পেয়েছে।

আফরোজা নাজনীন রাতে কুহুর সাথে ঘুমান৷ কুহুও ফুপুর বুকের সাথে লেপ্টে শুয়ে থাকে। আজ রাতই এ বাড়িতে ওর শেষ রাত। এমন করে আর কখনোই হয়তো ফুপুকে কাছে পাওয়া হবেনা। ফুপু তার এই ভরা সংসার ফেলে গ্রামে যেয়ে থাকতে পারেনা। বছরে দুই-চারবার বাপের ভিটেয় যায়। তাও সকালে যেয়ে সন্ধ্যায় চলে আসে। এই মায়াবতী ফুপুকে আর জড়িয়ে ধরতে পারবেনা বলে কষ্টে বুক ফেটো যাচ্ছে কুহুর৷ ফুপিয়ে কেঁদে উঠে কথাটা মনে আসতেই। আফরোজা নাজনীনেরও চোখে ঘুম নেই। তিনি ভাবছেন, আজকের পর থেকে এ বাড়িতে কুহু আর পা মাড়াবেনা। এই হতভাগ্য মেয়েটা সৎ মায়ের অবহেলা, অনাদর আর কতদিন সহ্য করবে! দুই-চারমাস পরপর তাও এখানে এসে তিন-চারদিন থাকত। আজ থেকে সেই রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল। আর তার জন্য তিনিই দায়ী। আগে যদি একটাবার তাহমিদের সাথে কথা বলত। তবে আজ এতদূর ঘটতনা।
সারারাত কেউই দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত হতেই আফরোজা নাজনীন বিছানা ছাড়েন। অজু করে এসে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যান। কুহুও উঠে অজু করে এসে ফুপুর পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায়।
নামাজ শেষে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে উঠেন তিনি। এরপর কুহুকে ব্যাগ গোছাতে বললেন। কুহু ব্যাগে কাপড়চোপর তুলতে শুরু করলে তিনি রান্নাঘরে এসে নাস্তা তৈরী করতে থাকেন। কাজের মেয়েকে দিয়ে শ্বাশুড়ির কাছে নাস্তা পাঠিয়ে তিনি একটা প্লেটে নাস্তা নিয়ে আসেন কুহুর কাছে। নিজ হাতে খাইয়ে দেন কুহুকে। কুহুও পরম তৃপ্ত নিয়ে ফুপুর হাতে খায়৷
খাওয়া শেষ হলে তিনি কুহুকে রেডি হতে বলে শ্বাশুড়ির কাছে যান। তার সাথে কিছু কথা বলবেন আফরোজা নাজনীন।

সকাল আটটা বাজার আগেই কুহুকে নিয়ে সানাউল রাশেদিন বেরিয়ে পরেন ফুলতলা গাঁয়ের উদ্দেশ্যে। নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন তিনি। জানালার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে নানান ভাবনায় মশগুল সে। কি হতে চলেছে পরবর্তীতে এই ভাবনাই মনে উঁকি দিচ্ছে বারবার। ছোটমা যদি গতকালের ঘটনা জানতে পারে তাহলে কি হবে! ভাবতেই শরীর হিম হয়ে আসছে৷
” মামনি, তুমি কোন চিন্তা করনা কেমন। যাই কিছু হোকনা কেন তুমি মনে রাখবে আমরা তোমার পাশে আছি। তুমি শুধু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর। ” সানাউল রাশেদিন কুহুর মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন । প্রত্যুত্তরে কুহু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ায়।
আফরোজা নাজনীন ফোন হাতে নিয়ে বসে আছেন। তার একমাত্র ভাইয়ের কাছে ফোন দিতে হাত কাঁপছে। তিনিই তার ভাইকে জানিয়েছিলেন তাহমিদের সাথে কুহুর বিয়ের বিষয়ে। তাতে তার ভাই কায়েস আহমেদের সায় ছিল। আজ তিনি ভাইকে কেমন করে বলবেন এ বিয়ে হবেনা। কায়েসের বউ শিউলি কেমন রিয়্যাক্ট করবে একথা শোনার পর! আফরোজা নাজনীনের বুকের ভিতর দুরুদুরু করছে।
নিজের সাথে বোঝাপড়া করে অবশেষে ফোন করে কায়েসকে। দুইবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে কায়েস ।
” আসসালামু আলাইকুম বড় আপা। আপনি ভালো আছেন? আর দুলাভাই ভালো আছে? ” এক নিশ্বাস জিজ্ঞেস করে কায়েস।
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমরা সবাই ভালো আছি। তোরা সবাই ভালো আছিস? আজ তোর দুলাভাই কুহুকে পৌঁছে দিতে গ্রামে গেছে। ” আর কোন কথা জোগাচ্ছেনা আফরোজা নাজনীনের মুখে।
” আপা, কুহুর বিয়ের বিষয়ে কি কথা হল? কবে বিয়ের দিন ঠিক করলেন? ”
ধক করে উঠল আফরোজা নাজনীনের বুক। কি জবাব দিবেন ভাইকে! তিনি টের পাচ্ছেন শরীরের কাঁপন। ঠোঁট দিয়ে জিহবা ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে বরে উঠেন, ” এ বিয়ে হবেনা। তাহমিদ এখন বিয়ে করবেনা। ওর কুহুকে পছন্দ নয়। ”
কায়েসের মুখ চুপসে গেছে বোনের কথায়। সে অনেক আশা করেছিল এবার অন্তত মেয়েটা সুখের মুখ দেখবে। ওর কপালে সুখ কি কভু নেই?

চলবে….

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১
জাওয়াদ জামী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here