বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব -১৯+২০

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী

কুহুর হোস্টেল সুপারকে আনানের চাচা সাজ্জাদ বলে রেখেছিলেন কয়েকটা দিন কুহুর হোস্টেলে ফিরতে রাত হবে। তিনিও মেনে নিয়েছেন। এতে করে কুহুর প্রতিদিন রাতে হোস্টেলে যেতে অসুবিধা হচ্ছেনা। প্রতিদিনই কুহুর সাজ্জাদ স্যার কুহুকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে যান।

আজ হলুদ সন্ধ্যা। এ উপলক্ষে প্রত্যেকটা মেয়ে বাহারি সাজে সেজেছে। আজ মেয়েরা পরছে সরষে ফুল রংয়ের শাড়ি। সঙ্গে আছে টাটকা ফুলের মালা। খোঁপা সাজিয়েছে লাল জারবেরায়। আর ছেলেরা তাদের সাথে মিলিয়ে পরেছে পাঞ্জাবী আর জিন্স।
সবাই চুলে খোঁপা বাঁধলেও কুহু ওর ঘন কেশরাশি খুলে রেখেছে। সেই খোলা চুলে পেঁচিয়ে রেখেছে হলুদ চন্দ্রপ্রভার মালা। জারবেরার থেকেও চন্দ্রপ্রভা কুহুর বেশি পছন্দের। ওর হোস্টেলের বাগানে একটা বড় চন্দ্রপ্রভা গাছ রয়েছে। গাছ জুড়ে ফুটে আছে থোকায় থোকায় ফুল। সেখান থেকেই কিছু ফুল নিয়ে মালা গেঁথেছে কুহু।

সিক্তা, আরোশি, দৃষ্টি, তনয়াসহ সব মেয়েরা উচ্ছল প্রজাপতির ন্যায় এদিকসেদিক ছুটোছুটি করছে। ব্যতিক্রম শুধু কুহু। ও চুপচাপ সুপ্তির পাশে চুপটি মেরে বসে আছে। মূলত শিউলি আক্তারের ঈগল দৃষ্টি থেকে বাঁচতেই ওর এভাবে বসে থাকা। এদিকে শিউলি আক্তার শুধু সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কুহুর কোন ত্রুটি পেলেই ওকে আচ্ছামত ঝাড়বে।

তাহমিদ শত ব্যস্ততার মাঝেও তার শ্যামাঙ্গীনিকে আড়ালে আবডালে থেকে ঠিক দেখে নিচ্ছে। বারবার দেখায়ও যেন ওর চোখের তৃষ্ণা কিছুতেই মিটছেনা। যতবার ও কুহুকে দেখছে ততবারই নতুন করে ওর শ্যামাঙ্গীনির প্রেমে পরছে। তাহমিদ বুঝতে পারেনা কি মায়া আছে এই মেয়ের মাঝে! হুট করেই এত অনুভূতি কিভাবে জন্মালো! এই অনুভূতির কোন নাম খুঁজে পায়না তাহমিদ। এমনকি এই অজানা অনুভূতির কোন নামও দিতে চায়না। শুধু অনুভব করতে চায় এক সমুদ্র প্রেমের। যে প্রেমের জোয়ারে ভাসাতে চায় মনের দুকূল। সেই সাথে ভাসাতে চায় তার শ্যামাঙ্গীনিকে৷ যে জোয়ারে ভাসলে তার শ্যামাঙ্গীনিকে হারানোর কোন ভয় থাকবেনা। যে জোয়ারে ভাসলে তার শ্যামাঙ্গীনির শিরায়-উপশিরায়, তনু-মনে শুধুই তাহমিদের নামের ভালোবাসা প্রবাহিত হবে।

” এতক্ষন ধরে দেখছ, তবুও দেখার সাধ মিটছেনা, ভাই! তোমার চোখে শ্যাওলা পরেনি এতবার ওকে দেখতে দেখতে! ধন্য তোমার চোখ। ” আনান টিটকারি মারে তাহমিদকে।
” তুই এখানে কি করছিস? তোর তো দেখছি মিনিমাম লজ্জাটুকুও নেই! বড় ভাই হয়ে ছোট বোনের প্রেমিকের দিকে নজর রাখছিস! তবে একটা কথা কি জানিস? তোর বোনটা কিন্তু সেই লেবেলের হট। ” তাহমিদ চোখ টিপে তাকায় দিকে। এবার আনান লজ্জা পায়।
” তুমি আমাকে বলছো লজ্জা নেই আর তুমি আমাকে কি বললে! সম্পর্কে আমি তোমার বউয়ের বড় ভাই মানে তোমারও বড় ভাই। তোমার উচিত পাঁচ বেলা করে আমাকে সালাম দেয়া। তা না করে তুমি আমার সামনে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করছ। ছিহ্ ভাই ছিহ্। ”
” আমার দেখার মাঝে ব্যাঘাত ঘটালে এরপর থেকে প্রতিনয়িত আরও অশ্লীল শব্দ তোকে শুনতে হবে। যদি সেসব শুনতে ইচ্ছে হয় তবে আমার দেখার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাতে পারিস। ” তাহমিদ ভাবলেশহীন মুখে জবাব দেয়।
আনান মুখ কালো করে থাকে। ও জানে তাহমিদের একরোখা স্বভাব। ধুপধাপ পা ফেলে অন্য দিকে চলে যায়। আনানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তাহমিদ। আজকের মত ভালোই জব্দ করা গেছে।

স্টেজে রাজসিক চেয়ারে বসে আছে সুপ্তি। ওর চারপাশে কাজিন সমাজ এবং বন্ধুমহলের আনাগোনা। একে একে সবাই এসে সুপ্তিকে হলুদ মাখাচ্ছে। এরমধ্যে বরপক্ষও এসে গেছে। তাদের স্বাগত জানাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেছে। কুহু ফুপুদের সাথে হাতে হাত মিলেয়ে এটা সেটা করছে।
বরপক্ষের সবাই স্টেজে এসে সুপ্তিকে হলুদ মাখায়। ওর সাথে সেলফি নিচ্ছে।
জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চলছে হলুদে। সবার হলুদ দেয়া শেষ হলে শুরু হয় দু’পক্ষের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যে যার মত পারফর্ম করতে শুরু করেছে। সিক্তা, আরোশি কুহুকে খুব করে অনুরোধ করছে গান গাইতে কিন্তু কুহু ওদের কথায় রাজি হয়নি। ওরাও মুখ গোমড়া করে আবার সুপ্তির কাছে ফিরে গেছে।

সানাউল রাশেদিন হাতে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে কিচেনের দিকে যাচ্ছেন।

” কি ব্যাপার সিনিয়র রাশেদিন! আপনাকে কে কাজ করতে বলেছে? আমরা কি দেশে নেই, যে আপনাকেই কাজ করতে হবে? নাকি সবাইকে দেখাচ্ছেন নিজের মেয়ের বিয়েতে ভাইয়ের ছেলে কোন হেল্প করছেনা! ” সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে সানাউল রাশেদিন তাহমিদের সাথে তেমন একটা কথা বলেননা। আর তাহমিদও বড় চাচ্চুর ভাবভঙ্গি দেখে তার সাথে আপনি করে কথা বলে। আসলে ও একটু খোঁচাতে চায় বড় চাচ্চুকে।
” তা হবে কেন! আমাকে হেল্প করার জন্য অনেকেই আছে। আর ভাইয়ের ছেলেও যে যথেষ্ট করছে তা-ও আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে একটুআধটু সাহায্য করে এত নাম কেনার দরকার নেই। আমার মেয়ের আরও ভাই-বোন আছে তার বিয়েতে হেল্প করার জন্য। আর সবাই যেখানে আনন্দ করছে তোমারও উচিত তাদের সাথে থেকে আনন্দ করা। তাছাড়া পরে তুমিই বলবে সিনিয়র রাশেদিন খাটিয়ে নিয়ে তবেই খেতে দিয়েছে। ” সানাউল রাশেদিন বিরক্ত হয়ে জবাব দেন।
তাহমিদ বড় চাচ্চুর হাত থেকে প্যাকেট জোড় করে নিয়ে প্রত্যুত্তর করে, ” আমার বাপেরও কম নেই যে আপনারটা খেয়েই বাঁচতে হবে। আর আপনার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে দুইদিন আপনার খেয়ে তো আজীবন থাকতে পারবনা। দুইদিন পর থেকেই আমার বাপেরটাই খাব। তাই এত খোঁ’টা দেয়ারও কাজ নেই। আর বোনের বিয়েতে ভাই কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ খেতে দিলেও কাজ করবে, না খাইয়ে রাখলেও কাজ করবে। ” তাহমিদ হনহন করে কিচেনের দিকে রওনা দেয়।
সানাউল রাশেদিনও চোখমুখ কুঁচকে তাহমিদের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকেন। বড্ড সাহস হয়েছে ছেলেটার৷ আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। আফরোজা আদর দিয়ে ছেলেটাকে মাথায় তুলে নাচাচ্ছে।
কমিউনিটি সেন্টারের বিশাল কিচেনে শেফের পাশাপাশি আফরোজা নাজনীনসহ কয়েকজন তদারকি করছেন।
তাহমিদ কিচেনে এসে প্যাকেটটা বড়মার কাছে দেয়।
” বড়মা, তোমার হাসবেন্ডকে বলে দিও, ওস্তাদি করে যেন কোন কাজ করতে না যায়। তখন আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা। ”
” আফরোজা, তোমার আদরের ছেলেকে বলে দাও ভবিষ্যতে আমার সাথে এরকম বে’য়া’দ’বি করলে ওকে ছেড়ে কথা বলবনা। ” সানাউল রাশেদিন ঝাঁঝ দেখিয়ে বললেন।
” তুমি এখানে কি করছ? হলরুমে যাও, দেখ সবাই ঠিকঠাক খাবার পাচ্ছে কিনা। দিনদিন তোমার বয়স বাড়ছে না কমছে? মেহমানদারি না করে ছেলেটার পিছনে লাগছ! ” আফরোজা নাজনীন দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বলে উঠেন।
স্ত্রীর ঝাঁঝ দেখে আর কিছু বলার সাহস পাননা সানাউল রাশেদিন। চুপচাপ হলরুমের দিকে চলে যান৷ তাহমিনা আক্তার ভাসুর – জা’র খুনসুটি দেখে মুখ টিপে হাসেন।

কমিউনিটি সেন্টারের হলরুম লোকজনের পদচারণায় গমগম করছে। আফরোজা নাজনীন তার দুই জা, বোন এবং অন্যাদের নিয়ে মেহমানদের আপ্যায়ন করছেন। সবার সাথেই টুকিটাকি কথাবার্তা বলছেন।
সন্ধ্যায় তাওহীদের শ্বশুর বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। ব্যস্ততার জন্য তাদের সাথে কথা বলা হয়ে উঠেনি। তিনি এখন হলের একপাশে দাঁড়িয়ে উনাদের সাথে কথা বলছেন। সেখানে তাহমিনা, নাজমাও আছেন।
” বড়মা, কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন গেস্ট এসেছেন। তুমি একটু দশজনের খাবার রেডি করে আমাকে দাও। পরে গল্প করো। ” তাওহীদ এসে আফরোজা নাজনীনকে বলল। তাওহীদকে এদিকে আসতে দেখে নীরাও এখানে এসেছে৷
কিন্তু তাহমিদ আগেই সেই দশজন মেহমানের জন্য খাবার নিতে কিচেনে গেছে। সেখানে শাহনাজ সুলতানা,শিউলি আক্তার, তাহমিনার দুই বোন আছে। তাহমিদ খাবার নিয়ে আসতেই বড় ভাইয়ের কথা ওর কানে যায়।
” তোমার আর মেহমানদারি করে কাজ নেই। তুমি দুইদিনের অতিথি, বরং তুমি আনন্দ কর। ” তাহমিদ কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে তাওহীদকে কথাগুলো বলে৷
” কি বলছিস তাহমিদ! আমি অতিথি হতে যাব কেন! আমি সুপ্তির ভাই। কিছু কিছু কাজ আমাকেও করতে হবে। ”
” বাহ্ মনে রেখছ তাহলে তুমি সুপ্তির ভাই। আমিতো ভেবেছিলাম যেখানে দূরের আত্মীয়রাও তিনদিন আগে এসেছে, সেখানে তুমি বিয়ের আগের দিন আসছ, হয়তো ভুলেই গেছ তোমার বোনের বিয়ে হচ্ছে। ”
” আমি ছুটি পাইনি তাই আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ভুলে যেতে পারিনা, সুপ্তি আমার বোন। ” মুখ কাঁচুমাচু করে বলে তাওহীদ।
” শালীর বিয়েতে ঠিকই সাতদিন আগে ছুটি পাও। তোমার বউও বোনের বিয়েতে পনের দিন আগে আসতে পারে। কিন্তু বোনের বিয়েতে তিন দিন আগে ছুটি পাওনা। বিষয়টা হাস্যকর হয়ে যায়না! তোমার কোন কাজ করতে হবেনা। তারচেয়ে বরং বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাক৷ হাজার হোক বড় ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছ। তাকে তো একা ছেড়ে দিতে পারনা। আর নিজের বাড়ির মানুষদের সামনে তো অবশ্যই নয়। তোমার বাপ-দাদার তো আর তাদের মত স্ট্যাটাস নেই। আমার কি মনে হয় জানো? তোমাকে লেখাপড়া করিয়ে বিসিএস ক্যাডার শফিউল রাশেদিন বানায়নি, বানিয়েছে তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। সেজন্যই তাদের এত তাঁবেদারি করো। ”
তাহমিদের এহেন কথায় উপস্থিত সকলে থমকে যায়। তাওহীদের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে, আর নীরা ঘামছে।
” তাহমিদ, এসব কি বলছিস? তুই যেয়ে মেহমানদের খাবার দে। এক্ষুনি যা। ” তাহমিনা আক্তার ছেলেকে ধকম দেন।
” ধমক দিয়ে কয়দিন সবাইকে থামিয়ে রাখবে মা! তারচেয়ে বরং সবাইকে জানতে দাও তোমার ছেলের আর তার বউয়ের চরিত্র। যে ছেলে বাবা-মা’কে দূরে ঠেলে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে মাতামাতি করে আর যাই হোক সে কোন আদর্শ সন্তান হতে পারেনা। তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি প্রতি মাসেই মেয়ের কাছে গেলে তাদের মেয়ের কোন সমস্যা হয়না, কিন্তু তুমি গেলেই তার যত সমস্যা? তার বাবা-মা’র থেকে কি তোমার যোগ্যতা কোন অংশে কম? নাকি তার বাবার থেকে আমার বাবা প্রভাব-প্রতিপত্তি কম? কোন অংশেই কম নয় বরং আমার বাবার তাদের থেকে কয়েকগুন বেশি প্রভাব-প্রতিপত্তি। ধন-সম্পদেও বেশি। তবে তুমি কার কাছে মাথা নিচু করে থাক? মনে রেখ তোমার ঐ নামধারী আদর্শ বিসিএস ক্যাডার বড় ছেলেও যেমন আছে তেমনি তাহমিদ নামক এক অসভ্য ছেলেও আছে। যে তোমাকে কোনদিন ফুলের টোকাও দিবেনা। আর তার বউও হবে স’ভ্য। কোন রূপবতী অ’স’ভ্য’কে বিয়ে করবেনা সে। তুমি বড় ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়েছ ঠিকই কিন্তু মানুষ বানাতে পারনি। তার ফল আজ ভোগ করছ, মা। ” তাহমিদ আর সেখানে দাঁড়ায়না।
তাওহীদ ছোট ভাইয়ের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। নীরা কিছু বলার অবস্থায় নেই। আর নীরার বাবা-মা যেন পালাতে পারলে বাঁচে।
আফরোজা নাজনীন জানেন তাহমিদ যা বলেছে তাতে এক বিন্দুও মিথ্যা নেই। আজ তার কেন যেন তাহমিদকে বুকে জরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।
তাহমিনা আক্তার মুখে আঁচল চেপে কাঁদছেন৷ তার এতদিনের আক্ষেপ, কষ্ট সব চোখের জল হয়ে ঝরছে। সত্যিই তিনি ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন কিন্তু মানুষ বানাতে পারেননি৷

পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে কুহু এতক্ষণ সব দেখছিল৷ তাহমিদের কথা শুনে ও অবাক হয়ে গেছে। সত্যিটা এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে কয়জন দেখাতে পারে!

চলবে….#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২০
জাওয়াদ জামী

” বেয়ান, আমরা এখন আসি। বাসায় পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। ” নীরার মা তেঁতো মুখে আফরোজা নাজনীনকে বলেন।
” এখনও এত রাত হয়নি যে, আপনারা যাওয়ার জন্য উতলা হচ্ছেন। নাকি আমার ভাতিজার কথাগুলো গায়ে লেগেছে! অবশ্য সত্যি কথা সবারই গায়ে লাগে। আমাদের ছেলে যে এখন আর আমাদের নেই, তা আপনাদের থেকে আর ভালো কে জানে। তা এসেছেন যখন অনুষ্ঠান শেষ করেই যান। নিশ্চিন্তে থাকুন আমরা আপনার মেয়ে-জামাইকে আটকে রাখবনা। যথাসময়ে ওরা আপনাদের বাসায় পৌঁছে যাবে। জেনে রাখুন আমরা কখনোই ছেলে এবং বউমার রাশ টেনে ধরিনি। সেটাতো আপনাদের কাজ। আমাদের বাড়ির মেয়েরাও সংসার করছে। তারা শ্বশুর বাড়ির মধ্যমনি। আমরা কখনোই এমন শিক্ষা মেয়েদের দেইনি, যে শিক্ষায় মেয়েরা শ্বশুর বাড়ির সবাইকে পর করে দিয়ে আমাকের নিয়ে মেতে থাকবে। ” সানাউল রাশেদিন যে ওদের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি তাওহীদ কিংবা ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি।
আজ সানাউল রাশেদিন গত ছয় বছরের রাগ উগড়ে দিলেন। তিনি অথবা বাড়ির অন্য কেউই এত বছরে একবারও তাওহীদ, নীরার আচরণ নিয়ে কোন কথা তোলেননি। আজ যখন সুযোগ এসেছে তার সদব্যবহার তিনি করলেন।

নীরার মুখে কোন কথা জোগাচ্ছেনা। ও আজ এভাবে চরম অপমানিত হবে তা ভাবতেই পারেনি। তবে এটা বেশ বুঝতে পারছে, বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ ওদের ওপর নারাজ। ও কিছুতেই নিজের এবং বাবা-মা’ র অপমান মানতেই পারছেনা। কিন্তু মুখের ওপর কোন জবাব দিতে পারছেনা। ও আশা করছে তাওহীদ কিছু বলুক। কিন্তু ওর আশায় জল ঢেলে দিয়ে তাওহীদ চুপ করে থাকে। কারন ওর কোন সাহসই নেই বড় চাচ্চুর মুখের ওপর কথা বলবে।
সানাউল রাশেদিন আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু তাহমিনার হস্তক্ষেপে থামতে বাধ্য হন৷
আফরোজা নাজনীন নীরার বাবা-মাকে যেতে দিলেননা। তারাও বুঝতে পারছে এখন চলে গেলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাবে।

তাহমিদ ভিষণ রেগে আছে। তাওহীদ আসার পর থেকে একবারও তার সাথে কথা বলেনি। তাওহীদও ভাইয়ের রাগ বুঝতে পারেনি। অবশ্য তাহমিদের এই রাগ একদিনের নয়। ভাইয়ের বিয়ের পর থেকে দেখে আসছে ভাইয়ের জীবনে ভাবি এবং তার বাবা-মা’র সিদ্ধান্তের আধিক্য। একসময় তাওহীদ তাদের হাতের পুতুলের ন্যায় হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ফিঁকে হতে থাকে বাড়ির সঙ্গে ওর সম্পর্ক। তাহমিনা আক্তার দুই-চার মাসে এক-আধবার ছেলের বাসায় গেলে নীরা অসন্তুষ্ট হত। অকারনে রা’গ দেখাত শ্বাশুড়ির সাথে। ঠিকমত রান্না করতনা। অসুখের ভান ধরে শুয়ে থাকত। তাহমিনা আক্তার সেসব বুঝতে পেরেও চুপ থাকতেন। ছেলেকে কিছুই জানাতেননা। তাহমিদ মায়ের সাথে দুই-একবার ভাইয়ের বাসায় গেছে, সেও লক্ষ্য করেছে ওদের প্রতি ভাবির আচরণ। আজ তিন বছর সে ভাইয়ের বাসায় যায়নি৷

আজ সুপ্তির বিয়ে। ছেলেরা সকাল সকাল কমিউনিটি সেন্টারে চলে এসেছে। সেখানে রান্নার দ্বায়িত্ব রাধুনিদের সাথে বাড়ির ছেলেরাও পালন করবে। মেয়েরা যাবে আরও কিছুক্ষণ পর।

সুপ্তির মন ভিষণ খারাপ। আজ থেকে এ বাড়ির সাথে ওর নাড়ির বাঁধন ঢিলে হয়ে যাবে। হয়তো বছরে এক-আধবার আসার সুযোগ হবে। হয়তো আবার বছরে একবারও আসতে পারবেনা। নারীজন্ম কত কঠিন আজ সেটা উপলব্ধি করতে পারছে। যে বাবা-মা দুনিয়ায় আনল, বুকে রেখে মানুষ করল, লেখাপড়া শেখাল, যে ভাই-বোনদের সাথে শৈশব-কৈশোর কাটাল, আজ থেকে তাদের কাছেই দুইদিনের অতিথি হিসেবে পরিগনিত হবে। এতদিনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সকল চাওয়া-পাওয়া, সকল পিছুটান পেছনে ফেলে অন্যের হাত ধরে সামনে এগোনোর দিন আজ। সম্পূর্ণ অপরিচিত অনেকের মাঝে, তাদের মত করে বাঁচতে হবে। আজ তার নবজন্মের দিন। যে দিনে ওর জীবনের খাতায় লেখা হবে অন্যের নাম। অথচ এই একুশ বছরের জীবনে সেই মানুষের নাম কোথাও ছিলনা। কেন মেয়েদেরই এত কিছু ত্যাগ করতে হয়! কেন মেয়েদেরই তাদের আপনজনদের ছেড়ে, নতুন মানুষদের আপন করে নেয়ার খেলায় প্রথম হতে হয়! তাদের সামান্য কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি কেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারেনা! এ কেমন নিয়ম! এসব ভাবতেই সুপ্তির চোখ জলে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনান। হুহু করে চোখের জলে বুক ভাসায়। রীতি বোনের রুমে এসে ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে ভয় পায়।
” কি হয়েছে সুপ্তি! তুই এভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর? আমাকে বল সোনা। ”
” বড় আপু, আমি কেমন করে সবাইকে ছেড়ে কেমন করে থাকব? সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবার মুখ দেখতে পারবনা। দিদুনকে না দেখে কিভাবে থাকব! ” কান্নায় ভেঙে পড়ে সুপ্তি।
রীতির চোখেও পানি।
” কাঁদিসনা সোনা। তুই যখনই সময় পাবি তখনই চলে আসবি। আমি রাহাতকে বলে দিব। ও আমার কথা অমান্য করতেই পারবেনা দেখিস। দেখবি একসময় নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখে যাবি। নিজের সংসারের প্রতি এতটাই মনযোগী হবি তখন আর এ বাড়িতে আসারই সময় পাবিনা। ” চোখ মুছে রীতি বলল।
” আমি এমন মনযোগী হতে চাইনা, যে বাবা-মা, আপনজনদের সাথে দেখা করার সুযোগ পাবোনা। আমি সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চাই। সবার সাথে বাঁচতে চাই। ”
দ্যুতি এসে দেখল ওর দুই বোন একসাথে কান্নাকাটি করছে।
” কি রে, বিয়ের কন্যা, এভাবে কাঁদছিস কেন! তোকে কিছু কথা বলি, মনযোগ দিয়ে শোন। ” সুপ্তি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। দ্যুতি বলতে থাকে,
” আজ চিরচেনা এই পরিবেশ থেকে অন্য বাড়িতে যাবি। দেখবি মানিয়ে নিতে অনেক কষ্ট হবে, কিন্তু হাল ছাড়বিনা। একসময় দেখবি তুই জয়ী হয়েছিস। নানান মানুষ, নানান কথা বলবে। এতে মন খারাপ বা রা’গ কিছুই করবিনা। তোর মন খারাপ দেখলে রাহাত কষ্ট পাবে। হয়তো তোর মন খারাপ দেখতে দেখতে রাহাত সেসব মানুষের প্রতি মনঃক্ষুণ্ন হবে। এতে সম্পর্কের সবার সাথে সবারই অবনতি ঘটবে। আর যদি রা’গ করিস তখন রাহাত বা ওর পরিবারের সবাই ভাববে তুই রা’গী, জে’দি। যে ভাবনাটা হবে তোর জন্য খারাপ। তাদের কথায় যদি তোর খারাপ লাগে, একটু হেসে সেখান থেকে সরে আসবি। জেনে নিবি তারা কি চায়। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিবি। রাহাতের কাছে কিছুই লুকাবিনা। দুজনে পরামর্শ করে সব কাজ করবি। তোর ভালোলাগা, মন্দলাগা সব ওর সাথে শেয়ার করবি। অন্যের উপরের রা’গ কখনও রাহাতের উপর দেখাবিনা। হাসিমুখে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবি। যদিও প্রথম প্রথম এসব বেশ কঠিন লাগে, কিন্তু পরে একসময় দেখবি তোর মত সুখী আর কেউ নেই। ঝ’গ’ড়া,রা’গ, জে’দ দিয়ে কারও মনের ভেতর প্রবেশ করা যায়না কিংবা কারো ভালোবাসা পাওয়া যায়না। ভালোবাসা দিয়েই ভালোবাসা আদায় করতে হয়। ” দ্যুতির কথাগুলো দুই বোন মনযোগ দিয়ে শোনে। সুপ্তি ভাবে একারনেই বোধহয় মেজো আপু এত সুখী। যে একা একা কখনও ভালোবাসা ভোগ করেনা, সবাইকে সাথে নিয়েই ভালোবাসা ভাগ করে বাঁচে।
” সুপ্তি মা, তুই এভাবে ভেঙে পরছিস কেন? তোকে কি আমরা চিরতরে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। তুই যেখানেই, যতদূরেই থাকিস আমাদের সন্তান হিসেবেই থাকবি। আমাদের দোয়া সব সময়ই তোর সাথে থাকবে। শুধ এতটা অনুরোধ, বাব-মা’র মান রাখিস। স্বামীর ঘরে গিয়ে এমনভাবে চলবি যেন সেখানে তোর বাবা মাথা উঁচু করে যেতে পারে। আমার বড় দুই মেয়ের মতই যেন তোকে নিয়ে গর্ব করতে পারি। এমনভাবে চলবি যেন সবাই তোকে মাথার মুকুট করে রাখে। নিজে অন্যায় করবিনা, আর কখনোই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবিনা। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়া মানে এই নয় যে, তুই তোর মর্জিমত সব করবি। তাদের কোন কিছু তোর খারাপ লাগতেই পারে। তুই সেটা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করে বুঝিয়ে বলবি। একদিনে কোন কিছুরই বদল সম্ভব নয়। বদল আসে ধীরে ধীরে। সুখের মূলমন্ত্র ধৈর্য। তুই যদি আজ ধৈর্য ধরিস এর ফল পাবি ভবিষ্যতে। যেই ফল হবে শুধুই মধুর। সেখানে লো’ভ, হিং’সা, তি’ক্ত’তা কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকবেনা। ” মেয়েদের কথার মাঝেই আফরোজা নাজনীন এসে সুপ্তিকে বোঝাতে থাকেন৷ পরম মমতায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন বুকের মাঝে। আজ থেকে মেয়েটা আরেক বাড়ির বাসিন্দা হতে চলেছে।

সুপ্তিকে সাজানো হয়েছে। হলরুমের উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে সুপ্তির পুরো শরীর। ওর পড়নে পাথরের কারুকাজ করা লেহেঙ্গা, শরীর জুড়ে বাহারি সোনার গহনা, মাথায় সোনার তাজের ওপর বসানো পাথরগুলো থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বাকি সব মেয়েরাও লেহেঙ্গা পরেছে। সেই সাথে পরেছে পাথরের গহনা। একেকজন একেকভাবে চুলে ডিজাইন করেছে। শুধু কুহুই লেহেঙ্গার সাথে একটা ঝুমকা বৈ কিছুই পরেনি। আর না বেঁধেছে চুল। লম্বা কেশরাশি ঢেউ তুলেছে পিঠ জুড়ে৷ সবাই যেখানে আনন্দে হৈহল্লা করছে ও সেখানে শিউলির ভয়ে চুপটি মেরে বসে আছে সুপ্তির পাশে।

নীরা গর্জিয়াস সেজেছে আজকে। যা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু লাগে। আফরোজা নাজনীন ভাবছে নীরা একটা উগ্র সাজ না সাজলেই পারত। তাহমিদ এক নজর নীরাকে দেখেই রা’গে
গজগজ করতে থাকে। সুযোগ খুঁজছে তাওহীদকে এ নিয়ে কিছু বলার। কিন্তু খুব সহজেই যে সেই সুযোগ ওর সামনে আসবে ভাবতেই পারেনি। হঠাৎ কোথায় থেকে যেন তূর দৌড়ে আসে তাহমিদের কাছে। বাচ্চাটা ওর মা’কে খুঁজে পাচ্ছেনা। তাহমিদ তূরকে কোলে নিয়ে এদিকসেদিক দেখছে কোথায় আছে ওর ভাই-ভাবী। বাইরে এসে দেখল বাগানে দুজন মিলে সেলফি নিচ্ছে। তাহমিদ তূরকে কোলে নিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে যায় সেদিকে৷
” তোমাদের একটা সন্তান আছে সেকথা ভুলে গেলে নাকি! মেয়েটা খুঁজে পাচ্ছেনা তার মা’কে। আর মা কিনা সেলফি তুলতে ব্যস্ত! নাকি লোকজনকে জানাতে চাচ্ছনা তুমি বিবাহিতা, একটা মেয়ে আছে! এখনও নিজেকে পাল্টানোর অনেক সময় আছে। সময় থাকতে নিজেকে পাল্টে ফেল। ” তাওহীদের কোলে তূরকে দেয় তাহমিদ।
” তাহমিদ, তুমি আসার পর থেকেই আমাকে এভাবে অপমান করছ কোন সাহসে? সব কিছুরই একটা লিমিট থাকে বুঝেছ? ”
” আমি আমার লিমিট সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত আছি। তুমি নিজের লিমিটের মাঝে থাকার চেষ্টা কর। আর তোমাকে আমি অপমান করিনি। তুমি এতদিন যা করেছ তাই সবার সামনে তুলে ধরেছি মাত্র। যখন তোমার কাছে আমি মা’কে নিয়ে যেতাম, তখন তুমি মায়ের সাথে কি আচরণ করেছ আমি তা নিজের চোখে দেখেছি। কিভাবে ধীরে ধীরে তোমার স্বামীকে তার বাবা-মা’র কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ তাও দেখেছি। এসব বললেই যদি তোমার অপমান হয়, তবে আমাকে ক্ষমা করো, এমন অপমান তোমাকে আমি প্রতিদিনই করতে চাই৷ ”
” তাহমিদ, বড় ভাবির সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা কি ভুলে গেছিস? তুই এত বেয়াদব হয়েছিস! ” তাওহীদ বউয়ের পক্ষ নিয়ে তাহমিদকে ধমক দেয়।
” সব সম্পর্কই আমার মনে আছে। কিন্তু তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, তোমার স্ত্রী তোমার মা’কে কতটা ছোট করেছে, অসম্মান করেছে। যদিওবা চোখে দেখনি সেসব। কিন্তু গতকাল শুনেছ। তবুও মায়ের পক্ষে কথা না বলে, বউয়ের সাফাই গাইছ। আর সেই তুমিই কিনা সম্পর্কের সমীকরণ আমাকে বোঝাতে আসছ! তোমাদের সাথে এই বিষয়ে আজই শেষবার কথা বলছি। সময় থাকতে শুধরে নাও। মা-বাবার দীর্ঘশ্বাস যে কত কঠিন, তা বুঝতে চেষ্টা কর। এমন যেন না হয় সেই দীর্ঘশ্বাসের অ’ন’লে একসময় পু’ড়ে ছা’র’খা’র হয়ে যাও। তখন শোধরাবার কোন সুযোগই পাবেনা। দুকূল হারাবে তখন। ”

তাহমিনা আক্তারের কোন কিছুই ভালো লাগছেনা। তার বড় ছেলে এসেছে ঠিকই, কিন্তু একটিবারও তার কাছে এসে বসেনি। শুধু দূরে দূরে থাকছে। তাহমিনা আক্তার ভেবে পাননা, কি এমন দোষ করেছেন তিনি। যার দরুন এভাবে তার ছেলে দূরে সরে যাচ্ছে! তিনি তো ছেলে-বউ কাউকেই কোন কিছুতেই বাঁধা দেননি। বউমার তার ওপর এত আক্রোশ কেন! আসার পর থেকে নিজে থেকে একটাবারও কথা বলেনি। কেবলমাত্র তাহমিনা আক্তারের কথার উত্তর দিয়ে চলছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। অনেকে কানাঘুষাও করছে এসব নিয়ে। মানুষের মুখ কেমন করে বন্ধ করবে তা জানা নেই তাহমিনা আক্তারের।

নির্দিষ্ট সময় বরপক্ষ এসে যায়। বরপক্ষের সবাইকে রজনীগন্ধা ও টুকটুকে লাল গোলাপ দিয়ে বরন করা হয়। ছিটানো হয় নানান ফুলের পাপড়ি। সসম্মানে বরকে বসতে দেয়া হয় তার জন্য সাজানো সিংহাসনে। চোখ ধাঁধানো সাজে সাজানো হয়েছে সেন্টারের প্রতিটি কোন। বরপক্ষকে বসতে দিয়ে তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে যায় সকলে। তাহমিদ সেই সকাল থেকেই ছুটোছুটির ওপর আছে। বেলা দুইটা বেজে গেছে অথচ এখনও সকালের নাস্তা করা হয়ে উঠেনি। কয়েকবার অবশ্য মা-বড়মা খেতে ডেকেছে কিন্তু ও সময়ের অভাবে খেতে পারেনি। এখন এত ছুটোছুটির মাঝে শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। ক্ষুধার তাড়নায় মাথা ঘুরছে। আর সহ্য করতে না পেরে কিচেনের দিকে যায়। কিচেনের দরজার সামনে আসতেই দেখল কুহু খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বের হয়ে আসছে। তাহমিদ বড় বড় ধাপ ফেলে কুহুর কাছে এসে ওর হাত থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে পাশে থাকা চেয়ারে বসে খাওয়া শুরু করে। কুহু হতভম্ব হয়ে তাহমিদের খাওয়া দেখছে। ও তাহমিদের এক কাজিনের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। ছেলেটার ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলতে পারছিলনা। কুহু বুঝতে পেরে ওর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিল।
” একটু পানি দিবা? বিরিয়ানি গলায় বেঁধে গেছে। ” তাহমিদের কথায় হুুঁশ আসে কুহুর। দৌড়ে কিচেনে যেয়ে এক জগ পানি আর একটা গ্লাস নিয়ে আসে। জগ থেকে পানি ঢেলে তাহমিদের সামনে ধরে। তাহমিদ কুহুর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি পান করে। গ্লাস ধরিয়ে দেয় কুহুর হাতে।
” এখানেই দাঁড়িয়ে থাক। এতটুকু শেষ হলে আরেকটু এনে দিবে। ” একমনে খেতে খেতে বলল তাহমিদ।
কুহু মনে মনে ভাবছে, এ কোন ফ্যাসাদে পরলাম। তিনি খাচ্ছেন আর আমার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! ছোটমা যদি দেখে তখন কি হবে! আমার হা’ড্ডি একটাও আস্ত রাখবেনা।
” ভয় নেই, তোমার দ’জ্জা’ল ছোটমা এখন ঐদিকে ব্যস্ত আছে। এদিকে আসার সম্ভাবনা নেই। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ভয়ে ভয়ে এদিকওদিক তাকায়। এই লোক আমার মনের কথা কিভাবে শুনল! ইনি কি সত্যিই তাহমিদ ভাইয়া, নাকি ভূ’ত!
” এত চিন্তার কিছুই নেই। তোমাকে কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝেছি তুমি ঐ লেডি হিটলারকে ভয় পাচ্ছ। তাই তোমাকে নিশ্চিন্ত করতে কথাটা বলেছি। আরেকটু বিরিয়ানি নিয়ে আসো। সাথে শসা নিয়ে আসবা। মাংস কম দিবা। ” হাতের ওয়ান টাইম প্লেট এগিয়ে ধরে কুহুর দিকে। কুহু হাত বাড়িয়ে নিয়ে কিচেনে আসে।
কুহু বিরিয়ানি নিয়ে আসে। প্লেট ধরিয়ে দেয় তাহমিদের হাতে। তাহমিদ তৃপ্তি করে খায়। খাবার শেষ করে পানি পান করে, গ্লাস কুহুর কাছে দেয়।
” দোয়া করি, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার কর। এভাবেই স্বামীকে কম মাংস আর শসা দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়াও। ” কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায়না তাহমিদ।
কুহু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছে তার যাওয়া দেখছে।
” সে বিরিয়ানিতে কম মাংস আর শসা খায় বলেও কি আমার জামাইও বিরিয়ানিতে কম মাংস আর শসা খাবে! আজব তো! ” কুহুর ঐ বোকা মাথায় একবারও আসলনা ওর স্বামী বলতে নিজেকেই বুঝিয়েছে তাহমিদ। কুহুর মস্তিষ্কে একটা কথাই সেঁটে গেছে, আর তা হল তাহমিদ ওকে পছন্দ করেনা।

বিয়ে পড়ানোর সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হলো। সুপ্তি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায় কিন্তু কবুল বলেনা। অনেক চেষ্টার পর ওকে কবুল বলানো হয়।
বিয়ের যাবতীয় কাজকর্ম শেষ। সন্ধ্যা হয়েছে সেই অনেকক্ষণ আগেই। এখন বিদায়ের পালা। সুপ্তি কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছে। আফরোজা নাজনীন অনেকক্ষণ আগেই আরেকটা রুমে নিজেকে বন্দী করেছেন। তিনি কিছুতেই মেয়ের সামনে আসতে পারবেননা। দেখতে পারবেননা মেয়ের চলে যাওয়া। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তিনি ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে ছিলেন। আজ আরেকটা মেয়েও চলে যাচ্ছে। তিনি সইতে পারবেননা এত কষ্ট। এদিকে সুপ্তি ওর মা’কে খুঁজছে। রীতি, দ্যুতি কিংবা তাহমিনা কেউই আফরোজা নাজনীনকে রুম থেকে বের করতে পারলেননা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে অসার হয়ে পরেছেন। বারবার একটাই কথা বলছেন, যদি পরের ঘরেই দিতে হবে, তবে কেন এত মায়া, ভালোবাসা দিয়ে বড় করলাম।

বিঃদ্রঃ আজ আরেকটা পার্ট লিখতে পেরেছি তাই আপনাদের জন্য পোস্ট করলাম। আগামীকাল রাতেই গল্পটা দেয়ার চেষ্টা করব। যদি সম্ভব না হয় তবে আমাকে গালি দিবেননা প্লিজ। আর হ্যাঁ অনেকেই জানতে চেয়েছেন, আমার ছেলে কেমন আছে? আলহামদুলিল্লাহ ও এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো আছে। আপনারা আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here