#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৫
জাওয়াদ জামী
মঙ্গলবার বিকেলেই আনান ওর বড় খালার বাসায় হাজির হয়। তবে আসার পথে কুহুকে নিয়ে এসেছে।
কুহু এখানে এসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। সবার সাথে কথা বললেও আশেপাশে তাহমিদকে দেখলনা। আজ কুহু সোজা দিদুনের রুমে আসে। আজ ও দিদুনের সাথে থাকবে।
তাহমিদ বাসায় ফিরে রাত নয়টায়। ওর জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল। তাহমিদ আসলে বড়মা ওকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে। ও ফ্রেশ হয়ে আসলে সবাই একসাথে খাওয়া শুরু করে।
রাত এগারোটা বাজে অথচ কুহুর চোখে ঘুম নেই। দিদুন সেই কখন ঘুমিয়ে গেছে। ঘুম না আসায় কুহু বিরক্ত হয়ে গেছে। খাট থেকে নেমে পা টিপে রুম থেকে বের হয়। সোজা উপরে এসে সিক্তার রুমের দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা ভেতর থেকে লক করা। এবার বিরক্তি তরতরিয়ে বেড়ে যায়। তারপর হঠাৎই মনে ইচ্ছে জাগে ছাদে যেয়ে রাতের প্রকৃতি উপভোগ করতে। যেই চিন্তা, সেই কাজ। কুহু এক দৌড়ে ছাদে আসে। একি! ছাদের দরজা খোলা কেন! কুহু দরজার সামনে এসে ছাদে উঁকি দেয়। কিন্তু পুরো ছাদ ফাঁকা। ও ভাবল হয়ত মনের ভুলে রোজি দরজা লাগায়নি।
ছাদে পা রাখতেই হাসনাহেনার তীব্র সুবাস নাকে এসে বা’রি লাগে। আজ চাঁদ যেন ঝিমিয়ে গেছে। আলোর পসরা সাজিয়ে ধরনীকে করেনি গরবিনী।
কুহু অন্ধকারে ধীর পায়ে হাসনাহেনা গাছের নিকট আসতেই, কোন কিছুর সাথে বেঁধে ধপাস করে পরে যায়।
” আউচ্, এভাবে হাঁটছ কেন! তুমি কি চোখে দেখনা? নাকি আমাকে মানুষ মনে হয়না! সোজা এসে কলিজার উপর ঝাঁ’প দিয়েছ। দিলে তো কলিজার হালুয়া বানিয়ে। তোমাকেই এই কলিজার হালুয়া নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে। তখন কিন্তু আমাকে দো’ষ দিতে পারবেনা। এবার উঠ, নাকি আমাকে দম বন্ধ করে মে’রে দিতে চাও! ” অন্ধকারে কথা বলে উঠে তাহমিদ। সেই সাথে চেপে রেখেছে কুহুর কোমড়।
অন্ধকারে এভাবে পা হড়কানোয়, আবার তাহমিদের কথা বলে ওঠায় কুহুর কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে।
” এতরাতে আপনি ছাদে! ”
” একই প্রশ্ন তো আমারও। ”
” ঘুম আসছিলনা, তাই এসেছিলাম। ”
” আর আমি ঘুমাতে এসেছি। ”
তাহমিদের কথা শুনে ঝটকা লাগে কুহুর। কেউ ঘুমাতেও ছাদে আসে! লোকটা কি দিনদিন পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছে!
” এভাবে নড়াচড়া করোনা। একটু শান্ত হয়ে থাকো কিছুক্ষণ। ” তাহমিদের কথায় কুহুর হুঁশ আসে। এতক্ষণ যাবৎ ও তাহমিদের বুকের উপর পরে আছে!
” ছাড়ুন, আমি উঠব। ”
” আরেকটু পর। ”
” প্লিজ, ছাড়ুন। ” কুহুর কন্ঠে অনুনয় ঝরছে।
” আমি কি সত্যিই তোমাকে ধরে রেখেছি! নাকি আমার সংস্পর্শে আরেকটু থাকতেই এত বাহানা করছ। ”
কুহু লক্ষ্য করল, তাহমিদের বাঁধন থেকেও সম্পূর্ন মুক্ত। কিন্তু এতক্ষণ তো ধরেই ছিল! আবার এখুনি ছেড়ে দিয়ে কত ভাব নিচ্ছে!
কুহু তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। তাহমিদও উঠে বসে।
একটু পর ছাদ কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হয়। তাহমিদ উঠে গিয়ে বাতি জ্বালিয়েছে।
কুহু রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে ওর মেঘবরণ কেশরাশি উড়ছে।
তাহমিদের নিকট এই মুহূর্তে কুহুকে অন্ধকার ফুঁড়ে বের হওয়া অতিমানবী মনে হচ্ছে। পেলব শরীরে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুহু। দাঁড়ানোর মাঝে কোনও জড়তা নেই। আজকাল মেয়েটার মাঝে বেশ দৃঢ়তা দেখা যায়। আগের সেই কুহুর সাথে এখনকার কুহুর বেশ তফাৎ।
তাহমিদ সেই কখন থেকে কুহুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তবুও এতে কুহুর কোন হেলদোল নেই।
” মেঘবরণ কন্যা, এবার অন্তত একটু সদয় হও। তোমার মুখের একটু কথা শোনার আশায় আমি চাতকের ন্যায় চেয়ে থাকি, তবু একটুও দয়া তোমার হয়না। অপেক্ষার অ’ন’লে আর কত পো’ড়া’বে? এ অ’ন’লে’র তীব্রতা যদি জানতে, তবে সেই কবেই আমার বুকে আ’ছ’ড়ে পরতে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু মিটিমিটি হাসছে।
এই মানুষটার কি সব সময়ই প্রেম পায়! যখনই দেখ, তখনই শুধু কথার আবেগে নিজেও ভাসবে,
আবার কুহুকে ভাসাবে।
” বলুন, কি শুনতে চান। ”
” এখন আর কিছু শুনতে চাইনা, অন্য কিছু চাই। ” তাহমিদের সোজাসাপটা জবাব।
কুহু ভুরু কুঁচকে তাকায় তাহমিদের দিকে। কুহুর এমন এক্সপ্রেশান দেখে তাহমিদ হেসে উঠে।
তাহমিদের প্রানখোলা হাসিতে মুখরিত হয় রাতের ধরনী। কুহু মুগ্ধ নয়নে তাহমিদের হাসি দেখছে। আগে কখনোই এই মানুষটার এমন প্রানখোলা হাসি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কারও হাসি কি এতটা মধুর হতে পারে!
” আচ্ছা বাদ দাও, আমার আপাতত কিছুই চাইনা। এবার বল, ফুলতলা থেকে কবে ফিরবে? ”
” তিনদিনের আগে ফিরছিনা। ”
” সাথে বই নিয়ে যেও। পরীক্ষার আর দেরি নেই। সারাদিন টইটই করে ঘুরে, রাতে পড়তে বসবে। আর হ্যাঁ, ঐ সৎমা নামক বি’ভী’ষি’কা’কে অযথা ভয় পাওয়ার কোন দরকার নেই। তুমি এখন ঐ বাড়ির দুই দিনের অতিথি। আর কখনোই সেখানে তোমাকে তিনদিনের বেশি থাকা হবেনা। আর বিয়ের পর তোমার সেখানে যাওয়া বন্ধ। প্রয়োজনে প্রতিমাসে আমার শালাবাবু আর শ্বশুরকে এখানে নিয়ে আসব। তখন তাদের দুচোখ ভরে দেখে নিবে। ”
” কি বলছেন, এসব! ফুলতলা আমার মা, দাদু-দাদি আছে। তাদের কাছে না গেলে আমার ভিষণ কষ্ট হবে। ”
কথা শেষ করে কুহু তাহমিদের দিকে তাকালে দেখতে পায়, তাহমিদ বাম ব্রু উঁচিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদের এমন চাহনিতে কুহু ভরকে যায়।
” শোন, আমি যা বলার বলে দিয়েছি। তবে বছরে একদিন আমি তোমাকে ফুলতলা নিয়ে যাব। আমরা ভোরে রওনা দিব, তুমি সেখানে কিছুটা সময় কাটাবে, আর সেইদিনই আমরা ফিরে আসব। ঐ সৎমার কাছে তোমাকে রাখবার কোন ইচ্ছে আমার নেই। ”
” ওহ্। ” খুব ছোট্ট করে উত্তর দেয় কুহু।
” একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি। ” কুহুকে দাঁড়াতে বলে তাহমিদ ছাদ থেকে বেরিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর ওয়ালেট হাতে নিয়ে ফিরে আসে।
” এই টাকাগুলো রাখ। প্রয়োজনে খরচ কর। ” ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দেয় তাহমিদ।
” আমার কোনও টাকা লাগবেনা। আপনি রেখে দিন। তাছাড়া আমার কাছে টাকা আছে। আর আপনি টাকা দিচ্ছেন কেন! ”
” এত বেশি কথা বলো কেন! তোমার সকল দ্বায়িত্ব এখন থেকে আমার। তাই টাকা আমি দিতেই পারি। আর টাকা তোমার লাগবে কিনা তা কালকেই বুঝতে পারবে। ”
” বাবা-মা’র কাছ থেকে টাকা নিয়ে, দ্বায়িত্ব পালন করতে আসছে। ”
” এই মেয়ে, এগুলো আমার রোজগারের টাকা। তুমি কি করে ভাবলে, বাবা-মা’ র কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি তোমাকে দিচ্ছি? সব সময়ই দুই লাইন বেশি না বুঝলেই নয়? ”
” আপনি টাকা রোজগার করলেন কিভাবে! কখনো তো কোন কাজ করতে দেখলামনা। ” তাহমিদকে পাত্তা না দিয়ে কুহু বলল।
” এই মেয়ে কি বলে! গত দেড় বছর ধরে আমি দুইটা টিউশনি করিয়ে, প্রতিমাসে ছয় হাজার টাকা রোজগার করি। সেই টাকাগুলো সব জমিয়ে রেখেছি। আর সেই টাকা থেকেই তোমাকে দিচ্ছি। ”
” আপনি টিউশনি করান কেন! আপনার কোন কিছুর অভাব আছে নাকি! ”
” আমি তোমার জন্য টিউশনি করাই। যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি, তোমাকে ভালোবাসি তার মাসখানেক পর থেকে টিউশনি করাচ্ছি। আমি জানতাম একদিন না একদিন তোমাকেই বিয়ে করব। তাই নিজে কিছু রোজগারের চেষ্টা করছি।”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকের পাঁজরে উথাল-পাথাল ঢেউ আছড়ে পরে। এই মানুষটা আগে থেকেই এত কিছু ভেবে রেখেছে!
কুহু আর দ্বিরুক্তি না করে হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নেয়। পাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে টাকা না নিয়ে কষ্ট দিতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা।
” তিনদিনের জন্য ছয় হাজার টাকার দরকার নেই। এক হাজার টাকা হলেই চলবে। ” এক হাজার টাকা নিজের কাছে রেখে বাকি পাঁচ হাজার টাকা তাহমিদের কাছে ফেরত দেয়।
” এটা সম্পূর্ণই তোমার। তোমাকে দিয়েছি, তুমি ইচ্ছে হলে নাও, আর নেয়ার ইচ্ছে না থাকলে ফেলে দাও। আই ডোন্ট কেয়ার। তবুও আমি ফেরত নিবনা। আন্ডারস্ট্যান্ড? ”
” যে নিজেই একটা ত্যা’ড়া’র গ্যারাজ। আর সেই আবার আমাকে বলে ত্যা’ড়া। ”
” গুড। এবার যাও। অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পর। তবে সকালে বেরোবার আগে আমাকে দেখা দিয়ে তারপর যেও। ”
ভোরে ঘুম থেকে উঠে, ফজরের নামাজ আদায় করে কুহু। কিছুক্ষণ পর আসে রান্নাঘরে। সেখানে তাহমিনা আক্তার এবং আফরোজা নাজনীন রান্নার কাজে ব্যাস্ত।
কুহুকে ওর ফুপু সিক্তাকে ডাকতে পাঠায়।
কুহু সিক্তাকে ডেকে তোলে।
সকাল সাতটা বাজতে বাজতে আনানও রেডি হয়ে নিচে আসে।
নাস্তা শেষে ওরা ফুলতলা যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
তাহমিদ সোফায় বসে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর সামনের সোফায় বসে তাহমিনার সাথে কথা বলছে। সিক্তা ওর ব্যাগ নিয়ে নিচে আসলেই ওরা রওনা দিবে।
” মা, তোমার ছোট বউমাকে বলে দাও, তার আদরের ছোটমার কোন ক’টু কথা যেন সহ্য না করে। আমি যদি এরকম কিছু শুনেছি, তবে তার কপালে দুঃ’খ থাকবে প্র’তি’বা’দ না করার জন্য। ”
তাহমিনা আক্তার ছেলের কথা শুনে হাসে। আফরোজা নাজনীনও হাসছেন।
সিক্তা নিচে আসলে ওরা বের হয় ‘ কুঞ্জছায়া ‘র ড্রয়িংরুম থেকে।
সবাই একে একে বেরিয়ে যায়। সবশেষে কুহু বের হতে গেলেই তাহমিদ ওর হাত টেনে ধরে, কপালে টুপ করে চুম্বন আঁকে।
তাহমিদের এমন কাজে কুহুর চোখ রসগোল্লার আকার ধারণ করে।
এদিকে তাহমিদ সেই ঘটনা ঘটিয়েই সেখান থেকে চ’ম্প’ট দিয়েছে।
” কই রে কুহু, তারাতারি আয়। নইলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। ” তাহমিনা আক্তারের ডাকে সম্বিৎ ফিরে আসে কুহুর।
আশেপাশে না তাকিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে আসে।
বিঃদ্রঃ গতকাল শব-ই-বরাত ছিল। তাই আমি লিখিনি। এমনকি গতকাল বিকেল থেকে অনলাইনে ছিলামনা। আজ কাজের ফাঁকে এতটুকু লিখতে পেরেছি। সেটাই পোস্ট করলাম।
চলবে..#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৬
জাওয়াদ জামী
সকালে ঘুম থেকে উঠে, নাস্তা করে কায়েস বাজারে যায়। বড় কাতল মাছ, চিতল মাছ, গলদা চিংড়ি, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, কবুতর, পাঁচ রকম মিষ্টি, দই, কয়েকরকম ফলমূল নিয়ে বাড়ি আসে। আসার পথে পাশের বাড়ির বৃদ্ধা চাচিকে ডেকে নিয়ে আসে। বৃদ্ধার তিনটা মেয়ে। তাদের সবার বিয়ে হয়েছে। কোন ছেলে না থাকায় বৃদ্ধা বাড়িতে একাই থাকে। কায়েসের বাবা-মা বেঁচে
থাকতেও তিনি এ বাড়িতে এসে রান্না করে দিয়েছেন। তাই আজকেও কায়েস রান্না করার জন্যই চাচিকে নিয়ে এসেছে।
দোকানের ছেলেটার হাতে বড়বড় দুইটা বাজারের ব্যাগ দেখে শিউলির চোখ কপালে উঠে।
কায়েস চাচিকে ব্যাগ থেকে সবকিছু বের করতে বলে। বৃদ্ধা ব্যাগ ঢালতেই তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে। এত মাছ-মাংস!
” বাবা, কায়েস? এত কিছু কিনছ যে? তোমার বাড়িতেই কোন কিছুর অভাব নাই, আবার বাজার থাইকা কিন্যা আনছ! ” বৃদ্ধা অবাক হয়ে জানতে চান।
” চাচি, আমার বড় মেয়ে আসছে। সাথে আমার ভাগ্নে-ভাগ্নীও আসছে। তাই মেয়ের পছন্দের মাছ, ভাগ্নে-ভাগ্নীর পছন্দের মাছ-মাংস এনেছি। আপনি ভালো করে রান্না করুন। যাতে বাচ্চারা খেয়ে খুশি হয়। আর ওরা যে কয়দিন থাকবে সে কয়দিন আপনিই রান্না করবেন। এবং এখানে থাকবেন। ”
কায়েসের কথা শুনে বৃদ্ধা খুব খুশি হন। তিনি এই বাড়ির সকল ঘটনাই জানেন, তাই বাড়তি কোন প্রশ্ন তিনি করলেননা।
কুহুর মন মানছেনা। কখন যে গ্রামে যাবে। আজ পথ যেন শেষ হচ্ছেনা। তিনজন সারা রাস্তা খুনসুটিতে মেতে থাকে। আনান কুহুকে জ্বা’লি’য়ে মে’রে’ছে। তাহমিদকে নিয়ে এটাসেটা টিটকারি মেরেই গেছে। কুহু নীরবে আনানের অত্যাচার সহ্য করেছে। রাস্তায় কোন দোকানপাট দেখলেই ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে, কুহুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইচ্ছেমত খাবার কিনে খেয়েছে। কুহু এখন বুঝতে পারছে তাহমিদ কেন জোড় করে টাকাগুলো দিয়েছিল।
দুইটার দিকে ওরা ফুলতলা পৌঁছায়। কায়েস মেয়ের অপেক্ষায় শুধু ঘরবাড় করছিল। বাড়ির সামনে গাড়ির হর্ন শুনতেই সে দ্রুতই বাইরে আসে।
কুহু গাড়ি থেকে বেরিয়েই বাবাকে সামনে দেখে ছুটে যায় বাবার কাছে। কায়েসও পরম স্নেহে মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। সিক্তা আর আনান গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ের মিলন দেখছিল। ওরা ইচ্ছে করেই দূরে দাঁড়িয়ে আছে।কতদিন পর মেয়ে তার বাবার কাছে এসেছে, তাদের এই সুখের মুহূর্তে ওরা বাঁধা দিতে চায়না।
” সিক্ত, তুইও কি শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি গিয়ে, তোর বাপকে এম্নেই জড়িয়ে ধরবি? আমার মনে হয় তুই ইচ্ছে করলেও, বাপকে জড়িয়ে ধরতে পারবিনা। তোর বাপের ভুঁড়ি যত বড়! যেন আস্ত একটা তবলা! তুই দুই হাত দিয়ে তোর বাপকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই, হাত শুধু ভুঁড়িটার মধ্যেই লুটোপুটি করবে। ”
আনানের কথা শুনে সিক্তা রে’গে আ’গু’ন হয়ে গেছে।
” এই, অসভ্য ভাইয়া তুমি চুপ করবে? আমার বাপের ভুঁড়ি আছে তাতে তোমার কি? গুণিজনের ভুঁড়িই সম্পদ। আমার বাবা গুণিজন তাই তার ভুঁড়ি আছে। তোমার বাপের কি আছে? না আছে ভুঁড়ি, না সে গুণিজন। শরীরে তো মাংসের বালাই নেই, আছে শুধু হাড়ের ওপর চামড়া। দেখে মনে হয় কেউ যেন ক’ঙ্কা’ল’কে মেকআপ করিয়ে দিয়েছে। ” সিক্তাও দ্বিগুণ তেজে উত্তর দেয়।
নিজের বাবার সম্পর্কে এরূপ বর্ননা শুনে আনানের মাথা গরম হয়ে গেছে।
” ঐ ছেমরি, চুপ যা। আসছে আমার বাবার খুঁ’ত ধরতে। আমার বাবার মত যোগ্যতা তোর বাপের আছে? আমার বাবা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর তুই কিনা আমার সেই বাবাকে ইনসাল্ট করিস? তোর বাপের ঐ ভুঁড়ি ছাড়া আছেটা কি? ”
” তোমার বাপ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আর আমার বাবা কি ফকির? আবার বাবার তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর সবাইকে কিনে নেয়ার মত ক্ষমতা আছে। আর যে ভুঁড়ির কথা বলছো, তবে শুনে রাখ ঐ ভুঁড়িই বাবার অ’হং’কা’র। ”
ভাগ্নে-ভাগ্নীর উচ্চস্বর কানে আসতেই কায়েস তাদের দিকে তাকায়। ততক্ষণে ওদের ঝগড়া বেশ কঠিন আকার ধারণ করেছে। সিক্তা পারলে আনানকে দুই ঘা লাগিয়ে দেয়।
কায়েস হাসিমুখে ওদের দিকে এগিয়ে যায়।
” তোরা আসতে না আসতে ঝ’গ’ড়া করছিস! এভাবে বাহিরে দাঁড়িয়ে কেউ ঝগড়া করে! আগে ভেতরে চল, খেয়েদেয়ে শরীরে শক্তি করে তারপর ঝ’গ’ড়া করিস। ” কায়েস সিক্তার হাত ধরে নিয়ে যায় বাড়ির ভেতর। তবে ভেতরে যাওয়ার আগে ড্রাইভারকে ভেতরে আসতে বলে।
কয়েকমাস পর নিজের ঘরে এসে কুহু চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা। ব্যাগ রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। নীরবে অনুভব করে বাতাসের ঘ্রাণ।
সিক্তা ফ্রেশ হয়ে এসে ওকে বসে থাকতে দেখে খেঁ’কি’য়ে উঠে।
” ঐ কুহু, তুই ফ্রেশ হবিনা? নোং’রা মেয়ে , এতক্ষণ ফ্রেশ না হয়ে বসে আছিস! ওঠ, যা ফ্রেশ হয়ে আয়। ”
কুহু সিক্তার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে কলপাড়ে যায়।
শিউলি আক্তার বারান্দায় বসে ছিল। সে কুহুকে দেখেও না দেখার ভান করে। কুহুও সেটা বুঝতে পেরেছে। সে-ও শিউলির সাথে কথা না বলে সোজা কলপাড়ে যায়।
খেতে এসে কুহু দেখল এলাহি আয়োজন। সেই বৃদ্ধা দাদী ওদের খেতে দিয়েছে। শিউলি এত আয়োজন দেখে রা’গে ফুঁ’স’ছে। বৃদ্ধা অনেকবার বলেছে, শিউলিই যেন ওদের খেতে দেয়। কিন্তু শিউলি তার কথার ধার ধারেনি। বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাই বাচ্চাদের খেতে দেয়।
কায়েসও ওদের সাথে খেতে বসেছে। শিহাব স্কুলে গেছে, ওর আসতে আরও দেরি হবে। তাই ওরা শিহাবের জন্য অপেক্ষা না করে খেতে বসে।
কুহুর পাতে এটা-সেটা তুলে দিচ্ছে কায়েস। কুহু না করলেও জোড় করে দিচ্ছে। ভাগ্নে-ভাগ্নীকেও বাদ রাখছেনা।
অনেকদিন পর কুহু তৃপ্তি করে খায়। ওদের খাওয়া হলে বৃদ্ধা খেতে বসে। শিউলি তখন পর্যন্ত একবারও এদিকে আসেনি।
রাত বারোটা বেজে পাঁচ। সিক্তা ঘুমিয়ে পরেছে। কুহু বিছানায় বই নিয়ে পড়ছে। ফোনের শব্দে ওর পড়ায় বি’ঘ্ন ঘটে। বই রেখে ফোন হাতে নিয়ে দেখল তাহমিদ ফোন করেছে। কুহু মুচকি হেসে ফোন রিসিভ করে।
শিউলি সিক্তা, আনানের সাথে হেসে হেসে কথা বললেও, কুহুকে দেখলেই মুখ কালো করছে। একবারের জন্যও কুহুর সাথে কথা বলেনি। আনান, সিক্তা এসব খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে। তবে প্রতিবারের মত কুহু ছোটমা ছোটমা করছেনা। ও নিজের মত করে চলছে।
সেই বৃদ্ধা দাদী আর প্রতিবেশি দুইজনকে সাথে নিয়ে ওর পালিত হাঁস-মুরগীগুলো ধরেছে। সেগুলো কাউকে দিয়ে জবাই করে নিয়ে বেছ-কেটে ঢাকা নিয়ে যাবে। এখন আর গ্রামে এসে থাকা হবেনা। এগুলো দেখে রাখার মত সময় শিহাবের নেই। তাই চিন্তা করেছে হাঁস-মুরগীগুলো জবাই করে ফুপুদের জন্য নিয়ে যাবে।
এভাবে হাঁস-মুরগীগুলো ধরতে দেখে শিউলি আক্তার চুপ থাকতে পারেনা। ওর বাপের বাড়ি থেকে কেউ আসলে রান্না করে কিংবা মাঝেমধ্যে মেয়ের বাড়িতে রান্না করে পাঠায়। এখন যদি সবগুলোই কুহু জবাই করে তাহলে কেউ আসলে তার নিজের পালিত হাঁস, মুরগীগুলো ধরতে হবে ভেবেই রা’গ তরতর করে বেড়ে যায়।
” সবগুলান হাঁস-মুরগীই জবাই দিতাছোস ক্যা? কয়ডা রাইখা দে। আমার মাইয়া-জামাই আইলে কি জবাই দিমু? এত খাওনের জিবলা ভালো না। ”
” তোমার মেয়ে-জামাইকে নিজের গুলো জবাই করে খাওয়াবে। এগুলো সব আমার। আমার নিজের জমানো টাকায় কেনা। এগুলোর দিকে তুমি নজর দাও কেন! আমি আমার হাঁস-মুরগী কি করব সেটা তোমার না দেখলেও চলবে। বাপ-দাদার অনেক কিছু আছে, তাই আমার খাওয়ার জিহ্বাও আছে। তোমার জিহ্বা থাকলে তুমিও খাবে, মানা করেছে কে! ” কুহুর সোজাসাপটা উত্তর শুনে শিউলির মুখে কোন কথা জোগায়না। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে আবার মুখ খোলে।
” কতা খুব বেশি কইতাছোস। এত বাড়িসনা, জিবলা টা’ই’না ছিঁ’ড়া ফালামু। তহন কতা কওনের জন্য আর জিবলাই থাকবোনা। ”
” আমার নিরবতাকে দুর্বলতা ভাবলে তুমি ভুল করবে। এতদিন আমি নিরবে তোমার সব অত্যাচার সহ্য করছি বলে ভেবনা এখনও সহ্য করব। কেউ আমাকে ই’ট মা’র’লে তাকে পা’ট’কে’ল ঠিকই ফিরিয়ে দিব আমি। আশাই করছি আমাকে মা’রা’র মত ভুল আর করবেনা। কখনও কিছু বলিনি তার মানে এই নয় যে আমি বলতে পারিনা। সেটাতো আমার ভদ্রতা ছিল। কিন্তু এখন ভদ্রতার কোন ধার আমি ধারবনা। আমাকে মা’রা’র সাহস কেউ করলে তার হাত আমি ভে’ঙে দিব। ”
কুহুর কথা শুনে শিউলির বুক শুকিয়ে গেছে। ডে মেয়ে সাত চড়ে রা কাটতনা, আজ সেই মেয়ে এসব কি বলছে! শিউলি বেশ বুঝতে পারছে তার আধিপত্য এবার শেষ হতে চলেছে।
কুহু শিহাব আর বাবার জন্য তিনটা হাঁ, তিনটা মুরগী কেটেবেছে ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। সেই বৃদ্ধা দাদিকেও হাঁস-মুরগী দিয়েছে। বৃদ্ধা নিতে না চাইলেও কুহু জোর করে দিয়েছে। বৃদ্ধা খুব খুশি হয়েছে। কুহুকে অনেক দোয়া করেছে।
আজ ওরা ঢাকা ফিরবে। সেদিনের পর থেকে শিউলি আর কুহুর সাথে কথা বলেনি। কুহু ইচ্ছেমত রান্না করে বাবা, ভাই, ফুপাতো ভাই-বোনদের খাইয়েছে। সেই বৃদ্ধা দাদীও ওকে কাজে সাহায্য করেছে। ওরা প্রত্যেকবার খাবার সময় শিউলিকে ডেকেছে, কিন্তু শিউলি ওদের রান্না করা খাবার ছুঁয়েও দেখেনি। সে নিজের খাবার নিজে রান্না করে খেয়েছে।
আনান সিক্তা এসব দেখে বেশ বিরক্ত হয়। আনান ওর মা’কে ফোনে সবটা জানিয়েছে। সব শুনে শাহনাজ সুলতানা ভিষণ রে’গে যান। ছেলেকে এ নিয়ে কিছু বলতে নিষেধ করে দেন। আনান মা’য়ের কথামত চুপচাপ থাকে।
কায়েস বোনদের জন্য পুকুরের মাছ, শাকসবজী, ফলমূল গাড়ি ভর্তি করে দিয়েছে। কুহু, আনান, সিক্তাকে ওদের পছন্দমত পোশাক কিনে দিয়েছে। কুহুর হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়েছে। কুহু নিতে চায়নি, কিন্তু কায়েস জোর করেই মেয়েকে টাকাগুলো দিয়েছে।
শিহাব সকাল থেকে কাঁদছে। ওর বড় আপু চলে যাচ্ছে, আবার কবে আসবে তার ঠিক নেই। অনেকদিন হয়তো আপুকে দেখতে পাবেনা, সেই দুঃখেই ও কাঁদছে।
” মা, সাবধানে থাকবি। মন দিয়ে পড়াশোনা করিস। তোর ফুপুরা এখানে আসতে দিতে না চাইলে জোর করবিনা। তোর মন খারাপ হলে আমাকে বলিস। শিহাবকে নিয়ে তোকে দেখে আসব। আর যখনই টাকার প্রয়োজন হবে, আমাকে জানাবি। কখনোই ভাববি না তোর কেউ নেই। ”
” আমার কিছুই লাগবেনা, বাবা। আমি চাই তুমি সুস্থ থাক, ভালো থাক। নিজের শরীরের খেয়াল রেখ। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করো। ঔষধ খেও। যখনই শরীর খারাপ লাগবে, সাথে সাথে আমাকে ফোন কর। আমার কাছে কিচ্ছুটি লুকিওনা বাবা। ” কুহু কান্না থামাতে পারছেনা।
বাবার কাছ থেকে, শিহাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে। কুহুর কান্না দেখে আনান, সিক্তারও মন খা’রা’প হয়ে গেছে।
চলবে…