#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী
আজ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কুহু, সিক্তা দুজনেই হাত-পা ছড়িয়ে ঘুম দিচ্ছে। আজ থেকে আগামী কয়েকদিন শুধু ঘুম আর ঘুম।
মাগরিবের আজান কানে আসতেই কুহু উঠে বসে। সিক্তাকে অনেক ডেকেও ঘুম থেকে জাগাতে না পেরে, অজু করে নামাজ আদায় করে। এরপর নিচে আসে দিদুনের কাছে। তাহমিনা আক্তার এবং আফরোজা নাজনীন মিলে রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন। কুহুও এসে তাদের সাথে হাত লাগায়।
ওদের কাজের মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। আফরোজা নাজনীন কুহুকে বললেন দরজা খুলতে।
কুহু দরজা খুলেই দেখল আনান হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
” কি রে, তাহমিদ ভাইয়ের বউ ভাবি, কেমন আছিস? বিয়ের আগেই শ্বশুর বাড়িতে বউমার আদর খাচ্ছিস! এমন কপাল কয়জনের হয়! ”
” ভাইয়া, তুমি এসেই শুরু করেছ! আবার আমাকে ভাবি ডাকছ! তোমার পা’গ’ল হতে আর দেরি নেই। ”
” সাধে কি আর তোকে ভাবি ডাকছি। তোর সেয়ানা হবু জামাই, আমি তোর বড় জানা স্বত্বেও সম্মান দিতে চায়না। আবার ছোট বোনকে যে তার হাতে তুলে দিতে চাই এ উপলক্ষে কোন ট্রিটও দেয়না। কথায় কথায় বেকায়দায় ফেলে। তাই তাকে শায়েস্তা করতেই এই নিনজা টেকনিক এ্যাপ্লাই করতে হচ্ছে। এখন থেকে তুই আমার ভাবি। যখন ইচ্ছে তোর কাছ থেকে ট্রিট আদায় করব। তার প্যাঁচে, তাকেই ফেলব। এখন সামনে থেকে সর। আর যা আমার জন্য ঠান্ডা লেবুর শরবত করে আন। ” কুহুকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আনান ভেতরে ঢোকে।
কুহু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে আনানের দিকে।
আনান নিচে কিছুক্ষণ খালামনির সাথে কথা বলে উপরে আসে। উপরে উঠেই প্রথমে উঁকি দেয় তাহমিদের রুমে। কিন্তু পুরো রুম জুড়ে সুনশান নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
এরপর আনান সোজা আসে সিক্তার রুমে। সিক্তা তখনও ঘুমে বিভোর।
আনান এদিক-ওদিক তাকিয়ে এক টানে সিক্তাকে তুলে বসায়। হঠাৎ এভাবে হ্যাঁচকা টান খেয়ে সিক্তার মাথা ঘুরে উঠে।
” এই কোন আপদ রে, এভাবে ঘুম ভাঙালি? ” বলেই সিক্তা আবার শুয়ে পরে।
” আমি তোর ঘুম ভাঙ্গাইলাম রে , ভুঁড়িওয়ালা বাপের ত্যাঁদড় মেয়ে। পরীক্ষা যেন দুনিয়ার আর কেউ দেয়না। ” আনানের গলা শোনা মাত্রই ঝট করে চোখ খোলে সিক্তা।
” এই অ’স’ভ্য ছেলে, তুমি এখানে এসেছ কেন! আমার বাড়িতে এসে, আমার বাবাকেই ইনসাল্ট করছ! তোমার এত বড় সাহস! ”
” তোর বাপের বাড়িতে এসেই তাকে ইনসাল্ট করব। তোর কোন সমস্যা? ”
” আমি বাবাকে ডাকব বলে দিচ্ছি। অ’স’ভ্য ছেলে। নিজের শুটকো বাপের কথা চিন্তা না করে, আমার বাবাকে নিয়ে পরে আছে। ”
” ঐ, আমার বাবাকে কি বললি? দাঁড়া আজকে তোর হচ্ছে। ” আনান সিক্তার চুল টেনে ধরে।
সিক্তা ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।
” একশো বার বলব শুটকো, শুটকো, শুটকো। তোমার বাপ একটা শুটকো। যতক্ষণ আমার চুল না ছাড়বে, ততক্ষণ বলতেই থাকব। ”
” বে’য়া’দ’ব মেয়ে, নিজের শ্বশুরকে কেউ এভাবে বলে! শ্বশুরকে সম্মান দিতে জানিসনা আবার নিজের ভুঁড়িওয়ালা বাপের সম্মান আশা করিস? ”
আনানের কথা শুনে সিক্তার মাথা হ্যাং হয়ে যায়। হা করে তাকিয়ে থাকে আনানের দিকে।
” কি বললে তুমি? কে, কার শ্বশুর? ”
আনান হঠাৎ করেই হুঁশে এলো। ঝগড়ার মাঝে কি বলেছে ভাবতেই চোখ বুজে আসে। সিক্তা আনানের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে, উত্তর শোনার আশায়।
আনান ঘাড় চুলকে অপ্রস্তুত হাসে।
” আমার বাবা, তোর শ্বশুর। তোর একমাত্র বরের একমাত্র বাপ। এবার বুঝেছিস, তোর শ্বশুরের একমাত্র ছেলের বউ? নাকি আরও ডিটেইলস বলতে হবে? ”
আনানের ঠোঁটকাটা কথা শুনে সিক্তা কি অনুভূতি প্রকাশ করবে বুঝতে পারেনা। তবে ও লক্ষ্য করল হঠাৎ করেই সামনের ছেলেটাকে বেশ লাগছে। তার হাসি, বাম গালে টোল, কোঁকড়া ঘনকালো চুল, একহাড়া গরনের উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারা নেহাৎ মন্দ নয়।
” কি রে, এভাবে সাইলেন্ট মোডে চলে গেলি কেন! আমার কথার প্রত্যুত্তরে তোর কোন কথা নেই বুঝি? আচ্ছা যা, তোর বাপকে ডেকে আন। তার সামনেই তাকে ভুঁড়িওয়ালা বলছি। ”
” একদম চুপ, শুট….. ” সিক্তা কথা শেষ করার আগেই আনান কথা বলে,
” আবার শ্বশুরকে উল্টাপাল্টা নামে ডাকছিস? তাও আবার একমাত্র বরের সামনে, তার একমাত্র বাপকে। তোর সাহস খুব বেড়েছে দেখছি! ”
” কক কে, কার বর? ফালতু কথা বলার জায়গা না পেলে, ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করো গিয়ে। ”
” কেন বর হিসেবে আমাকে পছন্দ নয় বুঝি? তোর বাপ কিন্তু এমন একটা ছেলে পেলে, সুযোগটা লুফে নিবে। তবে আমার কিন্তু তোকে হেব্বি পছন্দ। বউ হিসেবে তুই কিন্তু আমার মনের মতন। এই তোর কি আমাকে পছন্দ নয়? পছন্দ না হলেও অসুবিধা নেই। আমাকে তোর পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যত ইচ্ছে সময় নিবি। তবে শেষে হ্যাঁ বলবি এটাই আমার অর্ডার। তোর সেয়ানা ভাইকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনা কিছুতেই। ”
” আমার ভাইয়া তোমাকে কি করল! তার ওপর তোমার এত কিসের হিং’সা! ”
” কি করেনি তোর ভাই? এই তোর এসবে এত আগ্রহ কেন! তোর আগ্রহ থাকবে শুধু আমার ওপর। এখন অন্য চিন্তা না করে শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করবি, বুঝলি? এই নে, তোর শ্বাশুড়ির কাছ থেকে টাকা নিয়ে এই নুপুর তোর জন্য কিনেছি। যদি মুখে বলতে না পারিস, তবে নুপুর পায়ে পরলেই আমি বুঝে নিব। ” আনান পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে সিক্তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। এরপর ও রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আনান আরেকবার তাহমিদের রুমের সামনে এসে উঁকি দেয়।
” কি রে, বউয়ের বড় ভাই, এভাবে ছোট বোনের জামাইয়ের রুমে উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন! একটুতো লজ্জা কর। আজকাল দেখছি ছুঁচোর মত আচরণ করছিস! ”
” হাহ্ ভাই, মুখে বলছ বউয়ের বড় ভাই, কিন্তু মনে সম্মানের লেশমাত্র নেই। একটা কথা শুনে রাখ, কয়েকদিন পর, তুমি তাহমিদ আমাকে সম্মান দিতে সচেষ্ট থাকবে। আমি কিন্তু তখন তোমার মত এমন হিটলারি ফলাবোনা। ”
” কোন লাভ নেই। এমন একটা ফিঁচকে ছেলের কাছে আমার বোনকে কিছুতেই দিবনা। তাই মিছেমিছি সম্মান পাওয়ার আশা বাদ দে। ” তাহমিদের কথা শুনে আনানের মাথায় যেন বাজ পরল! বেচারার মুখ চুপসে গেছে। যেই কথা ও ছাড়া কেউ জানেনা, সেই কথা এই সেয়ানা লোকের কাছে পৌঁছাল কিভাবে!
” ভাই, স্যালুট তোমাকে। তোমার ঐ দুটা চোখ নাকি সিসি ক্যামেরা! তবে সে যাইহোক তোমার বোন আমার হচ্ছে, এটা জেনে রাখ।তোমার আশায় গুড়েবালি। তুমি অযথাই আমাদের দুজনের মধ্যে ডিপজলের ভুমিকা পালন করতে এসোনা। ও অলরেডি পটে গেছে। আর কয়েক বছর পর, আমি তোমার ছোট বোনের স্বামী হব। তুমি উঠতে-বসতে আমার সামনে সম্মানের ডালা নিয়ে হাজির হবে। এইযে আমি, আমার কন্যার বড় ভাই হয়েও সম্মান না পাওয়ার আক্ষেপ তখন ঘুচবে। ”
আনানের কথা শুনে তাহমিদের ভিষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু ওর এখন হাসা মানেই আনানকে প্রশ্রয় দেয়া, তাই অনেক কষ্টে নিজের হাসি চেপে রাখে।
” কই গো বউ, খালি এমন করে শুয়ে থাক কেন? বাড়ির কাজকর্ম করা লাগবেনা? বাড়ির বউদের শুয়ে থাকলে সংসারের অবনতি নিশ্চিত। ” সবুজের মায়ের ক’র্ক’শ আওয়াজ শুনেও কোন হেলদোল নেই দৃষ্টির। ও শ্বাশুড়ির কথার জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শোয়।
” কি ব্যাপার, তুমি না উঠে বিছানায় গ’ত’র চেপে ধরলে কেন? আচ্ছা মেয়ে তো তুমি! কোন আদবকায়দা বাপ-মা শিখায়নি! ”
” আহ্ আম্মা। আমার আদবকায়দা যথেষ্ট আছে , শুধু আপনাদের মনে হয় মাথার দো’ষ আছে। আপনি আগে বলতেন, বাপেরবড়ি থেকে কিছু আনিনি তাই বাড়ির সব কাজ আমাকেই করতে হবে। আমিও সেটাই করলাম। কিন্তু যখন বাপের বাড়ি থেকে সবকিছু আনলাম, আপনার ছেলেকে আমার আব্বু ছয় লাখ টাকা দিল, তারপরও আমাকে কাজ করতে হবে! এখন থেকে আমি কোন কাজ করবনা। হয় আপনি সব কাজ করবেন, নয়তো কাজের মেয়ে রাখবেন। ” দৃষ্টির পাল্টা জবাবে মিইয়ে যায় ওর শ্বাশুড়ি।
এই মেয়েকে বাগে আনতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে তার স্বামী, সন্তান বাড়িতে আসা মাত্রই এই মেয়ের নামে বিচার দিবে। একটা দফারফা না করে সে আজ ভাত মুখে তুলবেনা।
বিঃদ্রঃ গত দুইদিন থেকে বাসায় মেহমান আছে। কাজের ফাঁকে যতটুকু লিখতে পারি, ততটুকুই পোস্ট করি। আমি জানি গল্প ছোট হয় কিংবা দেরিতে পোস্ট করি, এ নিয়ে আপনাদের বিস্তর অভিযোগ আছে। আবার হয়তোবা মাঝেমধ্যেই বাসায় মেহমান আসার কথায়ও বিরক্ত হন। কিন্তু আমি সত্যিই নিরুপায়। আমার এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমি লজ্জিত।
চলবে….#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪০
জাওয়াদ জামী
দুপুর পরে সবুজ বাড়িতে আসলেই, ওর মা ছেলের কানে দৃষ্টিকে নিয়ে বি’ষ ঢুকিয়ে দেয়। দৃষ্টি তাকে যা যা বলেছে সেগুলোও বলে। এবং যেগুলো বলেনি সেগুলোও ইনিয়েবিনিয়ে বলে। এসব শুনে সবুজের ভিষণ রা’গ হয়। কিন্তু ও জানে এখন রা’গ করলেই ওকে সবকিছু হারাতে হবে। তাই সে মায়ের কথা পাত্তা না দিয়ে, মাকে বলে,
” মা, অযথাই রাগ কর কেন! দৃষ্টিকে নিজের মনমতো চলতে দাও। এখন থেকে তুমি দৃষ্টির কথামতো চলবে। ওকে হাতে রাখলেই তবে, ও ওর বাপের বাড়ি থেকে অনেক কিছু নিয়ে আসবে। দেখলেনা ওর বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতেই কেমন দিয়ে দিল। মা ও সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ওকে কারনে অকারণে খুঁ’চি’ও’না। ”
সবুজের মা চিন্তা করে দেখল, তার ছেলে যা বলেছে, এতে এক বিন্দুও মিথ্যা নেই। তাই তিনি ছেলের কথার সাথে তাল মেলান।
এরপর বেশ কয়েকদিন দৃষ্টির শ্বশুর বাড়ির দিনগুলো আরাম-আয়েশেই কাটে। শ্বাশুড়ি ওকে খোঁ’চা দিয়ে কথা বলেনা। খেতে বসলেই মাছের মাথা, মাছের বড় টুকরো, প্রয়োজনের অধিক মাংস না চাইতেও দৃষ্টির পাতে দেয়। দৃষ্টিও এতে খুব খুশি।
এরইমধ্যে দৃষ্টির মামাশ্বশুর আসে চেয়ারম্যান বাড়িতে। তার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে চেয়ারম্যান বাড়ির সকলকে দাওয়াত করেছে। বিয়ের তিনদিন আগে থেকে দৃষ্টিকে নিয়ে তার বোনকে যেতে বলে। দৃষ্টির শ্বাশুড়িও রাজি হয়। ও সবুজের কাছে ওর মামা বাড়ির গল্প শুনেছে। তারা নাকি খুব অবস্থা সম্পন্ন। তাই ননদের বিয়েতে নানা শ্বশুরের বাড়িতে যেতে হবে শুনে ওর মন খারাপ হয়ে যায়। সেখানে সব আত্মীয় স্বজনরা আসবে, বাহারি শাড়ি, গহনা পরবে। কিন্তু দৃষ্টির এসবের কিছুই নেই। ও মন খারাপ করে নিজের রুমে এসে শুয়ে থাকে।
দৃষ্টির আজকাল মনে হয়, ও যদি আব্বুর পছন্দে বিয়ে করত, তবে এত কষ্ট করতে হতনা। পর্যাপ্ত শাড়ি, গহনা কিংবা টাকার অভাব আব্বু কখনোই হতে দিতনা। মাসে অন্তত একবার হলেও আব্বু ওকে দেখতে আসত। কতকিছু আনত সাথে করে। ছোট ভাইটাও মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসত।
কষ্টে দৃষ্টির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরতে থাকে। ঠিক এই সময় শিউলি আক্তার মেয়েকে ফোন দিয়েছে। মায়ের নম্বর ফোনে ভাসতে দেখে, দৃষ্টির মুখে হাসি ফোটে।
” হ্যালো আম্মু, কেমন আছো? আব্বু কেমন আছে? শিহাব কোথায় আম্মু? ” একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো করে দৃষ্টি।
” একবারে এত প্রশ্ন করলে, আগে কোনডার উত্তর দিমু, মা! আমরা সগলেই ভালো আছি। শিহাব ইস্কুলে গেছে। তর বাপে মার্কেটে গেছে। তার আজকাল ব্যবসা খু্ব ভালো হইতাছে। এহন ক তুই ভালো আছস? তর আকাইম্মা শাউড়ী ভালো আছে? জামাই কনে? ”
” তোমার জামাই মিলে গেছে। আমার শ্বাশুড়ি তার ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। এরা সবাই ভালো আছে। ”
” তর মামাশ্বশুর আইছে? কবে আইছে হেয়? ”
” আজকেই আসছে। তার মেয়ের বিয়ে। সেজন্য আমাদের দাওয়াত করতে এসেছে। ”
” তরা যাবিনা বিয়াতে? যাইয়া বেড়ায় আসিস। বিয়ার পর তো তরে ওরা একবারও সেখানে নেয়নি। এই সুযোগও ছাড়িসনা। ”
” আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা, আম্মু। সেখানে সবাই দামী শাড়ি, গহনা পরে আসবে, কিন্তু আমার কিছুই নেই। তাই ভাবছি আমি যাবনা। ” মন খারাপ করে বলে দৃষ্টি।
” পা’গ’ল মাইয়া কয় কি দেখছ! তর মা কি মরছে! তুই কাইলকাই আইয়া আমার সব গয়নাডি নিয়া যা। আপাতত সেইগুলাই বিয়াতে পর। পরে তর বাপকে কইয়া, আমি তরে বিশ ভরির গয়না গড়াইয়া দিমু। আর আমি পনের হাজার টাকা দিমুনি, তাই দিয়া শাড়ি কিন্যা নিবি। আমার মাইয়া যেন বিয়ার বাড়িতে সবচেয়ে দামী শাড়ি পরে সে ব্যবস্থা আমি করমু। ”
মায়ের কথা শুনে দৃষ্টির মন প্রসন্ন হয়। মুখের অনাবিল হাসিই বলে দিচ্ছে ওর বুকের ওপর থেকে কোন ভারী পাথর নেমে গেছে।
রাতে সবুজ বাড়িতে আসলে দৃষ্টি তাকে মায়ের সাথে কথপোকথনের সবটাই জানায়। সবুজ দৃষ্টির কথা শুনে ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হয়।
পরদিন সকাল হতে না হতেই সবুজ দৃষ্টিকে নিয়ে ফুলতলা আসে।
বিকেলেই আবার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। এবার তাদের সাথে আছে শিউলির দেয়া পনের ভরির গহনা এবং পঁচিশ হাজার টাকা। শিউলি প্রথমে পনের হাজার টাকা দিতে চাইলেও, পরে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পঁচিশ হাজার টাকা দেয়।
শিউলির টাকা ও গহনা দেয়ার কথা কায়েসের অজানা থেকে গেল। সে জানলওনা নিজের সব গহনা এবং জমানো টাকা দৃষ্টিকে দিয়ে শিউলি ভবিষ্যতে নিঃশেষ হওয়ার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল৷
কুহু অ্যাডমিশনের জন্য কোচিং করছে৷ ও আর সিক্তা একসাথে ভর্তি হয়েছে। দুজনে পড়াশোনায় ভিষণ মনযোগী হয়েছে।
আনানের পরীক্ষা চলছে তাই ও বেশ কিছুদিন যাবৎ এ বাসায় আসছেনা।
তাহমিদের পরীক্ষা শেষের দিকে। সে এমনিতেই পড়ুয়া ছেলে, পরীক্ষা ছাড়াও সব সময়ই হাতে বই নিয়ে বসে থাকে। আর পরীক্ষার সময় তো কথাই নেই। এ সময় রাতে তিন ঘন্টার বেশি ঘুমায়না।
কুহুর সাথে এ কয়দিনে তাহমিদের খুব একটা দেখা হয়নি। কুহু ইচ্ছে করেই তাহমিদের আশেপাশে ভিড়েনা। কারন কুহু চায়না, ওর জন্য তাহমিদের পড়াশোনায় ক্ষ’তি হোক।
পরীক্ষা শেষ করে বাসায় আসতে তাহমিদের বিকেল হয়ে গেছে। কুহুরা কোচিং শেষে কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছে।
তাহমিদ বাসায় এসেই ফ্রেশ হয়ে সোজা নিচে আসে। সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছিল, এখন শেষ বিকেল। দুপুরে কিছুই খায়নি তাই প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।
এদিকে কুহু, সিক্তাও দুপুরে খায়নি। ওরা খাবার টেবিলে বসতেই তাহমিদ সেখানে আসে।
” বড়মা, খুব ক্ষুধা লেগেছে। তারাতারি খেতে দাও৷ ” কুহুর পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে তাহমিদ বলে।
” ভাইয়া, এটা কি করছ! নিজের চেয়ার ছেড়ে এখানে বসলে কেন! সব সময়ই দেখেছি, তুমি ঐ চেয়ার ছাড়া বসনা। কিন্তু আজ এখানে বসলে! আমাদের পাশে কখনোই এভাবে বসোনি কিন্তু। বিয়ের আগেই এই দশা! বিয়ের পর যে কি হবে ভাবতেই ভয় হচ্ছে। ” সিক্তা ইচ্ছে করেই তাহমিদের পেছনে লাগছে।
” সত্যিই বলেছিস৷ বিয়ের আগেই তোর বোনের পেছনে লেপ্টে আছি। নিজের তৈরি আগের সব নিয়ম ভাঙ্গছি। বিষয়টা আমার ক্ষেত্রে যেমন সত্য। তেমনি আনানের বিষয় নিয়েও আমি চিন্তিত। বেচারা আজকাল আর আমার জন্য এই বাসায় আসেনা। ” আর বেশি কিছু তাহমিদকে বলতে হলনা। ওর এই সামান্য কথা শুনেই সিক্তা বিষম খায়।
ও ভাবছে এসব গোপন ব্যাপার ভাইয়া জানল কেমন করে!
কুহু দুই ভাই-বোনের কথা শুনছে। কিন্তু তাহমিদের শেষের কথা শুনে একটু থমকায়। ওদের দুজনের কথার মাঝে হঠাৎ আনান আসল কেন বুঝতে পারেনা।
আফরোজা নাজনীন একে একে ছেলে-মেয়েদের খাবার দেন।
চিংড়ির দোপেয়াজা কুহুর খুব পছন্দের। তাই অন্য তরকারি না নিয়ে শুধু সেটা দিয়েই খেতে থাকে। তাহমিদ খাওয়ার মাঝেই কুহুর পছন্দ-অপছন্দ সব লক্ষ্য করে।
আফরোজা নাজনীন তাহমিদের প্লেটে চিংড়ির দোপেয়াজা তুলে দিলে, ও সকলের অগোচরে কুহুর প্লেটে দুইটা চিংড়ি দেয়। কুহুর আর তাহমিদকে কিছু বলা হয়ে উঠেনা। তাহমিনা আক্তার এসে ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
সযত্নে তিনি ছেলের পাতে এটা-সেটা তুলে দেন। কুহু আর সিক্তাও বাদ যায়না।
খাওয়া শেষে তাহমিদ নিজের রুমে এসে, ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। আজকে আর কোন পড়া নয়। আজ শুধু ঘুম।
সকালে ঘুম উঠতে দশটার বেশি বেজে যায়। এত বেলা হয়েছে অথচ কেউ ওকে ডাকেনি! আর দেরি না করে ঝটপট বিছানা ছাড়ে তাহমিদ। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখল তাওহীদ তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এসেছে। হঠাৎ বাসায় ভাইকে দেখে অবাক হয়ে গেছে তাহমিদ। এভাবে না জানিয়ে ওরা কেন এসেছে!
তাহমিদকে দেখে তূর দৌড়ে এসে চাচ্চুর কোলে উঠে। তাহমিদও আগলে নেয় ভাতিজীকে। দুজনে মিষ্টি মধুর আলাপনে মেতে উঠে।
প্রাথমিক আলাপ বিনিময় করে তাওহীদ নিজের রুমে আসে। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে নাস্তা সেড়ে নেয়।
তাওহীদের স্ত্রী নীরা কুহুকে দেখার পর থেকে মুখ গোমড়া করে আছে। ওর শ্বশুর বাড়িতে ওকে সমাদর না করে, সবাই কুহুকে নিয়ে মাতামাতি করে, এটা নীরা মানতে পারছেনা। ও কুহুকে হেনস্তা করার কোন উপায় খুঁজছে।
দুপুরে খাবার পর সবাই ড্রয়িংরুমে বসে টুকটাক কথা বলছে। কুহু ফুপুর সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। যদিও আফরোজা নাজনীন কুহুকে কাজ করতে বারণ করেছেন, তবুও কুহু ফুপুর কথা শোনেনি।
সানাউল রাশেদিন কুহুর কাছে এক কাপ চা চাইলে, কুহু তাকে চা বানিয়ে দেয়।
এই অসময়ে বড় চাচ্চু চা পান করবে শুনে তাহমিদ তার পেছনে লাগতে ভুল করেনা।
” বুঝলে দিদুন, মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ধনী হলে, দুপুরেও চা পান করে। এরা আসলে আশেপাশের সবাইকে নিজের বিলাসিতা দেখিয়ে মজা পায়। ”
” আম্মা, আপনার নাতি রুপী বে’য়া’দ’ব’টা’কে আমার বিষয়ে কোন কথা বলতে নিষেধ করে দেন। আমি যদি একবার রে’গে যাই, তবে ওর বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব বলে দিলাম। আমার চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে এর মত বে’য়া’দ’ব একটাও জন্মায়নি। ”
” দিদুন, সিনিয়র রাশেদিনের কাছে কি তার চৌদ্দ পুরুষের লিষ্ট আছে! নাকি তার চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে কে, কি করেছে সেগুলো মনে রাখার কন্ট্রাক নিয়ে রেখেছে! সত্যিই তুমি রত্নগর্ভা দিদুন। এমন ছেলের জন্ম দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়! ”
” তাহমিদ, কি শুরু করলি এসব! বড় চাচ্চুকে সম্মান দিতে ভুলে গেছিস? ” তাহমিদের বাবা শফিউল রাশেদিন ছেলেকে থামাতে বলে উঠেন।
” শোন শফিউল, সম্মান জিনিসটা তোমার ছেলের চৌদ্দ হাতের ভেতরে নেই। সম্মানও তাকে দেখে ভয় পায়। কখনযে সম্মানকে অসম্মানে রুপান্তরিত করবে তোমার ছেলে, সেজন্যে তারা আগেভাগেই তার কাছ থেকে দূরে থাকে। ” সানাউল রাশেদিন খোঁ’চা মারে তাহমিদকে।
” দিদুন, দেখেছ, আমাদের সামনে সম্মানের গ্যারেজ বসে আছে! যার পুরো শরীরে সম্মানের দল জায়গা পেতে মা’রা’মা’রি করছে! ” তাহমিদও পাল্টা খোঁচা দেয় সা’না’উ’ল রাশেদিনকে৷
এবার তাদের ঝগড়ার মাঝে হস্তক্ষেপ করেন আফরোজা নাজনীন। দুজনকেই ধমকে থামিয়ে দেন।
এতক্ষণ নীরা এসব দেখে ভেতর ভেতর জ্ব’ল’ছি’ল। এত বড় ছেলেকে এত আস্কারা দেয়ার কি আছে তা সে ভেবে পায়না। এজন্য সে আফরোজা নাজনীনকে পছন্দ করেনা। কারন তিনি সব সময়ই তাহমিদকে সাপোর্ট করেন।
কুহু কেবলই দিদুনের কাছে বসেছে। দিদুন কুহুর মাথায় মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
” কুহুমনি, আমাকে একটা পান বানিয়ে দিবে? অনেকক্ষন পান ছাড়া বসে আছি। ”
” এক্ষুনি দিচ্ছি, দিদুন। ”
” দিদুন, তুমি পান খাবে, সেটা আমাকে বললেই পারতে। বাড়ির মেহমানকে দিয়ে কাজ করাতে নেই, জানোনা? এই মেহমান আজ আছে কাল নেই। তাকে একটু রেষ্ট করতে দাও। গ্রামের মানুষ ও, দিনরাত হেঁসেল সামলেছে, এখানে যে কয়দিন আছে সে কয়টাদিন অন্তত রেষ্ট করুক। ” নীরা ব্যঙ্গাত্বক গলায় দিদুনকে বলে।
নীরার কথা শুনে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলে কথা থামিয়ে নীরার স্পর্ধা অবলোকন করছে।
” কি বলছিস নীরা! কুহু আমাদের ঘরের মেয়ে। ও মেহমান হতে যাবে কেন! ” দিদুন মিষ্টি কথায় পরিস্থিতি সামলে নিতে চাচ্ছেন।
” মেহমান যে ঘরের মানুষ হয়, তা আমি তোমার কাছ থেকেই শুনলাম। অবশ্য এ ধরনের মেহমানকে ঘরের মানুষই বলা যায়। যাদের কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। যারা একবার ধনীদের বাড়িতে আসলে, আর যেতে চায়না। যাদের পরিবারের লোকজনের কোন সম্মান নেই। একটা যুবতী মেয়েকে দিনের পর দিন অন্যের বাড়িতে রেখে দেয়। এদের বংশ যে কতটা নিচু, তা এদের এমন আচরণেই বোঝা যায়। ”
নীরার কথা শুনে আফরোজা নাজনীন অপমানে মাথা নিচু করে। কুহু সেখান থেকে দিদুনের রুমে এসে মুখ লুকায়।
নীরা মুচকি মুচকি হাসছে। ওর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এক ঢিলে দুই পাখি মে’রে’ছে। বড়মাকে অপমান করাও হল, আবার কুহুকে এই বাড়ি থেকে বের করার রাস্তাও করে দিল৷
কিন্তু নীরার এই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হয়না। গালে সপাটে একটা চ’ড় খেয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের ব্যাক্তির দিকে।
তাহমিনা আক্তারের চোখমুখ রা’গে’র চোটে লাল হয়ে গেছে। শান্ত,ধীর মানুষটা যেন এই মুহূর্তে ভয়ংকরী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।
নীরার বিশ্বাসই হচ্ছেনা যে ওর শ্বাশুড়ি ওকে চ’ড় মে’রে’ছে।
তাহমিনা আক্তার সেখান থেকে সরে যেয়ে, তাওহীদের সামনে দাঁড়ান। সাত-আটটা চ’ড় পরপর বসিয়ে দেন ছেলের গালে৷
চলবে…