বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব -১১

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
“একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারো না! সেই তো রুহানী উড়াল দিয়ে চলে গেল।”
রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি কি করবো চাচ্চু, আমি তো বুঝতে পারিনি রুহানী এভাবে চালাকি করবে। ওকে তো প্রতিদিন খাবারের সাথে ড্রা***গ দিয়ে বেশিরভাগ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো।”

টেলিফোনের অপর পাশে ঢাকা রাফাতের চাচা রেগে গেলেন। তিনি রাফাতের নির্বুদ্ধিতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি বারবার ভুলে যাও, রুহানী কিন্তু মোটেও জন্মগত বোবা নয়। এক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সে তার কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। কিন্তু যেকোনো সময় তার জবান ফিরে আসতে পারে। তুমি ওকে হাত-পা খোলা অবস্থায়, মুক্ত অবস্থায় একটা ঘরের মধ্যে শুধু বন্দী করে রেখেছিলে। ও কার মেয়ে জানো তো? হাসনেয়ারার মেয়ে ও। যার জন্য তোমার বাবা তোমার মাকে দিনের পর দিন অবহেলা করে, কষ্ট দিয়ে দিয়েছে তারপর সেই হাসনেয়ারার জন্য নিজেকে ও তোমার মাকে শেষ করেছে। তোমাদের দুই ভাই-বোনকে এতিম করেছে। এখন সেই হাসনেয়ারার মেয়ে তোমার বোনের জীবনটা!”

পুরনো স্মৃতি মনে করানোতে চোখের পর্দায় ভেসে উঠে সেই ভয়ংকর স্মৃতি। পরক্ষনেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। রাগ ও দুঃখ দুটোই এখন তার মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় ধপ ধপ করছে। রাফাত হিংস্রাত্নক স্বরে বলে,
“কিচ্ছু ভুলিনি আমি। চাইলেও ভুলতে পারবো না। আমার মায়ের প্রতিটা কান্না, কাকুতি-মিনতি কিছুই আমি ভুলতে পারব না। নিজের মাকে বাঁচাতে পারিনি, কারণ তখন ছোটো ছিলাম। বাবা নামক মানুষটার উপর কিছু বলার সাহস ছিল না। কিন্তু নিজের বোনকে রক্ষা করতে, ওকে বোনকে সুখে রাখতে আমি সবকিছু করতে পারব। এতে যদি আমায়ও ওই মানুষটার মতো হতে হয় তো হবো।”

রাফাতের চাচা বাঁকা হাসলেন। তিনি নিজের ভাতিজাকে বাহবা দিয়ে বললেন,
“যা লাগে করো। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি। আপাতত কিছুদিন যেখানে আছো সেখানেই থাকো। নিজের ফোন অন করবে না। যোগাযোগ করতে হলে আজ যেভাবে করলে সেভাবেই করবে। ওই দিকটায় আমি খেয়াল রাখব।”

“ঠিক আছে।”

রাফাত টেলিফোন রেখে, বিল মিটিয়ে চাদরে মুখ ঢেকে টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে যায়।

________

রাতের নির্জন প্রহরে খোলা টেরেসে একাকী বসে আছে রুহানী। কিছুক্ষণ আগেই আরহানের সাথে মেসেজে বাক্য আদান-প্রদান করে ঘুম পাচ্ছে বলে অফলাইন হয়েছে। কিন্তু তার নেত্রদ্বয় রক্তিম হয়ে জ্বা*লাপো*ড়া করলেও নিদ্রাকন্যারা যে ধরা দিচ্ছে না! তিন-চার দিন যাবত তার সাথে এটাই হচ্ছে। মাথাব্যথার জন্য জোড় করে ঘুমাতে হচ্ছে। আজ তার মোটেও জোড় করতে ইচ্ছে করছে না। বসে বসে আরহানের বলা কথাগুলো ভাবছে। আরহান বলেছে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু রুহানী যে এখনই বিয়েটা করতে চাচ্ছে না। অন্তত সাফা সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত। সাফার সাথে হওয়া সবকিছু নিয়তি হলেও কিছুটা কষ্ট তো তার কারণেও পেয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু সময় বসে থাকার পর হঠাৎ করে মাথাব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে ধরলে উঠে রুমে যায়। তারপর একটা পেইনকি*লার ও হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আরহানের। আজ বেশ বেলা করেই ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে সকাল সাড়ে আটটা বাজে। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে যায় সে। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রুহানীর নাম্বারে কল করে কিন্তু রিসিভ হয় না। পরপর দুইবার কল করে রিসিভ না হওয়ায় ভাবল, হয়তো ফোনটা সাথে নেই। তাই ফোন রেখে তৈরি হওয়া শুরু করল।
পরিপাটি হয়ে আরহান নিচে নেমে ডাইনিং এ গিয়ে বসে দাদীকে হাঁক ছাড়ে,
“দাদী, জলদি নাস্তা আনতে বলো। নয়তো আমি নাস্তা না খেয়ে চলে যাব।”

তখন আলো খান রান্নাঘর থেকে প্লেট হাতে ডাইনিংয়ের দিকে আসতে আসতে বলেন,
“আজ ব্রেকফাস্ট আমি নিজে বানিয়েছি। সার্ভেন্টদের বলেছি দুপুরের খাবারটা দেখতে।”

আরহান উৎসাহী হয়ে বলে,
“কী বানিয়েছো ফুপি?”

“এগ স্যান্ডউইচ!”

নামটা শোনা মাত্রই আরাহানের মুখটা বিরস হয়ে যায়। এই এগ স্যান্ডউইচ তার মোটেও পছন্দ না। যদি চিকেন স্যান্ডউইচ বলতো তাও মানা যেত। সেদ্ধ ডিমও তার চেয়ে ভালো। আরহান জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে রেখে তার দাদীর দিকে তাকায়। তার দাদী চোখের ইশারায় খেয়ে নিতে বলে। এই বাধ্য হয়ে আরহান একটা এগ স্যান্ডউইচ ও জুস নিয়ে খেতে আরম্ভ করবে তখনি আলো খান বাধা দিয়ে বলেন,

“সবাই আসুক। একসাথে খাই।”
“তোমরা একসাথে খেও। আমার ক্লাস আছে আমায় যেতে হবে।”
“তোমার ক্লাস কি এখন? মা তো বলল তোমার ক্লাস দশটাতে।”
“হ্যাঁ ক্লাস দশটাতেই। আমি এখন রুহানীর বাড়িতে যাব। ওকে পিক করব। তারপর কলেজে যাব।”

রুহানীর নামটা শুনে আলো খানের মুখটা চুপসে গেল। তিনি কৃত্রিম হাসি দিয়ে আর কিছু বললেন না। আরহান দ্রুত খেয়ে উঠে গেলে আলো খান তার মায়ের কাছে এসে বলেন,

“মা, রুহানী মেয়েটার সাথে আরহানের বিয়ের ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখলে ভালো হতো না?”

আমেনা খানম কপাল কুঞ্চন করে মেয়ের পানে চেয়ে তার কথা বোঝার চেষ্টা করলেন। তিনি শুধালেন,
“কী ভেবে দেখব?”

“এটাই যে মেয়েটা কথা বলতে পারে না, তার উপর প্রায় অনেকগুলো দিন মেয়েটা একটা ছেলের সাথে ছিল। সেখানে কী হয়েছে না হয়েছে তা তো আমরা স্বচক্ষে, সরজমিনে দেখিনি। বিয়েটা তো সারা জীবনের ব্যাপার। একটু ভেবেচিন্তে দেখলে ভালো হতো।”

আমেনা খানম মুচকি হেসে মেয়েকে আশ্বস্ত করলেন,
“সেটা আরহান ও রুহানী ওরাই বুঝে নেবে। যেহেতু সারাটাজীবন ওরা দুজনই একসাথে থাকবে। ওরা নিজেদের মধ্যে বুঝ করে যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই আমরা মেনে নেব। আমরা আর কয়দিনের! আজ আছি কাল নেই।”

“এটা ঠিক যে, যারা সারা জীবন একসাথে থাকবে, সিদ্ধান্তটাও তাদের হওয়া উচিত। কিন্তু ভালো-মন্দ দেখার ব্যাপারটাও তো আমাদের। বিষয়টা আমার বলার দরকার ছিল তাই বলেছি।”

আমেনা খানম আর কোন জবাব দিলেন না। ইতোমধ্যে নাস্তার টেবিলে সবাই এসে জড়ো হয়েছে।

________

আরহান রুহানীদের বাড়ির গেইটে গাড়ি থামিয়ে রুহানীকে আরো তিনবার কল করে। কিন্তু তাতেও কোন রেসপন্স আসে না। তাই সে এবার বাধ্য হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। কলিংবেল চাপলে জাহানারা শেখ দরজা খুলেন। দরজার বাহিরে আরহানকে দেখে জাহানারা শেখ হাস্যজ্জল কণ্ঠে বলেন,

“আরে আরহান, আসো আসো।”

আরহান ভেতরে এসে জিজ্ঞাসা করে,
“আন্টি রুহানী কোথায়? ওকে আমি অনেকবার কল করেছি, কিন্তু ও কল রিসিভ করেনি। কলেজের সময় হয়ে যাচ্ছে তো।”

“রুহানী তো ঘুম থেকেই ওঠেনি!”

“কীহ! এত সময় তো ও ঘুমায় না।”

আরহানের কন্ঠে বিস্ময়ের রেশ। জাহানারা শেখ বলেন,
“হয়তো খুব ক্লান্ত তাই। বুঝোই তো, কত বড়ো ধকল গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। আজ না হয় রেস্ট করুক। কাল থেকে যাবে।”

আরহান ব্যাপারটা ভেবে সায় দেয়। তারপর বলে,
“আচ্ছা আন্টি, তবে ওকে এখন ঘুম থেকে উঠিয়ে নাস্তা করিয়ে নিন। তারপর আবার নাহয় রেস্ট করুক।”

“হ্যাঁ সেই জন্যই যাচ্ছিলাম। তুমি বসো আমি রুহানীকে ডেকে দিচ্ছি।”

“না আন্টি আমার যেতে হবে। আমি কলেজ শেষে দেখা করে যাব।”

“হ্যাঁ তোমার তো ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আচ্ছা যাও তবে। দুপুরে কিন্তু এসো। এখানে খাবে।”

আরহান মাথা দুলিয়ে চলে যায়।

________

সাফার মা মিসেস শাহানা সাফার পাশে বসে আছেন। তিনি এক ধ্যানে মেয়ের পান্ডুর মুখশ্রী দেখে চলেছেন। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে তার ঘোর কাটে। তিনি কাজের মেয়েকে ডেকে বলেন,

“দেখ তো রিতা, কে এসেছে?”

কাজের মেয়ে রিতা দরজা খুলে দেখে এক অপরিচিত লোক। রিতা মিসেস শাহানাকে ডাক দিয়ে বলে,
“আম্মা, কে যেন আইছে? আমি চিনি না।”

রিতার কথা শুনে মিসেস শাহানা ভাবুক হলেন। হঠাৎ অপরিচিত কে আসবে! তিনি উঠে সদর দরজার কাছে গেলেন। অতঃপর বাহিরে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে অবাক হয়ে বলেন,

“রঞ্জু ভাই যে। এত বছর পর? আসেন ভাই ভিতরে আসেন।”

লোকটা ভেতরে এসে সোফায় বসে। তারপর বলে,
“হ্যাঁ ভাবি অনেক বছর পর এলাম। হসপিটালের কাজের জন্য বছরে তিনবার কি চারবার দেশে আসা হয়। কিন্তু এক দিনের জন্য। তারপর আবার ফিরে যাই। আর আপনি তো জানেন আমার হসপিটাল আমি সামলাই না। কিন্তু এইবার হসপিটাল একটা প্রজেক্ট ধরেছে। তাই কিছুদিন দেশে আছি। তা ফয়সাল ভাই কোথায়? আর সাফা?”

সাফার কথা শুনে মিসেস শাহানা বিমর্ষ হয়ে গেলেন। তিনি বললেন,
“আপনার ভাই অফিসে গেছেন। আর সাফা!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। অতঃপর ওড়নাতে ভিজে উঠা চোখের কোণ মুছলেন। মিস্টার রঞ্জু খন্দকার শুধালেন,
“কী সাফা?”
“সাফা কো*মাতে আছে। একটা অ্যা*ক্সিডেন্টে মেয়েটা আমার কী থেকে কী হয়ে গেল!”

মিস্টার রঞ্জু খন্দকার যেন ভীষণ অবাক হলেন। তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কীভাবে? আমি তো জানিই না।”

এরপর মিসেস শাহানা সবটা খুলে বললেন। এবার রঞ্জু খন্দকার বলেন,
“সাফার চিকিৎসার দায়িত্ব আমি নিতে চাই। ওকে লন্ডনসহ বিশ্বের যেকোন জায়গায় নিতে হয় তো নিব।”

“আপনার ভাই ওকে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার ব্যবস্থা করছে।”

“তাহলে তো ভালোই আমি সেখানকার বেস্ট ডাক্টারের সাথে কনসাল্ট করব। সাফাকে সুস্থ হতেই হবে।”

“তাই যেন হয় ভাই। দোয়া করবেন।”

“আমাকে সাফার কাছে নিয়ে চলুন ভাবী।”

মিসেস শাহানা, মিস্টার রঞ্জু খন্দকারকে নিয়ে সাফার রুমে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
আগামীকাল পরবর্তী পর্ব পাবেন।
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here