#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৫)
বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায় নিবিড়। জাগতিক সকল চিন্তা-ভাবনা, নিয়ম-কানুন ভুলে গেছে যেন! টিকেট ছাড়াই বাসে চড়ে বসেছে। অর্ধেক পথে কন্ডাক্টর টিকেট চাইলে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে। কন্ডাক্টর দ্বিতীয়বারের মতো টিকেট চাইলে সচকিত হয়। প্যান্ট ও শার্টের পকেট হাতায় পাগলের মতো। টিকেট না পেয়ে বলল,
” হারিয়ে গেছে! ”
কথাটা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। কন্ডাক্টর থতমত খেল! চুল উষ্কখুষ্ক থাকলেও তরুণ চেহারায় শিষ্ট, সভ্য আভাস। সদাচারসম্পন্ন। এমন একটা ছেলে বোকার মতো বলছে, টিকেট হারিয়ে গেছে। সেজন্য আবার বাচ্চাদের মতো কাঁদছেও! মাথায় সমস্যা আছে নাকি? কন্ডাকটরকে দ্বিধায় ফেলে নিবিড় মানিব্যাগ বের করল। তার হাতে দিয়ে বলল,
” সব নিয়ে নেন, ভাই। তবুও আমাকে বাবার কাছে পৌঁছে দিন। ”
কন্ডাক্টরের সন্দেহ কেটে হলো। নিশ্চিত হলো এই ছেলেটি পাগল। তাই দ্রুত নিবিড়ের কাছ থেকে সরে গেল। বলা তো যায় না, যদি কামড়ে দেয়!
____________
বাস থেকে নেমেই দৌড়াতে থাকে নিবিড়। রিকশা ডাকার ধৈর্য্যও ধরতে পারেনি। ছুটে চলা রিকশা-ভ্যানের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটছে সে। যেন কোন জীবন-মৃত্যুর প্রতিযোগিতায় নেমেছে সে! বাঁচলেও প্রথম হতে হবে, মরলেও প্রথম হতে হবে। নাহলে সব শেষ! সকলকে পেছনে ফেলতে গিয়ে দু-এক বার উল্টো পথ থেকে ছুটে আসা তিন চাক্কার সামনে পড়েছিল। ভাগ্যিস, তারা ব্রেক কষেছিল! নাহলে প্রতিযোগিতা মাঝপথেই থেমে যেত।
একরকম দম বন্ধ করেই নিজেদের বাড়ির সামনে পৌঁছাল। দূর থেকে পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড় নজরে আসতেই নিবিড় বদলে গেল। অশ্রুভরা চোখদুটো শুকিয়ে গেল হঠাৎ। হাত দিয়ে উষ্কখুষ্ক চুলগুলো বিন্যাস করল সুন্দর করে। শার্টের নিচের দিকটা প্যান্টে গুঁজতে গিয়ে দেখে বুকের কাছে দুটো বোতাম খোলা। সময় নিয়ে সেগুলোও লাগাল। আলুথালু অবস্থা থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করতে দম টানল কয়েকবার। প্রলম্বিত নিশ্বাসে গলার স্বর হালকা হয়েছে বোধ হয়। সেই অবস্থায় ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল। উঠোনে পা রাখতে রাখতে দুইহাত দিয়ে মুখটা এমনভাবে মুছল যেন পানি দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করছে, ক্লান্তভাব কাটিয়ে সতেজ হচ্ছে।
” ঐ তো নিবিড় আসছে। মুখ থেকে কাপড় সরাও জলদি, বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে দেও। ”
বাবার মুখ দেখার বদলে আনিস মোল্লার দিকে তাকিয়ে রইল নিবিড়। নিশ্বাস আটকে উচ্চারণ করল, ‘ শেষবারের মতো!
আনিস মোল্লা নিজেই সাদা কাপড়টা সরালেন। কান্নাপ্রায় গলায় বললেন,
” মন ভরে দেখে নেও, বাবা। ”
নিবিড় দেখল না। বড় বড় পা ফেলে ঘরের ভেতর ঢুকল। ছেলের আসার খবর পেয়েই কুলসুম নাহার কোথাও থেকে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়লেন ছেলের বুকে। পাগলের মতো চিৎকার করে কান্না করলে নিবিড় ধমকে ওঠে। কান্না থামাতে বলে আবারও বাইরে বেরিয়ে আসে। ভীষণ শান্তভাবে আনিস মোল্লাকে বলল,
” চলেন, জানাজার ব্যবস্থা করি। ”
এমন পরিস্থিতিতে নিবিড়ের শান্ত ও সহজ আচরণ হজম করতে পারছেন না আনিস মোল্লা। বিস্ময়াপন্ন হয়ে মৃদু স্বরে বললেন,
” মুখ দেখবে না? ”
” না। ”
” শেষবারের মতো দেখে নেও। পরে কিন্তু চাইলেও…”
নিবিড়কে বুঝাতে চাচ্ছিলেন আনিস মোল্লা। মৃত্যুযাত্রীর কবর হয়ে গেলে আর কখনও দেখার সুযোগ হয় না। পুরো বাক্যটা শেষ করতে দিল না নিবিড়। তাগিদ দিয়ে বলল,
” মৃত মানুষকে যত তাড়াতাড়ি কবর দেওয়া যায় ততই ভালো। আসেন, চাচা। ”
আনিস মোল্লার হৃদয় কেঁপে উঠল। হকচকিয়ে গেছেন খুব।নিবিড়ের নিষ্ঠুরতা তাকে বাক্যহারা করে ছেড়েছে। সেই অবস্থায় দেখলেন, বাবার লাশ কবরে রাখার সময় কতটা শক্ত ছিল। চোখদুটো একবারের জন্যও ভিজে উঠেনি।
___________
মতিন মিয়ার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকে ঐবাড়িতেই অবস্থান করছিল কোমল। সামনে থেকে নাহলেও দূর থেকে সবটায় চক্ষুদর্শন করছিল সে। কুলসুমকে সামলাতে গিয়ে বার বার বিফল হয়েছে। তবুও হাল ছাড়েনি। নিজ থেকেই ঝাপটে ধরে কাটিয়ে দিয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা ছিল না তার কাছে। তবুও চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টার মধ্যেও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কুলসুম নাহার। পাশের বাসার একভাবিকে দিয়ে নিবিড়ের ডাক পাঠিয়েছিল সে। নিবিড় দেখতে আসার বদলে কঠিন হয়ে বলেছিল, জ্ঞান ফেরানোর দরকার নেই।
আনিস মোল্লার মতো কোমলও প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল নিবিড়ের এমন আচরণে। পর মুহূর্তে ভাবল, জ্ঞান ফিরলেই তো আবার কান্না-কাটি করবে। এরমধ্যেই গলা বসে গেছে। ফ্যাসফ্যাস শব্দ হচ্ছে। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া নেই। বসে থাকতে পারছিল না, সমস্ত শরীর কাঁপছিল। এমন অবস্থায় যদি অজ্ঞান অবস্থায় একটু জিরিয়ে নেয় তাহলে ক্ষতি কী? এই সুযোগে মায়ের সাথে দেখা করে আসা যাবে। খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তো! রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে কুলসুম নাহারের নিশ্বাস পরীক্ষা করল, দাঁতে দাঁত আটকে গেছে নাকি দেখে নিল ভালো করে। তারপরেই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল। কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ল, ভয় পেল। সে ফিরে আসার আগেই যদি জ্ঞান ফিরে আসে? পাগলামি করে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়? এতসকল ভাবনা মনের দুয়ারে কড়া নাড়তেই সে ফিরে গেল কুলসুম নাহারের কাছে। শিয়রে বসে পরিচিত একজনকে অনুরোধ করল, তার মাকে একটু ডেকে পাঠাতে।
____________
রাবেয়া খাতুনের রান্না করে আনা ভাত-তরকারি দুটো থালাতে সাজিয়ে নিল কোমল। একটা থালা মায়ের হাতে করে নিবিড়ের রুমে পাঠাল। অন্যটা নিয়ে বসে থাকল কুলসুম নাহারের পাশে। তিনি গভীর ঘুমে ভারী নিশ্বাস ফেলছেন। ঘুম ভাঙলে খায়িয়ে দিবে সেই অপেক্ষায় আছে।
বেশ কয়েক মিনিট পর রাবেয়া খাতুন নিবিড়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। হাতে থালা না থাকায় একটু খুশি হয় কোমল। ভেবে নেয়, নিবিড় খেয়েছে। তবুও মনের খটকা দূর করতে জিজ্ঞেস করল,
” পুরোটা খেল? ”
রাবেয়া খাতুন মেয়ের পাশে বসে দুঃখী গলায় বললেন,
” ছুঁয়েও দেখেনি। আমি যে এতক্ষণ ধরে বকবক করলাম এক ঝলক তাকিয়েও দেখল না। এমন একটা ভাব যেন আমি ওখানে নেই। শেষে বাধ্য হয়ে থালাটা রেখে আসলাম। পরে যদি খেতে ইচ্ছে হয়, খাবে। ”
বলতে বলতে কোমলের মাথায় হাত রাখলেন। দরদমাখা কণ্ঠে বললেন,
” তুইও তো কিছু খাসনি। ”
কোমল শুকনো হাসল। মাকে খুশি করতে বলল,
” আমার ক্ষুধা লাগেনি, মা। লাগলে ঠিক খেয়ে নিব। খাবার তো পড়েই আছে। ”
রাবেয়া খাতুন একটুও খুশি হলেন না। কপট রাগ নিয়ে তাকালেন। পরিস্থিতি এতই দুরাবস্থা যে কিছু বলতেও পারছেন না। তাই চুপ করে থাকলেন। কোমল বলল,
” বাবাকে বলো তো, আজ এখানে থাকতে। ”
” কেন? ”
কোমল একটু চুপ থেকে মায়ের দিকে তাকাল। চিন্তিত গলায় বলল,
” কাকিমার সাথে তো আমি আছি, কিন্তু….”
কথাটা শেষ করল না কোমল। ধরে নিল, মা বুঝে নিবে। রাবেয়া খাতুনও বুঝতে পেরেছেন। নিবিড়কে একা ছাড়তে ভয় পাচ্ছে তার মেয়ে।
____________
পরের দুটো দিনও নিবিড় স্বাভাবিক থাকল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠল, দাঁত ব্রাশ করল, দুপুরে গোসল করল, বিকেলে বাইরে থেকে হেঁটে আসল। কী মনে করে সন্ধ্যার দিকে বাজার করে আনল। মাকে ডেকে বলল, রান্না করতে। তার ক্ষুধা পেয়েছে। কুলসুম নাহার রান্না করার অবস্থায় ছিল না বিধায় কোমলই রান্না করল। কাউকে দিয়ে তার রুমে খাবার বেড়ে পাঠাল অথচ খেল না কিছুই। প্রথম দিন বাবাকে নিবিড়ের রুমে ঘুমাতে বললেও তারপর থেকে মোহন কাকাকে রেখেছিল। বয়সে নিবিড়ের থেকে খুব বেশি বড় না। হয়তো তার সাথে একটু দুঃখ ভাগ করবে। কিন্তু তেমনটা ঘটেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানিয়েছে, একটা কথাও বলেনি সে। তিনি যে মাঝেমধ্যে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করেছেন তার উত্তরও দেয়নি। বোবার মতো চুপচাপ শুয়েছিল শুধু। তার ধারণা, নিবিড় শুয়ে থাকলেও ঘুমাইনি একফোঁটা। তিনি নাকি ঘুমের মধ্যেও টের পেয়েছেন, রুমে কেউ হাঁটছে।
কোমলের মন এমনিতে অশান্ত ছিল। কুলসুম নাহারকে জোর করে এক-দুই দানা খাওয়াতে পারলেও নিবিড়কে পারছে না। পুরো দুটোদিন সম্পূর্ণ অভুক্ত সে। এমন অবস্থায় যে সুস্থ মানুষের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে এই যেন অবিশ্বাস্য। তন্মধ্যে মোহনের দেওয়া প্রতিবেদনে তার মন আরও খারাপ হলো। নিজের অসফলতায় ভেঙে গেল খুব। মনে পড়ল, সেরাতে মতিন মিয়ার বলা কথাগুলো। মানুষটা তার উপর ভরসা করেই তো দায়িত্বগুলো দিয়েছিল। অথচ সে কিছুই পালন করতে পারছে না! কোমলের নরম মন সিক্ত হলো। চোখদুটো ভিজে আসল। অদ্ভুত এক চাপা কষ্ট ছড়িয়ে পড়ল মন ও শরীরে। সে কষ্ট সহ্য করাও তার পক্ষে কষ্ট হয়ে দাঁড়াল। সিদ্ধান্ত নিল সে নিজে কথা বলবে নিবিড়ের সাথে। সামনাসামনি। আর কতদিন এভাবে চলবে? দায়িত্ব এড়িয়ে যাবে? তার যে এখন একমাত্র কাজই হলো মায়ের দেখাশুনা করা। তারজন্যে তো নিজেকেও সুস্থ রাখতে হবে।
কোমল রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। মতিন মিয়াকে কবরে শুয়িয়ে দিয়ে আসলেও আশপাশের বাড়ির মেয়ে-বউদের আনাগুনা এখনও রয়েছে এবাড়িতে। হুটহাট যে কেউ চলে আসে কুলসুম নাহারের সাথে দেখা করতে। সান্ত্বনা দিতে, আশ্বাস দিতে। তাদের বিদায় দিয়ে পিলপিল পায়ে হাজির হয় নিবিড়ের রুমে। হাতে ভাতের থালা। সে সরাসরি নিবিড়ের দিকে তাকাতে পারল না। আড়চোখে দেখল শক্ত হয়ে উদাস দৃষ্টিতে চৌকির এককোণে বসে আছে। কোমলের উপস্থিতি তার উদাস কাটাতে পারেনি। কোমল ভীরুমনে নিবিড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভাতের থালায় চোখ রেখে বলল,
” তোমার প্রিয় ডিম বোনা করেছি। ”
এতেও যেন নিবিড়ের দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসল না। কোমল আর কী বলবে খুঁজে পেল না। অথচ কিছু সেকেন্ড পূর্বেও সে অনেক কথা সাজিয়ে রেখেছিল। কোমলের ইচ্ছে হলো একটা ধমক দিতে। কঠিন স্বরে কিছু একটা বলতে। সম্ভব হলো না। কঠিন হওয়া, ধমক দেওয়া, এ ব্যাপারগুলো তার স্বভাব বিরুদ্ধ।
কোমল দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না আবার ফিরে যেতেও পারছিল না। তাই ভাত মাখতে শুরু করল। আঙুলের সাহায্যে লোকমা বানিয়ে ধরল নিবিড়ের মুখে। অন্য দিকে চেয়ে বলল,
” দুইদিন ধরে না খেয়ে আছ, একটু খেয়ে নেও। কাকিমা খুব চিন্তা করছে। ”
এবার যেন নিবিড়ের উদাসভাব কাটল। সম্বিৎ ফিরল। এক ঝলক কোমলের দিকে তাকিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরল অকস্মাৎ। তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ভয়ে কেঁপে উঠল কোমল। হাত থেকে থালা পড়ে গেল ঝনঝন শব্দে। সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই নিবিড়ের। হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করে বলল,
” আমার দুঃস্বপ্ন ভেঙে দেও, কোমল। আমি সহ্য করতে পারছি না। মারা যাচ্ছি। এই দেখ নিশ্বাস নিতে পারছি না। ”
বলতে বলতে চোখের উষ্ণ জল ছেড়ে দিল নিবিড়। সেই উষ্ণ জল কোমলের কালো বোরকা ভেদ করে পেট স্পর্শ করল। কোমল আরও একবার কেঁপে উঠল।
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৬)
” আমার দুঃস্বপ্ন ভেঙে দেও, কোমল। আমি সহ্য করতে পারছি না। মারা যাচ্ছি। এই দেখ নিশ্বাস নিতে পারছি না। ”
বলতে বলতে চোখের উষ্ণ জল ছেড়ে দিল নিবিড়। সেই উষ্ণ জল কোমলের কালো বোরকা ভেদ করে পেট স্পর্শ করল। কোমল আরও একবার কেঁপে উঠল। বরফের মতো জমে যাওয়া শরীরটাও অনুভব করল নিবিড়ের দম আটকে যাওয়া কান্না।
” বাবার এতবছরের লালিত স্বপ্নটাকে বাস্তব করার সময়টুকুও পেলাম না। আমাকে মাঝপথে রেখে চলে গেলেন! এই ব্যর্থতার বোঝা কী করে বয়ব আমি? কোমল, আমাকে পথ দেখাও। এই বোঝা থেকে মুক্তি করো। ”
নিবিড়ের কণ্ঠে সিক্ত আকুলতা। একের পর এক অসম্ভাব্য অনুরোধ। কোমলের হৃদয় উতলা হয়। চোখদুটো নোনা অশ্রুতে টলমল করছে। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
” তুমি ব্যর্থ নও। নিয়তির শিকার। ভাগ্যের প্রতিফলক। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। শক্ত হতে হবে। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আগত সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। ”
” আমার যে ভীষণ ভয় হচ্ছে, মায়ের সামনে যেতে পারছি না। আমি পারব না! ”
” পারবে। তুমি ভীতু নও। আমি জানি, তুমি অনেক সাহসী। ”
নিবিড়কে সাহস দিতে দিতে তার চুলে হাত রাখল কোমল। আনমনে আঙুল বুলাতে থাকল। যেন, এক অবুঝ বালককে আদুরে ভাষায় বুঝ দিচ্ছে। নিবিড় শান্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। নিশ্বাস পাতলা হয়ে আসছে। কোমল অদূরে দৃষ্টি রেখে বলল,
” তোমার বাবাও জানে, তুমি খুব সাহসী। সেজন্যই তো মায়ের দায়িত্ব পেলে এত তাড়াতাড়ি। তোমার উপর আস্থা আর ভরসা করেই তো কাকিমাকে রেখে গেলেন নিশ্চিন্তে। এরপরও বলবে, তুমি ভিতু? ”
নিবিড় কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ থাকলে কোমল একটু স্বস্থি পেল। আরও বলল,
” তুমি নিশ্চয় বাবার এই ভরসা ভেঙে দিবে না? দায়িত্ব এড়িয়ে যাবে না? মায়ের দেখাশুনা করবে জীবন দিয়ে। তার ভালো-মন্দ সবকিছুর খোঁজ নিবে নিয়মিত। পারবে তো? ”
কোমল উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে উদাস হলো। মনে পড়ল মতিন মিয়ার ক্লান্ত মুখ, সিক্ত কণ্ঠস্বর আর একটা প্যাকেট। তৃতীয়বারের মতো কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। উদাস দৃষ্টি চঞ্চল হলো। পুরো ঘরটায় চোখ বুলিয়ে বলল,
” সবার আগে কাকিমার জন্য ভালো থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ”
এইটুকু বলতে গিয়ে সেদিন মতিন মিয়ার সাথে হওয়া পুরো আলাপটাই উপস্থাপন করল কোমল। যেন, এমন সুযোগ আর পাবে না। পেলেও অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই সবটায় জানানো উচিত। নাহলে ঝড় সামলে উঠবে কিভাবে?
পুরোটা বলা শেষে কোমল অস্থিরচিত্তে বলল,
” তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি প্যাকেটটা নিয়ে আসি। ”
নিবিড়ের বাঁধন থেকে ছুটতে চাইল কোমল, পারল না। বাঁধন আলগা হওয়ার বদলে আরও শক্ত হয়ে আসছে। সে নরমসুরে আবার বলল,
” ছাড়ো আমাকে। ”
নিবিড় ছাড়ল না। কোনো সাড়াশব্দও করল না। কোমল খেয়াল করল, নিবিড়ের শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে গেছে। পুরো ভর ছেড়ে দিয়েছে তার উপর। সে পিছনে সরলেই নিবিড় ঝুকে যাচ্ছে। নিবিড়ের বন্ধ চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলল, ‘ ঘুমিয়ে পড়েছে! ‘ কোমলের অস্থিরতা হারিয়ে গেল। উত্তেজনা মিইয়ে গেল। শান্ত চোখে আরও একবার পুরো কক্ষটায় চোখ ঘুরিয়ে আনল। চারপাশ নির্জন, নিস্তব্ধ। খোলা জানালা দিয়ে রাতের হাওয়া উড়ে আসছে। দূরের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে একটা সম্মোহন সুর। কোমল কেমন এক আচ্ছন্নতায় ডুবে গেল। একস্থির চেয়ে থাকল নিবিড়ের নিদ্রিত মুখটায়। চেয়ে থাকতে থাকতে আবিষ্কার করল, এই মুখটা তার চেনা নয়। চোখগুলো আলাদা। চোয়াল ভর্তি গাম্ভীর্য, ঠোঁটদুটো সরস। কোমলের গাঢ় দৃষ্টি কেঁপে উঠল হঠাৎ। বজ্রাহত হলো যেন। এক ঝটকায় সরে যেতে চাইল নিবিড়ের কাছ থেকে। ব্যর্থ হলো। আকস্মিক টানে নিবিড়ের গাঢ় ঘুম হালকা হলো। মাথাটা একটু তুলে পাশ বদলে নিল। কোমলের নরম পেটে আগের চেয়েও গভীরভাবে নাক ডুবিয়ে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেল। কোমল স্তব্ধ দৃষ্টিতে পুরোটা পর্যবেক্ষণ করল। সরল মুখটায় রাগ জমাট হতে গিয়েও হলো না। বিরক্ত আসতে গিয়েও আসল না। কিন্তু এভাবে তো দাঁড়িয়ে থেকে কারও ঘুমানো দেখা যায় না। একটা জরুরি বিষয়ে আলোচনাও চলছিল। সেটা শেষ করা দরকার। কোমল মাথা নামিয়ে আনল নিবিড়ের কানের কাছটায়। জোরে ডাকলে যদি ভয় পায়, তাই মৃদু স্বরে ডাক দিতে চাইল। ঠিক তখনই মনে পড়ল মোহন কাকার কথা। নিবিড় সারারাত জেগে থাকে। রাতভর রুমে হাঁটাহাঁটি করে। এতরাত জেগে থাকার কারণ-ই বুঝি এই? ক্লান্ত চোখদুটি অবশেষে ঘুমানোর ফুরসত পেল! আরাম পেল! এই দীর্ঘ সময়ের পর নিশ্চিন্তমনে নিদ্রাভঙ্গের কারণ হতে চাইল না সে। আবার এভাবে দাঁড়িয়ে সারারাত কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। নিবিড়ের জায়গায় অন্য কেউ হলে চেষ্টা করা যেত। এখন নিবিড়ের সময় ভালো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি প্রতিকূলে। কোনো নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা একদমই অনুচিত। কোমল ডাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করল। সাবধানে হাত বাড়িয়ে বালিশ এনে রাখল ঠিকঠাক অবস্থানে। নিবিড়ের কাঁধ ধরে সরাতে গিয়ে বুঝল আগে হাতদুটো আলগা করা দরকার। তাই কাঁধ ছেড়ে কোমর জড়িয়ে রাখা হাতদুটোতে হাত রাখল। ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিতেই আচমকা তার বোরকা খামচে ধরল দুইহাতে। কোমল সেই হাত ছাড়াতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হলো। একহাত ছাড়িয়ে নিলে অন্যহাতে আবার কাপড় খামচে ধরছে। একসময় অধৈর্য্য হয়ে নিবিড়ের হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে নিল। এই পন্থা কাজে লাগল দারুনভাবে। কাপড় খামচে ধরা থেকে বিরত হলো। একইভাবে দুইহাত বন্দি করে তাকে যখন বালিশে শুয়াল তখন আরেক বিপত্তি ঘটল। কাপড় ছেড়ে দিলেও কোমলের হাত ছাড়ছে না। চেষ্টা করতে করতে দরজার দিকে তাকাল। ভেতরে আসার সময় দরজার পাল্লা ভিজিয়ে দিলেও সিটকিনি তুলে দেয়নি। এভাবে আর কতক্ষণ থাকবে সে? যদি নিবিড়ের মা চলে আসে? তিনি নিশ্চয় কোমলের জন্য অপেক্ষা করছে। কোমল বাধ্য হয়ে নিবিড়কে ডাকল ক্ষীণ গলায়। নিবিড় সজাগ হলেও চোখের পাতা মেলল না। ভার ও অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” বাবা, ঘুমাতে দেও। ”
কোমল থতমত খেল। পরক্ষণেই একটা বিষাদের বাতাস বয়ে গেল মুখজুড়ে। মায়া ছড়িয়ে পড়ল মুখে, চোখের চাহনিতে। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল নিবিড়ের পাশে। একপলক তার দিকে চেয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল দরজায়। ভাবল, রাত বেশ গভীর। এইসময় এবাড়ি অন্যকেউ আসবে না। কাকিমাও হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর যদি এসেই পড়ে তাহলে বুঝিয়ে বলবে, তিনি নিশ্চয় বুঝবেন। নিবিড়কে তো তিনিই বড় করেছেন কোলেপিঠে করে। তার কাজকর্ম সম্পর্কে অবশ্যই অবগত। সেই হিসেবে খুব খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। কোমল নিজেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এভাবে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। ঘুমের মধ্যে যদি হাত ছেড়ে দেয় তাহলে তখনই বেরিয়ে যাবে, নয়তো ভোরের দিকে নিবিড়কে ডেকে দিবে।
চৌকির পেছনে পিঠ ঠেকাতেই নিবিড় তারদিকে মুখ করে শুলো। সে তাৎক্ষণিক আরেকটা বালিশ টেনে এনে নিজেদের মধ্যিখানে রাখল। জায়গা সীমিত হওয়ায় বালিখ রাখল খাড়া করে। দুজনের আঙুলে মিলিত হাত দুখানা পড়ল বালিশের তলায়।
_______________
ভোরের পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙল নিবিড়ের। চোখ মেলে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে থমকে গেল অকস্মাৎ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নারী মুখটায়। তার পাশে একটি মেয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। বালিশ মাথার নিচে দেওয়ার বদলে কোলবালিশ বানিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। এত স্বল্প জায়গা দখল করেছে যে দেহের অর্ধাংশ বালিশের মধ্যেই পড়ে আছে। নিবিড় বিস্ময়াভিভূত হয়ে উঠে বসল। এই মেয়েকে সে চেনে না। গ্রামে দেখেছে বলেও মনে হচ্ছে না। তাহলে সে তার রুমে আসল কী করে? আবার তার পাশেই শুয়ে আছে। নিবিড় কিঞ্চিত বিচলিত হলো। দ্বিধায় পড়ল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকেই মাকে ডাকতে যাচ্ছিল। তখনই নজর পড়ল মেয়েটির পরিহিত কাপড়টির উপর। এমন কালো রঙের বোরকা তো কোমল পরে! নিবিড় চিন্তায় পড়ে গেল। সন্দেহি চোখে মেয়েটির আপাদমস্তক দেখে নিল দ্রুত। মুখ এগিয়ে নিয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল মেয়েটির বন্ধ চোখজোড়ায়। কৃষ্ণ অখিপল্লবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠোঁটজোড়ায় হাসি ফুটল। আলতোভাবে বালিশে মাথা রেখে মধুর করে ডাকল,
” বিবি? ”
কোমলের ঘুম ছুটে গেল। হুড়মুড়ে উঠতে গেলে নিবিড় দ্রুত বলল,
” নড়ছেন কেন? আমার বিবিকে মনভরে দেখতে দিন। ”
কোমল মুখে হাত দিল ঝটপট। নিকাব নেই। ঘুমের মধ্যে খুলে গেছে হয়তো। সে মরিয়া হয়ে খুঁজতে নিলে নিবিড় দুষ্টু হেসে বলল,
” পাবেন না। ”
কোমল সে কথা গুরুত্বে নিল না। মাথা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক খুঁজে না পেয়ে উঠে সরে যেতে চাইল। সে সুযোগ হলো না। নিবিড় নিজের মাথাসহ বালিশ নিয়ে রাখল কোমলের কোলে। অনুযোগের সুরে বলল,
” আপনি কিন্তু কথার খেলাফ করছেন। ”
কোমল সপ্রশ্নে তাকালে নিবিড় আবার বলল,
” কথা ছিল, আমি সেদিন আপনাকে দেখতে পারব, যেদিন আপনি নিজ থেকে দেখাবেন। ”
কোমল মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। দুইহাতে বালিশ ধাক্কা দিতে দিতে বলল,
” আমি ইচ্ছে করে দেখাইনি। দুর্ঘটনা। তাছাড়া, শর্তে ছিল, তোমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর…”
কোমলকে কথা শেষ করতে দিল না নিবিড়। বালিশ থেকে মাথা তুলে দুই হাতের কনুই ফেলে উপর হলো। বলল,
” পড়াশোনা কোনো বিষয় নয়, আপনি চেয়েছিলেন আমি প্রাপ্তবয়স্ক হই। যেটা আমি হয়েছি। এখন আমার বয়স একুশ। ”
কোমল কিছু একটা বলতে চেয়েছিল তার আগেই নিবিড় জোর দিয়ে বলল,
” প্রাপ্তমনস্কও হয়েছি। বিশ্বাস না হলে দুলাল ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। ”
” দুলাল ভাই কে? ”
” আমার রুমমেট। যার নাম্বারে আপনি দুইবার কল করেছেন। ”
কোমল চিনতে পারল কী পারল না সেই চিন্তা বাদ দিয়ে বলল,
” কী হলাম, কী হলাম না, এতকিছুর হিসেব করতে পারব না। আপনি বলেছিলেন, আপনাকে দেখার পর যদি আমার পছন্দ হয় তাহলে আইনমনে বিয়ে হবে আমাদের। ”
” তুমি আবার জেদ করছ। ”
” হ্যাঁ, করছি। আপনাকে বশ করার জন্য আমার একমাত্র অস্ত্রই হলো এই জেদ। মা সবসময় বলতো আপনার মন নাকি খুব নরম। সহজে কাউকে দুঃখ দেন না, ফিরিয়ে দেন না। অথচ আমি সেই মনের দেখাই পেলাম না! ”
নিবিড়ের দুঃখ প্রকাশে কোমলের দুঃখ হলো না। হাসি পেল খুব। হাসলে ছেলেটা প্রশ্রয় পাবে তাই গোপন করে বলল,
” তুমি কিন্তু সকল শর্ত ভেঙে ফেলেছ। ”
নিবিড় নিরুদ্বেগে বলল,
” আমি শাস্তি নিতে প্রস্তুত। ”
” তাহলে তালাক দেও। ”
নিবিড় বালিশের থেকে ভর সরিয়ে উঠে বসল। সুধীর গলায় সুধাল,
” আপনি সত্যি চালাক চান? ”
কোমল নীঃশব্দে মাথা নাড়লে নিবিড় আবার বলল,
” অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে না। আমার চোখে চোখ রেখে বলুন, আপনার তালাক চাই। তাহলে এখন, এই মুহূর্তে আপনাকে মুক্ত করে দেব। ”
কোমল ধীরে ধীরে তাকাল নিবিড়ের দিকে। চোখে চোখ রাখলেও তালাকের কথাটা সহজে উচ্চারণ করতে পারল না। নিবিড় সেই চোখে চেয়ে থেকে বলল,
” আপনি মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ঠিকই স্বীকার করেছেন, নাহলে সকলের আড়ালে আমার রুমে আসতেন না। আমার সামনে বসে থাকতেন না। আমার দুঃখে, দুঃখ পেতেন না। আচ্ছা, এই গ্রামে তো অন্যদের বাবারাও মারা গিয়েছে, আপনি কি তাদের কাছে ছুটে গিয়েছেন? নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়ে সেই বাড়িতে পড়ে ছিলেন? রান্না-বান্না করে খায়িয়েছেন? সেই বাবার ছেলের জন্য এত চিন্তা করেছেন? তার রুমে ঘুমিয়েছেন? ”
কোমল উত্তর দিতে পারে না। মাথা নিচু করে ফেললে নিবিড় নরম স্বরে বলল,
” এসবকিছু আমাদের জন্য করেছেন। কারণ, আপনার মন মেনে নিয়েছে, আমি আপনার স্বামী, এটা আপনার শ্বশুরবাড়ি। ”
নিবিড়ের কণ্ঠে স্বামী শব্দটা শুনতেই কোমল মাথা তুলল ঝটিতে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলে নিবিড় বলল,
” আমি ছোটবেলা থেকেই আপনাকে দেখতে চাইতাম খুব। সেজন্য কত কাণ্ডকারখানা করেছি, তার হিসেব নেই। বিয়ে হওয়ার পর সেই চাওয়া আরও গভীর হয়েছে, প্রতিজ্ঞায় রূপ নিয়েছে। ছটফট করেছি প্রতিটা মুহূর্তে। তারমানে এই নয় যে, আপনি দেখতে কতটা সুন্দর বা কুৎসিত সেটা দেখতে চাইতাম। আমি তো শুধু আমার বিবির মুখের গড়নটা দেখতে চেয়েছি, যাতে শয়নে-স্বপনে তাকে কল্পনা করে বছরের পর বছর পার করে দিতে পারি। ”
কোমলের বিস্ময় দৃষ্টি মুগ্ধতায় রূপ নিল। নিবিড় চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
” আমি নাহয় বোকা, কিছু বুঝি না। শুধু জেদ করি। কিন্তু আপনি তো বুদ্ধিমতি, সবকিছু বুঝেন, প্রাপ্তমনস্ক। তাহলে আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, এই মুহূর্তে আপনার সান্নিধ্য আমার কতটা দরকার! ”
______________
অনড়া দুইদিন যাবৎ মোল্লাবাড়িতে ঘুরঘুর করছে। কোমলকে খুঁজছিল একটা বিশেষ তথ্যের জন্য। কিন্তু তথ্য তো দূর তার দেখাও মিলছে না। তাই বাধ্য হয়ে রাবেয়া খাতুনকে জিজ্ঞেস করল,
” আন্টি, আমার নামে কি কোনো চিঠি এসেছে? ”
” আমি তো বলতে পারব না। কোমলকে জিজ্ঞেস কর। তোর আঙ্কেল এসব চিঠিপত্র কোমলকে দিয়েই পড়ায়। ”
অনড়া মনখারাপ করে বলল,
” বুবু রুমে নেই। ”
” ঐবাড়িতে যা। নিবিড়ের বাবা মারা যাওয়ার পর ও ঐখানেই থাকছে। ”
অনড়া মোল্লাবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। নিবিড়ের বাবা মারা গেছে, সে শুনেও দেখতে যায়নি। লাশ দেখতে তার ভয় লাগে। ঘুমাতে পারে না। শরীর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। মরাবাড়ির গন্ধে তার বমিও হয়। তাই ছোটবেলা থেকেই এসব থেকে দূরে থাকে। অনড়া নিজের বাড়ির দিকে ফিরতে মনে পড়ল, সেদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় নিবিড়কে দেখেছিল রাস্তায়। দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি যাচ্ছিল। এখনও নিশ্চয় আছে। বুবুও তো ঐবাড়ি। এই সুযোগে বিয়ে করে নিলে কেমন হয়? এতদিনে মরাবাড়ির গন্ধ নিশ্চয় চলে গেছে। লাশ দাফন হয়েছে তিনদিন হয়ে গেছে। নিবিড়ও মনে হয়, একটু স্বাভাবিক হয়েছে। এখন বিয়ের কথা বলা-ই যায়। সে বললে যদি আবার রেগে যায়? মার দিয়ে বসে? অনড়া ঠিক করল, বিয়ের কথাটা বুবুকে দিয়ে বলাবে। তার বুবু অনেক ভালো, বয়সেও বড়। নিবিড় চাইলেও রাগ করতে পারবে না।
অনড়া আনন্দমনে ছুটে গেল নিবিড়দের বাসায়। বেলা খুব বেশি হয়নি বিধায় আশেপাশে কাউকে দেখল না। ধরে নিল সকলে ঘুমিয়ে আছে। তার তো আবার ধৈর্য্য কম। তাই বুবুকে ডাকতে লাগল। ডাকতে ডাকতে একটা দরজা ধাক্কা দিল। খুলে গেল সহজেই। সে কণ্ঠে বুবু ডাক নিয়েই ভেতরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মতো শক্ত হয়ে এলো তার দেহ। চোখদুটো বড় বড় করে দেখল, তার বুবু নিবিড়ের সামনে বসে আছে। মুখে নেকাব নেই। একটা হাত নিবিড়ের দুই হাতে বন্দি।
অনড়ার হঠাৎ আগমনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল নিবিড়। কোমলের হাত ছেড়ে চৌকি থেকে নামল ঝটপট। বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে বলল,
” আপনি শাস্তির ব্যবস্থা করুন, আমি বিয়ের ব্যবস্থা করছি। ”
চলবে
[