#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৫)
” কী হয়েছে, কোমল? ”
কোমল দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। থমথমে গলায় বলল,
” ভেতরে এসো। ”
নিবিড় ভেতরে ঢুকল মুমূর্ষু রোগীর মতো। ভীত দৃষ্টি আঠার মতো এঁটে আছে কোমলের নিষ্প্রভ মুখটায়। পলক ফেলছে না পর্যন্ত। দৃষ্টি সরলে কিংবা পলক ফেললে গর্হিত অন্যায় হয়ে যাবে এমন ভাব। ঘামে ভেজা শরীরটা আরও একবার ঘেমে উঠছে। কোমল দরজা আটকে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে গেল। এক গ্লাস পানি এনে নিবিড়ের হাতে দিয়ে বলল,
” বসে খাও। ”
নিবিড় যন্ত্রমানবের মতো মাটিতে পাতা বিছানায় গিয়ে বসল। ঢকঢক করে পুরো পানি পান করে বলল,
” এবার তো বলুন, কী হয়েছে। ”
নিবিড়ের কাতর কন্ঠস্বর, করুণ চাহনিতে মাথা ঝুঁকে এলো কোমলের। কী একটা বলার জন্য ঠোঁটদুটি কেঁপে থেমে যাচ্ছে বারবার। পায়ের নখ দিয়ে মেঝে খুঁটতে খুঁটতে ব্যথা হয়ে আসল তবুও সেই কথাটি বলা হলো না। নিবিড় স্থির থাকতে পারল না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। আচমকা স্ত্রীর হাতদুটো মুষ্ঠিতে বন্দি করল। ভীষণ অসহায় সুরে বলল,
” আপনার এই নীরবতা আমার ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। দয়া করে বলবেন, কী হয়েছে? আমার মা ঠিক আছে তো? ”
কোমল ক্ষীণ স্বরে জানাল,
” হ্যাঁ, তিনি সুস্থ আছেন। ”
” আপনার বাবা-মা? ”
” তারাও সুস্থ। ”
” তুমি? তুমি, ঠিক আছ? ”
কোমলের মনোযোগ পাওয়ার জন্য নিবিড় মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ‘ তুমি ‘ করে ডাকে। এই ব্যাপারটি কোমল ধরতে পেরেছে অনেক আগেই। তবুও অনুযোগ তুলেনি। মনে মনে খুশি হয়েছে এই ভেবে যে, তার ইচ্ছেপূরণের চেষ্টা করছে। হয়তো একদিন ইচ্ছে করে নয় মন থেকেই বলবে। সেই দিনটি বোধ হয় আজ। কোমলের আনন্দ হওয়া উচিত। খুশিতে একগাল হাসা উচিত। অথচ হলো উল্টো। অনচ্ছ মুখটা বিমর্ষতায় ঢেকে গেল। চোখের তারা ঘোলাটে হয়ে আসল। অবশ কণ্ঠটা কাঁপতে থাকল। নিবিড় হাত ছেড়ে কোমলের বাজু চেপে ধরল। হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে ব্যগ্র ভাবে বলল,
” আমি আর নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে কেউ আমার গলা চেপে ধরছে! ”
কোমল চোখ বন্ধ করে ফেলল। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” আমি অন্তঃসত্ত্বা। ”
কোমলের বাজু ছেড়ে দিল নিবিড়। অবাস্তব কিছু দেখে ফেলেছে এমনভাবে চেয়ে থাকল কোমলের মুখটায়। অনেকটা সময় বিমূঢ় থেকে ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। দৃষ্টি অন্যদিকে সরে গেলেও নিষ্পলক রয়েছে। বাকশক্তি হারিয়ে মূর্তির মতো বসে থাকলে কোমল ধীরে ধীরে বসল তার সামনে। অসহায়ভঙ্গিতে বলল,
” বিশ্বাস করো, ইচ্ছাকৃত হয়নি এটা। আমি প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলাম। তবুও কী করে যে হয়ে গেল! ”
নিবিড় নিশ্চুপ থাকলে কোমলের চোখে অশ্রু জমতে শুরু করল। কেঁদে ফেলবে এমনভাবে বলল,
” আমি সবসময় তোমার ভালো চেয়ে এসেছি। ঝামেলা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু এবার! আমি নিজেই তোমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছি। মাফ করে দেও। ”
কোমল একটু চুপ থেকে উগ্র হয়ে বলল,
” মাফ করো না। শাস্তি দেও। এমন অন্যায়ের জন্য কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত আমার। এত বড় ভুল কী করে করলাম? নিশ্চয় অসতর্ক হয়েছিলাম আমি। সামান্য অসাবধানতার জন্য এত বড় বিপদ ডেকে আনলাম। ”
কোমলের অপরাধ স্বীকারের মধ্যে নিবিড় জিজ্ঞেস করল,
” ভ্রূণের বয়স কত? ”
নিবিড়ের কণ্ঠস্বরে কোমল শক্তি পেল। ভয় দূর হলো খানিকটা। উৎসাহ নিয়ে বলল,
” বেশি হয়নি। পাঁচ-ছয় সপ্তাহ হবে। সহজেই নষ্ট করা যাবে, তাই না? আমি সেজন্যই এখানে এসেছি। আমাদের গ্রামে তো ভালো ডাক্তার নেই। হাসপাতাল দূরে। তারমধ্যে বাবার পরিচিতরা অনেকেই আছে সেখানে। যদি কেউ জানতে পারে, পুরো গ্রামে ছড়িয়ে যাবে। এখানে সে ভয় নেই। নিশ্চয় তুমি ভালো হাসপাতাল কোনটা জানো। সেখানে গিয়ে কথা বলে এসো আগে। তারপর আমাকে নিয়ে যেও। ”
নিবিড়কে তাড়া দিলেও তার দিক থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। কোমল উঠে দাঁড়াল। নিবিড়ের একহাত ধরে টান দিলে সে চোখ তুলে তাকাল। নির্মল চাহনি রাখল কোমলের পেটে। অন্যহাত দিয়ে সেখানে স্পর্শ করে বলল,
” এখানে সত্যি আরেকটা প্রাণ আছে? ”
কোমল থতমত খেল। নিবিড়ের হাত ছেড়ে দিল আনমনে। সে দুর্বোধ্য কৌতূহলে সুধাল,
” সেই প্রাণ একটু একটু করে মানুষের রূপ নিবে। হাত হবে, পা হবে, চোখ হবে, মুখ হবে। তারপর পৃথিবী দেখবে, তাই না? ”
কোমল বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারল না। নিবিড় পূর্বের চেয়েও দ্বিগুন উৎসাহে সুধাল,
” সেই হাতে আমাকে স্পর্শ করে, পা দিয়ে টুকটুক করে হাঁটবে। মুখ দিয়ে বাবা বলে ডাকবে। ঠিক যেমন আমি বাবাকে ডাকতাম। আপনাকেও তো মা বলে ডাকবে, কোমল। তখন আপনার কেমন লাগবে? বাচ্চাদের শরীর খুব নরম হয়, তাই না? আমি ধরলে তো ব্যথা পাবে। আমি ধরব না। আপনি ধরবেন, কেমন? আপনার হাত নরম আছে। ব্যথা পাবে না। আমি শুধু দূর থেকে আদর করব, ভালোবাসব। খুব সাবধানে চুমু খাব। ”
কোমলকে টেনে বসিয়ে দিল নিবিড়। বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
” ও যখন পৃথিবীতে আসবে তখন খুব ছোট হবে। আপনি এত ছোট্ট বাবু দেখেছেন আগে? ছুঁয়েছেন? আমি দেখিনি কখনও। শুনেছি আর বইয়ে পড়েছি। আমার তো বিশ্বাস-ই হচ্ছে না, এতদিন যাবৎ বইয়ে যা পড়েছি, এখন সেটা বাস্তবে দেখব। এই কোমল, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? স্বপ্ন হলেও দুঃখ পাব না। এমন মিষ্টি স্বপ্ন দেখার জন্যও তো ভাগ্য লাগে। ”
” তুমি স্বপ্ন দেখছ না। ”
নিবিড়ের বিস্ময় আকাশ ছুঁলো। চোখ বড় বড় করে সুধাল,
” এসব সত্যি? ”
কোমল মাথা উপরনিচ করলে নিবিড় উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে ছুটে যেতে যেতে বলল,
” আমার তো মনে হচ্ছে, আপনিও আমার স্বপ্ন! ”
বলতে বলতে দরজা টেনে বেরিয়ে গেল। চপল চিত্তে বড় রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করে ফিরে এলো। পূর্বের মতো কোমল দরজা আড়াল করে দাঁড়ালে নিবিড় জড়িয়ে নিল তাকে। আপ্লুত স্বরে বলল,
” স্বপ্নে নয় বাস্তব। সত্যি আমাকে কেউ বাবা বলে ডাকবে! আমাদের জীবনে একটা আদুরে প্রাণ আসবে। ”
নতুন খুশিটা যেন নিবিড়কে পাগল করে দিয়েছে! প্রায় ঘণ্টাখানেক সেই খুশির ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে চলল। বৃষ্টির মতো ছুটে চলা আনন্দ বুলিতে বিঘ্ন ঘটানোর সুযোগ পেল না কোমল। চুপচাপ সবটা শুনে গেল বিভোর হয়ে। এক মুহূর্তের জন্য নিজের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেও ক্রমে ফিরে আসে আবার। নিবিড়ের বয়স, পড়ালেখা, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ ধাপে ধাপে জায়গা করে নিল তার চিন্তা-ভাবনায়।
” আপনি কি এই সংবাদ দিতে এখানে এসেছিলেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” অন্যকিছু না? ”
” না। ”
” তাহলে আপনার মুখ দেখে আমি ভয় পেলাম কেন? চোখ-মুখ কেমন করে রেখেছিলেন জানেন? আমি তো ভেবেছিলাম, আগের মতো কোনো মৃত্যু সংবাদ…”
নিবিড় ইচ্ছে করে বাক্যটা শেষ করল না। কোমল কথা বলার সুযোগ পেল। এখানে যে শুধু সংবাদ দিতে নয় সেই সংবাদটা মিটিয়ে দিতে এসেছিল তা আরও একবার উচ্চারণ করল। সাথে এটাও বুঝিয়ে বলল, এই মুহূর্তে একটা নতুন সদস্য আগমনের ফলে তার ভবিষ্যৎ কতটা ঝুঁকিতে পড়বে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, গোছানো পরিকল্পনা অগোছাল হবে। নিবিড় এসবে কোনো পাত্তা দিল না। জিজ্ঞেস করল,
” আমাকে প্রথম জানিয়েছেন? ”
” হ্যাঁ। আমি চেয়েছিলাম, আমার আর তোমার মধ্যেই গোপন রাখতে। ”
” এটা গোপন রাখার মতো ব্যাপার? সবাই জানলে কত খুশি হবে জানো? তুমি সকলকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছ? ”
নিবিড় কোমলের পাশ থেকে সরে গেল। টেবিলের উপর থেকে মোবাইল তুলে নিলে কোমল জিজ্ঞেস করল,
” কাকে কল করছ? ”
” তোমার বাবাকে। আমি নিশ্চিত, তুমি কাউকে না জানিয়ে এখানে এসেছ। ”
কোমল মাথা হেঁট করে নিল। নিবিড় আনিস মোল্লাকে কোমলের তথ্য দিয়ে কল কেটে বলল,
” সুসংবাদটা সরাসরি দিলে বেশি ভালো হবে, তাই না? সামনেই তো আমার নিমন্ত্রণের তারিখ। তখন গিয়ে জানাব। ”
কোমল উত্তর দেওয়ার বদলে উঠে দাঁড়াল। নিবিড়কে বুঝানোর চেষ্টা করল আরও একবার। সে কোমলের হাত ধরে টেনে নিল নিজের কাছে। একহাতে কোমর জড়িয়ে কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
” এতদিন আমার দায়িত্ব নিয়েছেন, এখন নাহয় আমার সন্তানের নিবেন। সুযোগ বুঝে আমরা দুজন মিলে সব শোধ করে দেব। ”
কোমল কিছু একটা বলতে চাইলে নিবিড় থামিয়ে দিল। আশ্বাসের সুরে বলল,
” আমার পাগলামিকে ভয় পাচ্ছেন তো? সেটা নাহয় আরও কিছুদিন বন্দি থাকবে। কথা দিচ্ছি, এখন যেমন শান্ত আছি তেমনই থাকব। ”
” এখন শান্ত আছ? ”
কোমলকে ছেড়ে দিল নিবিড়। অন্যদিকে সরে বলল,
” এই জীবনে আমার প্রশংসা করবেন বলে মনে হচ্ছে না! ”
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৬)
” এখনই চলে যাবেন? ”
কোমল শুকনো কণ্ঠে উত্তর দিল,
” হ্যাঁ। ”
নিবিড়ের মনখারাপ হলো। সমুজ্জ্বল মুখটা উজ্জ্বলতা হারাল এক নিমিষেই। কোমলের দিকে এগিয়ে গেলে সে চটজলদি বলল,
” এমনিতে কাউকে না জানিয়ে চলে এসেছি, সবাই দুশ্চিন্তা করছে হয়তো। তাছাড়া আমাদের তো এখন দেখা হওয়ার কথা ছিল না। ”
” কেউ দুশ্চিন্তা করছে না। এখন তারা জানে, আপনি আমার কাছে আছেন। দেখা হওয়ার কথা ছিল না, তবুও হয়েছে। আমাদের উচিত…”
নিবিড়কে কথাটা শেষ করতে দিল না কোমল। দ্রুত বলল,
” তুমি বলেছিলে কোনো পাগলামি করবে না। ”
নিবিড় সরে গেল কোমলের কাছ থেকে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলল,
” তৈরি হোন, আমি বাসে তুলে দিয়ে আসব। ”
স্বামীকে অখুশি অবস্থায় রেখে যেতে মনে বাঁধা পাচ্ছে কোমল। তোষামোদ করতে বলল,
” রাতে কী খাবে বলো। রান্না করে দিয়ে যাই। ”
” প্রয়োজন নেই। আপনার দেরি হয়ে যাবে। একা এতদূর যাবেন, রাত করা যাবে না। ”
নিবিড়ের কণ্ঠ বেশ কঠিন, দুরধিগম্য। পাথরের মতো শক্তভাবটা টলাতে পারবে না বলে বোধ হলো কোমলের। ছোট্ট নিশ্বাস ত্যাগ করে বোরকা পরে নিল। নিবিড়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মিষ্টিস্বরে সুধাল,
” জড়িয়ে ধরব একটু? ”
নিবিড়ের শক্তভঙ্গি বরফের মতো গলে গেল। কোমলকে বুকে চেপে ধরল শক্ত করে। আর্দ্র স্বরে বলল,
” মিলন ও বিচ্ছেদের পর্ব আর কত চলবে? ”
” আরও দুই বছরের মতো। ”
” কোটি কোটি বছর পার করে আসার পরও দুই বছর বাকি? ”
কোমল হেসে ফেলল। আপনমনে উচ্চারণ করল, ‘ পাগল একটা! ‘
” কিছু বললেন? ”
” না, এবার বের হই? ”
কোমলকে একহাতে জড়িয়ে রেখে দরজার দিকে এগুলো নিবিড়। অল্প অল্প পাগলামি চলল বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত। টিকেট কেটে সিট খুঁজে বের করল নিবিড়। কোমলকে সেখানে বসিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে সে শঙ্কিত গলায় বলল,
” বাস ছেড়ে দিবে তো! নামো। ”
” আগে ছাড়ুক। ততক্ষণ অপেক্ষা করি। চলন্ত বাস থেকে নামার অভ্যেস আছে আমার। ”
কোমলের শঙ্কা বেড়ে গেল। নিবিড়কে নামার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করল। সেই সময় বাসের ইঞ্চিন চালু করল গাড়িচালক। নিবিড় অনিচ্ছা স্বত্তেও নামতে বাধ্য হলো। কোমল জানালা দিয়ে চেয়ে দেখল, নিবিড় নিরাপদে নেমেছে। শঙ্কাটা দু-হাতে ঢলে দিয়ে হাসার চেষ্টা করল। চোখের ইশারায় বিদায় নিলে নিবিড় চিৎকার করে বলল,
” আমার ভালো লাগছে না। থেকে যান।
ততক্ষণে বাস ছেড়ে দিয়েছে। কোমল জানালা দিয়ে মাথা বের করলে নিবিড় পূর্বের চেয়েও দ্বিগুন চিৎকারে বলল,
” এটা আমার অনুরোধ না, আদেশ। ”
কোমল বাস থামিয়ে নেমে এলো। নিবিড় খুশিতে ঝলমল করে উঠল। দৌড়ে স্ত্রীর নিকট ছুটে আসলে সে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। পুরো রাস্তায় নীরব থেকে ফিরে গেল নিবিড়ের বাসায়। দরজা খুলে সোজা ঢুকল রান্নাঘরে। রান্নার উপকরণ গুছাতে ব্যস্ত হলো একনিষ্ঠতায়। স্ত্রীর রাগের কারণ জানা সত্ত্বেও ভাঙাতে অক্ষম হলো। চেয়ার টেনে পড়তে বসে বলল,
” কথা বলবেন না তো? ঠিক আছে, আমিও বলব না। আপনি আপনার কাজ করুন, আমি আমার কাজ করি। দেখি, কে জিতে। ”
নিবিড় বই মেলে গলা ছেড়ে পড়তে থাকল। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে রাত নয়টায় ঠেকেছে। কোমল রান্না শেষ করেছে অনেক্ষণ। থালায় ভাত বেড়ে নিবিড়ের অপেক্ষা করছে। সে খাবে তো দূর, সেদিকে তাকাচ্ছেই না। একনাগাড়ে পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠেছে। কণ্ঠ শুনাচ্ছে মোটা, ক্লান্ত। কোমল নিজেই উঠে গেল নিবিড়ের কাছে। রাগ বজায় রেখে একস্থির চেয়ে থাকল তার শ্রান্ত মুখটায়। চেয়ে থাকতে থাকতে কী যে হলো কে জানে! আচমকা বসে পড়ল নিবিড়ের কোলে। বুকে মাথা রেখে চুপটি করে রইল। নিবিড় তখনও বই পড়ছে। কোমলকে দেখতেই পায়নি এমন ভাব। কোমল অনেক্ষণ চুপচাপ থেকে নিবিড়ের বই বন্ধ করে দূরে সরিয়ে রাখল। নিবিড় বিরক্তের ভান ধরে বলল,
” পড়তেও দিবেন না? ”
কোমল হালকা গলায় উত্তর দিল,
” না। আমি যতদিন আছি ততদিন আপনার ছুটি। ”
নিবিড়ের পরনে থাকা টি-শার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে পুনরায় বলল,
” ক্লান্ত লাগছে খুব। আপনার সাথে আমারও ছুটি চাই। দায়িত্ব থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্ত হতে চাই। আপনার বিবি হয়ে থাকি কিছুদিন? আপনার যা খুশি করুন, যেভাবে ইচ্ছে চলুন। এই কয়দিন আমার দিক থেকে কোনো বাঁধা থাকবে না, চাপ থাকবে না। ”
নিবিড় উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
” আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? ”
বলতে বলতে কোমলের কপালে, গলায় হাত রেখে তাপমাত্রা দেখে নিল। কোমল সেই হাত সরিয়ে বলল,
” কিছু হয়নি আমার। শুধু একটু ক্লান্ত। ”
নিবিড় টের পেল কোমল সবটুকু ভার তার উপর ছেড়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলছে। কপালের পাশে এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
” আপনি ছুটি দিলেও আমি গ্রহণ করব না। কখনই না। আপনার অধীনে থাকতে আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি। ”
কোমল মাথা তুলে বলল,
” উপহার ফেরত নিব? ”
” আপনি ঘুমাননি? ”
” ঘুমাতে দিচ্ছ? ”
” এখন কী করলাম? ”
নিবিড়ের দোষটা সামনে আনল না কোমল। আগের কথায় ফেরত গেল,
” উপহার ফেরত নেব? ”
” কিসের উপহার? ”
” বিবাহ বার্ষিকীর। ”
নিবিড় কপাল কুঁচকে ফেলল। একটুক্ষণ থম মেরে থেকে বলল,
” আমাদের বিয়ের চার বছর হয়ে গেছে? ”
” জি, সাহেব। ”
” কী উপহার এনেছেন? আমি তো দেখলামই না। আর আপনি ফেরত নেওয়ার কথা বলছেন! ”
কোমল দুষ্টু হেসে বলল,
” এই উপহার দেখা যায় না। ”
” কেন? ”
” আল্লাহ আমাদের সেই শক্তি দেননি তাই। ”
নিবিড় আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” বলাও যায় না? ”
” যায়। ”
” তাহলে বলুন। আমি শুনে ধন্য হই। ”
” সময়। আমি আপনাকে সময় উপহার দিচ্ছি। যে সময়টাতে শুধু আপনার ইচ্ছের প্রাধান্য থাকবে। ”
নিবিড় ভ্রূ কুৃঁচকে চেয়ে থাকল কোমলের মুখশ্রীতে। সেকেন্ড কয়েক পেরুতে কোমলের রহস্যঘেরা কথাবার্তা বুঝে ফেলে বলল,
” একটু আগে যে পড়াশুনা থেকে ছুটি দিলেন সেটাই আপনার উপহার? ”
” পছন্দ হয়নি? ”
” হয়েছে। কিন্তু তার আগে যে সুসংবাদটা দিলেন সেটা বেশি পছন্দ হয়েছে। ”
কোমল লজ্জায় লাল হলো। নিবিড়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললে সে বলল,
” এত বড় বড় দুটো উপহার দিয়ে আমাকে ঋণী করে ফেলেছেন। এখন তো আমারও উপহার দিতে হয়। ”
” লাগবে না। ”
” অবশ্যই লাগবে। বলুন, আপনার কী চাই। ”
” কিছু না। ”
” এমন বললে আমি কষ্ট পাব। আমি হয়তো দামী কিছু দিতে পারব না। কিন্তু শুনতে তো পারব? সামর্থ্য হলে ঠিক আপনার সামনে হাজির করব। ”
” ততদিন মনে থাকবে? ”
” বলেই দেখুন। ”
কোমল কিছু একটা মনে করার ভাব ধরে সময় কাটাল কিছুক্ষণ। সহসা বলল,
” এখন কিছু মনে পড়ছে না। ”
” আরেকটু ভাবুন, ঠিক মনে পড়বে। ”
” যখন পড়বে তখন বলব। ”
” কথা দিচ্ছেন? ”
” হ্যাঁ। ”
________________
মাঝরাতে কোমলকে পাশে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায় নিবিড়। হুড়মুড়ে উঠে বসতেই দেখে, সে জায়নামাজে বসে আছে। দু-হাত তুলে অঝোরে কাঁদছে। নিবিড় সাবধানে আগের ন্যায় শুয়ে পড়ল। স্ত্রীকে বিরক্ত করতে চাচ্ছে না কিছুতেই।
কোমল প্রায় ঘণ্টাখানেক পর নামাজ শেষ করল। জায়নামাজ ভাঁজ করে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়তে চোখে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ পেল। চমকে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি ঘুমাওনি? ”
নিবিড় উত্তর দেওয়ার বদলে এলোপাথাড়ি চুমু খেতে শুরু করল। কোমল হালকা বাঁধা দিয়ে বলল,
” কী হলো তোমার? ”
নিবিড় থামল। কোমলের চোখে চোখ রেখে বলল,
” আমি জানি নিজের সাথে কতটা যুদ্ধ করেছেন আপনি। একদিনে এই সিদ্ধান্তে আসেননি। বহুদিনের লড়াইয়ের পর শক্ত হতে পেরেছিলেন। ”
” কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছ? ”
” বাচ্চা নষ্ট করার সিদ্ধান্ত। ”
কোমল মিইয়ে গেল। একটা গাঢ় অনুতাপের পর্দা পড়ল মুখটায়। নিবিড় একগালে হাত রেখে বলল,
” সৃষ্টিকর্তার সম্পর্কে আপনার ভীরুতা চোখে পড়ার মতো। চাল-চলন, বেশভূষা প্রশংসনীয়। সেই আপনি তার দেওয়া উপহার নষ্ট করার সাহসিকতা দেখাতে চেয়েছিলেন? অকল্পনীয় না? নিজের সাথে খুব লড়লেন, যুদ্ধ করলেন। বুকে পাথর চেপে সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেললেন। তবুও সক্ষম হতে পারলেন না। একটা চাপা ভয় আপনাকে আমার সামনে হাজির করল। ”
” কী বলতে চাচ্ছ তুমি? ”
” আপনার যদি সত্যি বাচ্চাটা নষ্ট করার ইচ্ছে থাকত তাহলে আমার কাছে আসতেন না। এই সংবাদ আমার কানে পৌঁছানোর আগেই নষ্ট করে ফেলতেন। এতটুকু ক্ষমতা আপনার আছে। কিন্তু আপনি তেমনটা করেননি, আমার কাছে এসেছেন। কারণ, আপনার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমি আপনাকে আটকাব। আপনার ভুলটাকে ফুল ভেবে খুশিমনে কুড়িয়ে নেব। ”
কিছু একটা বলার জন্য কোমলের ঠোঁট কেঁপে উঠলে বাঁধা দিল নিবিড়। সেখানে আঙুল রেখে বলল,
” আপনার ভুল ছিল না। খোদার ইচ্ছে ছিল। তিনি চাচ্ছেন, আমরা এক হয়ে থাকি সারাজীবনের জন্য। দয়া করে কষ্ট পাবেন না। কাঁদবেন না। আপনি ফেরেশতা নন, মানুষ। ভুল হতেই পারে। মনে করুন, কিছু সময়ের জন্য সয়তানের বশে ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার দ্বারা মুক্ত হয়েছেন। ”
কোমল নিবিড়ের আঙুলে চুমু খেল। বুকের কাছে চেপে ধরে বলল,
” আমার খুব ভয় হচ্ছে, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন তো! ”
” ভয় নেই, আমি আছি আপনার পাশে। আলো-আঁধারে সবখানে আমায় দেখতে পাবেন। ”
চলবে
[