বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা ২ পর্ব -১২

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ১২

এক তৃতীয়াংশ পুড়ে যাওয়া ঘরটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ঘরের প্রাণ গুলো। ক্ষণে ক্ষণে কান্নার দাপটে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুষ্প, পত্র। তাদের সামলে নিচ্ছে বিন্নী। ছায়া শক্ত হাতে গুছিয়ে নিচ্ছে পুড়ে যাওয়া ঘরের অবশিষ্ট ধ্বংসস্তূপ টুকু। পুরোপুরি পুড়ে ছাঁই হয় নি। আগুন খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার ফলে আধপোড়া ঘরটা দাঁড়িয়ে আছে টলমলে ভঙ্গিতে। ছায়ার চিৎকার শুনে আশেপাশের মানুষ গুলো এসে সাহায্য করার কারণেই ঘরটাকে বাঁচাতে পেরেছে। তবে আগুন মোটামোটি ভালো ছড়িয়েছিল। ঝকঝকে টিনের চাল কালো রঙে ছেয়ে গেছে। কেবল পরিপূর্ণ ভাবে ঠিক আছে ছায়াদের রুমটুকু। আপাতত সবাই সেখানেই ঠাঁই নিয়েছে। ছায়া সন্দিহান চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সবটুকু। কড়াই থেকে এতটা আগুন লাগার কথা না। তার মনের সন্দেহ গাঢ় হলো, কিন্তু কিছু বোঝারও উপায় নেই।

সবটা গুছিয়ে ঘরে এসে স্বস্তির শ্বাস ফেললো ছায়া। পত্র তখন ঘরের এক কোণে জুবুথুবু হয়ে বসে চিকন স্বরে কাঁদছে। ছায়া সেখানে এক পলক তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“কাঁদছো কেন, অদ্ভুত! সব তো ঠিকই আছে।”

মায়ের গম্ভীর কণ্ঠে পত্রের কান্নার গতি বাড়লো। হেঁচকি তুলে বললো,
“আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলাম, মা। আমাদের সাথে এমন কেন হচ্ছে! পর পর এতগুলো বিপদ একসাথে?”

“এ গুলো সামান্য বিপদ। আমরা সামলে নিবো ঠিক। আচ্ছা, তুমি স্কুল থেকে এসে ঠিক কী দেখেছো?”

“আমি তো স্কুল থেকে এসে দেখি বাড়ির সদর দরজা পুরোটা খোলা। চারপাশ আঁধার করে কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বাড়ির ভেতরে এসে দেখি রান্নাঘরে ততক্ষণে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।”

ছায়া চুপ করে শুনলো মেয়ের কথা। কতক্ষণ ভাবলো কি যেন তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“বুঝলাম। তোমার কোথাও লাগে নি তো?”

“না।”

ছায়া উঠোনে নেমে গেলো আবার। কিছু শুকনো কাঠ নিয়ে আগুন জ্বালালো উঠোনের এক কিনারায়, ঘর থেকে নতুন বাসনপত্র নামিয়ে আনলো। ঠাকুর বাড়ির জেঠিমা বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“ওমা বৌ! রাঁধবা নাকি? এখন আর তোমার এসব করার দরকার নাই। অনেক ঝঞ্জাট গেছে। তোমরা বরং আমাদের সাথে চলো। আমাদের বাড়িতে খাবে।”

“না দিদি, তা কী করে হয়। আপনারা বরং আমাদের সাথে খাবেন আজ। একা মানুষ আর রান্নাবান্না করার প্রয়োজন নেই।”

ছায়ার কথা মানতে নারাজ জেঠিমা। তাই দু’জনের মাঝে বাক বিতণ্ডা হলো কিন্তু ছায়ার যুক্তির কাছে অবশেষে পরাজিত হলো জেঠিমা। অতঃপর হতাশ কণ্ঠে বললেন,
“ঠিক আছে, তোমার কথাই হবে। আমিও সাহায্য করছি রান্নায়।”

ছায়া রাজি হলো সে প্রস্তাবে। দু’জন হাত লাগালো রান্নায়। পত্র, পুষ্প, বিন্নী বসে রইলো ঘরে। পত্র এক দৃষ্টিতে জানালার বাহিরে তাকিয়ে রইলো। পুকুরের ঘাট খা খা করছে তখন নীরবতায়। পত্র বার কয়েক সেখানে তাকিয়ে রইলো। বাবার জন্য চিন্তাও হলো। কি জানি, বাবাটার কী অবস্থা। এক দৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পত্র দেখলো কোয়াটারে আসা শহরের ছেলেগুলো চারজনেই ঘাটে এসেছে। সবাই হাসা-হাসি করছে নিজ মতন। সিগারেটে নিজেদের সুখ উড়িয়ে দিচ্ছে। পত্র তাকিয়ে রইলো হাসতে থাকা আতস, নভ, কঙ্কর, গৌরবদের দিকে। এরা আসার পরই চা বাগানের সব উলোট পালোট হয়ে গেছে। এর মাঝে একজন মানুষের কাছ থেকে পত্রের জবাবদিহিতা নেওয়ার আছে। ধ্বংসের সূচনা তো সেই মানুষটার হাত ধরেই। পত্র আর প্রেমে অন্ধ থাকবে না।

ভাবতে ভাবতেই রাত নামলো প্রকৃতির বুক চিরে। ততক্ষণে সদর থেকেও খবর পাঠানো হলো সমিরবাবুর। মানুষটা প্রাণে বেঁচে গেলো বাম পা টা চিরতরে নিজের কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। তা শুনে আরেকদফা কান্নাকাটি করলো মেয়ে গুলো। ছায়া শক্ত হাতে সামলে নিলো তাদের। বিন্নী এবং ওর মা বেশ জোরাজুরি করলেন পত্রদের নিয়ে যেন ছায়া ওদের বাড়িতে থাকেন কিন্তু ছায়া রাজি হলেন না। বাড়িতে যতই নিরাপত্তার অসুবিধা হোক সে এখানেই থাকবে। অতঃপর ছায়ার কথা মেনেই বিন্নী এবং ওর মা ফিরে গেলো নিজ বাসগৃহে।

সময়টা তখন রাতের দ্বিতীয় ভাগ। বারোটা হয়তো বাজে। পুষ্প ও পত্র ঘুমিয়ে আছে ছায়াদের খাটে এবং ছায়া মাদুর পেতে শুয়েছেন নিচে। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় কেমন রাতের গভীরতা ছাড়াচ্ছে চার পাশে। ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে অনবরত। সেই গম্ভীর রাতের নিশ্চুতা ভেদ করে কয়েক জোরা পায়ের শব্দ শোনা গেলো পত্রদের বাড়ির আশপাশ জুড়ে। পত্র ও পুষ্পের চোখে তখন কেবল মাত্র দেখা দিয়েছিল ঘুমের আভাস। ছায়া কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। পায়ের শব্দ গুলো নিকটে ঘনিয়ে আসতেই ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো ছায়া। মাকে আচমকা উঠে বসতে দেখে পুষ্প ও পত্রও শোয়া থেকে উঠে বসলো। উৎকণ্ঠিত হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে মা? কী হয়েছে?”

ওদের প্রশ্নের উত্তরে ছায়া নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে সাবধানী চোখে ইশারা করলো চুপ থাকার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেলো মেয়ে দু’টি। ছায়া উঠে বসলো। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিলো। চারপাশের আঁধারের ভাব তখন কিছুটা হালকা হলো। পর পর অনেক গুলো পায়ের শব্দ যেন ঘুর ঘুর করছে চারপাশে। জানলা, দরজা বন্ধ থাকায় ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না কারা ঘুরছে। পুষ্প কিঞ্চিৎ ভীত হলো, মায়ের দিকে তাকিয়ে ভীতু স্বরে প্রশ্ন করলো,
“মা, কারা যেন হাঁটছে আশেপাশে। কে এগুলো! মা?”

“চুপ। একটুও ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই তোদের। আমি আছি তো। তোরা চুপ থাক। আমি দেখছি।”

“মা, আমিও যাবো তোমার সাথে বাহিরে। আজ একটাকেও বাঁচতে দিবো না। চলো।”

পত্রের দিকে তাকালো ছায়া। খুব গোপনে বোধহয় সে বাঁকা হাসলো কিন্তু তা প্রকাশ পেলো না বাহিরে। আগের ন্যায় গম্ভীর থেকে বললো,
“তুমি এখানেই থাকো। আমি দেখছি কে আছে। তারপর নাহয় বের হইও।”

পত্র মায়ের কথায় রাজি হলো। ছায়া ধীর হাতে ততক্ষণে দরজার খিল খুলেছে। জ্বলজ্বল করা হারিকেনটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে উঠোনে। পত্র ঘরের মাঝে খুঁজে খাটের নিচ থেকে একটা রামদা বের করলো। তা দেখে পুষ্প ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে বোকা বোকা কণ্ঠে বললো,
“এই এই তুই দা নিয়েছিস কেন?”

“আজ একটা কিছু করেই ছাড়বো পুষ্প। তুই ভয় পাবি না। ওদের শেষ করে দিবো আজ।”

“যদি হামলা করতে কেউ এসেই থাকে তবে তো তারা শহুরের সেই ছেলে গুলো তাই না?”

“হ্যাঁ, তো?”

“তো, তুই পারবি তো তাদের কিছু করতে?”

পুষ্পের প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো পত্র। পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো পুষ্পের দিকে। রামদা টা নিচু করে বেশ বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“শহুরে ছেলে হয়েছে তো কী হয়েছে? রামদা এর চেয়ে নিশ্চয় তাদের জোর বেশি না তাই না?”

“কিন্তু ভালোবাসার কাছে তো রামদায়ের জোর নেহাৎই তুচ্ছ। তাই না কী?”

পুষ্পের কথায় পত্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। মুহূর্তেই তার জ্বলে উঠা সাহস নিভে গেলো। অস্বস্তিতে ভরে গেলো আঙিনা। আমতা-আমতা করে কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার কণ্ঠ দিয়ে বের হলো না কোনো শব্দ কণিকা। বাহিরের ধুপধাপ হাঁটার শব্দ ততক্ষণে চুপ হয়ে গিয়েছে। দু’বোনের কথোপকথন থেমে গেলো তৎক্ষনাৎ। মায়ের কণ্ঠস্বরও তো আর পাওয়া যাচ্ছে না। পিলে চমকে উঠলো ওদের। মায়ের কোনো ক্ষতি হলো না তো? ছুটে বেরিয়ে এলো পত্র পিছে এলো পুষ্পও। উঠোনে নামতে তারা অবাক। ঘরে এতক্ষণ আঁধার থাকলেও উঠোন জুড়ে চাঁদের মলিন আলো হামাগুড়ি দিচ্ছে। আর সে আলোতে দেখা গেলো বাড়ির সদর দরজা খোলা। বাহির থেকে ভেসে আসছে কিঞ্চিৎ ধোঁয়া আর হলুদ কমলে মিশেল আভা। দুজনেই ভয় পেয়ে গেলো তা দেখে। মায়ের বিপদ হলো না তো! ব্যস্ত পায়ে ছুটে বেরিয়ে এলো বাড়ি ছেড়ে। দরজার বাহিরে পা রাখতেই তার চমকে গেলো। পত্রের হাতে উঠিয়ে রাখা রামদাটা মুহূর্তেই লুকিয়ে ফেললো ওড়নার পিছনে। চা বাগানের পরিচিত কয়েকজন পুরুষ অবয়বের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো তাদের মাকে। মুখে দূঢ় এক হাসি টেনে।

মেয়েদের বেরিয়ে আসতে দেখেই ছায়া কিঞ্চিৎ চোখ রাঙালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“তোরা বের হয়েছিস কেন? নিষেধ করে ছিলাম না?”

“তোমার সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না তো, তাই আরকি ভয় হচ্ছিলো।”

দুই বোনের আমতা-আমতা উত্তরে হাসলো উপস্থিত লোক গুলো। প্রায় পাঁচ ছয়জন। তার মাঝে কালো, বেটে করে পান খেয়ে দাঁত লাল করা লোকটা আস্বস্ত করে বললো,
“পত্র, পুষ্প যা তোরা তোদের মাকে নিয়ে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমা। আমরা সবাই আছি তোদের সাথে। কোনো চিন্তা নেই। আমি, জুয়েল, নরেন, তালেব, মুনির সবাই তোদের বাড়ির আশা পাশ পাহারা দিবো। কেউ তোদের কিছু করতে পারবে না। বিপদের দিনে আমরা থাকবো না তো কে থাকবে!”

কৃতজ্ঞতায় স্বজল হয়ে গেলো উপস্থিত তিনজন নারীর চোখ। ছায়া বার বার ধন্যবাদ জানিয়ে সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে মেয়েদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। পত্র আর পুষ্প ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম এলো না ছায়ার। থেকে থেকে সজাগ হয়ে উঠলো তার মস্তিষ্ক। এপাশ ওপাশ ফিরে কেটে গেলো তার রাত।

প্রতিদিনের মতন আজও সকাল হলো, কাক ডাকলো, সূর্য উঠলো। পত্র উঠোন ঝাড়ু দিলো, ছায়া স্নান করে রান্না বসালেন। দুপুরের দিকে খাবার নিয়ে সে সদরে যাবে আবার সন্ধ্যা নামতে নামতে চলে আসবেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই সকলে তাড়াতাড়ি হাত মিলিয়ে কাজ শেষ করার লক্ষ্যে আছে।

সকালটা ঝলমলে করে উঠতেই উঠোনে হাজির হলো বিন্নী এবং জেঠিমা। তাদের দেখে বাড়ির ভেতর উপস্থিত পত্র, পুষ্প এমনকি ছায়াও বেশি অবাক হলো। ছায়া অবাক কণ্ঠে বললো,
“দিদি! অত বড়ো গাট্টি গোস্তা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”

“চলে যাচ্ছি বৌ। তোমার সাথে অনেক কথা বলেছি, কখনো বকেছি, মান রেখো না কেমন। কোনো অভিযোগ রেখো না তোমরা আমার উপর।”

জেঠিমার কথায় যেন সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তারা বিস্মিত নয়ন জোড়া মেলে তাকিয়ে রইলো বিন্নী ও বিন্নীর মায়ের দিকে। মানুষ গুলোর চোখ দু’টো কেমন টলমল করছে! যেন এখনই অশ্রু গড়িয়ে পড়বে।

পুষ্প ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো জেঠিমাকে। কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে, প্রলাপ বকতে বকতে বললো,
“কই যাবে তুমি জেঠিমা! তোমাদের ছাড়া আমরা থাকবো কীভাবে? এত পাষাণ হচ্ছো কেন গো?”

পঞ্চাশে পা রাখা মহিলাটার চোখেও তখন বাঁধন হারা অশ্রু। পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে কান্না মাখা কণ্ঠেই বললো,
“চলে তো যেতেই হবে রে, মা? এই চা বাগান আমার ছেলে কেড়েছে, স্বামী কেড়েছে। আমার সম্বল বলতে মেয়েটা। তাকে নিয়েই আমি বাঁচতে চাই৷ তোদের ছেড়ে যেতে বড্ড মায়া হচ্ছে। আমার অভ্রটা যাওয়ার পর তুই যেমন করে যত্ন নিলি আমার, আমি তার বিনিময়ে তোরে কিছুই দিতে পারি নি। কেবল বলবো মা, আমার ছেলেকে ভুলে যা। তোর জীবনটা বড্ড ছোটো শোক পালনের জন্য। হাসবি, খেলবি, বাঁচবি আবার।”

পুষ্প তখন কথা শোনার অবস্থায় নেই। কাঠখোট্টা মেয়েটা অভ্রদা’র মৃত্যুর পরপরই কেমন যেন বদলে গেলো। ভুলে গেলো নিজের নিজস্বতা। হয়ে উঠেছিল অভ্রদার প্রিয় মানুষদের ভরসাস্থল।

“কালও তো আমরা একসাথে ছিলাম, দিদি, আপনি তো কিছুই বললেন না! হুট করেই চলে যাচ্ছেন যে?”

“আমার ভাই এসেছে নিয়ে যেতে। রাজধানীতে চলে যাবো। শহরের জীবন কঠিন জানি, তবে হয়তো আমাকে আর শূন্য হতে হবে না।”

“এখানের সব জায়গা জমি কী করবেন? শেয়াল কুকুরের ভোগে যাবে সব।”

“গেলে আর কী করার বলো। তবে আমার ভাই মাঝে একবার এসে নাহয় জমির ঝামেলা মিটিয়ে যাবে। ভালো থেকো সবাই।”

জেঠিমার চোখে টলমল করা অশ্রু মুহূর্তেই গড়িয়ে পড়লো। পত্রও বিদায় বেলা জড়িয়ে ধরলো নিজের প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে। বিন্নীও কেঁদে উঠলো পত্রকে জড়িয়ে ধরে। পাড়া প্রতিবেশীও ভিড় করেছে পত্রদের বাড়ি। বিন্নীদের বিদায়ের কথা ছড়িয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। জেঠিমা সবাইকে জড়িয়ে ধরে ধরে কাঁদলো। বাঁধা হলো না এখানে কোনো ধর্ম, বর্ণ,জাতি। ঠাকুর বাড়ির বউ কিনা কাঁদছে সবচেয়ে নিচু জাতির মানুষদের গলা ধরে!বিধর্মী মানুষদের গলা ধরে! এই যুগে এটা অবিশ্বাস্যকর হলেও চা বাগানে এটা ঘটেছে। সবাই যে সবার বড্ড প্রিয়। এখানে মানবধর্মের উর্ধ্বে ঠাঁই মেলে নি কোনো কিছুর। এখন পুজো হয়েছে প্রতিদিন ভালোবাসার। শুদ্ধতম মানুষদের শুদ্ধতম ভালোবাসার। পুরো চা বাগান যেন হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বিদায় দিতে তারা বিন্নীদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে ট্রেনের পথ অব্দি গেলো। যেন জন সমুদ্রের ফেউ। জেঠিমা শেষ মুহূর্তে নিজেকে ধরে না রাখতে পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,
“ও দিদি, ও পত্রের মা, কাকী গো, নারী নাকি শ্বশুর বাড়ি পা রাখে জীবিত শরীর নিয়ে আর বিদায় নেয় মৃত শরীর নিয়ে। আমার বুঝি অত দুর্ভাগ্য গো! বেঁচে থাকতেই ছাড়তে হচ্ছে স্বামীর বাড়ি, স্বামীর ঠিকানা! এমন বেঁচে থেকেও মৃত্যু আমায় কেন দিলো ভগবান। কোন পাপে আজ আমি পথের ভিখারি। সব থেকেও আজ শূন্য। এমন দিন ভগবান আমার নামে কেন লিখলো গো!”

জেঠিমার আর্তনাদে চা বাগান স্তম্ভিত। একে একে কেঁদে উঠলো সবাই। শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ছায়ার মতন শক্ত নারীও কাঁদলো। পত্র নিজের প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে বুকের মাঝে লেপ্টে রাখলো। চোখ গড়িয়ে পড়লো অশ্রু কণা। আকাশ পানে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার দোরে অভিযোগ করে বললো,
“কেনো হারাচ্ছে সব? মানুষকে শূন্যতা দিতে তুমি এত পছন্দ করো?”

চঞ্চল বিন্নী কাঁদছে হাউমাউ করে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সাজানো শৈশব, রঙিন হাসি, চঞ্চল সুখ। কই আজ সব! কই হারালো শৈশব? আজ সুখের মৃত্যুতে সে চরম ভাবে নিহত, চরম ভাবে।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here