#বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ
#পর্ব_২২
#নবনী_নীলা
সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশে রুহিকে দেখতে না পেয়ে উঠে বসলো আহান। পরে মনে পড়লো রুহি তো গেস্ট রুমে ঘুমিয়ে আছে। প্রতিদিন সকালে রুহিকে পাশে দেখে ঘুম ভাঙ্গার অভ্যাস হয়ে গেছে আহানের। গেস্ট রুমের জন্যে এমন বিপদে পড়তে হবে জানা থাকলে কখনো ফ্ল্যাটে সে গেস্ট রূম রাখতো না। আহান বিছানা থেকে নেমে গেস্ট রূমের দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার লকটায় চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেলো। ভাগ্যিস দরজাটা ভিতর থেকে লাগিয়ে দেয় নি। আহান দরজাটা হাল্কা খুলে বিছানার দিকে তাকালো, গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে রুহি। আহান দরজাটা খুলে দিয়ে দেওয়ালের সাথে পিঠ হেলিয়ে দাড়িয়ে একদৃষ্টিতে রুহিকে দেখছে। রুহি ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করে উল্টো পিঠ হয়ে মাথার বালিশটা জড়িয়ে ধরলো। রুহির কাণ্ডে আহান এক গাল হাসলো। ঘুমের মধ্যেও আহানকে হাসাতে ব্যার্থ হলো না রুহি। আহান দরজাটা আবার আগের মতন চাপিয়ে দিয়ে কিচেনে এলো। পকেট থেকে ফোন বের করে রাতুলকে কল করলো। একহাতে কানে ফোনটা ধরে অন্যহাতে কিচেনের একটা সেলফের দরজা খুললো।
রাতুল কল রিসিভ করলো। আহান স্পিকার বাড়িয়ে ফোনটা একপাশে রেখে বললো,” হ্যালো, রাতুল শোনো আমার ড্রায়ারের ফাইলগুলো তুমি আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে এসো। আজ আমি অফিসে যাবো না।”
” আচ্ছা সেটা তো পারবো কিন্তু আপনি কি সুস্থ আছেন স্যার?”, চিন্তিত গলায় বলল রাতুল।
” হ্যা আমি ঠিক আছি। আর শোনো রাতুল, আমার আরেকটা জিনিস লাগবে।”, চুলায় ফ্রাইং প্যানটা বসিয়ে দিলো আহান।
” কি লাগবে স্যার? আমাকে বলুন।”,
” আমার হলুদ গোলাপের চারা লাগবে।”, আশে পাশে রুহি আছে কিনা দেখে নিয়ে ফোনের স্পিকার কমিয়ে কানে ধরলো ফোনটা।
রাতুল ওপাশ থেকে অবাক হয়ে বললো,” হলুদ গোলাপ? কিন্তু স্যার আপনার তো হলুদ রঙ পছন্দ না। ”
” সেটা তোমায় ভাবতে হবে না যেটা বলেছি সেটা করো। আর হ্যাঁ এমন ভাবে আনবে জাতে বোঝা না যায়। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”
” জ্বি স্যার। অবশ্যই।”
আহান কল কেটে ফোনটা একপাশে রেখে দিলো। তারপর ব্রেকফাস্ট বানাতে লাগলো।
রুহি ঘুম থেকে উঠে বসেছে। তারপর চারিদিকে তাকাতেই মনে পড়লো সে এখন আহানের ফ্লাটে আছে। চারিদিকটা কেমন জানি এই ঘরে কোনো প্রাণ নেই এমন ভাব। দেওয়ালের রঙ থেকে শুরু করে বিছানার চাদর সব কিছু খুব ক্লাসি। দেওয়াল গুলো বলতে গেলে ফাকা তেমন কোনো পেইন্টিং নেই খালি খাটের পিছনে একটা বড় পেইন্টিং। পেইন্টিং টা সুন্দর এই পাইন্টিংটাই রুমটাকে সুন্দর করে তুলেছে। রুহি রূমের ভিতরে কোনো ওয়াশরুম পেলো না। রুহি চুলের ভিতরে হাত চালাতে চালাতে বাহিরে এলো। বের হতেই সামনে ড্রয়িং রুম। ড্রয়িং রুমের একপাশের একটা দেয়ালে আর্টিফিসিয়াল কিছু গাছ দিয়ে সাজানো। আর বাকি সব দেওয়াল প্রায় ফাকা কোনো ওয়ালম্যাট নেই কিচ্ছু নেই। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে যেতেই কিচেনে আহানকে দেখলো। আহান মনোযোগ সহকারে রান্না করছে। এই দৃশ্যটা রুহির কাছে অনেক নতুন। এই লোকটা রান্নাও জানে। রুহি এগিয়ে গিয়ে আহানের পাশে দাড়ালো। তারপর অবাক হয়ে তাকাল, এতো রান্না করেছে! কিন্তু এগুলো কি? এ কেমন ব্রেকফাস্ট!
আহান রুহির এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,” ঘুম শেষ?”
রুহি দৃষ্টি না সরিয়ে হা সূচক মাথা নাড়ল তারপর বললো,” এইগুলো আপনি করেছেন? একা একা!” বলে আহানের দিকে তাকালো।
আহান কিছু বললো না শুধু তাকিয়ে রইলো তারপর বললো,” যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
রুহি ভ্রু কুঁচকে বললো,” ওয়াশরুম কোথায়?”
আহান নিজের রুমের দিকে ইশারা করলো। রুহি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কি অদ্ভুত গেস্ট রুমের সাথে রেস্ট রুম না দিয়ে নিজের রুমে দিয়েছে। তারপর আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” এটা কেমন ব্যাপার।”
” আমার একা থাকতে ভালো লাগে। তাই যাতে কেউ আমার ফ্ল্যাটে এসে আমার শান্তি নষ্ট না করে তাই এই ব্যাবস্থা।”,
কি অদ্ভুত রে বাবা! রুহি কটাক্ষ করে বললো,” আপনি গেস্ট রুম রেখেছেন কেনো ওটাও উরিয়ে দিতেন।”
” Yeah, now I about regret that.”, বলে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল আহান।
রুহি আড় চোখে তাকিয়ে আহানের রূমের দিকে গেলো। রূমে ঢুকার সাথে সাথে একটা পেইন্টিংয়ে রুহির চোখ আটকে গেলো। তুষার ঝড়ে দুটো সাদা পাখি উড়ছে। কি অপূর্ব সে দৃশ্য! রুহি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফ্রেশ হতে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে খাবার টেবিলে বসলো। তবে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। সামনে ব্রেড, অমলেট, সালাদ, জুস আরো কিসব রাখা।
রুহি একটা ব্রেড নিয়ে খেতে শুরু করলো। এইটার টেস্টটা কেমন জানি।
” এটার টেস্ট এমন কেনো?”, প্রশ্ন করল রুহি।
আহান ফোন নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বরুহির দিকে তাকালো তারপর বলল,” এটা গ্লুটেন ফ্রী ব্রেড।”
শব্দটা রুহির মাথার উপর দিয়ে গেলো। জিনিসটা কি সেটা রুহি আর জানতে চাইলো না। মানসম্মান ডুবানোর কোনো ইচ্ছে নেই তার। এমনিতেই আহান ফোনটা নিয়ে ব্যাস্ত। রুহি কোনো রকম গিলছে। উফফ কোথায় পরোটা, মাংস, ডাল, লুচি, আলুর দম আর এখানে কিসের নিরামিষ খাবার সব। রুহি নিজের সামনে থাকা জুসের গ্লাসটা হাতে নিলো। জুসটা মোটেও তার সুবিধার মনে হচ্ছে। কমলা, আপেল, আমের জুস তো এমন দেখতে হয় না। রুহি একটা চুমুক দিলো তারপর নাকমুখ কুচকে ফেললো। এটা আবার কি। রুহি তাড়াতাড়ি পানি খেয়ে নিজের মুখের স্বাদ ঠিক করলো। রুহির হুড়োহুড়িতে আহান রুহির দিকে তাকালো তারপর বললো,” কি হয়েছে?”
রুহি পানির গ্লাসটা টেবিলে রেখে বললো,” এটা কি? এটা কেমন জুস আপনি কি চিনি দিতে ভুল গেছেন নাকি?”
” নাহ্ দিয়েছি তবে আল্প পরিমাণে।”, রুহির দিকে দৃষ্টি রেখে বললো আহান।
” এটা কিসের জুস?”, নাক মুখ কালো করে বললো রুহি।
” এটা অভোক্যাডো জুস। কেনো তোমার ভালো লাগে নি?”
” এ আমি কোথায় এসে পরলাম। আপনি কী সবসময় এইসব খেয়ে থাকেন? না মানে এর আগে তেমন খেয়াল করে দেখিনি।”
” কি আবোল তাবোল বলছো বলতো।”, আহানের কথার মাঝে কলিং বেল বেজে উঠলো। আহান উঠতে নিতেই রুহি উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,” আপনি বসুন। আমি দেখছি এমনিতেও এসব আমি আর খেতে পারবো না,আপনার অভোক্যাডো জুস।”
রুহি দরজা খুলে দেখলো রাতুল এসেছে। সে রুহির হাতে কিছু ফাইল আর একটা বক্স দিয়ে চলে গেলো। রুহি ভিতরে আসতে বললো কিন্তু সে অসলো না। রুহি বক্সটা খুলতেই আহান এসে রুহির হাত থেকে বক্সটা নিয়ে এলো। আহানের আচরণে রুহি সন্দেহের চোখে তাকালো।
” বাবা কি এমন আছে ভিতরে এমন খপ করে নিয়ে গেলেন যে আমি কি খেয়ে ফেলতাম নাকি?”,
আহান কড়া চোখে বললো,” পারমিশন ছাড়া অন্যের জিনিস দেখতে হয় না সেটা জানো না?”
” সে যখন বক্স খুলেই ফেলেছি, ভিতরে কি আছে সেটা তো আমাকে দেখতেই হচ্ছে।”, আহান কিছু বলার আগে রুহি আহান থেকে বক্সটা নিয়ে নিলো। রুহি এমনটা করবে সেটা আহান ভাবেনি।
রুহি বক্সটা খুলে একটা ছোট হলুদ গোলাপের চারা দেখে অবাক হয়ে আহানের দিকে তাকালো এর মাঝে আহান বক্সটা রুহির থেকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রুহি পিছন পিছন গেলো।
” আপনি গোলাপের চারা দিয়ে কি করবেন?”, প্রশ্ন করলো রুহি।
আহান উওর না দিয়ে করিডোরে গিয়ে চারা গাছটা একপাশে রেখে দিলো। রুহি অনেক অবাক হয়ে গেলো। করিডোরে একপাশে ছোটো ছোট গাছের একটা সুন্দর সাজানো বাগান। এদিকটায় আসাই হয় নি, তাই এতো সুন্দর জায়গাটা দেখাই হয় নি।
” ও আচ্ছা। তাহলে এইজন্যে গাছটা এনেছেন। কিন্তু আমি কতো হলুদ গোলাপের গাছ কিনেছি, সব গাছ মরে যায়।”, রুহি মন খারাপ করে বললো।
আহান গাছটা ভালো একটা জায়গায় রেখে। পকেটে হাত ভরে রুহির দিকে এগিয়ে এলো। রুহির কাছে এসে একটু ঝুঁকে বললো,” ভালোবাসা জিনিসকে আগলে রাখতে হয়।” বলে রুহির হাত ধরে নিয়ে এলো।
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”, মুখ কালো করে বললো রুহি।
” তুমি কি খাবে বলো?”, সরু চোখে তাকিয়ে বললো আহান।
রুহি হেসে উঠে বললো,” আপনি বানাবেন?”
” হ্যা আর তুমি আমায় হেল্প করবে।”, কড়া চোখে বললো আহান।
” কিন্তু আমি তো পারি না।”, নিচের ঠোঁট উল্টে বললো রুহি।
” আমি শিখিয়ে দিবো।”, বলে রুহিকে নিয়ে কিচেনে চলে এলো।
তারপর রুহির গলার ওড়নাটা সরিয়ে দিতেই রুহি হকচকিয়ে তাকালো। আহান রুহিকে ঘুরিয়ে অ্যাপ্রনটা পরিয়ে দিলো। রুহি একটুর জন্য ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তারপর আহান রুহিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাড় করলো, তারপর উপর থেকে নিচে দেখে বললো,” পারফেক্ট।”
রুহি ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলে তাকালো। তারপর আহান রুহিকে বললো,” কি খাবে?”
রুহি কিছুক্ষণ ভেবে বললো,” আলু পরোটা।”
” ওকে, যদিও আমি জানি না এটা কিভাবে বানায় বাট আই উইল ট্রাই। তুমি দাড়াও আমি ফোনটা নিয়ে আসি।”, বলে আহান ফোন খুঁজতে গেলো।
রুহি অবাক হয়ে দেখছে কারন হটাৎ আজ আহানের আচরণে এতো পরিবর্তন। ঝগড়াও করছে না। সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে।
রুহি কিছু পেঁয়াজ দেখে ছুরি দিয়ে সেগুলোকাটতে লাগলো। যদিও সে কোনোদিন কাটে নি তবুও চেষ্টা করতে দোষ নেই। আহান ফোন হাতে এসে রুহির পেঁয়াজ কাটা দেখে হাত তর্জনী দিয়ে ভ্রূ ডলে এগিয়ে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে রুহির হাত দুটো ধরলো। রুহি হটাৎ এমন স্পর্শে কেপে উঠলো। বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছে। আহান কাছাকাছি আসলেই তার বুকের ভিতরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। আহান রুহিকে পেঁয়াজ কাটা শিখিয়ে দিলো যদিও রুহি ভালো ভাবে এখনও পারে না কিন্তু যতটুকু পারে তাতেই সে মহা খুশী। তবে রুহির চোখ ছল ছল করছে পিয়াজের কারনে।
আহান ইউটিউব দেখে রুহির পছন্দের আলুপরোটা বানালো। রুহি প্লেটটা নিতে আসতেই আহান প্লেটটা সরিয়ে নিলো। তারপর রুহির দুপাশে হাত রেখে ঝুকে দাড়ালো। হটাৎ এমন করলো কেনো আহান। শয়তানে কি আবার গুতো মেরেছে?
” কি হয়েছে? আমাকে প্লেটটা দিন।”, নীচু স্বরে বলল রুহি।
” এতো সহজে? আমি যে এতো কষ্ট করলাম আমি কি পাবো?”রুহির খুব কাছে মুখ এনে বললো আহান।
রুহি একটা ঢোক গিললো। হটাৎ এতো কাছে আসায় দুজনের চোখাচোখি হয়। রুহির বুকের ভিতরটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। রুহি একটা ঢোক গিলে দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো।
তারপর বলল,” মানে?”
আহান রুহিকে শুধু মাত্র লজ্জা দিতেই এগিয়ে এসেছিলো, কিন্তু এখন তার নেশার মতন লাগছে। আহান আরো ঝুকে এসে বললো,” মানে বুঝতে পারছো না?” আহানের চোখের দিকে তাকাতেই রুহির মানেটা বুঝতে বাকি রইলো না। রুহি চোখ সরিয়ে ফেললো। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে তার। রুহি চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে না সূচক মাথা নাড়ল। আহান তর্জনী দিয়ে রুহির মুখটা উপরে তুলে বললো,” না বুঝলে তো বুঝিয়ে দিতে হয়।”
[ তোমরা আমাকে পাত্তা দেও না তাই বাকিটা কাল বলবো।]
#চলবে