#বেনিফিট_অফ_লাভ -৯
Tahrim Muntahana
সকাল হয়েছে, হট্টগোল ও বেড়েছে। ডেজি ঘুম থেকে উঠেই রান্না ঘরে চলে এসেছে। মনের সুখে গুনগুন করে গান গাইছে আর রান্না করছে। বাড়ির কাজের লোক গুলো হা হয়ে তা দেখছে। নতুন বউয়ের এমন রূপ তাদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। রান্না যখন প্রায় শেষ, ডেজি শাড়ির আঁচল কোমর থেকে খুলে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে। আঁচল দিয়ে মুখ, গলার ঘাম মুছে শরীর এলিয়ে দেয় সোফায়। চোখ বুজে চেঁচিয়ে ডেকে উঠে,
-“মিসেস গাঁজা, মিসেস গাঁজা, নামুন তাড়াতাড়ি। বেলা বাজে নয়টা এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এই বাড়িতে এমন নিয়ম চলবে না। খেয়ে খেয়ে কুমোরের মতো শরীর টা বানিয়েছে, তাড়াতাড়ি নিচে নামুন।”
দুই ছেলের সাথে গল্প করছিলেন বেনিফিট খাজা। ছেলের বউয়ের ডাকে তো মাথায় আগুন ধরেই গেছে তার উপর খাওয়ার খোঁটা দিয়ে যেন মেয়েটা নিজের কাল ডেকে আনলো। বিছানা থেকে নেমে শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দিতে দিতে নিচে নেমে এলেন। শামউল, শিতাব অসহায় ভঙ্গিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিজেরাও দৌড় লাগালো। কি হয় কে জানে। নিচে নেমে ডেজি কে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকতে দেখে বেনিফিট খাজা গর্জে বললেন,
-“এই বেজি, হোয়াট বললা ইউ মি কে? ইউর সাহস তো কম নো! আমার হোমে এসে আমাকেই খাওয়ার খোঁটা দিচ্ছ।”
ডেজি তা কানেই নিল না। কানে আঙুল ঢুকিয়ে এমন ভান করলো যেন কিছু শুনেই নি। পরক্ষণেই বেনিফিট খাজার হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে দিল। চাপা স্বরে বললো,
-“একদম চুপ থাকুন, নাহলে আজ খাবার না গাঁজা পাবেন মিসেস গাঁজা।”
-“এই বেজি, ইউকে চড়িয়ে সিধে করে দিবো। মাদার ইন লো হই ইউর!”
-“আচ্ছা আসুন একটা ডিল করি?’
বেনিফিট খাজা প্রথমে ইতস্তত করে মাথা নাড়ালো। ডেজি হাসি মুখে বললো,
-“শাশুড়ি বউমা যেখানে, আপদ নাই সেখানে!”
-“ইটস মাদার মাদার আর ভাগ্নে হবে।”
-“আপনি আমার মামা লাগেন? বেশী কথা বলেন, চুপ করে থাকেন।”
বেনিফিট খাজা চুপ হয়। ডেজি ফিসফিস করে বলে,
-“আপনার এই মিউমিউ করা দুই ছেলেকে শিক্ষা দিবো, ঘরে তো কথা বলতে পারেই না, বাইরেও পারে না। দেখলেন না বিয়ে বাড়িতে আপনাকে সাপোর্ট করেনি। আমাকেও করেনি। আর আপনার ছোট ছেলে বখাটের মতো ঘুরে বেড়ায়। তাই আমরা এদের শিক্ষা দিয়ে মানুষ করবো, রাজী আছেন?”
বেনিফিট খাজা প্রথমে চোখ রাঙিয়ে তাকালেও পরক্ষণে ভাবলেন। সত্যিই তার দুই ছেলে একটাও জাতের না। অতি আদরে ঠিক মানুষ হয়নি। ‘তাকেও সাপোর্ট করে না’,কথাটা কাজে লাগলো। ফট করেই রাজী হয়ে গেলেন। ডেজি বাঁকা হেসে সোফায় পা তুলে বসে দুজন কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“রান্না ঘরে সব রান্না করা আছে, যাও দুজন সার্ভ করবে।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল দুজন। কি বলে? তারা করবে মানে? মুখ খুলে কিছু বলবে পূর্বেই বেনিফিট খাজা বললেন,
-“ওয়ান কথাও নো, শুধু ওয়ার্ক। গো গো, ক্ষিধে পেয়েছে।”
দুজন আরো বেশী অবাক হয়ে গেল। ডেজি মিটিমিটি হাসছে। দু ভাই নিরব ভূমিকা পালন করে ছুটে গেল রান্না ঘরের দিকে। কাজের লোক গুলো বাকি টুকু করেই রেখেছিল। ডাইনিংয়ে খাবার গুলো রাখতেই ডেজি বেনিফিট খাজা কে নিয়ে চেয়ারে বসলো। একজন কে হাত দিয়ে ইশারা করতেই শরবতের গ্লাস নিয়ে আসলো। মিষ্টি হেসে ডেজি শরবতের এক গ্লাস বেনিফিট খাজার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“মিসেস গাঁজা এইটা আপনার জন্য, আমি খুব যত্ন নিয়ে বানিয়েছি। পুরোটা শেষ করবেন।”
বেনিফিট খাজা বউমার এমন যত্নে গদগদ হয়ে গেলেন। সবুজ রঙের শরবতের গ্লাস হাতে তুলে নিয়েই চুমুক বসালেন। এক চুমুক গলাধঃকরণ করেই তার মুখশ্রী এমন কুঁচকে গেল ডেজি মুখ চেপে ধরলো হাত দিয়ে। ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার। কিন্তু হাসলেই ক্ষতি। মায়ের রিয়েকশন দেখে শামউল বললো,
-“মম, কি হয়েছে? ভালো হয়নি? কিসের শরবত এটা?”
-“করলার শরবত, কত উপকারী জানো? মায়ের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে তো। তোমরা দুজন চুপ করে বসে থাকো।”
শিতাব কিছু বলতেই যাচ্ছিল। ডেজির ধমকে সাহস পেল না। বেনিফিট খাজা ছেলের বউয়ের এমন হাসিতে ফেলেও দিতে পারছেন না, আবার খেতেও পারছেন না। ডেজি আহ্লাদ করে বললেন,
-“কি হলো মা? ভালো হয়নি? আপনার জন্য স্পেশাল বানিয়েছি।”
বেনিফিট খাজা পুরোটা শেষ করলেন। গা গুলিয়ে আসছে, মুখ তেতো হয়ে বমি আসতে চাইছে। ডেজি বুঝলো, একটু খারাপ ও লাগলো। মিষ্টি এক শরবত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“এটা খান, তেতো চলে যাবে।”
বউমার কাছে নাস্তানাবুদ ভালোয় হলেন বেনিফিট খাজা। টু শব্দ করলেন না। শিতাব পুরোটাই বুঝতে পেরেছে। বেনিফিট খাজা নাস্তা শেষ করে সোফায় চলে যেতেই শিতাব চাপা সুরে বললো,
-“মমের সাথে এমন না করে, একটু ভালোবাসে তার কথার সাথে তাল মেলাও মিনিটেই প্রিয় হয়ে উঠবে।”
-“সবসময় নেগেটিভ নিও না শিতাব। মায়ের শরীর আগের তুলনায় অধিক বেড়েছে, কয়েকদিন পর উনি হাঁটতে পারবেন না ভালো করে। এর আগেই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। কাল সকাল থেকে দুই ছেলে হাঁটতে নিয়ে যাবে, ব্যায়াম করাবে। সাথে দাদীকেও নিয়ে যাবে। খাবারের দিকটা আমি দেখে নিবো।”
শিতাবের মতো চাপা সুরে ডেজি বলে নি। বেনিফিট খাজা শুনেও চুপ রইলেন। মেয়েটা তার প্রিয় হয়ে উঠেছে কালকেই। তাই তো জুশ টা তিনি খেয়ে নিলেন, কথা না বাড়িয়ে। মনসুর হক, চাঁন হোক একটু পরেই এলো নাস্তা করতে। তাদের নাস্তায় প্রায় শেষের দিকে আবার সেই কলিং বেল। খাওয়ার সময় কে আসে কে জানে। কাজের লোক গিয়ে দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে সিলভিয়া ঢুকলো শেখ লবিন সহ আরো দুজন মেয়ে কনস্টেবল নিয়ে। ডেজি এগিয়ে এলো, খুশি হয়ে বললো,
-“আপু তুমি?”
সিলভিয়া একপলক তাকালো জবাব দিল না, নিজ থেকে বললো,
-“এসপি সিলভিয়া রেড! আমাদের কাছে প্রমাণ আছে এই বাড়িতে বউয়ের উপর অত্যাচার করা হয়।”
ডেজি উদাস হয়ে পড়লো। কালকে রাতে একবার ফোন দেওয়া উচিত ছিল। সে জানতো সিলভিয়া এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। তার মানে লাগলে সে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। ডেজি বুঝানোর জন্য কিছু বলবে সিলভিয়া শুনলো না। শিতাব এগিয়ে এসে বললো,
-“আপনার কাছে কেউ অভিযোগ করেছে?”
-“ইয়াহ, এবাড়ির পূত্র বধূই করেছে। এবং কি আশেপাশের প্রতিবেশীরাও বয়ান দিয়েছে, বিয়ের পর দিন ই কিভাবে অত্যাচার করা হয়েছে।”
বাড়ির সবাই ডেজির দিকে অবাক হয়ে তাকালো। ডেজি থতমত খেয়ে গেল। মিনমিনে সুরে বললো,
-“কালকের ইস্যুটা এত বড় করছো কেন আপু? আজ সব ঠিকঠাক। শাশুড়ি-বউমার মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই।”
সিলভিয়া যেন ডেজির কথা শুনতেই পাচ্ছে না। বেনিফিট খাজা আর বসে থাকতে পারলেন না। এগিয়ে এসে বললেন,
-“ইউ পুলিশ, ইউর সাহস তো বিগ বিগ। হক হোমে পুলিশ নিয়ে আসার পারমিশন হো দিয়েছে ইউ কে?
সিলভিয়া বাঁকা হাসলো। হাত কড়া টা বের করে বেনিফিট খাজার সামনে দাঁড়াতেই আঁতকে উঠলো সবাই। শামউল এসে মা কে ধরলো। শিতাব সিলভিয়ার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ নিয়ে বললো,
-“আপনি বাড়াবাড়ি করছেন সিলভিয়া রেড।”
সিলভিয়ার কি হলো সে নিজেও জানেনা। শিতাবের কলার চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“পুলিশের কাজে বাঁধা দেওয়ার আপনি কে? কোন অধিকারে আপনি মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন? এর জন্য আপনাকেও ধরে বেঁধে থানায় নিয়ে যেতে পারি আপনি জানেন?”
অপমানে চোখ লাল হয়ে এলো শিতাবের। কালকের বলা হুজুগে পরিকল্পনার কথা গুলো অপর পক্ষ কে কতটা হার্ট করতে পারে আজ যেন সে টের পেল। তার পরিকল্পনা যে পুরোটাই ভুল ছিল এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারলো। কিন্তু খুব দেরী হয়ে গেছে। সিলভিয়া শিতাব কে ধাক্কা দিয়ে মাঝখান থেকে সরিয়ে বেনিফিট খাজার হাত চেপে ধরে। হাত কড়া পড়াতে গিয়েও থেমে যায়। বাড়ির সকলের অবস্থা একদম যা তা। কি থেকে কি হলো, হচ্ছে কেউ ই যেন বুঝতে পারছে না। ডেজির অনুতাপ হচ্ছে এখন, কেন যে নিজের সংসারের কথা বাবার বাড়িতে বলতে গেল! আফসোস হচ্ছে। সবাই কে আরেকটু অবাক করে দিয়ে সিলভিয়া দূরে সরে এলো। হাত কড়া কনস্টেবলের হাতে দিয়ে বললো,
-“আজ ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম, এ বাড়ির দিকে আমার নজর থাকবে। এরকম কোনো কিছু নজরে এলে সেদিন ধরে বেঁধে সোজা থানায় নিয়ে যাবো।”
সিলভিয়া শিতাবের দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে যেন বুঝিয়ে দিল নিজের ক্ষমতা এবং সে কে। শিতাব নিজেও বাঁকা হাসলো। কিছু বললো না। যেন ইট মারলে পাটকেল খেতেই হবে। নিজের বাহিনী নিয়ে চলে যেতেই ডেজি বড় বড় পা ফেলে বেনিফিট খাজার নিকট এলো। মাথা নিচু করে বললো,
-“মা, আমি আসলেই সরি, কি বলবো। আপু যে রাগের বশে এমন করবে বুঝতে পারি নি।”
এতকিছুর পরেও বেনিফিট খাজা হাসলেন। ডেজির চিবুকে হাত রেখে বললেন,
-“ইউ সো কিউট। ইউর সিস্টার কিউট নো। আই হেইট হার। আই বুঝতে পেরেছি। ইউ ইজি হও।”
ব্যাপার টা যেমন নিমিষেই জটিল হয়ে উঠেছিল তেমনি সহজ হয়ে গেল। ডেজি মনে মনে পণ করেই নিল, আর যাই হোক নিজের সংসারের কথা বাবার বাড়ি বলবে না। এটা ঠিক ও না। যেখানে তার সারাজীবন থাকতে হবে দোষ গুন মেপেই তাকে থাকতে হবে। সংসারে ঝগড়া অশান্তি হবে, তাকেই তো সব কিছু আয়ত্তে এনে সুখে থাকতে হবে। সংসারে বাবার বাড়ির লোকের আধিক্য থাকলে কখনোই সে সংসার ভালো যায় না। বাবার বাড়িটা তার জায়গায় রেখেই নিজের সংসার গুছিয়ে নিতে হবে। নাহলে ছুটকি ছাটকি ঝামেলা বড় রকম অশান্তি হয়ে দাঁড়াবে। বাবার বাড়ির লোকজন ও চিন্তায় থাকবে, শশুড় বাড়িও অশান্তি লেগে থাকবে। এর থেকে শান্তিপ্রিয় মতবাদ ই ঢের ভালো।
চলবে…?
শব্দ সংখ্যাঃ ১৩১৪