বেলাশেষে পর্ব -০৯

#বেলা_শেষে। [০৯]

ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে দিগন্ত। রুমের পরিবেশ ঠান্ডা দেখে বড় করে শ্বাস ত্যাক করে সে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখতে পায় ভূমিকা বিছানায় বসে ইকুইটি এন্ড ট্রাস্ট আইন বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। পড়ায় মনোযোগ নেই শুধু বইয়ের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে রাগ পুশে রাখলে যা হয় আর কি। দিগন্ত মৃদু হেসে ভূমিকার পাশে গিয়ে বসলো। ভূমিকা ওকে দেখেও দেখলো না। সে ঘাড় ঘুড়িয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসলো। ভূমিকার মুখের রিয়্যাকশন দেখে খুব হাসি পাচ্ছে দিগন্তর। সে খুব কষ্টে নিজের হাসিটাকে দমিয়ে রাখছে। ভূমিকার হাতের স্প্রিড এবার বেড়ে গেছে। সে দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। দিগন্ত উকি দিয়ে দেখছে ভূমিকার বইয়ের দিকে আর মনে মনে বলছে,

-বেচারা বই, আজ তোর জন্যে আমি বেঁচে আছি এখনও। আমার উপর থাকা সব রাগ তোর উপর ঝাড়ছে। বেঁচে তাকলে দেখা হবে কোনদিন।

বিরক্ত হয়ে ভূমিকা বই রেখে দিলো। শান্ত চোখে দিগন্তের দিকে তাকাতে দিগন্ত বলে উঠলো,

-বইয়ের উপর রাগ ঝাড়ছো কেন?? আমি তো তোমার পাশেই আছি। আমি অন্যায় করেছি যা বলার আমাকে বলো। বেচারা বই মরে গেলে তাতে তোমাই ক্ষতি।

ভূমিকার বুঝতে বাকি রইলো না দিগন্ত তাকে রাগানোর জন্যেই কথাগুলো বলছে। কিন্তুু ভূমিকা সে এখন রাগ করবে না। ভূমিকা তো জানে দিগন্ত তখন কেন ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। ভূমিকা শান্ত গলায় বলল,

-আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি আপনার জন্যে চা করে আনছি। এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না ভূমিকা। চলে আসলো রান্নাঘরে। ভূমিকার শান্ত কথায় দিগন্ত শক্। ভূমিকা এতটা শান্ত ভাবে কথা বলবে এটা তার ভাবনার বাইরে ছিলো। নাকি ভূমিকার এই শান্তকথা বড় কোন বিপদের ইঙ্গিত। একদণ্ড বসলো না সে। ছুটে চলে আসলো রান্নাঘরে। ড্রয়িংরুমের সুফাতেই বসে ছিলো মাশহুদ ওর তার স্ত্রী। ভূমিকার পিছুপিছু দিগন্তকে রান্নাঘরে আসতে দেখে দিগন্তের মা বলল,

-ছেলেমেয়ে দুটোর ভালোই ভাব হয়েছে দেখছি। কেও কাওকে ছাড়া থাকতেই পারছে না। স্ত্রীর কথা হাহা করে হেসে দিলো মাশহুদ তালুকদার। হাসতে হাসতে বলল,

-আমাদের ভূমি মাকে ভালোবাসা না বেসে থাকা যায় নাকি। তবে যাই কও গিন্নী ছেলে কিন্তু বাপের মতোই হয়েছে। প্রেম কুমার। বাপের মতোই ভালোবাসতে শিখেছে।

-তোমার যত আজাইরা কথা। বুড়ো হয়ে গেলে অথচ এখনো তোমার মনের রং গেলো না।

-আর যাবেও না বুঝলে গিন্নী। যার পাশে এমন সুন্দর গুলুমুলো বউ আছে তার মনের রং কোন দিনও যাবে না।

-এই তুমি থামতো। ছেলেমেয়ে দুটো রান্নাঘরেই আছে। তোমার এই কথাবার্তা শুনলে কি ভাববে বলতো।

-ভাববে তাদের বাপ এখনো কতটা,,,,

-এই চুপ। থামতো তুমি।

-আমাকে একটা পান দেও গিন্নী। দিগন্তের মা বসে বসে তার স্বামীর জন্যে পান বানাতে লাগলেন। আর এদিকে ভূমিকা চা বানাচ্ছে আর দিগন্ত ওর পিছন পিছন ঘুড়াঘুরি করছে। আর উকি ঝুকি মারছে। ভূমিকা চা বানাতে বানাতে বলল,

-আপনি আমার পিছুপিছু ঘড়ঘুড় কেন করছেন??

-দেখছি আমার চা-য়ে বিষটিশ মিশিয়ে দাওকি না।

-দিলেও সমস্যা কোথায়। হসপিটাল তো পাশেই আছে।

-তা ঠিক। বাট আমাকে হাসপিটালে নিয়ে যাবে কে?? তুমি নিশ্চয় নিবে না। তুমি আমাকে বিষ খাওয়াবে তো বাঁচানোর জন্যে নয় তাইনা। দিগন্তের এই কথাশুনে ভূমিকার বুকের ভেতরে ছেদ করে উঠলো। হাটদুটো আলগা হয়ে আসলো তার। ভূমিকা দিগন্তকে বিষ দিবে এটা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা সে। দিগন্ত নাই মানুক বিয়েটা তো মিথ্যে হয়ে যাবে না। কালেমা পাঠ করে বিয়ে করেছে। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তারা। এখানে প্রেম ভালোবাসা সবটাই বৈধ। যত খুশি ভালোবাস তাতে কোন পাপ নেই বরং আর সোয়াব পাওয়া যাবে। এই বন্ধন কি এত সহজে ভাঙে যাবে। না, ভূমিকা কিছুই ভাবতে পারছে না। দিগন্ত তার স্বামী এই সত্যিটা অস্বীকার করার ক্ষমতা তার নেই। ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছে বিয়ের পর একটা মেয়ের কাছে তার স্বামিই সব। স্বামির ঘরই তার নিজের ঘর। তাহলে ভূৃমিকার বেলায় সেই নিয়মেয় ব্যতিক্রম কেন হলো।

চা কাপে ঢেলে সেটা দিগন্তের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, কিছু মিশাই নি নিশ্চিতে খেতে পারেন। তারপর সেখান থেকে প্রস্থান করলো ভূমিকা। দিগন্ত তাকিয়ে আছে ভূমিকার চলে যাওয়ার পানে। আচ্ছা মেয়েটাকি রাগ করলো নাকি। দিগন্ত তো ভূমিকাকে রাগানোর জন্যে বলেছিলো চা-য়ে বিষ মেশানোর কথা। চা-টা আর মুখে তুলল না দিগন্ত। যে করেই হোক ভূমিকার মান ভাঙাতে হবে। চা-এর কাপ সেখানেই রেখে চলে যাওয়ার জন্যে সামনে এক পা বাড়াতেই দিগন্তের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। এই অসময়ে আবার কে কল করলো? অনিচ্ছা থাকা সত্তেও পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। মোবাইলের স্কিনে মিমির মানটা জ্বলজ্বল করছে। এই সময় আবার মিমি কেন কল করলো। কল রিসিব করবে কি করবে না দ্বিধায় পড়ে যায় দিগন্ত। ভাবতে ভাবতে কলটা কেটে যায়। দিগন্ত মোবাইলটা পকেটে পুরে রাখে। তারপর রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই আবারও কল আসে। দিগন্ত এবার কল রিসিভ করে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। সুফার এক কোনে বসে দিগন্তকে দেখছিলো ভূমিকা। কল রিসিভ করে দিগন্তের রুমে চলে যাওয়ায় ভূমিকার বুঝতে বাকি রইলো না কে কল করেছে। ঠোঁট চেপে বড় করে শ্বাস নিলো ভূমিকা। সে কিছুতেই দিগন্ত আর মিমির মাঝখানে আসতে পারে না। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, চেয়ারম্যান সত্যিটা না জেনে দিগন্তের সাথে ওর বিয়ে দিয়েছে। এই বিয়ের মেয়াদ কতদিন ঠিক জানা নেই ভূমিকার।

দুপুরের খাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে ভূমিকা। মাথাটা আজ ভিষন ভার। অনেকক্ষণ যাবৎ ঘুমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তুু ঘুম পরিরা কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না তার দু- চোখের পাতায়। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। আড়মোড়া হয়ে উঠে বসলো সে। পাশেই ড্রেসিংটেবিলের সামনে চোখ পড়তেই দেখতে পেল দিগন্ত ফরমাল ড্রেসে সেখানে দাঁড়িয়ে শরীরে বডি স্প্রে দিচ্ছে। ভূমিকা তাকিয়ে রইলো সেদিকে কিছুক্ষণ। ওর খুব করে ইচ্ছে করছে দিগন্তের মাথার ওই চুলগুলো নাড়িয়ে এলোমেলো করে দিতে। ভূমিকা যখন দিগন্তের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে পালিয়ে আসতে নিবে তখন দিগন্ত ভূমিকার হাত চেপে ধরবে। আর ওর কাছে মাথা নত করে দিবে। ভূমিকা নিজ হাতে যত্নকরে দিগন্তের মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিবে। নিজের ভাবনার থেকে বেড়িয়ে অন্যদিকে মুখ করে তাকালো ভূমিকা।

আয়নাতে এতক্ষণ যাবৎ ভূমিকাকে দেখছিলো দিগন্ত। আজ একটু অন্যরকম লাগছে ভূমিকাকে। কেমন জানি চুপচাপ, মনে হয় তার অন্তরে বিষন্নতা নেমেছে। এমন চুপচাপ ভুমিকাকে মেনে নিতে পারছে না দিগন্ত। ভূমিকা তো হবে এমন যাকে একটা কথা বললে সে হাজারটা কথা শুনাবে। রাগে কটমট করে তেরে আসবে মারতে। আচ্ছা ভূমিকা এখনো তার উপর রেগে আছে। তাই এত চুপচাপ ম্যাডাম। দিগন্ত ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়ালো তারপর বলল,

-সরি, ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো ভূমিকা। দিগন্ত কি এমন করেছে যে, তাকে সরি বলছে।

-এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার সরি এক্সেপ্ট করো।দিগন্ত সরি বলছে তার আবার জোর গলায়। মানে তার সরি এক্সেপ্ট করতেই হবে। আচ্ছা এভাবে কেও সরি বলে নাকি। সরি তো বলবে মাথা নিচু করে। তার কন্ঠে থাকবে অনুতাপ, অনুরোধ স্পষ্টত। কিন্তু দিগন্তের কথা শুনে মনে হচ্ছে সে সরি বলে ভূমিকাকে ধন্য করছে। কিন্তু ভূমিকা সেই তো কম কিসে। ভূমিকা বলে উঠলো,

-আপনি কি জোর করে সরি এক্সেপ্ট করাবেন নাকি? আমি করবো না আপনার সরি এক্সেপ্ট। কথাগুলো বসে চুপ করে বসে থাকে ভূমিকা। তারপর মনে মনে বলে, আচ্ছা ওনি আমাকে সরি কেন বলছে। ওনি কি কোন ভুল করছে নাকি। যাই হোক সরি যখন বলছে এবার ওনাকে একটু নাচানো যাক।

-ওও হ্যালো কি এত ভাবছেন??

-ভাবছি আপনি সরি কেন বলছেন। বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো ভূমিকা।

-সত্যিই তো আমি তোমাকে সরি কেন বলছি। ঠোঁট চেপে হেসে বলল দিগন্ত। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, থাংক্স। আর কিছু বলে না ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে চলে যায় দিগন্ত। ভূমিকা রাগে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফ্লোরে ফেলে দেয়। আর মনে মনে নিজেকে গালি দিতে থাকে। আরো পার্ট নে। কি দরকার ছিলো দিগন্তকে নিজের মনের কথা বলতে। এবার দিলতো তোকেই বোকা বানিয়ে।

সূর্য মাথার উপর থেকে হেলে পড়েছে। পশ্চিম গগনের দিকে যাচ্ছে যাচ্ছে ভাব। চারিদিকে গোধুলির ন্যায় রাঙা হয়েছে। চারিদিকে নিবিড় নিস্তব্ধ। কোলাহল পূর্ন এই শহরা যে সূর্যের সাথেই হেলে পড়েছে। ভূমিকা চায়ের কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে বারান্দায়। বিকালের শহরটা উপভোগ করছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। একাকি সময় কাটানোর জন্যে এর থেকে ভালো কোন ওয়ে জানা নেই ভূমিকার। এমনি সময় মাশহুদের গলার আাওয়াজ শুনতে পেল ভূমিকা। তাদের রুমে দাড়িয়ে মাশহুদ দিগন্তকে ডাকছে। ভূমিকা চায়ের কাপ সেখানেই রেখে রুমের ভিতরে আসলো । ভূমিকাকে দেখে মাশহুদ জিগ্যেস করলো,

-দিগন্ত কই?

-বাহিরে গেছে। কেন আব্বা কিছু লাগবো??

-একটু ডক্তারের কাছে যাওন লাগছিলো। তোমার শ্বাশুড়ির রিপোর্ট তো বিকালে দেওনের কথা। তাই দিগন্তকে খুজছিলাম।

-আচ্ছা আমি আইনা দিতাছি। ভূমিকা রেডি হতে থাকে।

প্রকৃতিকে জ্যোতির অলংকার পড়িয়ে নিঃশব্দ পায়ে সন্ধা নামে পৃথীবিতে। প্রবিন দিনকে পিছনে ফেলে নতুন এক দিনের সূচনায় পশ্চিম গগনের সূর্য ডুবে যায়। চারিদিকে আবছা অন্ধকার নেমে আসে ক্রমশ অন্ধকারে হতে থাকে। এই আবছা আলোই রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভূমিকা। হাসপিটালে এসে তার শ্বাশুড়ি মায়ের রিপোর্ট গুলো নিয়ে বাসায় ফিরছে এখন। কিন্তুু প্রবলেম হলো সে এই সময়ে রাস্তায় কোন গাড়ি পাচ্ছে না। এদিকে চারিদিকে ক্রমশ অন্ধকারে দুরের দৃশ্যবলি অস্পষ্ট হতে শুরু করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভূমিকা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। গাড়ি আসছে কি না? তখনি একটা বড় গাড়ি এসে থামলো ভূমিকার সামনে। গাড়িটা ভূমিকার সামনে ব্রেক করায় দু পা পিছিয়ে যায় ভূমিকা। কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে গাড়ির দিকে তাকায় সে। রাস্তায় এত জায়গা থাকতে তার সামনে এসেই কেন গাড়ি ব্রেক করলো। ভূমিকাকে অবাকে করে দিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে আরাভ। সে ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়াতেই ভূমিকা অস্ফুটভাবে বলে,

-আরাভ সাহেব আপনি???

ভূমিকার কথায় কিন্চিৎ হেসে নিজের উপস্থিতি স্বিকার করলো আরাভ।

চলবে,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here