বেলাশেষে পর্ব -১৮

#বেলা_শেষে। [১৮]

-আমি আপনাকে যতই দেখছি তত বেশী অবাক হচ্ছি মিসেস ভূমিকা তালুকদার। আপনার সাথে এত অন্যায় হয়েছে তবুও সবটা সহ্য করে হাসি মুখে সবার সাথে মেলামেশা করছেন। কি অদ্ভুত আপনি। আপনাকে দেখলে কেও বুঝতেই পারবে না আপনার মনের ভেতরও চাপা কষ্টা আছে। আজ দিগন্ত না বললে আমি হয়তো সত্যিটা কখনো জানতে পারতাম না। জানেন আমার খুব করে ইচ্ছে করে আপনার সমস্ত কষ্ট দূর করে দিতে। আপনাকে হাসি খুশি এক প্রনবন্ত জিবন দিতে। সেখানে কোন দুঃখ থাকবে না কষ্ট থাকবে না। থাকবে শুধু আনন্দ উল্লাস আর ভালোবাসা। আপনার প্রতিটা হাসির কারন হতে চাই আমি। কিন্তু সেই অধীকার আপনি আমাকে কখনো দিবেন না। আপনার মন জুরে তো বিরাজ করছে দিগন্ত। কারন আপনি যে ওর ওয়াইফ। আপনি আমার মনে ভালোবাসার জাগরণ ঘটিয়েছন। কিন্ত আপনার মনে আমার জন্যে কোন ভালোবাসাই নেই। এই #বেলা_শেষে না আসলেও পারতেন আমার জিবনে। আচ্ছা এদেশে কি এলএলবি পড়ার জন্যে আর কোন ইউনির্ভাসিটি ছিলো না। কেন আপনাকে আমার শহরে আসতে হলো। ভূমিকার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলল আরাভ।

-এই যে বাবা আরাভ, তোমার আবার কি হইলো। কিছু বলছো না যে। ম্যানেজারের কথায় ঘোর কাটলো আরাভের। তারপর বলল,

-জ্বি চাচা বলুন!!!

-এই ভর দুপুরে তুমি আবার কই হাড়াইলা। এই মাইয়ার বিচার করো। কত্তবড় সাহস এর জানো। আমাকে বলে আমি নাকি টুকলি করে ক্লাস পাড় করেছি। আর না হয় আমি স্যারের মেয়েকে ডিস্টার্ব করতাম তাই স্যাররা আমাকে বেশী বেশী নাম্বার দিয়েছে যাতে আমি তাড়াতাড়ি স্কুল কজেল থেকে চলে আসি। ম্যানেজার রাগান্বিত হয়ে কথাগুলো বললেও, ওনার কথা শুনে সকল স্টাফ হেসে দিলো। এমনকি আরাভ নিজেও। সে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,

-এইবার ম্যানেজার কাকা পরেছে সঠিক মানুষের হাতে। আপনি পারেনও বটে। যাই হোক আমার এবার শান্তি মিলবে। কিন্ত আপনার শান্তি মিলবে কোথায়??

-মিসেস ভূমি ভুল কি বলেছে।আপনি সব হিসাবেই গোলমাল করেন। রাকিক কথাগুলো বলে ম্যানেজারের দিকে তাকাতেই দেখে ম্যানেজার তার দিকে রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আছে। ম্যানেজারের এমন চাহনি দেখে রাকিব শুকনো ডুকগিলে আমতা আমতা করে বলল,

-আ-আমার অনেক কাজ পরে আছে আমি যাচ্ছি। রাকিব চলে গেলো। তারপর একে একে সবাই যার যার কাজে চলে যায়। আরাভ ভূমিকার দিকে একপলক তাকিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ম্যানেজার ভূমিকাকে শাসিয়ে বলে,

-তোমাকে আমি দেখে নিবো। বিনিময়ে ভূমিকা ভুবন ভুলানো হাসি উপহার দিলো। এটা দেখে ম্যানেজার রাগে ঘটঘট করতে করতে চলে যায়।

নদীর স্রোতের মতো প্রবাহমান সময় বয়ে চলেছে প্রতিমুহূর্তে। কারো জন্য সে থেমে থাকেনা। জীবনে সাফল্যের মূলমন্ত্রই হল সময়ের সঠিক ব্যবহার।মহামূল্য সময়কে যে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে জানে,সেই পারে সাফল্য অর্জন করে নিতে। আর যে সঠিক ব্যবহার করতে জানে না তার জিবনে নেমে আসে চরম দুঃখ। ভূমিকার মাঝে মাঝে মনে হয় সে যদি আবার সেই ছেলেবেলা ফিরে পেত তাহলে নিজের জিবনটাকে সঠিক ভাবে গুছিয়ে নিতে পারতো। কেমন জানি ছন্নছাড়া হয়ে গেছে তার জিবন। প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রনায় ভুগছে সে। কিন্ত সেটা কাওকেই বুঝতে দিচ্ছে না।
কেটে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক। এর মধ্যে অবশ্য দিগন্ত একবার ভূমিকার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু ভূমিকা পাত্তা দেয়নি। ভূমিকার এখন কলেজে যাওয়া হয়ে উঠে না। নিতু ক্লাস করে আর ভূমিকা ওর কাছ থেকে সব নোটস নিয়ে পড়ে। এখং বেশীর ভাগ সময় তার অফিসেই কাটাতে হয়। সারাদিন ম্যানেজারকে খেপানো আর টুকটাক কাজ করা হয়। ভূমিকা যখন ম্যানেজারকে খেপায় আর ম্যানেজার রেগে ভুত হয়ে যায় কিন্ত ভূমিকাকে কিছু বলতে পারে না। এই দৃশ্য দেখে নিজের কেবিনে বসে অধরোষ্ঠ চেপে হাসে আরাভ। আরাভে কেবিনের চারিদিকে ওয়ান সাইড মিরর হওয়াতে সে সেখান থেকে সবকিছু দেখতে পায়। কাজের ফাঁকে ভূমিকাকে দেখা, কফির মগে চুমুক দেওয়ার সময় আড় চোখে ভূমিকার দিকে তাকানো আরাভের এখন একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। দিগন্তের এক্সাম চলছে। সে এখন তার এক্সাম নিয়ে ব্যস্ত।মিমিও এখন তাকে তেমন ডিস্টার্ব করে না। এই এক্সাম শেষ হলেই তো সে দিগন্তকে কাছে পাবে। ইসলামিক নিয়ম মেনে তারা আবার বিয়ে করবে এক সাথে সংসার করবে।ভাবতেই লাজ্জায় লাল হয়ে যায় মিমির মুখশ্রী।

ভূমিকা মন দিয়ে কাজ করছিলো আর ম্যানেজার রাগে ফুসফুস করছে। ব্ল্যাক মাম্বা সাপের ন্যায় রাগ হচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে এখনি ছোবল মেরে দিতে। কিছুক্ষণ আগে ম্যানেজার কাকা একটা হিসেব করতে বসছিলো। লাষ্ট মোমেন্ট এ গিয়ে সেটাও গুলিয়ে ফেলে। তাই ভূমিকা ওনাকে বলে, এই যে টুকে পাশ করা ম্যানেজার আপনার দ্বারা এসব হবে না আপনি সরুন আমি করে দিচ্ছি। ম্যানেজার তো রেগে একাকার। কিন্ত ভূমিকা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে মন দেয়। কিছুক্ষণ পর আরাভ আসে এখানে আর ম্যানেজার কে উদ্দেশ্য করে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

-ম্যানেজার কাকা, লাষ্ট প্রজেক্টে আমাদের কোম্পানি কত টাকা লস করেছে।

ম্যানেজার আমতা আমতা করে বলে,
-সেটা তো জানিনা বাবাজি।

-আপনি বলতে পারবেন মিসেস ভূমিকা। [আরাভ]

-টুয়েন্টি সেভেল লাক স্যার। [ভূমিকা]

-আরাভ গিয়ে ভূমিকার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলো। আর বলল, কালকের প্রজেক্টের ফাইলটা একটু দেখান প্লিজ। জ্বি স্যার। ভূমিকা একটা ফাইল বের করে আরাভকে সব হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আরাভ সেদিকে না তাকিয়ে তাকিয়ে আছে ভূমিকার মুখের দিকে। আরাভের অধরোষ্ঠে ঝুলানো এক মুগ্ধকর হাসি।

পরেরদিন মিটিংরুমে ম্যানেজারকে না নিয়ে ভূমিকাকে নিয়ে যায় আরাভ। ম্যানেজার বুঝতে পারছে ভূমিকার কারনে তার জায়গা চলে যাচ্ছে। তাই সে মনে মনে ভাবলো ভূমিকাকে তার সাথে রাখবে না। তার কাজ সে একাই করবে। কোন এসিস্ট্যান্ড লাগবে না তার। সেদিন মিটিংটা সুন্দরভাবে কম্প্লিট হয়। মিটিং থেকে যখনি আরাভ ফিরে আসে তখন ম্যানেজার বলে দেয় সে তার এসিস্ট্যান্ড চায়না। তার কাজ সে নিজে করবে। কারো হেল্প লাগবে না তার। আরাভ কিছু বলে না। মৃদু হেসে সেখান থেকে চলে আসে। ম্যানেজারের এসিস্ট্যান্ড না থাকলে আরাভ পাগল হয়ে যাবে।

এদিকে জুবাইদা ছেলের সারাদিন অফিসে থাকা নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছে। কালকেও তার বান্ধুবির মেয়ে এসেছিল কিন্তু আরাভের সাথে দেখা করতে পারেনি। আরাভ ওর মা কে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে সে আর কোন মেয়ের সাথে দেখা করবে না। জুবাইদাও কম কিসে। সে তার বান্ধুবির মেয়েকে নিয়ে গেছে একটা কবিরাজের কাছে।সে একটা ডাব পড়ে দিয়েছে। যেটা খেলে আরাভ বিয়ে করতে রাজি হবে। আরাভ বিয়ে করবে, তাদের একটা বউ মা হবে। ছোট ছোট বাচ্চারা পুরো বাড়ি জুরে খেলা করবে। ভাবতেই খুশিতে আত্নহারা হয়ে যাচ্ছে জুবাইদা। কিন্ত কে জানতো সেই ডাবের পানি খেয়েও আরাভ বিয়েতে মত দিবেনা। আরাভের মায়ের ধারনা কবিরাজ ঠিকি ডাব পড়ে দিয়েছে। কারন তাদের সামনেই তিনি কি যেন বিরবির করে বলে ডাবে ফু্ঁ দিচ্ছিলো। তাহলে কাজ হলো না কেন?? হয়তো ডাবে কোন সমস্যা ছিলো তাই কাজ হলো না। পরের বার তাবিজ নিয়ে আসবে।

একমাস পর,,,,,,,,

রাস্তার পাশে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন যুবক। পরনে হোয়াইট প্যান্ট, আর মিষ্টি কালারের শার্ট। প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে দোল খাচ্ছে যুবকটির কেশ। যুবকটি একটু পরপর তার হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর সামনে থাকা দুু-তলা বিশিষ্ট এই বাড়ির একটা রুমের দিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এই গেট দিয়ে নেমে আসলো এক আসমানি পরি।যার গায়ে ছিলো হোয়াইট কালারের শাড়ি। মাথায় খোলা চুল আর দু-হাত ভর্তি চুড়ি। পরিকে আসতে দেখেই যুবকটি ঞ্জান শুন্য হয়ে পরে। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই আসমানি পরির দিকে। পরিটা যখন তার সামনে এসে দাঁড়ালো যুবকটির ইচ্ছে করে তাকে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু সে যে এটা কিছুতেই করতে পারবে না। বহু কষ্টে নিজকে সামলিয়ে নিল সে।

-এখন অন্ততপক্ষে বলুন কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে।

-সেটা গেলেই দেখতে পারবেন।

-এখন বললে প্রবলেম কোথায়??

– ইউ উইল লস কনছিউসনেচ। আরাভের কথায় মন খারাপ করলো ভূমিকা। ভূমিকার এমন কালো মুখ দেখে মৃদু হাসলো আরাভ। তারপর বলল,

-গাড়িতে বসুন। ভূমিকা আড় চোখে আরাভের দিকে তাকিয়ে বেংচি কাটলো যেটা আরাভের নজরা এড়ালো না। তারপর গাড়িতে উঠে বসলো। আরাভ স্মিত হাসলে। তারপর সেও গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

মিনিট দশেক পর গাড়ি এসে থামলো একটা দুতলা ভবনের সামনে। আরাভ আর ভূমিকা দুজনেই গাড়ি থেকে মেনে ভাবনটির সামনে দাঁড়ালো। ভূমিকা তাকিয়ে আছ এই বাড়ির দিকে। কি সুন্দর মনোমুগ্ধকর বাড়ি। পুরো বাড়িটাই সাদারঙ করা। আর তার সামনে দিয়ে নানা ফুলে ভরপুর।

-কি হলো এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি? ভেতরে চলুন। আরাবের কথার প্রতিউত্তরে ভূমিকা বলে,

-আমার তো ইচ্ছে করছে এখানেই বাকি জিবনটা কাটিয়ে দেই।

-আপনি চাইলে সেটাও হবে। মনে মনে বলল আরাভ। তারপর ভূমিকার দিকে তাকিয়ে থেকে ভূমিকার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো। এই প্রথমবার আরাভ ওর হাত ধরেছে যেবার ভূৃমিকা কিছু বলছে না।

বাড়ির ভেতরে এসে ভূমিকা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। অধরে হাসি ফুটিয়ে আরাভের দিকে তাকায় একপলক। আরাব চোখের ইশারায় ওকে সামনে এগিয়ে যেতে বলে। ভূমিকা এতটাই খুশি হয়েছে যে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভুলে গেছে সে। আরাভের পাশে দাঁড়িয়ে সামনে থাকা এই চার ব্যক্তিকে দেখে যাচ্ছে।

চলবে,,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here