বেলাশেষে পর্ব -১৯

#বেলা_শেষে। [১৯]

ড্রয়িংরুমে মুখোমুখি বসে আছে দিগন্ত আর ভূমিকা। দিগন্তের দু-পাশে বসে আছে দিগন্তের বাবা মা। আর ভূমিকার পাশে ভূমিকার বাবা মা। নওশাদ তপু আর আরাভ এক সাইডে দাঁড়িয়ে আছে। ভূমিকা তখন দিগন্তের বাবা মা আর ওর বাবা মা-কে দেখে খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেছিলো। পরে যখন এখানে দিগন্ত ও তার বন্ধুরা আসে তখনি বিষন্নতায় ছেয়ে যায় ভূমিকার মন। অজানা এক ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে মায়ের বুকে মাথা গুজে দেয় সে। এতগুলো দিন পর আবার দিগন্তের মুখোমুখি হওয়াটাকে নরমালি নিতে পারে নি সে। পরক্ষনে যখন বুঝতে পারলো দিগন্ত ভালো আছে। ভূমিকাকে নিয়ে দিগন্তের কোন মাথা ব্যথা নেই তখন নিজেকে শক্ত করে স্বাভাবিক করে নেয় ভূমিকা। দিগন্ত মাথা নিচু করে বসে আছে। আর ভূমিকা তাকিয়ে আছে ওর বাবার মুখপানে। এই মানুষটার মুখ দেখলে দুনিয়ার বাকি সব ভূলতে পারে সে। অথচ এই মানুষটার মুখে না আছে কোন হাসি আর না আছে সুখের ছোঁয়া। হয়তো ভূমিকার এই অবস্থার জন্যে তিনি নিজেকে দায়ী করছেন। সেদিন চেয়ারম্যান যখন দিগন্ত আর ভূমিকার বিয়ের কথা বলে তিনি কেন অমত করলেন না। তাহলে তো ভূমিকাকে আজ এত কষ্ট পেতে হতো না। সকলের ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে মাশহুদ বলে উঠলো,

-দিগু, এহনো তোমার কাছে সময় আছে, একটু ভাইবা দেখো। তুমি কি সত্যিই ভূমি মা-কে ডিভোর্স দিবার চাও।

মাশহুদের কথা শুনে দিগন্ত ভূমিকার দিকে তাকালো। ভূমিকা তখনো তার বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলো। দিগন্তের কেন জানি মনে হচ্ছে এই ডিভোর্স না হলেই ভালো হয়। সে ভূমিকার সাথে সারাজিবন কাটাতে পারবে।এমন একটা মেয়ের সাথে কে না চায় সারাজিবন কাটাতে। পরক্ষনেই মিমির কথা মনে পরে তার। না- না এসব কি ভাবছিস তুই দিগন্ত। তুই তো মিমিকে ভালোবাসিস তাহলে এই স্টুপিড মেয়েটার কথা কেন ভাবছিস। তুই ছাড়া আর কে আছে মিমির। মিমি তোকে খুব ভালোবাসে। নিজের বিবেকের কাছে হেরে যায় দিগন্ত। করুন চোখে ভূমিকার দিকে একপলক তাকিয়ে মাশহুদকে বলে,

-নতুন করে আর কিছু ভাবতে চাইনা আমি, আব্বা।

দিগন্তের কথাশুনে অশ্রুসিক্ত নয়নে ভূমিকা তাকালো ওর দিকে। দিগন্তের সে দিকে খেয়াল নেই। সে তাকিয়ে আছে মাশহুদের দিকে। মাশহুদ শেষ পর্যন্ত কি সিদ্ধান্ত নেয় সেই অপেক্ষা। ভূমিকা বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। মনে হচ্ছে কেও ছুড়ি দিয়ে তার হৃদপিন্ডটাকে ক্ষত বিক্ষত করছে। এই বিয়ের পরিণতি তো আগে থেকেই জানা ছিলো তাহলে কেন এত কষ্ট হচ্ছে ভূমিকার। শেষ পরিণতি জানার পরেও কেন এত বড় ভুল করে ফেলল সে। দিগন্তকে ভালোবেসে ফেলল। ভূমিকা দু-হাতে শক্তকরে শাড়ির আঁচল চেপে ধরলো। ভূমিকাকে এমন অবস্থায় দেখে হাত শক্তমুঠি করে নিলো আরাভ। ভূমিকার এমন ছটফটানি সহ্য করতে পারেনি আরাভ। তাই সে নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

মাশহুদ তার ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে দিগন্তের হাতে দিলো। দিগন্ত কাগজটা ভালো করে পরখ করে নিয়ে ভূমিকার দিকে তাকালো। ভূমিকা তখন চোখ মিটমিট করে অশ্রু লুকানোর চেষ্টা করছে।

দিগন্ত আর ভূমিকা দুজনেই সেই কাগজটাতে সই করে দেয়। কি অদ্ভুত তাইনা, একদিন দুজনে একই কাগজে একটা করে সই করে একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলো। আর আজও একটা সই করেই সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসলো। অদ্ভুত তাইনা। আসলেই সব অদ্ভুত।

________________________
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে পকেটে দু-হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে আরাভ। আরাভের চোখের সামনে এখনো ভূমিকার সেই অস্বস্তিকর চেহারাটা ভেসে উঠছে বারবার। আরাভ যতই ভুলার চেষ্টা করছে সেই মুহূর্তটাকে ততই যেন সেটা ওকে আরো বেশী আঁকড়ে ধরছে। এবার খুব রাগ লাগছে আরাভের। নিজের রাগকে ধমাতে না পেরে গাছের উপর স-জোরে ঘুসি মারলো। এতে তো তার রাগ কমেই নি উল্টো হাতে ব্যথা পেল অনেকটা। হাতের কিছু অংশ ছিঁলে গেছে। যেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আরাভ তার হাতের অবস্থা দেখে হাত ঝাকি দিয়ে নিলো। তারপর দু-চোখ বন্ধকরে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলো। এমনি সময় পাশে কারো উপস্থিতি টের পেলো আরাভ। কে এসেছে সেটা দেখার জন্যে পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল ভূমিকা। ভূমিকার চোখে চোখ পড়তেই চটজলদি আবার পিছনে ফিরে আরাভ। বড় বড় শ্বাস নিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাকিক করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে আরাভের কানে আসলো ভূমিকার শান্ত কন্ঠে বলা কথাগুলো।

-আপনি -ই সবাইকে এখানে ডেকেছেন?? প্রতিউত্তরে আরাভ কিছু বলল না।

-কি হলো বলুন, আপনি আমার বাবা মা-কে এখনে ডেকেছেন?? কিছু বলছেন না কেন?? সবাইকে আপনি ডেকেছেন?? আরাভের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ভূমিকা।

-রিল্যাক্স, এক সাথে এত প্রশ্ন করলে কোনটার এ্যনসার দিবো। ভূমিকার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠলো,

-হ্যাঁ, এটাই সত্যি আমি ওনাদের সবাইকে এখানে ডেকেছি।

-কেন করলেন এটা আপনি?? আর আপনি-ই বা সবটা জানলেন কোথা থেকে??

-দিগন্তের থেকে জেনেছি। আরো কোন প্রশ্ন আপনার।

এবার ভূমিকার কথা গেলো আটকিয়ে। সে এখন কি বলবে। অবাধ্য অশ্রুরা এসে ভীড় জমিয়েছে চোখের কোটরে। জড়ানো গলায় বলে উঠলো,

-আপনি এটা না করলেও পারতেন স্যার। এতদিন তো আমার একটা পরিচয় ছিলো।আমাদের সমাজের সকলে এক নামে জানতো আমাকে আমি তালুকদার বাড়ির বউ। আর এখন আমার পরিচয় কি হবে জানেন। আমি একজন ডিভোর্সি মেয়ে। হ্যাঁ, এটাই আমার পরিচয় আমি ডিভোর্সি। আপনাদের শহুরে সমাজ ডিভোর্সি মেয়েদের কোন চোখে দেখে তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের কোন স্থান নেই বললেই চলে। কোন ভালো কাজে আমাদের যেতে নেই। পান থেকে চুন খসলেই শুনতে হয় মানুষের হাজারো কথা। স্বামির ঘর ভাঙা সম্পর্ক ভাঙা মেয়েদের যে কোন সম্মান নেই আমাদের সমাজে। মনে হয় যেন আমরাই সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ করেছি। এতটুকুও সম্মান নেই আমাদের। আর আত্নসম্মান ছাড়া বেঁচে থাকার যন্ত্রনাটা আপনারা বুঝবেন কি করে। কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো ভূমিকা।

ভূমিকার প্রতিটা কথা আরাভের বুকে বিষাক্ত তীরের ন্যায় আঘাত করে। সে নিরাধার চোখে তাকিয়ে থাকে ভূমিকার মুখ পানে। কষ্ট হচ্ছে আরাভের ও কষ্ট হচ্ছে খুব। সে তো পারবে না এই কষ্টকে কারো সামনে প্রকাশ করতে। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নেয় সে। তারপর বলে,

-এতদিন তো একটা মিথ্যে সম্পর্কের শিকলে বেড়িয়ে ছিলেন। এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেয়ে আপনি খুশি হয় নি। আপনার নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছে না। আপনার সমাজ কি বলবে না বলবে এই নিয়ে ভেবে তো নিজের জিবন নষ্ট করার কোন মানে হয় না। হ্যাঁ মানছি, ডিভোর্স জিসিনটা ভালো নয়। কিন্তু, এটা হারামও নয়। হালাল। হ্যাঁ আল্লাহ কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে, তালাক। প্রতিবেশী, সমাজ, রাষ্ট্র এরা কি বলবো না বললো সেটা ভেবে কেন নিজেকে কষ্ট দিবেন। আমারা মুসলমান, ইসলাম আমাদের ধর্ম। ইসলাম মানে কি জানেন, শান্তি। আর এই ইসলামের পতাকাতলে থেকে আপনি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভয়ে নিজের শান্তির কথা ভাববেন না, সে কি হয়। ইসলামের ইতিহাসে আছে, অনেক সাহাবি শুধু মাত্র সওয়াবের নিয়তে এই আশায় থাকতেন কোন বিধবা কিংবা ডিভোর্সি মেয়ে আছে কি না, যাকে বিয়ে করা যায়। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও কিন্তু একাদিক বিধবা ও ডিভোর্সি মেয়ে বিয়ে করেছেন।

নবী ও সাহাবিগন যেখানে বিধবা ও ডিভোর্সি মেয়েদের সম্মান দিয়েছে। তাদের বিয়ে করে নিরাপত্তা ও নিরাপদ জিবন দিয়েছে সেখানে আমাদের সামজে ডিভোর্সি ও বিধবা মেয়েদের মন্দচোখে দেখার প্রবনতা অবশ্যই মন্দ কাজ। পাপের কারন ও বটে।

এতক্ষণ আরাভের কথা ভালো শ্রোতার মতো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো ভূমিকা। আরাভ তো কিছু ভুল বলে নি। যেখানে ইসলাম আমাদের সাম্মান দিয়েছে সেখানে সমাজের ভয় কেন করবো। দু-হাতে চোখের পানি মুছে ভূমিকা। না সে কাঁদবে না। যে মানুষটা তার নয় তার জন্যে কেন সে কষ্ট পাবে।

-আপনি ঠিক-ই বলেছেন স্যার। যেটা হওয়ার গেছে। ফেলে আসা কোন কিছু নিয়ে আমি ভাবতে চাই না। আমার একটা সন্দর ব্রাইট ভবিষৎ আছে। এখন থেকে সেটা নিয়েই ভাববো। ভূমিকার সিদ্ধান্ত কিৎচিত হাসলো আরাভ।

-আংকেল আন্টি চলে গেছেন?? [আরাভ]

-বাবা মা ভিতরেই আছে। আপনিও চলুন না। [ভূমিকা]

আবারও স্মিত হাসলো আরাভ। তারপর বলল, আপনি যান আমি এখানেই ঠিক আছি। হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে চাপ দাঁরির কিয়ৎ অংশ স্লাইড করে নিলো আরাভ। এমন সময় ভূমিকার চোখ আটকে গেলো আরাভের হাতের দিকে। ফর্সা হাতের কিছুটা লাল লাল অংশ। সেখানে রক্ত জমাট বেধে লাল হয়ে আছে। ভূমিকার সাথে কথা বলার ব্যস্ততার হাতে ছিঁলে যাওয়ার যন্তণা ভুলে গেছিলো সে।

-স্যার, আপনার হাত থেকে তো রক্ত বের হচ্ছে। তড়িৎ গতিতে ছুঁড়ে দেওয়া ভূমিকার প্রশ্নে হাতের দিকে নজর দেয় আরাভ। আর তখন মনে পরে তার হাতে আঘাত দেওয়ার কথা। আরাভ হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর বলল,

-ঠিক আছে, আপনি যান।

-কোথায় ঠিক আছে। দেখি হাতটা দেখি। বলেই আরাভের হাত নিজের হাতের আবদ্ধে নিলো ভূমিকা।

-কতটা ছিঁলে গেছে। আর আপনি বলছেন ঠিক আছে। খুব জ্বালা করছে না। হ্যাঁ করছেই তো। এভাবে ছিঁলে গেলে অনেক জ্বালা করে। ইশ, এখন আমার কাছে তুলা নেই। আচ্ছা আপনার কাছে টিসু আছে। রক্ত পরিষ্কার করে দিতাম।

আরাভের কানে ভূমিকার কোন কথাই ডুকছে না। সে তাকিয়ে আছে এই ব্যাস্ত ভূমিকার মুখশ্রীর দিকে। তারপর তাকালো ভূমিকার হাতে আবদ্ধ থাকা তার হাতের দিকে।

-কি হলো, টিসু আছে আপনার কাছে??

-হ্যাঁ।

-কই দেন তাহলে??

-হ্যাঁ।

আরাভের এই হ্যাঁ হ্যাঁ করাতে বিরক্ত হয় ভূমিকার। এই স্যারটার আবার কি হলো শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করে যাচ্ছে। উহঃ তুলা থাকলে এখন এই রক্ত পরিষ্কার করে দিতে পারতাম।

-স্যার আপনি একটু ভিতরে আসুন। স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করাতে হবে। আসুন আমার সাথে।

এই মুহূর্তে আরাভের কি হচ্ছে কোন কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কোন কথাই বের হচ্ছে না আবাভের কণ্ঠনালির ভেতর থেলে। শুধু মাত্র ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে ভূমিকার দিকে। আরাভের এমন অবুঝের মতো চাহনি দেখে ভূমিকা বেশ বিরক্ত হয়। তাই সে আরাভের মতের অপেক্ষা করে না। আরাভকে টেনে বাড়ির ভেতরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

চলবে,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here