#বোকা_প্রেমিকা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট৮
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষেধ)
শুধু তোমার কন্ঠস্বর শুনবো বলে;
রাতের পর রাত জাগা আমার।
চোখে ঘুম নিয়ে…
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা!
তুমি ভালো থেকো..!
যদি আমার না হও;
অন্য কারও হইয়ো না।
যদি ইচ্ছে হয়,
না হও আমার সাথে তুমি করো
প্রতারণা
তুমি অন্য কারও হইয়ো না…
তুমি অন্য কারও হইয়ো না
শুভর এই বোকা প্রেমিক গানটার সাথে জলের জীবনের অনেকটা অংশই মিলে যায়।খুব আপন মনে হয় গানের প্রতিটা লাইনকে।যদিও জল নিজের মতো করে গানটাকে একটু পালটে নিয়েছে।গানের লাইনে সে ছলনার জায়গায় প্রতারণা বসিয়ে দিয়েছে।মেয়েরা করে ছলনা আর ছেলেরা করে প্রতারণা।এই একটু হালকা পরিবর্তনে জল গানের নাম পালটে রেখেছে #বোকা_প্রেমিকা।কাল জলের বিয়ে।বর্ষণের সাথে।বিয়ের আগে মেয়েরা কত কি করে।সংসার জীবন নিয়ে কত স্বপ্ন বুনে।আর জল রাতের নির্জনে ছাদে বসে গিটারের টুংটাং সুরের সাথে নিজের পছন্দের গানে গলা মিলাচ্ছে।বাংলা গান জলের বরাবরই খুব পছন্দের।বাংলা গানের প্রত্যেকটা লাইনের কথা জলের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।আর এই হার্ট টাচিং লিরিক্সের জন্যই জলের কাছে বাংলা গান এত প্রিয়।ফোনের স্ক্রিনে জল দেখে আড়াইটা বাজে।আর জাগা ঠিক হবে না।কাল বিয়ে। সারাদিন অনেক ধকল যাবে জলের ওপর দিয়ে।যদিও বিয়েটা হবে ঘরোয়া ভাবে ছোট পরিসরে।জলের বাবার ইচ্ছে ছিলো বেশ বড় পরিসরে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেবেন।কিন্তু তাতে জলই দ্বিমত পোষণ করে।কি লাভ ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে?অতিথি হিসাবে যারা আসবে তারা শেষমেশ পেট ভরে খেয়ে খুঁত ধরে বাড়ি ফিরবে।বাঙালির স্বভাবই তা। জলন্ত সিগারেটটা শেষ করে জল ঘরে যায় ঘুমাতে।
___________
জল খুব ভোরে উঠে বাবার বাসার দিকে রওনা দেয়।কলিংবেলে চাপ দিতেই ফিরোজা বেগম দরজা খুলে দেন।জলকে দেখে তিনি মুচকি হাসেন।জল তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ঘরে চলে যায়।গিয়ে আবার আরেকটা ঘুম দেয় সে।যখন তার ঘুম ভাঙে তখন সকাল ন’টা।জল জাবেদ সাহেবের ডাক শুনতে পান।তিনি জলকে সকালের নাস্তা করার জন্য ডাকছেন।জল ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে যায়।গিয়ে দেখে খাবার টেবিলে সাজিয়ে বসে আছেন জাবেদ সাহেব।জলকে দেখে তিনি হেসে বলেন,,
” অবশেষে বিয়ের কনের ঘুম ভাঙলো।তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
জল মুচকী হেসে চেয়ারে বসে।ফিরোজা বেগম এসে জলের প্লেটে দুটো পরোটা আর মাংসের তরকারি দেন।জল করুণ দৃষ্টিতে জাবেদ সাহেবের পানে চেয়ে থাকেন।মেয়ের চাহনিতে জাবেদ সাহেব বুঝতে পারেন যে মেয়ে কিছু বলতে চাইছে।
” কিছু বলবে?”
” খাইয়ে দেবে?কতদিন তোমার হাতে খাই না।”
জাবেদ সাহেব আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।চোখের কোণে জমা নোনা জল মুছে পরোটা ছিড়ে মেয়েকে খাইয়ে দেন।খাইয়ে দিতে দিতে বলেন,,,
” যাক অবশেষে তোমার রাগ ভাঙলো আমার প্রতি।”
জল এবারও মুচকী হাসে।খেতে খেতে নিজের মনের মধ্যে আওড়াতে থাকে সে,,
” রাগ তোমার প্রতি আমার কখনোই ছিলো না বাবা।যা ছিলো অভিমান।যা তুমি কখনো বুঝো নি।এমনকি বুঝার চেষ্টাও করো নি কখনো!অথচ তুমি প্রায়ই আমায় বলতে তোমার মতো করে আমায় কেউ বুঝে না।মানুষ আসলে কেউ কাওকে বোঝার মতো ক্ষমতা রাখে না।তারপরও প্রিয়জনকে ফর্মালিটির জন্য একপ্রকার মিথ্যে স্বান্তনা দিয়েই বলে ‘ আমি তোমাকে বুঝি।’ পৃথিবীতে এর মতো বড় মিথ্যা কথা আর একটাও নেই।”
জাবেদ সাহেব মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছেন।রান্নাঘর থেকে কাজের বুয়া এই দৃশ্য দেখে বলেন,,
” যাইক!মাইয়াডারে যত পাগুন্নি ভাবছিলাম মাইয়াডা অতও পাগুন্নি না।কত সুন্দর কইরা বাপের হাত থনে খাওন খাইতাছে!”
” ওর নাম জল। ওকে ওই নামেই ডাকবে।মেয়েকে পাগল বলছো জানলে তোমার খালু কিয়ামত লাগিয়ে দেবে।”
খালার কথা শুনে প্রত্যুত্তরে বলেন ফিরোজা বেগম।খালা কোনো কথা না বলে কাজে মন দেয়।
জল খেতে খেতে বাবাকে বলে,,,
” ছোটবেলায় প্রায়ই তুমি এভাবে খাইয়ে দিতে।কত সুন্দর ছিলো না ছোটবেলাটা?তুমি,আমি,মা কত মজা করতাম প্রতিদিন।খেলতাম,একই সাথে বসে টিভিতে টম এন্ড জেরি দেখতাম।কত সুন্দর ছিলো আমার ছোটবেলা নামক অতীতটা।”
মেয়ের কথা শুনে জাবেদ সাহেব আফসোসের দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
” আসলেই।তোর ছোট বেলাটা অনেক সুন্দর ছিলো।শুধু আমার কারণে তোর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো।”
জাবেদ সাহেবের চোখে,মুখে,কন্ঠে তখন তীব্র অপরাধ বোধের ছাপ।জলের বুঝতে বাকী রইলো না জাবেদ সাহেব নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজের কাজের জন্য প্রতিনিয়ত নিজেকে দোষী করছে,শাস্তি দিচ্ছেন।তিনি তার কাজের জন্য অনুতপ্ত।
খাওয়া হয়ে গেলে জল শাওয়ার নিতে যায়।ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে জল।প্রায়ই নির্ঘুম রাতের জন্য চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পরে গেছে।মুখে হাজারো আঘাত আর বয়সন্ধিকালে হওয়া ব্রণের দাগ।কিন্তু তাও কেন যেন জলকে সুন্দর লাগছে।অন্য রকম সুন্দর। হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন সৃষ্টি কর্তা নাকি বিয়ের আগে মেয়েদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেন।জল আজ নিজে তা উপলব্ধি করলো।শাওয়ার নিয়ে জল নিজের ঘরে যায়।দেখে জাবেদ সাহেব আগে থেকেই শাড়ি,গয়না-গাটি রেখে গেছেন।ঠিক এই কারণেই জল এই বাড়িতে আসতে চায় না।বাড়ির প্রতিটি ধুলিকণা বারংবার জলকে ওর সুন্দর অতীতে নিয়ে যায়।যা খুবই যন্ত্রণাদায়ক।জল ছোট থাকতে জাবেদ সাহেব এভাবেই সব গুছিয়ে রেখে যেতেন।জলকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তিনি অফিসে যেতেন।
শাড়িটা বেশ ভারী।রঙ লাল গোলাপী।বলতে গেলে গাঢ় গোলাপী।তারমধ্যে হাতের ভারী কাজ করা।জলের শাড়ি সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই।তাই জল সঠিক ভাবে ধরতে পারলো না শাড়িটা আসলে কি শাড়ি।তবে আন্দাজ করতে পারলো কাতান হবে শাড়িটা।
জল শাড়িটাকে সাইডে রেখে বিছানায় নিজের গা এলিয়ে দেয়।এরই মধ্যে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পায় জল।
” কে?”
” আফা আমি।টুনির মা।আপনে তৈয়র হইছেন?”
” না।”
” ওমা!এহনো তৈয়র হন নাই?আপনের হশুর বাড়ি থনে তো মানুষ আইয়া পরছে।আপনের জামাইডা যে সুন্দর আফা!কালা পাঞ্জাবীতে একেবারে ফুইট্টা উঠছে মানুষডা।”
” আপনাকে কিছু জিজ্ঞাস করেছি আমি?”
” আজ্ঞে না।”
” তাহলে শুধু শুধু আগ বাড়িয়ে কথা বলছেন কেন?”
” বিয়ার দিন মাইয়ারা জানবার চায় তো জামাইরে কিবা দেহা যাইতাছে।আমি ভাবছি আপনারও মন চাইতাছে শুনতে আপনার জামাইরে কিবা দেহা যাইতাছে।তাই কইলাম আর কি….”
” বলা হয়ে গেছে?”
” জ্যা।”
” আসতে পারেন।”
জলের এ হেন আচরণে টুনির মা বেশ অনেকটাই রেগে যায়।রাগে ক্ষোপে জলের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে তিনি বিদায় হন।
” শিক্ষা দিক্ষা কিচ্ছু নাই ছেমড়ির।থাকবো কিবায় বাপে অন্য বেডির লগে পিরিত মারাইছে।মায়ে গেছে গা এইন্না নিয়া।বাপ মায় তো নিজেগোরডাই বুঝছে।মাইয়ারে মানুষ করার সময় কই হেগো?”
টুনির মার সব কথাই জল শুনছিলো।একেকটা কথা জলের হৃদয়কে তীরের মতো আঘাত করছিলো।মানুষ এমন ভাবে জলকে নিয়ে কথা বলে যেন অতীতে সব কিছু জলের জন্যই হয়েছে।জল দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাড়িটা হাতে নেয়।মিনিট পনেরো বিশের মতো লাগে জলের শাড়ি পরতে।তারপর দীর্ঘসময় নিয়ে অদক্ষ কাঁপা হাতে কাজল দেয় জল।এই বারও জলের চোখে খোঁচা লাগে।বেশ অনেকটাই ব্যথা পায় জল।
” আপু আসবো?”
” কে?”
” আমি বর্ষা।”
” আচ্ছা।এসো।”
বর্ষা এসে দেখে জল অতি সাবধানতার সাথে নরম কাপড় দিয়ে চোখ মুছছে।বর্ষা তা দেখে জলকে বলে,,,
” কি হয়েছে আপু?”
” কাজল দিতে গিয়ে খোঁচা খেয়েছি।”
বর্ষা হেসে দেয়।হাসতে হাসতে বলে,,,
” কাজল দিতে গিয়ে কেউ খোঁচা খায়?”
” আমি আগে কখনো দিই নি কাজল।বুঝতেই পারছো।সাজগোজে ভোচার মা।”
” আমি সাজিয়ে দেবো?”
” দিবে?তাহলে তো আমার ভালোই হয়।”
বর্ষা ড্রেসিনটেবিলের কাছে গিয়ে দেখে কাজল,লিপস্টিক,প্রেস পাউডার ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
” আপু এগুলো দিয়ে কি বিয়ের সাজ হবে?”
” জানি না।ভারি সাজগোজ বলতে আমি যা বুঝি তাই নিয়ে এসেছি।”
” এগুলোই যদি তোমার কাছে ভারি সাজ হয় তাহলে আমার সাজ তোমার কাছে কি?মানুষজন তো দেখে বলবে তোমার না আমার বিয়ে।”
হেসে দেয় বর্ষা।সাথে জলও।
চলবে,,ইনশাআল্লাহ