ভালবেসে অবশেষে পর্ব -১১

#ভালবেসে_অবশেষে
#নুশরাত_জেরিন
পর্ব: ১১

মিলির বাড়িতে যাওয়া হয় না অনেকদিন। সেই যে বিয়ের পরে এসেছে আর যায়নি। তাদের বৌভাত অনুষ্ঠান হয়নি। বিয়েটাও তো স্বাভাবিকভাবে হয়নি, তাছাড়া সিয়াম নিজেও অফিস কামাই করে না, একটা দু’টো দিন যাও ছুটি পায় তবু বাড়ি ছাড়া নড়তে চায় না। সপ্তাহে একদিন সে আরাম করে ঘুমোয়। দশটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে স্টাডি রুমে ল্যাপটপ নিয়ে ঢোকে। সেখানেই আবার অফিস খুলে বসে।
মিলি কয়েকবার বাড়ি যেতে চেয়েও পারেনি। প্রথমবার বাড়ি যাবে, সিয়ামকে ছাড়া কিভাবে যায়? লোকসমাজ বলেও তো একটা কথা আছে। এমনিতেও এভাবে বিয়ে হওয়ায় লোকেরা কত কানাঘুষা করে। একা একা গেলে না জানি আরও কত কী বলবে।
উপায় না পেয়ে সে নীরার কাছে গেলো। নীরা বলল,
“ভাইয়া না গেলে তুই একাই যা বোন, ভাইয়া কোথাও যাওয়াটা তেমন একটা পছন্দ করে না জানিসই তো। তাছাড়া দুদিন আগে তোর মন রাখতে বিয়ে বাড়ি গেলো। এখন কী আবার ছুটি নেবে? ”

মিলি নিজেও ভাবলো। কথাটা একদম সত্যি। তার মন রাখতেই তো সিয়াম দুটো দিন ছুটি নিয়েছিলো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও! এখন আবার তাকে জোর করার মানে হয় না। কিছু বিষয় ছাড় দেওয়াটা উচিৎ।
তার ভাবনার মাঝে রেনু বেগম এলেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মিলি আর নীরার কথোপকথন তার কানে এসেছে।
তিনি বললেন,
“বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে রে মা?”

মিলি মাথা নাড়লো। আসলেই তার বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। কতদিন সামনাসামনি দেখা সাক্ষাৎ হয় না। নীরার কনসিভ করার কথা শুনে তারা এসেছিলো, তাও তো কতদিন হয়ে এলো। যদিও নিয়মিত ফোনে কথা হয়, ভিডিও কল করে। তারপরও ফোনে কথা বলে কী মন ভরে? জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে না? তাছাড়া নিজের রুমটা কতদিন খালি পরে আছে, আগে তো নিজের রুম ছাড়া কোথাও গেলে মিলির ঘুমই আসতো না। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।

রেনু বেগম বললেন,
“তবে যা, কিছুদিন গিয়ে থেকে আয়। সত্যি তো এতটুকু মেয়ে, বিয়ের পর সেই যে এলো…”

মিলি বলল,
“আপনার ছেলেকে ছাড়াই যাবো? লোকে যদি কিছু বলে?”

“সিয়াম যাবে বললে? তাহলে বলে দেখ। আর লোকের কথা কানে তুলিস তুই? লোকের কাজই তো মানুষের পিছু লাগা, মানুসিক ভাবে হেনস্তা করা।”

নীরা বলল,
“ভাই কী যাবে মা? ক’দিন আগে ছুটি নিলো… তারপর তো বারবার করে বলে দিলো, ‘আর একটা দিনও ছুটি নেওয়ার কথা মুখে তুলবে না।'”

মিলি বলল,
“বললেও হয়ত যাবে না মা, তারচেয়ে বরং আমি যাই? দুদিন থেকে চলে আসবো?”

রেনু বেগম বললেন,
“আজই যাবি? যা তাহলে, তবে সিয়ামকে জানিয়ে যাস।”

মিলি খুশিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

আলমারি থেকে জামা কাপড় ব্যাগে ভরার মাঝে মাঝে সিয়ামকে কল করলো মিলি। একবার, দু’বার, তিনবার.. পাঁচবারেও যখন ফোন রিসিভ হলো না তখন সে বাদ দিলো। সিয়াম বলেছিলো একবার, আজকের দিনে তার মিটিং থাকবে। হয়ত ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে।
মিলি ম্যাসেজ পাঠালো।
মায়ের রুমে এসে সালাম দিয়ে নীরার সাথে দেখা করে গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভার চাচা তাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। রেনু বেগম বারবার ড্রাইভারকে সাবধানে চালাতে বলতে লাগলো। এমন ভাবে দিকনির্দেশনা শুনে মিলির হাসি পেলো। এমন শাশুড়ি ভাগ্য করে পাওয়া যায়!

সিয়াম এলো সন্ধ্যে করে। আজ তার খুব খাটুনি গেছে। নতুন প্রজেক্ট শুরু করার আগে তাকে গাধার মত খাটতে হবে। দুপুর থেকে বিকেল অবধি তো মিটিং করতে করতেই পেরিয়ে গেলো।
ক্লান্ত শরীরে রুমে এসে বসতেই সে গলার স্বর উচু করে ডাকলো,
“মিলি!”

কাজের মেয়েটা প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো। বলল,
“কিছু লাগবে ভাইজান?”

সিয়াম যদিও মিলিকে আশা করেছিলো তারপরও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বলল,
“এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দে তো।”

মেয়েটা দ্রুত গতিতে বেরিয়ে মিনিট খানেকের মধ্যে আবার ফিরে এলো। হাতে তার পানি ভর্তি গ্লাস।
বলল,
“আর কিছু লাগবে?”

এক নিশ্বাসে পানিটুকু খেয়ে পুনরায় হাতে ধরিয়ে বলল,
“নাহ্, তুই যা।”

মেয়েটা প্রস্থান করতে সিয়াম গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। ক্লান্তিতে চোখ বুঝে আসছে। একটা ঘুম দিলে ভালো লাগতো। তবে তার আগে গোছল করা দরকার। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। আশেপাশে নজর ঘুরিয়েও মিলির হদিস পেলো না। মেয়েটা আজ কোথায় গেলো কে জানে!

রাতে খাবার টেবিলেও যখন মিলির দেখা মিলল না ঠিক তখুনি সিয়ামের টনক নড়লো। আসলেই, মেয়েটা গেলো কোথায়! মা, নীরা এমনকি সৌরভও টেবিলে এসে বসেছে শুধু মিলি ছাড়া।
সিয়ামকে খাবার নাড়াচাড়া করতে দেখে রেনু বেগম বললেন,
“খাচ্ছিস না কেনো সিয়াম, খাবার ভালো হয়নি?”

সিয়াম সে কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“সবাই কোথায় মা?”

রেনু বেগমের কপালে ভাজ পরলো। পরক্ষনে আসল ব্যপার বুঝতে পেরে তিনি হেসে উঠলেন। সৌরভও হাসলো।
বলল,
“সবাই বলতে কার কথা বলো ভাই? বোনভাবির কথা?”

সিয়াম থতমত খেলো। কড়া এক ধমক দিয়ে বলল,
“খাবার সময় এত কথা বলিস কেনো সৌরভ? চুপচাপ খাবার খা।”

সৌরভের মুখটা তখন দেখার মতো হলো। সে নিজেও যেন বেআক্কেল বনে গেছে। সে আগে কোথায় কথা বলল! তার মুখটা দেখে নীরা শব্দ করে হেসে ফেললো। অনেক কষ্ট করেও সে হাসি আটকাতে পারেনি। হাসার ফলে তার গলায় খাবার আটকে গেলো।

রেনু বেগম বললেন,
“তোকে মিলি বলেনি?”

সিয়াম বলল,
“কী বলবে?”

“ও যে আজ বাবার বাড়ি গেলো। তোকে নলে যায়নি?

” নাতো!”

“তোকে ফোনে পায়নি হয়তো, নয়ত ঠিক বলে যেতো। মিলি অতটাও দায়িত্বজ্ঞ্যনহীন মেয়ে না! তোর ফোন কোথায়? ”

সিয়াম তখুনি মনে পরলো তার ফোন বন্ধ। দুপুরে সাইলেন্ট করে রাখার পর চালু করতে গিয়ে দেখে কখন যেন চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরেও চার্জে দিতে মনে নেই।

মিলি বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে। বাবা মাকে বলে আসা হয়নি৷ সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে সে। আজ সকালে বাবার সাথে কথা বলেছিলো। কন্ঠ শুনেই সে বুঝেছে বাবার মনটা খারাপ। নিশ্চয়ই তার জন্য। কতদিন দেখা হয় না। আজ দেখা হলে নিশ্চয় খুব খুশি হবে।
একপ্রকার লাফাতে লাফাতে কলিং বেল বাজালো মিলি। দরজা খুললো তার মা।
এতরাতে মেয়েকে দেখে কয়েকবার চোখ ঝাপটে তিনি চিৎকার করে উঠলেন৷ পরক্ষনেই বুকে টেনে নিলেন। মিলি নিজেও মায়ের বুকে মাথা রাখলো।
আতাউর রহমান মাত্র ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বাইরে চেচামেচি শুনে বেরোতেই তিনি কেঁদে ফেললেন।
মিলি বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
“কাঁদছো কেনো বাবা? আমাকে দেখে খুশি হওনি?”

আতাউর রহমান বললেন,
“হুট করে কান্না পেয়ে গেলো, এতে আমার কী দোষ বুড়িমা?”

“ইশ তোমার এই ডাক টাকে কত মিস করেছি জানো?”

“আর আমাকে মিস করিসনি?”

মিলি হেসে ফেললো।

“বলবো কেনো, বুঝে নেও।”

….

প্রায় ভোররাতের দিকে আরেকবার কলিং বেল বাজলো। মিলি নিজেই উঠে এলো। মা বাবা তার সাথে গল্প করতে করতে অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে। বয়স হয়েছে তাদের। এখন আবার উঠে আসতে গেলে তাদের কষ্ট হতো।
মিলি নিজেই ঘুমকে একপাশে রেখে দরজা খুলতে এলো। দরজা খোলার সাথে সাথে তার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম হলো। সিয়াম এসেছে।
পরনে বাড়িতে পরার টি শার্ট, ট্রাউজার। পায়ে ঘরে পরার স্যান্ডেল। লোকটা বাড়ি থেকে সোজা এখানে এসেছে? পোশাক চেন্জ করতে কী ক্ষতি ছিলো?
মিলি মাথায় হাত দিলো, সিয়াম এতটাও পরিবর্তন হবে সে ভাবেনি।

,
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here