#ভালোবাসা_তুই
#পর্বঃ৯
#লেখিকা_সাদিয়া_আক্তার
_____________________________
ভার্সিটি শেষে বাসায় পৌঁছে ইরা তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে।ইরার এমন আচরনে রীতিমতো হতভাগ হয়ে তাকিয়ে আছেন ।যে মেয়ে তিন থেকে চারদিন নিজের রুম থেকেই বের হয়নি আর খাওয়া তো দূরের কথা সে মেয়ের মুখে এমন খুশির জ্বলক দেখে তো অবাক ।
ইরা মুখে বিরাট হাসির রেখা টানতে টানতে বলে,
—–আম্মু আজকে আমি খুব খুশি।মনে হচ্ছে জীবনের বেঁচে থাকার যেনো অর্ধেকের চেয়ে বেশি সুখ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। আর বাকিটা তো দিলে নিতেই পারবো না মনে হচ্ছে।
ইরার আম্মু সাহেলা বেগম মেয়ের খুশিতে নিজেও বেশ খুশি যদিও তার কারণ জানেন না।তাই কারণ জানতেই বলে,
——আরেএ মা!বলবি তো কি হয়েছে?হঠাৎ এমন কি হলো যে আমার এতোদিনের মরামুখো মেয়ে আজ এত্ত খুশি?(হেসে)
——মা মা! তুমি বুঝবে না।
——আরেএ বলেই দেখ না।আমি তো চাই আমার মেয়ে সারাজীবন এমনি হাসিখুশি থাকুক।
——আমার জীবনে যে জিনিসটা অপূর্ণ ছিলো ভেবে নাও সেইটার আজ অর্ধেকটা পূর্ণ হয়েছে।
——হুম বুঝতে পারছি তাহলে তো তোর ভাইয়া বাবার সাথে কথা বলে দেখতে হবে কি বলিছ!
——আরেএ না না আম্মু এখন না।কি যে তুমিও আরও পরে।আচ্ছা আমি এখন যাই ফ্রেশ হব।খাবো।
——আচ্ছা যা ফ্রেশ হয়ে আস।আমি খাবার বারছি।
সাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আয়নার সামনে চুল মুচছে।মিট মিট করে হাসছে একটু পর পর তূর্যের অনুভূতির কথা তার জন্যে ভেবে।ভাবতে দেরি নাই তন্মধ্যেই তূর্যের কল এসে পরে।ইরা দেখেই রিসিভ করেই বলে,
—-হ্যালো।
—-বাসায় পৌঁছেছো?
—–সেই কতো আগে।
—–খেয়েছো দুপুরে?
—–না খাবো।
—–আপনি খাওয়া-দাওয়া করেছেন?
—–না এখনো বাহিরে।কিছু কাজ আছে সেই জন্যে।
—–আচ্ছা বাসায় গিয়ে খেয়ে নিয়েন।
—–অকে।তুমিও খেয়ে নিয়ো।
ফোন রেখেই ইরা মুচকি হেসে খেতে চলে যায়।
🍁
ঠাসসস করে বাড়ির গার্ডকে থাপ্পড় মেরে বসলো আমির।
—–বাড়ির গেইট খুলতে এতো লেইট হয়?আমি এভাবে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো তোর গেইট খুলার অপেক্ষায়?
কিছুটা কান্নামাখা কন্ঠে গার্ড লোকটি বলে,
——স্যার! আমি তো দুই মিনটি দেরি কইলাম।বাথরুম পাইছিলো স্যার।
——তোর বাথরুম মাই ফুট!মুখে মুখে বেশি তর্ক করলে নেক্সট টাইম কাজে আসা লাগবে না।মনে রাখবি।
আমির চলে যাওয়ার পর অবাক হয়ে যায় গার্ডের লোকটি।আমগোর স্যার তো কহনো এমইন ব্যবহার করে নি।আজ এমন কি হইলো স্যার এমন রাইগগা আছেন?!
আমির রুমে ঢুকেই রুমের দরজা বন্ধ করে পাশে ঝারবাতি,স্টাডি টেবিলে রাখা বই,বিছানার চাদর সবকিছু ছুড়ে তন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
“না, না ইরা তুমি আর কারও হতে পারো না।তুমি শুধু আমার হবে।আমি আজ বিশ্বাস করতে পারছি না যা আমি নিজের চোখে দেখে আসছি।কিভাবে পারলে তুমি ইরা তূর্যের মত ওই
বেহায়া,আবালটাকে ভালোবাসতে।তুমি নিজেও জানো না তোমার জন্যে আমি কত বড়লোক ঘরের মেয়েদের প্রপোজাল রিজেক্ট করে আসছি শুধু তোমাকে পাবার আশায়,তোমার ভালোবাসার আশায়।”
আমির এইসব বলে বলে তার রুমের সবকিছু একএক করে ভেঙে যাচ্ছে।তার ভাঙাচূড়ার শব্দ শুনতে পেয়ে রাশেদ (আমিরের বাবা)দৌড়ে রুমের দরজা নক করতে শুরু করে।
–আমির আমির কি হয়েছে?তুই ঠিক আছিস বাবা।দরজা খুল।আমার ভয় হচ্ছে রে!
যাও তো আব্বু।ডিস্টার্ব করবে না।আমাকে একা থাকতে দাও।
রাশেদ সাহেবের কাছে আমিরের রুমের এক্সট্রা চাবি থাকায় তিনি রুমে ঢুকে যান।দেখেন আমির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে হাতে সিগারেট নিয়ে।চোখ আগুনের লার্ভার মতো লাল হয়ে আছে।হাতে কিছুটা ক্ষত।বাবাকে দেখতে পেয়ে আমির সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে পিশে দেয়।
—–তুমি এলে কিভাবে রুমে?(আমির)
—–আমি তোর বাবা ভুলে যাস না।তাই আমার ছেলের চিন্তার জন্যে এক পিতা অনেককিছু করে ফেলে যা তুই বাবা হলে বুঝবি।এখন বলবি কি হয়েছে?তোর মা মারা যাওয়ার পর তোকে আমিই কোলেপিঠে মানুষ করেছি।যখন যা চেয়েছিস দিয়েছি।তুই কক্ষনো আমার কাছে কিছু লুকোছ না।তবে আজ এমন কি হলো যে এমন ভাঙচূড়!
রাশেদ সাহেবের কথাগুলো শুনে,না চাইতেও হিচকে কান্না করা কন্ঠে আমির বলে,
—–আব্বু আমি ইরাকে চাই আব্বু!
—–ইরা?ইরাটা কে?তোর কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।সব খুলে বল।
আমির তার মনের সব কথা খুলে তার বাবাকে জানাই।জেনে রাশেদ কিছুটা মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়।কারণ আমিরের জন্যে অনেক ভালো ভালো বড়লোক ঘরের, বড় বিজনেসম্যানের মেয়েদের বিয়ের প্রপোজাল এসেছে।বাট এইসব ছেড়ে আমির পাগল সামান্য তার ভার্সিটির পড়ুয়া এক মেয়ের জন্যে।বেপারটা ঠিক হজম করতে পারছেন না।তবুও ছেলের কোনো চাহিদা অর্পূণ রাখেননি তিনি তাই ভেবেই রাশেদ সাহেব বলে,
—–অকে।আমি দেখছি।তুই চিন্তা করিছ না বাবা।
বলেই চলে যান।
🍂
প্রায় তিনদিনপর ভার্সিটি ক্লাস শেষ করে ইরা তূর্যের জন্যে অপেক্ষা করছে।তূর্য কিছুক্ষনপর আসে।
—-সরি সরি ম্যাম দেরি করে ফেলছি।
ইরা কথার উত্তর না দিয়ে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্যদিকে মুখ ফিরে।
—–আরে সরি তো বললাম।একটা কাজ ছিলো তাই লেট হয়ে গেসে।এখন আবার আমাকে মনে মনে গালি দিও না আমি ওইটা সেইটা।আমি সেখানকার বান্দর ওইখানকার বান্দর।
শুনেই ইরা কিছুটা অবাক হয়ে ফিক করে হেসে দিলো। অবাক হয়ে বলে,
—–আল্লাহ! আপনি কিভাবে জানেন?
—-হুম হুম সবি জানি।(একটু রেগে)
—-কিভাবে?বলেন না?
—–সেদিন তুমি বাসে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ছিলে সেইদিন ঘুমের ঘোরে আমাকে যা তা বলেছো।তোমার মনের কথা সব জানতে পেরেছিলাম সেদিন আমাকে নিয়ে।আমাকে যেমন ঘুমেরঘোরে গালিয়েছো তেমনি তোমার অনুভূতিগুলোও জানতে পেরেছি আমার বেপারে।
ইরা এখন লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।”আল্লাহ কি বলেছি।ছি ইরা!”(মনে মনে)
—–হয়েছে এবার মনে মনে বলে লজ্জায় লাল হতে হবে না।তবে লজ্জা পেলে তোমাকে ভালোই মানায় বিশেষ করে ওই টমেটোর মতো গুলুমুলু গাল গুলো।
তূর্যকে পিঠে কিল ঘুষি মেরে ইরা বলে,
—–হয়েছে বুঝছি।আমাকে খালি লজ্জা দিবেন কিভাবে এগুলোই ভেবে আসেন।(রেগে)
——হাহাহা।আচ্ছা এখন চল তোমার বাসার সামনে নামিয়ে দেই।বলেই তূর্যের ফোন এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার বেজেই চলছে।
——আচ্ছা কলটা রিসিভ করেন।তখন থেকে থেকেই বেজেই যাচ্ছে।উফফ!
——না করবো পরে।আগে নামিয়ে দেই তোমাকে বাসায়।
এই বলে ইরাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায় তূর্য।ইরা বাসায় এসে দেখে প্রচুর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।অনেক জোরে বজ্রপাত হচ্ছে।আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেসে।যেনো মেঘগুলোর দখলে আকাশটা এখন। মেঘের এমনরুপে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ইরা মাঝেমধ্যে। বাসায় ফাহিম ভাইকে আজ দেখতে পেলো না।
ইরা বলে,
—–আম্মু আম্মু, ভাইয়া কোথায় আম্মু?দেখতে পারছি না।বেরিয়েছে একটু আগে।
—–বাইরের অবস্থা দেখতে পাচ্ছো?কেমন আজকে?ভাইয়াকে বাসায় থাকতে বলবা না!
—–কি যেনো কাজ যেতেই হবে নাকি।আর তুই তো জানিস তোর ভাই তোর চেয়েও বেশি জেদি কারো কথা শুনে না তেমন একটা।
🍂
ইরা মন খারাপ করে বেরিয়া যায়।হঠাৎ তূর্যের কথা মনে করতেই কল দিলো।কিন্তু তূর্য কল বার বার বিজি বলছে।ভাইকেও কল দেয় তার কল ও বিজি।খুব টেনশন হচ্ছে এখন ইরার দুজনের জন্যেই।কিছুক্ষনপর ইরার ফোনে কার যেনো কল আসে।একটা অচেনা নাম্বার থেকে রিসিভ করতেই,
——ফাহিমকে কিছু ছেলেপুলের দল ধরে ইচ্ছেমতো মারছে।কিছুতেই কাউকে আটকে রাখা যাচ্ছে না।আর বেশি দেরি হলে হয়তো সিরিয়াস কিছু হয়ে যাবে।
বলেই কলটি রেখে দেই অচেনা সেই লোকটি।
ইরা কিছুই বুঝতে পারছে না।সবকিছু যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।কিচ্ছুক্ষনপর ইরার মোবাইলে একটি মেসেজ আসে। মেসেজের শব্দে ঘোর কাটে ইরার।মেসেজ অপেন করতেই, ওই অচেনা লোকটি তাকে সেই জায়াগার ঠিকানা সেন্ড করে।ইরা আর কিছু না ভেবে কোনো মতে বিছানায় পরে থাকা ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জোরিয়ে বেরিয়ে যায়।প্রচুন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।তবুও সেই ঠিকানায় পৌঁছে ইরা ফাহিমকে খুজতে লাগলো। দুর থেকে কয়েকজন ছেলেদের বিশ্রি ভাষার গালাগাল শুনতে পেয়ে ওইদিকটাই যেতে থাকে ইরা। তার ভাইকে কিছু ছেলেপুলে দুইহাত পা বেধে মারছে লাঠি দিয়ে।ভাইয়া বলে চিৎকার দিয়ে ফাহিমের কাছে চলে যায় সেই ছেলেদেরকে সরিয়ে।সেখানে থাকা সবাই ইরার কান্ড কিচ্ছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখছে।ফাহিমের অবস্থা কিছুটা খারাপ।নাক,মুখ থেকে রক্ত ঝরছে।হাত,পায়েরও কিছুটা অংশ কেটে গেছে।ইরা ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁধে দিলো।
—–ভা ভাইয়া তো তোমার এই অবস্থা কেনো?আর উনারা কারা ভাইয়া?
আমতা আমতা করে রাগি স্বরে ফাহিম বলে,
——তুই যা ইরা এখান থেকে।এইটা আমার মেটার।তুই জোরাইছ না।বাসায় যা।
——না ভাইয়া তোমাকে না নিয়ে এক পাও আগাবো না।
বলেই পিছন থেকে এক চিরচেনা স্বর ভেসে আসলো।
ওই ছেলেগুলোকে সে বলে,
—–ওই কি হলো তোদের? হাতে পায়ে চুড়ি পরে এসেছিস যে কথাটা শালা এখনো বলেনি।তোরা পারবি না আমাকেই এখন যা করার করতে হবে।
বলেই হাতে লাঠি নিয়ে ফাহিমের দিকে যেতে থাকলো।
ইরা সেই চেনা কন্ঠ শুনে পিছনে তাকিয়েই হতভম্ব হয়ে যায়।তূর্য হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহিমেকে হিট করার জন্যে।ইরাকে এভাবে হঠাৎ দেখে তূর্যেও অবাক। লাঠিটি পরে যায় হাত থেকে।ফাহিম বলে,
—–তুই কি ভেবছিস তুই আমাকে এভাবে ছেলেপুলে এনে মার খাওয়াবি আর আমি তোকে সব গোর গোর করে বলে দিবো?নেভার।তুই শালা আমাকে মেরে মাটিতে পুতিয়ে ফেল তবুও বলবো না।
তূর্য ফাহিমের কোনো কথারই উত্তর দিতে পারছে না।ইরার দিকেই তাকিয়ে আছে।বুঝার চেষ্টা করছে ইরার এখানে আসার কারণটা।তূর্য কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইরা
ফাহিমকে উঠিয়ে নিলো।
কান্না জোরজারিত কন্ঠে ইরা বলে,
—-উঠো ভাইয়া।তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
ফাহিমেরে হাত তার কাধে রেখে কিছুটা ভার নিলো। কারণ ফাহিম মাইর খাওয়ায় উঠতে পারছে না।ফাহিমকে নিয়ে ইরা সামনে যেতেই ছেলেগুলো আটকাতে গেলে তুর্য ইশারা করে ছেলেগুলোকে। তাদের যেতে দিতে বলে।পথ না আটকাতে বলে।প্রচুন্ড বৃষ্টির মধ্যে ইরা ফাহিমকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ভিজে চুপচপ একদম। কোনো গাড়ি পাচ্ছে না।তারাহুরোয় ফোন বাসায় রেখে আসায় কাউকে জানাতেও পারছে না।মেঘ না চাইতে বৃষ্টি এমনি ঘটনা ঘটলো ইরার সাথে।আমিরের গাড়ি কিছুদুর গিয়ে তাদের সামনে দাড়াঁয়।আমির গাড়ি থেকে বেরিয়ে এই অবস্থায় ইরাকে দেখতে পেয়ে অবাক।আমির বলে,
—–ইরা এই কি?এভাবে কাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো।উনি কে?
——-প্লিজ আমির আমাদের একটু হসপিটাল অবধি লিফট দিবেন।খুবই বিপদে পরেছি।(কান্না করতে করতে)
—–হ্যা সিউর।
বলেই আমির ফাহিমকে ধরে গাড়িতে ঢুকায়।হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার জন্যে।ইরা কান্না করছে আর তার ভাইকে ধরে বলছে,
—–ভাই তোমার কিচ্ছু হবে না।
আমির ইরার কান্না দেখে আরও বিচলিত হয়ে পরছে।
___________________
চলবে🍂