#ভালোবাসা রং বদলায়
লেখক —- #মাহমুদ
পর্ব — ৩
,
রূপা চুলোয় মাছ ভাসছিলো আর দ্বীপের সাথে কাটানো পুরোনো দিনগুলো নিয়ে স্মৃতিসরণ করছিলো। সত্যিই কতই না সুন্দর ছিলো সেই দিনগুলি। দ্বীপের সাথে সেই প্রথম দেখা!
ঠিক পাঁচ বছর আগে। একদিন রূপা বাজার থেকে তরকারি কিনে বাসায় ফিরছিলো। এমন সময় কেউ একজন তাকে ধাক্কা দিতেই সে নিচে পড়ে গেল। সেই সাথে তরকারি গুলোও ছিটিয়ে ছুটিয়ে রাস্তায় পড়ে গেল। রূপা বেশ বিরক্ত হয়ে ছেলেটির দিকে তাকাল। বললো,(লেখক মাহমুদ)
– ‘রাস্তায় চলার সময় একটু দেখে শুনে চলতে পারেন না? দেখুন তো আপনার জন্য তরকারিগুলো রাস্তায় পড়ে গিয়েছে!’
দ্বীপ বললো,
– ‘সরি! আসলে আমি বুঝতে পারিনি। একটু তাড়া ছিলো তো তাই….’
– ‘ইটস ওকে।’
দ্বীপ বললো,
– ‘থ্যাংকস! বাই দ্যা ওয়ে আপনার নামটা কী জানতে পারি?’
– ‘আমার নাম জেনে আপনি কি করবেন?’
– ‘এমনি। কেন জিজ্ঞেস করে কি ভুল করলাম নাকি?’
– ‘তা না। আমিও এমনিই জানতে চাইলাম। আমার নাম রূপা। আর কিছু?’
– ‘না।’
– ‘তো… আপনার নাম কী?’
– ‘দ্বীপ।’
– ‘ওহ।’
আর কিছু বললো না রূপা। নিচে ঝুকে সে তরকারি খুঁটতে লাগলো। দ্বীপ বললো,
– ‘কিছু মনে না করলে আমি হেল্প করতে পারি?’
– ‘থ্যাংকইউ! কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন নেই।’
দ্বীপ আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পর দেখলো, রূপা ব্যাগে তরকারি ঢুকালেও সেগুলো নিচে পড়ে যাচ্ছে। এতে করে রূপা বেশ বিরক্তও হচ্ছে। দ্বীপ আর কিছু না ভেবে ওর সাথে তরকারি খুটতে লাগলো। রূপাও আর বাধা দিলো না।
যাওয়ার সময় রূপা বললো,
– ‘আরো একবার থ্যাংকইউ আপনাকে!’
– ‘ওয়েলকাম।’
– ‘তাহলে আসি।’
– ‘অবশ্যই।’
রূপা কিছু পথ এগুতেই ১০/১২ কুকুর দেখতে পেল। রূপা ভেবেছিল কুকুরগুলো তাকে কিছু বলবে না। সে তো এখন বড় হয়ে গিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে পা বাড়াতেই কুকুরগলো একসাথে ঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠলো। রূপা, ‘ওমাগো’ বলে লাফিয়ে উঠলো। কুকুরগুলো যেই ওর দিকে এগুতে লাগলো সে ভয়ে পিছন দিকে দৌড়াতে লাগলো। রূপা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল কুকুরগুলোও তার পিছন পিছন ছুটে আসছে। ভয়ে রূপার গলা শুকাতে লাগলো। মনে মনে সে বিখ্যাত দোয়াটি বার বার পড়তে লাগলো, আলিফ লাম, কুত্তা থাম! আলিফ লাম, কুত্তা থাম! আলিফ লাম কুত্তা থাম! আলিফ লাম, কুত্তা থাম!!’ আজ মনে হয় সে গেছে! ভাবতেই চোখ বন্ধ করে ফেললো ও। হঠাৎ কারো বুকে তার মাথা ঠেকে গেলো। মুখ তুলে তাকিয়ে সে দেখতে পেল দ্বীপকে। রূপা অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘দ্বীপ।’
দ্বীপ দেখতে পেল রূপা থরথর করে কাঁপছে। কিন্তু কেন?
দ্বীপ বললো,
– ‘কি হয়েছে? এমনভাবে কাঁপছেন কেন?’
– ‘আমাকে বাঁচান। ওর আমাকে মেরে ফেলবে।’
– ‘কারা মেরে ফেলবে?’
রূপা তার এক হাত পিছন দিকে ইশারা করে বললো,
– ‘ওরা… ওরা মেরে ফেলবে। প্লিজ ওদেরকে তাড়িয়ে দিন। না হলে আমাকে মেরে ফেলবে।’
দ্বীপ এদিকওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। বললো,
– ‘আপনি প্লিজ শান্ত হন। এখানে আমি আর আপনি ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নেই।’
– ‘আছে আছে। আপনি ভালো করে দেখুন। ওরা তো আমার পিছনেই…..’
বলতে বলতেই পিছন ঘুরে তাকালো রূপা। দ্বীপ বললো,
– ‘দেখুন এখানে কেউই নেই।’
– ‘এটা কিভাবে সম্ভব? একটু আগেই তো ওরা ছিলো।’
– ‘কারা ছিলো সেটাই তো বলছেন না? কোনো ছেলে কি আপনার যাওয়ার পথে ডিস্টার্ব করেছে?’
– ‘হু… ছেলে না তবে ১০/১২ গুন্ডা আমার পিছনে লেগেছিল। আপনি আজ না থাকলে আমি মনে হয় শেষ হয়ে যেতাম।’
– ‘মানে? গুন্ডা তো ছেলেরাই হয়। আপনি কোন গুন্ডার কথা বলছেন?’
– ‘আরে আপনি চিনেন না? ওই যে রাস্তাঘাটে সবাই একসাথে থাকে। মেয়ে দেখলেই পিছন ধরে। যাকে এক কথায় বলে কুকুর… ‘
রূপার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো দ্বীপ। বললো,
– ‘এতক্ষণ ধরে তাহলে আপনি এই বিখ্যাত গুন্ডাদের কথা বলছিলেন?’
– ‘হু…’
– ‘আপনি পারেন ও বটে। কুকুরকে গুন্ডা বানিয়ে দিলেন! এটা আমার জীবনে প্রথম শোনা!'(লেখক মাহমুদ)
– ‘তো কি বলবো ওদেরকে? ওরা তো গুন্ডাদের মতোই আমার পিছু ধরলো।’
– ‘আচ্ছা! তা আপনার বাসা এখান থেকে কতদূর?’
– ‘এইতো এখান থেকে বেশি দূর না। যেতে যেতে দুই মিনিট লাগবে।’
– ‘ও। তা হেটে হেটে না গিয়ে রিক্সায় করে যেতে পারেন না? তাহলে আর কুকুরের… সরি গুন্ডাদের নজরে পড়তেন না?’
– ‘মজা নিচ্ছেন না?’
– ‘মজা নেবো কেন? আচ্ছা চলুন!’
– ‘চলুন বলতে!’
– ‘আপনাকে তো গুন্ডারা যেকোন সময় এট্যাক করতে পারে। তাই আরকি বললাম আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
– ‘না না। তার কোনো দরকার নেই। গুন্ডাগুলো এখন আর নেই। আমি একাই যেতে পারবো।’
– ‘গুন্ডাগুলো যদি যাবার পথে আবারও আসে? তখন কি করবেন?’
দ্বীপ দেখলো রূপা কথাটা শুনে বেশ ভয়ে পেয়েছে। ও একগাল হাসি দিয়ে বললো,
– ‘ভয় নেই আমি তো আছি।’
দ্বীপের কথাটা শুনে যেন ভরসা পেল রূপা।
দ্বীপ হাটতে হাটতে রূপাকে বললো,
– ‘আচ্ছা! একটা কথা বলো তো।’
– ‘কি?’
– ‘তুমি কি রোজই বাজার করতে আসো?’
– ‘হ্যা।’
– ‘ও! তা তোমাকে না পাঠিয়ে তোমার বাবা কিংবা মা যেতে পারেন না?’
– ‘বাবা তো সবসময় ব্যস্ত থাকেন। আর মা তো সংসার সামলাতে সামলাতে ব্যস্ত থাকেন। তাই আর কি আমার আসতে হয়।’
– ‘ও।’
– ‘হু… আমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্য অনেক অনেক থ্যাংকস!’
– ‘মানে? আমরা বাড়ি এসে গেছি?’
– ‘জি।’
– ‘ও। আমি ভাবলাম…..’
– ‘কি?’
– ‘তেমন কিছু না!’
– ‘তাহলে আমি আসি?’
– ‘ইয়াহ!’
রূপা চলে যাচ্ছিলো ধ্রুব পিছন থেকে ডেকে বললো,
– ‘এই যে শুনছেন?’
– ‘জি?’
– ‘আপনার ফোন নাম্বারটা কি পেতে পারি? না মানে! যদি গুন্ডারা আপনাকে আবারও এট্যাক করে তাহলে আপনি আমাকে একটা কল দিতে পারবেন। আর আমি আপনাকে ওদের হাত থেকে বাচাতেও পারবো।’
রূপা চুপ করে আছে। দ্বীপ বললো,
– ‘প্লিজ…….’
রূপা বললো,
– ‘আইডিয়া টা কিন্তু মন্দ না।’
এরপর থেকে দুইজনের মাঝে বেশ কথোপকথন চললো। তারা একে অপরকে জানতে জানতে ঘনিষ্ঠ হতে লাগলো। তারপর গিয়ে একসময় দুজন বন্ধুত্বে পরিণত হলো। আস্তে ওরা একেঅপরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলো। সেই স্বপ্ন থেকেই শুরু হলো ওদের ভালোবাসার অধ্যায়! এখনও রূপার মনে পরে সে দিনগুলোর কথা! কত কথা, দেখা করা, কতশত প্লানিং সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতোন ছিলো। কত মধুময় না সেই দিনগুলি!(লেখক মাহমুদ)
হঠাৎ হাতে গরম খুন্তির ছ্যাকা পড়তেই ভাবনার জগত ছেড়ে বেরিয়ে এল রূপা। হাতের যন্ত্রণায় আহ বলে কেঁকিয়ে উঠলো সে। ডান সাইডের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ধ্রুবকে।
– ‘কি ভাবছিলি এতক্ষণ ধরে? সেই ধরে যে তোকে ডাকতেছি কানে যাচ্ছিল না? কি করেছিস একটু দেখ তো! মাছ ভাজতে গিয়ে তো কয়লা বানিয়ে ফেলেছিস দেখছি! মানুষ কখনও এতটা বেখেয়ালি হয়?’
ধ্রুবের ধমকে কেপে উঠলো রূপা। ধ্রুব বললো,
– ‘কথায় আছে না? কাকে দিলাম রাজার পাঠ! তোর উপর আমার এতবড় দায়িত্ব দেয়াটা ভুল ছিলো। আজ তো দেখছি আমার সবার সামনে মাথা কাটা যাবে। শুধুমাত্র তোর মত একটা সস্টুপিড মেয়ের জন্য।’
– ‘আসলে আমি বুঝতে পারিনি। আর এমনটা হবে না।’
– ‘এত কথা এখন আর আমি শুনতে চাই না। আশেপাশে মা আর আত্মীয়স্বজনরা আছে। আমি এখানে কোনো সিনক্রেয়েট করতে চাই না। সো শ্যাট আপ। এন্ড আমার জন্য এক কাপ লাল চা বানিয়ে নিয়ে আয়।’
– ‘জি।’
ধ্রুব চলে গেল। রূপা হাতে খুন্তির ছ্যাকা জায়গায় আঙুল বুলাতে লাগলো। বেশ জায়গা জুড়ে পুরে গিয়েছে ওর। এখন খুব জ্বলছে। হাতে কিছু দেবে তারও কোনো সময় নেই। এখন ধ্রুবের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভাবতেই চা বসিয়ে দিলো সে।
বেশকিছুক্ষণ ধরে ঘরের সামনে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। ভিতরে যাবার মতো কোনো সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না সে। কিন্তু এভাবে দাঁড়ানোরও কোনো মানে হয় না। ধ্রুব যদি দেখতে পায় সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। নাহ! আর দাঁড়াবে না সে। ভাবতেই রূপা এগুলো ঘরের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে ধ্রুবের সামনে দাঁড়াতেই সে ওর দিকে তাকালো। রূপা বললো,
– ‘আপনার চা…’
ধ্রুব চা টা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করছিলো। তারপর এক চুমুক দিতেই ইয়াক বলে মুখ থেকে ফেলে দিলো সে। ধ্রুবের এমন কান্ডে অবাক হয়ে গেল রূপা। ধ্রুব বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর রূপাকে বললো,
– ‘এটা কি বানিয়েছিস তুই?’
রূপা কাপা কন্ঠে বললো,
– ‘চ চা…….’
– ‘সেটা তো আমিও দেখতে পাচ্ছি। এটা চা নাকি অন্যকিছু? আমি না তোকে বলেছি দুধ চা বানিয়ে আনতে! তাহলে তুই লাল চা আনলি কেন? তুই জানিস না আমি লাল চা খাইনা। এরপরও কেন লাল চা বানিয়ে আনলি?’
– ‘আপনিই তো বললেন লাল চা বানাতে!’
– ‘আমি বলেছি মানে? কখন বললাম আমি লাল চা বানিয়ে আনতে?’
– ‘একটু আগেই তো বলেছিলেন লা চা…..’
– ‘জাস্ট শ্যাট আপ! আমার মুখের উপর তর্ক করা না?’
বলতে বলতেই গরম চা রূপার গায়ে ঢেলে দিলো ধ্রুপ। এরপর চায়ের কাপ মেঝেতে ফেলে দিতেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ধ্রুব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রূপাকে একটা ধাক্কা দিতেই সে মেঝেতে পড়ে থাকা কাচের উপর পড়ে গেল। একটা কাচ ওর হাতে ফুটে গেল। বেশ কয়েক জায়গা দিয়ে কলকল করে রক্ত ঝড়ছে ওর। ধ্রুপ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বললো,
– ‘দিন দিন দেখছি তোর সাহস খুব বেড়ে যাচ্ছে। আমার উপরে কথা বলার স্পর্ধা কোথায় পেয়েছিস তুই? আর আজ যেখানে তোর একা রান্না করার কথা ছিল সেখানে তুই আমার বোনকে দিয়ে কোন সাহসে রান্না করালি? বল আমাকে কোন সাহসে করালি?’
রূপা কিছু বলছে না। চুপচাপ স্তব্ধ হয়ে সে বসে আছে। ধ্রুব রূপার মুখ এক হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,
– ‘একটা কথা শুনে রাখ। আমার মা কিংবা বোন, তাদেরকে দিয়ে যদি কোনো কাজ করাতে দেখি তাহলে আমার থেকে কেউ খারাপ হবে না। একটা কথা মনে রাখবি তুই এই বাড়ির দাসী। তোকে যেমন ভাবে কাজ করতে বলা হবে তুই নিতান্তই সেই ভাবেই কাজ করবি। এস লাইক অ্যা দাসীদের মতো!’
কথাগুলো বলেই ধ্রুব চলে গেল ঘর ছেড়ে। রূপা চিৎকার করে কাঁদছে। হাতের যন্ত্রণায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে ওর। মানুষ এতটা নির্দয় কিভাবে হতে পারে? একটুও কি ধ্রুবের মনে মানুষত্ব বলতে কিছুই নেই?
চলবে,,,,,,,,,,,,
অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ