#ভালোবাসার_রংবদল
#পর্বঃ১০
#Saiyara_Hossain_Kayanat
সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ঘুম অবস্থায় চোখ মেলে সামনে আদ্র ভাইকে আমার দিকে ঝুঁকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আঁতকে লাফিয়ে উঠে বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে পরলাম। বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলাম-
—”আপনি এতো সকালে এখানে কি করছেন আদ্র??”
আমার কথায় মনে হচ্ছে উনি প্রচুর বিরক্ত হলেন। ওনার ভ্রু জোড়া আগের থেকেও বেশখানিকটা কুচকে গেল। আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন-
—”চারপাশে তাকিয়ে দেখ শুভি উত্তর পেয়ে যাবি।”
ওনার কথা মতো আমি চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখতেই মনে পরলো কালকের কথা। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আর এখন আমি নিজের বাসায় না আদ্র ভাইয়ের বাসায়। আমি আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে মিনমিনিয়ে বললাম-
—”আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম বিয়ের কথা।”
আদ্র আমার দিকে মলিন মুখে তাকিয়ে অসহায়ের মতো বললেন-
—”আমি কি তোকে শুধু শুধুই পিচ্চি বলি শুভি!! বিয়ের দিন কান্নাকাটি করে হিচকি তুলতে তুলতে আমার বুকেই গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পরলি। বাসর রাতে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে পুরো রাত আরামসে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলি। আর এখন??? এখন তো ভুলেই গেলি আমাদের বিয়ের কথা।”
ওনার কথা গুলো শুনে প্রচুর হাসি পাচ্ছে তবু্ও খুব কষ্টে হাসি আটকে রেখেছি। উনি এবার আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-
—”তোর কি আর কোনো অদ্ভুত ইচ্ছে আছে?? থাকলে ওই গুলাও পূরণ করে ফেল। বিয়ের স্মৃতি গুলো একদমই অদ্ভুত রকমের করে ফেল। আমার তো মনে হচ্ছে তুই ইচ্ছে করেই এমন করছিস! আমি তোকে সব সময় রাগ দেখাই, ধমকাই, শাসন করি তাই প্রতিশোধ নিচ্ছিস।”
এবার আমি আর হাসি দমিয়ে রাখতে পারলাম না। খিলখিল করে হেসে উঠলাম। আমার হাসি দেখে আদ্র ভাই আমার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি হাসতে হাসতে বললাম-
—”আরও বেশি করে ধমকান আমাকে। এবার থেকে আমিও প্রতিশোধ নিবো আদ্র ভাইইইইইইই।”
একথা বলেই আমি হাসতে হাসতে ওয়াশরুমের চলে গেলাম। আর উনি এখনো মলিন মুখ করে বসে আছে।
—————————
আকাশের রক্তিম আভা কেটে এখন আঁধার নেমে আসছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার এই পরিবেশটা উপভোগ করছি বললে ভুল হবে। আসলে সারাদিন সাবার সামনে হাসি মুখে থেকে এখন নিজেকে একটু একা সময় দিচ্ছি। সারাদিন সব কিছু ভালো গেলেও আন্টির ব্যবহার আগের থেকেও অবনতির দিকে। ওনার চোখে আমি আমার জন্য আগে ভালোবাসা দেখতে পেলেও এখন সেই চোখেই আমি ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি। সবাই আমার সাথে ভালো করে কথা বললেও আন্টি আমাকে এড়িয়ে চলছে। দীপ্ত আমাকে অনেক বুঝিয়েছে বলেছে আন্টির রাগ কিছুদিনের মধ্যেই কমে যাবে। তবে আমি তেমন কোনো লক্ষন দেখছি না মনে হচ্ছে রাগ দিন দিন বেরেই চলছে।
আন্টির এমন ব্যবহার আর আব্বুকে মিস করা সব কিছু মিলিয়ে ভিতর ভিতর খুব কষ্ট পাচ্ছি তবে কাউকে বলতে পারছি না।
—”এই অবেলায় এখানে কি করছিস শুভি?”
আদ্রর কন্ঠ শুনে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে বললাম-
—”এই তো আকাশ দেখছি। আপনিও দেখুন প্রকৃতির রূপ লালচে-ধূসর রঙের আকাশ কতো সুন্দর।”
আদ্র আমার পাশে এসে দাড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন-
—”তোকে কিছু কথা বলার ছিলো শুভি। এখন কি তোমার সময় হবে?”
ওনার এমন কথায় খুব অবাক হলাম কারন উনি কখনো এভাবে কথা বলেন না আমার সাথে। আর কখনো কিছু বলার জন্য পারমিশন ও নেন না। হয়তো আজ কোনো সিরিয়াস কথা বলবেন। আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম-
—”হুম বলুন কি বলবেন।”
আদ্র আগের মতোই আকাশ দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন-
—”আমাদের বিয়ে হয়েছে শুভ্রতা এখন তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি আর আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাস। তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব এখন আমার উপর। তাই আশা করি তোমার ভালো লাগা, খারাপ লাগা, মন খারাপ সব কিছু তুমি আমার সাথে শেয়ার করবে। অবশ্য তুমি শেয়ার না করলেও আমি বুঝে যাবো তবুও আমি চাই তুমি নিজের মুখে আমাকে সব বল। এতো দিন আংকেলকে বলেছো আর এখন থেকে আমাকে সব বলবে। আমি চাই না আমার অনুপস্থিতিতে তোমার সাথে কিছু হলে সেগুলো আমার অজানা থাকুক। আর হ্যাঁ বিশ্বাসটা যেন আমাদের মধ্যে সব সময় অটল থাকে। একটা সম্পর্কে বিশ্বাস হলো সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি বুঝতে পেরেছ।”
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে মনযোগ দিয়ে ওনার বলা কথা গুলো শুনলাম। ওনার কথার প্রতিত্তোরে শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।
————————
দেখতে দেখতে দুই মাস কেটে গেল। এই দু-মাসে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। ভালোবাসার রংবদল হয়েছে অনেক। যে মানুষটা কে ছাড়া আমার এক মূহুর্ত চলতো না আজ সেই প্রিয় মানুষটা কে ছাড়া আমি থাকা শিখে গেছি। এই দু-মাসে আব্বু আর দিদুমনির সাথে দেখে হয়েছে প্রায় সাত আট বার হবে হয়তো। এখন আর আগের মতো তাদের জন্য নিরবে কান্না করি না। অভ্যাস হয়ে গেছে তাদেরকে ছাড়া থাকতে। তবুও বুকের ভিতর কোথাও যেন কষ্ট লুকিয়ে আছে।
মা মানে শাশুড়ী মা উনি আর এখন আমাকে এড়িয়ে চলে না। যা বলার মুখের উপর বলে দেয়। প্রতি দিন ওনার মুখে তিক্ত কথা কূট কথা শুনতে শুনতে এখন আমার গায়ে সয়ে গেছে। আমি কিছু বলি না প্রতিবাদ করি না। চুপচাপ ওনার সব কথা শুনে যাই যতই হোক উনি তো একটা সময় আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
বিয়ের পর থেকে ভার্সিটি যাওয়া হয় খুবই কম। ভার্সিটি থেকে এসে বাড়ির সকল কাজ করেও কেন যেন শাশুড়ী মা’র মন জয় করতে পারিনি আজও। তবে দীপ্ত যতটা সময় পায় আমার মন ভালো করার জন্য নানানরকম কথা বলে। মেয়েটা ভয়ে তার মায়ের মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। তবে তার মায়ের উপর তার খুব আক্ষেপ। মাঝে মাঝে আমার সাথে এমন ব্যবহার দেখে প্রতিবাদ করে তবে মা’র ধমক খেয়ে আবার চুপসে যায় মেয়েটা।
আদ্র সারাদিনই অফিসে কাটায়। সকাল সকাল চলে যায় আর বাসায় ফিরে রাত নয়টার দিকে। ওনার ভালোবাসা রংবদল হয়েছে খুব বেশি। সারাদিন এতো তিক্ত কথা শুনে দিন শেষে ওনার বুকেই আমি শান্তি খুজে পাই। ওনার ভালোবাসার রঙ আগের থেকেও রঙিন হয়েছে। এখন আর বকাঝকা করে না। প্রতিদিন সকালে কপালে একটা করে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে যাওয়া আর রাতে একটা করে আমার প্রিয় জিনিস অথবা ফুল নিয়ে আসা ওনার প্রতিদিনের কাজ। মায়ের এমন ব্যবহারের কথা আদ্র কিছুই জানে না। মা কখনো ওনার সামনে বাজে ব্যবহার করেই না। আর আমিও মা’র কথা ওনাকে কিছুই বলি না। আমি চাই না আমার জন্য তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হোক। আর আমিও মায়ের ওইসব খারাপ ব্যবহার মনে রাখি না। কারন দিন শেষে আদ্রর কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসা আমার কষ্ট গুলোকে ভুলে যেতে বাধ্য করে। ওনার কাছ থেকে এতো ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় নিমিষেই সব কষ্ট ভুলে যাই।
—”আচ্ছা তুই সব সময় এই সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকিস কেন?”
আজ কলেজ থেকে আসার পর মা আমাকে একটু বেশিই বকা দিয়েছে তাই মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আচমকা আদ্রর কন্ঠ শুনে চমকে গিয়ে পিছনে তাকালাম। অবাক হয়ে বললাম-
—”আপনি আজ এতো তাড়াতাড়ি এসে পরলেন যে!! কিছু হয়েছে??”
আদ্র আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নরম সুরে বললেন-
—”কিছু হয়নি এমনিতেই মনে হলো আমার শুভি এখন আমাকে খুব মিস করছে আর এখন আমাকে তার পাশে চায় তাই চলে আসলাম। আচ্ছা রেডি হয়ে নে আজ আমরা লংড্রাইভে যাবো।”
কথাটা শেষ করেই আমার কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন। এই লোকটা সব সময় আমার মন খারাপের সময় অদ্ভুত ভাবে আমার কাছে চলে আসে। যখনই ওনাকে জাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে তখনই ম্যাজিকের মতো এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
—————————
এই সন্ধ্যায়, দুচোখ সাগরে, বুকের পাঁজড়ে
ভেসে যায়
অবাক জোছনায় লুকিয়ে রেখেছি
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়….
এই অবেলায়, তোমারি আকাশে, নীরব আপোষে
ভেসে যায়
সেই ভীষণ শীতল ভেজা চোখ
কখন ও দেখাইনি তোমায়,,
কেউ কোথাও ভালো নেই যেন সেই,
কতোকাল আর হাতে হাত অবেলায়??
কতোকাল আর ভুল আবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়,,
সেই কবে কার ভায়োলিন, বেজে যায় কতোদিন…..
প্রানে চাপা ঢেউ, দেখেনি আর কেউ।।
কখনো অভিমান, অবাধ্য পিছুটান
জানিনা কি কষ্টে এই অবেলায়,,,
তবুও নির্বাসন বাসর সাজিয়ে,
ঠোঁটে চেপে ধরা থাক ভালোবাসায়।
(গান- এই অবেলায়..🖤)
চুপচাপ গাড়িতে বসে ছিলাম আর আদ্র বেশ মনযোগ দিয়ে ড্রাইভিং করছিলেন। হঠাৎ করে এই গানটা কানে ভেসে আসলো। আদ্রর এতো সুন্দর কন্ঠ আর এতো ভালো গান গাইতে পারে আগে জানতাম না। ওনার গানের সুরে কেমন যেন আলাদা এক মাদকতা আছে। কিন্তু এই গান কেন??? গানের প্রতিটা কথা যেন আমারই জন্য গাওয়া মনে হচ্ছে। ওনার কন্ঠে গান শুনে আমি কোথাও যেন হারিয়ে গেছিলাম। আমার ভাবনার মাঝেই আদ্র খুব গম্ভীর গলায় বললেন-
—”আচ্ছা শুভ্রতা তোর কি কিছু বলার আছে আমাকে??”
ওনার কথায় আমি কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
—”মানে কি বলছেন?”
আদ্র ওনার মুখের গম্ভীরতা কাটিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে বললেন-
—”আমাকে ভালোবাসার কথা। এখনো কিন্তু আমাকে ভালোবাসার কথা বলিস নি তুই।”
ওনার এমন অদ্ভুত আচরণ আমার কাছে কেমন যেন লাগছে। তবুও তেমন পাত্তা না দিয়ে আমি নিজেকে সামলিয়ে কিছুটা ভাব নিয়ে বললাম-
—”সময় হলেই বলবো। ততোদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকুন।”
চলবে….
(আজকের পর্বটা বড় করে দিলাম। কেমন লাগলো জানাবেন গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষাই রইলাম। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️)