#ভালোবাসার_রংমহল
#জাহানারা_রিমা
পর্বঃ ৬/অন্তিম
সময় স্বল্পতার কারণে কেনাকাটাগুলোও দ্রুতই সেরে ফেলতে হচ্ছে। আর দুদিন পর হলুদ, পরেরদিন বিয়ে। টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা বাকি থাকায় আজ আবারো আসতে হলো। নাদিম আর প্রিয়ম ইতোমধ্যে হাপিয়ে উঠেছে। মেয়েরা এতো কেনাকাটা কিভাবে করে সেটাই তাদের মাথায় ঢুকছে না। এতো ধৈর্য আসে কোথা থেকে এদের। এসির মাঝেও ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা প্রিয়মের। প্রিয়মরা বের হতে যাবে এমন সময় মাইশা বলল, “নাদিম আমার মনে হয় লেহেঙ্গাটা ভালোই ছিল। নিয়ে নিলেই পারতাম।”
নাদিম অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো মাইশার দিকে। তখন অনেকবার বলার পরেও মাইশা লেহেঙ্গাটা নেয়নি। রঙ, ডিজাইন আর দাম সব নিয়েই খুতখুত করছিল। এরপরেও অনেক কেনাকাটা করেছে। তার পরেও এখন আবার অইটাই নিতে চাইছে।
নাদিম অসহায় দৃষ্টিতে প্রিয়ম আর কুহুর দিকে তাকালো।
মাইশাকে বলল, “মাইশু প্লিজ আমার আর ধৈর্য নেই। আমি এখন আবার চারতলায় উঠতে পারবোনা।”
মাইশা ক্রুদ্ধভাবে চাইলো নাদিমের দিকে। বলল, “তুমি কি সিঁড়ি ভেঙে যাবে নাকি? যাবেতো লিফটে করে তাহলে সমস্যা কোথায়।”
অগত্যা নাদিমকে চলতে হলো মাইশার সাথে। ওর অবস্থা দেখে প্রিয়ম আর কুহু মুখটিপে হাসতে থাকে।
পেছন থেকে কেউ কুহুর নাম ধরে ডাকতেই দুজনেই পেছন ঘুরে চাইলো। ব্যক্তিটিকে দেখেই ধীরেধীরে প্রিয়মের মুখভঙ্গি পাল্টাতে থাকে। প্রিয়মের দিকে তাকাতেই কুহুর মনের মাঝে শয়তানি বুদ্ধি খেলে যায়। হাসিহাসি মুখ করে ব্যক্তিটির দিকে এগিয়ে যায়। অজ্ঞাত ব্যক্তিটিরও মুখের হাসি চওড়া হয়। প্রিয়মও আসে কুহুর পেছন পেছন। ছেলেটি প্রিয়মকে দেখেই বলে, “ভাইয়া কেমন আছেন?” আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
প্রিয়ম মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। হ্যা হ্যা চিনবো না কেন?”
মনে মনে বলল, “শালা তোরে ভুলি কেমনে? সেদিন আমার কুহুকে যেভাবে স্ক্যান করছিলি ইচ্ছেতো করছিল সেখানেই তোকে কয়েক ঘা দিয়ে দেই।
ছেলেটা হাসিহাসি মুখে এবার কুহুর দিকে চাইলো। কোন রাখঢাক না রেখেই বলল, “আসলে কুহু আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই আপনার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আর আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন নিশ্চয় আর রাফসান আঙ্কেল না করবেন না? আপনি বললে আমরা আবার আপনাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে পারি।” প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কি বলেন ভাইয়া?”
কুহুর পেট ফেটে হাসি আসছে। কোনরকমে সেটাকে আটকে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত কিনা ওরই হবু বরের কাছে অনুমতি চাইছে ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে কিনা? প্রিয়মের মুখটা তখন ছিলো দেখার মতো।
কুহু বলল, “আপনি প্রস্তাব পাঠাতে পারেন কোন সমস্যা নেই।” কুহু শতচেষ্টা করেও নিজের হাসিটা আটকে রাখতে পারছেনা, হঠাৎই ফিক করে হেসে ফেলে। কুহুকে এভাবে হাসতে দেখে নাঈম খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। নাঈমের সামনেই প্রিয়ম কুহুর হাত চেপে ধরে বলে, “খুব শখ না তোর? আজ তোর সব শখ আমি মেটাচ্ছি।”
নাঈমের দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি ভাইয়া। আপনি ভুল সময়ে ভুল মানুষকে চুজ করেছেন। শি ইজ অলরেডি এনগেজড।” কুহুর হাত উঁচু করে আঙটিটা দেখালো। “আর দুদিন পর আমাদের বিয়ে। আপনার দাওয়াত রইলো। আসবেন অবশ্যই।” নাঈম অপ্রস্তুত হাসলো। কি বলবে ভেবে পেলোনা।
কুহুর বাহু ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে এলো প্রিয়ম। এতক্ষণ মজা করলেও এবার কুহুর খানিকটা ভয় করতে লাগলো। প্রিয়ম কি রেগে গেলো নাকি?
ফ্রন্ট সিটে কুহুকে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে প্রিয়ম। নাদিমকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দেয় যে ওরা চলে যাচ্ছে। গাড়ি চালাতে শুরু করে নিঃশব্দে। প্রিয়মকে এভাবে নিরব দেখে কুহুর খারাপ লাগতে শুরু করে। নানাভাবে চেষ্টা করে প্রিয়মের রাগ ভাঙানোর। কথা, পাগলামি কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা। জোকস বলে হাসানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। প্রিয়মের অগ্নিবর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থাকলেও পরবর্তীতে আবার নতুন উদ্যমে নিজের কাজে লেগে পড়ে। কুহুর পাগলামিতে প্রিয়মের গাড়ি চালাতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। একটু পরপর হাত ধরে টানাটানি করছে। আর না পেরে কুহুকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। ধমক খেয়েই কুহু মুখ ভার করে বসে থাকে। আর একটা কথাও বলেনা। একটু পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। কুহুর কান্না দেখে হকচকিয়ে যায় প্রিয়ম। ভেতর থেকে একটা তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে। গাড়ি থামিয়ে কুহুকে নিজের কাছে টেনে নেয়। আলতো স্পর্শে ওর চোখেরজল মুছে দেয়। কুহু নাক টেনে বলে, “আমার উপরে আর রেগে নেইতো?”
প্রিয়ম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না, নেই।”
কথাটা শুনেই কুহু সোজা হয়ে বসে। ওকে দেখলে এখন কেউ বলবেনা যে এই মেয়ে একটু আগে এমন মরা কান্না কাঁদছিল। প্রিয়ম চোখদুটো ছোটছোট করে তাকাতেই কুহু প্রিয়মের নাক টেনে দিয়ে বলে, “এটা হলো রাগ ভাঙানোর নিনজা টেকনিক বুঝলেন মশাই।” বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। প্রিয়ম মুগ্ধ হয়ে কিছুমুহূর্ত চেয়ে থাকে সেই হাসির দিকে।
মিনিট না গড়াতেই কুহু হাসি বন্ধ করে কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায়। মাথা নিচু করে বলে, “সরি। আমি আর এরকম ধরনের মজা করবোনা। আমি জানি তোমার খারাপ লেগেছে।”
প্রিয়ম গহন হেসে ওকে আবারো নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, “কে বলেছে আমি রাগ করেছি? এই পাগলিটার উপর তো আমি এক সেকেন্ড ও রাগ করে থাকতে পারিনা। সবসময় এভাবেই হাসিখুশি থাকবি।”
কুহুর চুলের উপর দিয়েই নিজের ঠোঁটদুটোর আলতো ছোঁয়া দিয়ে বলে, “ভালোবাসি আমার এই পাগলিটাকে। তার হাসি, কান্না, মজা, দুষ্টুমি সবটুকু নিয়েই ভালোবাসি।”
কুহু নিজেও এবার প্রিয়মকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমিও ভালোবাসি।”
“কাকে?”
“জানিনা।”
প্রিয়ম সরু চোখে তাকায়। তাকায় কুহুও। তারপর দুজনেই হেসে ফেলে। নির্মল হাসি।
____________
বিয়ের দিন সকালবেলা প্রিয়ম কুহুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দীপ্তিকে দুশ্চিন্তা করতে দেখে রাফসান সাহেব বললেন, “চিন্তা করোনা। ওরা ঠিক সময়েই চলে আসবে। আমি জানি ওরা কোথায় গেছে।”
কুহু বুঝতে পারছেনা প্রিয়ম ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। কি এমন কাজ যে বিয়ের দিনেই এভাবে বের হতে হচ্ছে। প্রায় মিনিট কুড়ি পার হলে কুহু রাস্তাটা চিন্তে পেরে গম্ভীর হয়ে যায়। ভাবনায় ডুবে পড়ে। ওই দুজন মানুষকে আজকে আরো বেশি করে মনে পড়ছিলো। প্রিয়ম কিকরে বুঝলো? মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধাটা আরো বেড়ে গেলো। গাড়ি এসে থামলো একটা কবরস্থানের সামনে। দুজন নিঃশব্দে নেমে পড়ে। কুহুর বাবা আর মায়ের কবর দুটো পাশাপাশি। দুজন সেদিকে এগিয়ে যায়। প্রিয়ম বলে, “এখানে এনেছি তারমানে এই নয় যে আবারো কাল রাতের মতো কান্না করবি।”
কুহু চমকে উঠে কথাটা শুনে। প্রতিটা মেয়ের জন্যই বিয়ের দিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন দিনে সবাই চায় তার আপনজন গুলো তার পাশে থাকুক। তবে সবার ভাগ্যে সেটা থাকেনা। যেমনটা কুহুর ভাগ্যে নেই। কালরাতে বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিলো। মামনির কোলে শুয়ে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিল কাল রাতে। হ্যা একথা ঠিক ওর মামনি আর বড়বাবা কখনো ওকে বাবা মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। তবুও কোথাও না কোথাও একটা ফাক থেকেই যায়। তবে সেই দৃশ্য যে প্রিয়মের চোখে পড়বে সেটা ও বুঝতে পারেনি। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে কুহু প্রিয়মের দিকে তাকায়। ওর চোখ থেকে টপটপ করে কয়েকফোটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তেই প্রিয়ম সযত্নে নিজের হাতে সেগুলো মুছে দিয়ে বলে, “আমার আগেই উচিৎ ছিলো তোকে এখানে নিয়ে আসা। কিকরে যে মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। এখন আর কান্নাকাটি নয়।”
প্রিয়ম কবর জিয়ারত করলো। তারপর দুজন মিলে মোনাজাত ধরলো। দোয়া চাইলো তাদের নতুন জীবনের জন্য।
সমাপ্ত,,
[