#ভালোবাসি_বলেই_তোমাকে_প্রয়োজন
লেখক – এ রহমান
পর্ব ১৩
— এখন আর একা কথা বলার মতো কিছুই নেই। যা কথা হবে সবার সামনে। এখানে তো আমরা সবাই এক ফ্যামিলি। বাইরের কেউ নেই। তাহলে ভয় পাচ্ছেন কাকে?
বলেই সোফায় বসে পড়লো অরণ্য। সারিয়ার বাবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল তার দিকে। ভীষন রাগান্বিত চেহারা। রাগে হাত পা কাপছে তার। হুংকার ছেড়ে বললেন
— কি ভেবেছো? আমি তোমার কাছে মাথা নত করবো? আমার মেয়ে তোমাকে বিয়ে করেছে বলে আমি মেয়ের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তোমাকে মেনে নেবো। কখনো না। প্রয়োজন হলে আমার মেয়েকে ডিভোর্স করিয়ে সারাজীবন বাসায় বসিয়ে রাখবো। তবুও তোমার কাছে আমি মাথা নত করবো না।
অরণ্য হালকা হাসলো। বলল
— ডিভোর্স করতে দুজনের সম্মতি লাগে। যথোপযুক্ত কারণ লাগে। আপনি বললেই তো আর ডিভোর্স হয়ে যায় না। তাছাড়াও ডিভোর্স দেবো বলে তো বিয়ে করিনি। বউ বলে সীকৃতি দিতেই বিয়ে করেছি।
সারিয়ার বাবা প্রচন্ড রেগে গেলেন। রাগের চোটে কথা জড়িয়ে আসছে তার। ভীষন উত্তেজিত হয়ে বললেন
— আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো। তোমার শরীরে যেমন রক্ত কাজ তো তেমনই হবে। সাপের বাচ্চা তো সাপই হয়। মানুষ হয় না। কিন্তু আমি মানুষ ভেবে আবারও ভুল করে বসলাম।
শেষের কথাটা বেশ তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন তিনি। অরণ্যর গায়ে লেগে গেলো। তীব্র অপমানের ফলা সরাসরি আত্মসম্মানে গিয়ে বিধলো। হাত মুঠ করে নিলো সে। সারিয়ার বাবা আবারও বললেন
— সেদিনই বলেছিলাম আমার সামনে আর কোনদিন আসবে না। কথা দিয়েছিলে তুমি। কিন্তু রাখতে তো পারলেই না উল্টা ধোঁকা দিলে। তোমার রক্তে ধোঁকা মিশে আছে। এটা আমার আগেই ভাবা উচিৎ ছিলো।
অরণ্য এবার আর নিজের রাগটা সামলাতে পারলো না। উঠে দাড়িয়ে দাতে দাঁত চেপে বলল
— আমার রক্তে কোন ধোঁকা নেই। কিন্তু আপনার রক্তে লোভটা ঠিকই আছে। যার দরুন আরো একবার অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যাচ্ছিলেন। লোভে পড়ে আবারও একটা জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এবার সেটা আপনার নিজের মেয়ে ছিলো। এটাও আপনি ভুলে গিয়েছিলেন। নিজের মেয়ের জন্য পাত্র ঠিক করে ফেললেন অথচ পাত্র সম্পর্কে কিছুই জানলেন না। শুধু বাড়ি গাড়ী দেখেই বিয়ে ঠিক করে ফেললেন? অদ্ভুত বাবা আপনি।
— তাহলে কি করতাম? তোমার বাবার মতো ফকিরের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দিতাম?
সারিয়ার বাবার কথাটা অরণ্যর একদম পছন্দ হয়নি। হুংকার ছেড়ে বলল
— আমার বাবা ফকির নয়। উনি যথেষ্ট ভালো একজন মানুষ। আপনার কথা শুনে আমার মা যদি সেদিন আপনার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতো তাহলে হয়তো অনেক টাকার মালিক হতে পারতো। কিন্তু সুখ পেত না। আজ আমার মায়ের কোন কিছুর অভাব নেই। সে সবদিক থেকেই সুখী। কিন্তু আপনার এতো সম্পদ থাকার পরেও আপনি কি সুখী হতে পেরেছেন?
অরণ্যর কথা শুনে সারিয়া হতবাক হয়ে গেলো। গভীর মনোযোগ দিল তার কথায়। পরবর্তী কথাটা শুনতে চায় সে। কোনভাবে কি তার বাবা অরণ্যর মাকে চেনে? কিন্তু কিভাবে? তাহলে এতদিন বলেনি কেনো? অরণ্যর গলার আওয়াজে তার ঘোর কেটে গেলো। অরণ্য উদাসীন কণ্ঠে বললো
— আমি আপনার সামনে আসতে চাই নি। আমার সত্যিই কোন ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু আপনার কাজকর্ম আমাকে বাধ্য করেছে আপনার সামনে আসতে। আমি আপনার মেয়েকেও বিয়ে করতে চাইনি। পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমাকে এরকম কিছু করতে হয়েছে। সারিয়া এসবের কিছুই জানতোনা।
সারিয়ার বাবা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। তার মানে সীমান্ত ঠিকই বলেছে। সারিয়া সত্যিই কিছু জানে না। তিনি অরণ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন
— তার মানে তুমি ধোঁকা দিয়েছো? আমার মেয়েকে না জানিয়েই তার সাইন নিয়েছো?
অরণ্য সহজ সাভাবিক ভাবেই বলল
— হ্যা আমি আপনার মেয়েকে ধোঁকা দিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা যে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি সেটা তো মিথ্যে নয়। না আমি অস্বীকার করতে পারবো আর না আপনার মেয়ে অস্বীকার করতে পারবে।
সারিয়ার বাবা হুংকার ছেড়ে বললেন
— মানি না আমি এই সম্পর্ক। এটা মিথ্যে সম্পর্ক। তুমি ধোঁকা দিয়েছো আমাকে আর আমার মেয়েকে। কেনো? প্রতিশোধ নিতে চাও? তোমার মায়ের ভুলের শাস্তি তুমি আমাকে দিতে চাও?
অরণ্য শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। সাভাবিক ভাবেই বলল
— আমার মা ভুল করেনি। আপনার উপহার দেয়া নরকের মতো জীবন কে উপেক্ষা করে নিজের সুখকে প্রাধান্য দিয়েছে। সুখ বেছে নিয়েছে সে। কারণ আমার মা অনেক বুদ্ধিমতী। সেটা আপনি বুঝবেন না। কারণ আপনার কাছে টাকার চেয়ে আর কোন কিছুর মূল্য নেই। তবে আজকে আমি আপনাকে একটা কথা দিয়ে যাচ্ছি আপনার মেয়েকে আপনি নিজে যেদিন আমার হাতে তুলে দেবেন সেদিনই আমি তাকে আমার বাড়ির বউয়ের মর্যাদা দেবো। তার আগে সারিয়া আপনার কাছে আমার আমানত। আর এই কথাটা মোটেও ভুলে যাবেন না। ভুলে গেলে যা হবে তার সব কিছুর জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।
কথা শেষ করে অরণ্য একবার সারিয়ার দিকে তাকাল। সে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখের মাঝে হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু অরণ্য কোন কিছুর উত্তর দিতে প্রস্তুত নয়। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
— আমি যাচ্ছি। আপনি যেদিন আমাকে ডাকবেন সেদিনই আসবো আবার।
সারিয়ার বাবা শব্দ করে হাসলো। বলল
— এটা একেবারেই অসম্ভব। এসব স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দাও।
অরণ্য দৃষ্টি তুলে তাকাল। মৃদু হেসে বলল
— এখন পর্যন্ত আপনার জীবনের অনেক অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ আপনার কাছেই আছে।
অরণ্য থেমে যেতেই সারিয়ার বাবা চমকে গেলেন। তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। তার চেহারা দেখেই আন্দাজ করা সম্ভব যে অরণ্য এমন কিছু বলে ফেলেছে যা তিনি প্রকাশ করতে চান না। অরণ্য আর দাড়ালো না। বাইরে চলে গেলো। কিন্তু হুট করেই সারিয়ার মনে জেগে উঠলো পাহাড় সমান অভিমান। অরণ্য একবারও তার সাথে কথা বলল না। একবারও তার মনের অবস্থাটা বুঝতে চাইলো না। ভীষন সার্থপর। তার অজান্তেই তাকে বিয়ে করে নিলো। কিন্তু একবারও জানতে চাইলো না সে কি চায়। তার মনের অনুভূতিটা প্রকাশ করার সুযোগ দিলো না তাকে। আর এই সার্থপর মানুষটাকেই নিজের মন দিয়ে বসে আছে সে। এই মানুষটার কাছে তার অনুভূতির দাম নেই অথচ এই মানুষটার জন্য অনুভূতি গুছিয়ে রেখেছে তার মনে। এখন নিজের উপরেই করুণা হচ্ছে তার। কেনো এমন সার্থপর একটা মানুষকে ভালোবাসতে গেলো সে। ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। সারিয়ার বাবা এতক্ষণ দাড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন। দুম শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সেই শব্দে সারিয়ার ঘোর কাটলো। একটা শ্বাস টেনে মস্তিষ্ক স্থির করতেই অরণ্য আর বাবার কথোপকথন মনে পড়লো। রহস্যের উন্মোচন তখনো বাকী। শারমিনের দিকে তাকাল। সে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। মৃদু স্বরে বলল
— আপু?
শারমিনের কোন হেলদোল দেখতে পেলো না। ঘাড়ে হাত রেখে আবার ডাকলো।
— আপু কি ভাবছো?
শারমিন চমকে উঠলো। ভিত চোখে তাকাল। কয়েকবার অস্থির ভাবে পলক ফেললো। সারিয়ার কথার উত্তর না দিয়েই ঘরে চলে গেল। সারিয়া বেশ অবাক হলো। কারণ এখন পর্যন্ত শারমিন এরকম আচরণ করেনি। কিন্তু তার আচরণে সারিয়ার মনে হলো সে কিছু লুকাতে চাইছে। তার মানে এমন কোন রহস্য আছে যা শারমিন নিজেও জানে। কিন্তু তাকে জানানো হয়নি। তাকে না জানানোর কোন কারণ খুঁজে পেলো না সারিয়া। পুরো কথোপকথন শুনে এটা বুঝতে পেরেছে যে অরণ্যর মায়ের সাথে তার বাবার একটা সম্পর্ক আছে। কোন কারণে তার বাবা অরণ্যর মাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু সম্পর্কটা কি? আর কেনই বা এতদিন তাকে বলা হয়নি। সেদিন অরণ্যর সাথে বাবার দেখা হওয়ার সময় সারিয়ার মনে হয়েছিল তার বাবা অরণ্যকে আগে থেকেই চিনতেন। আর সে কারণেই তার সাথে যেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা কোনভাবেই তাকে জানতে দেয়নি। এমনকি অরণ্য নিজেও তাকে এই বিষয়ে কিছুই বুঝতে দেয়নি। তাহলে কি কেউই চায় না সারিয়া এসব কিছু জানুক। কিন্তু এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? এলোমেলো চিন্তা ধারা সমস্ত মস্তিষ্কে বিচরণ করছে। হুট করেই মাথা ব্যথাটা বেড়ে গেলো। চেপে ধরে বসে পড়লো সোফায়। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। ভীষন কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু এই রহস্যের সমাধান তাকে করতেই হবে। যে কোন উপায়ে।
চলবে……