মন গহীনের গল্প পর্ব -৩১+৩২

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব -৩১
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
ঢাকায় শ্যুটিং এর কাজ শেষ করেই তিশমা আবার এসেছে কক্সবাজারে। কাজের প্রয়োজনেই গত মাসে তাকে আসার দ্বিতীয় দিনেই তাকে রাতের ফ্লাইটে ঢাকায় যেতে হয়েছিলো। আজ ফ্রী হয়েই আবার ফিরে এসেছে, মূলত সে ম্যানেজারকে ঠিকঠাক জ্বালাতে না পারায় আবার এসেছে। হোটেলে পৌঁছে প্রথমেই সে রিশাদের খোঁজ নিলো। রিশাদ চট্টগ্রাম গেছে হয়তো বিকেলের আগে ফিরবে না তাই ম্যানেজারকে প্রথম কাজ দিলো তাকে রিশাদের বউ আর ফুপির রুম দেখিয়ে দেওয়া। তিশমাকে দেখেই বিরক্তিতে লোকটা ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিলো। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে অপ্রিয় ব্যাপারগুলোকে আলাদা সাইডে রাখা জরুরি বলেই সে তিশমা সহ্য করার চেষ্টা করছে। প্রথমে মেহউইশের দরজায় করাঘাত করলো কিন্তু দরজা খুলল রেহনুমা। তিশমা প্রথমেই স্লামালিকুম বলতেই রেহনুমা গোমড়া মুখ করে বলল, ‘সালাম ঠিক করে দাও মেয়ে।’ ম্যানেজার সাহেব তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। রেহনুমার কথা শুনে সে মুচকি হাসলো, খুশি হয়েছে খুব সে আর তিশমার মুখখানিও দেখার মত হয়েছিলো।

-‘আপনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন কেন? নিজের কাজে যান।’ ম্যানেজারকে বলতেই সে চলে গেছে। তিশমাকেও ডেকে রুমের ভেতরে নিলেন রেহনুমা। মেহউইশ বেলকোনিতে বসে নির্জনকে বসানোর চেষ্টা করছে। বাচ্চাটাও কেমন হেলে দুলে এদিক ওদিক করে পরে যাচ্ছে ফ্লোরে বিছানাো ম্যাট্রেসের ওপর। গ্রিলের ফাঁক গলে সকালের সূর্যের আলো আর সামুদ্রিক হাওয়া এসে লুটোপুটি খাচ্ছে মেহউইশ, নির্জনের গায়ে। বর্তমান সময় মেহউইশের এখানে মন্দ কাটছে না শুধু মা আর ভাইকে অনেকদিন ধরে না দেখায় মনটা খারাপ থাকে মাঝে মাঝেই। ইভান এখন স্মৃতি ছাড়া কিছুই নয় তার জীবনে। ইভানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টাও সে কম করেনি। কিন্তু কোথাও একটু ত্রুটি থাকায় যোগাযোগটা আর হয়ে উঠেনি। দু’বছরের সম্পর্ক এত সহজেই মলিন হওয়ার নয় তবুও বিয়ের পবিত্রতাও শক্তিশালী এক বাঁধন। মনের মিল ছাড়াও দুজন মানুষকে একসাথে বেঁধে রাখার মত অলৌকিক শক্তি শুধু মাত্র বিয়েতেই আছে হয়তো। মেহউইশ অবাক হয় নিজেকে নিয়ে ভাবতে গেলেই। কখন যে সে অসহ্যবোধ করা রিশাদকে সহ্য করা শিখে গেছে নিজেও জানে না। শুধু জানে নির্ঘুম রাতে সে আবছা আলোয় রিশাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশাদের মুখের প্রতিটা অংশ তার এখন মুখস্ত। ঘুমন্ত অবস্থায় রিশাদের ঠৌঁটের বা দিকে কোণায় একটুখানি রেখার সৃষ্টি হয়। হঠাৎ দেখলে মনে হয় লোকটা মুখ বাঁকিয়ে হাসছে বুঝি!

রেহনুমা বেলকোনিতে এসে তিশমাকে বসার জন্য কাউচ দেখিয়ে মেহউইশকে বলল, ‘ রিশাদের বান্ধবী এসেছে কফি বানাও।’ মেহউইশ কফির কথা শুনে সামনে তাকাতেই তিশমাকে দেখে প্রথমেই ভ্রু কুঁচকালো। পরে হুঁশ এলো এই মডেল কন্যা রিশাদের বন্ধু তাই ভদ্রতা দেখিয়ে হ্যালো বলল। তিশমা যেচে পড়ে অনেকক্ষণ গল্প করলো যা রেহনুমা কিংবা মেহউইশ কারোই ভালো লাগেনি। তিশমাও হয়তো বুঝতে পেরেছে তাদের মনের ভাব তাই নিজেই উঠে গেল। সন্ধ্যার পর রিশাদ হোটেলে ফিরলে মেহউইশ গম্ভীর মুখে অন্যদিকে ফিরে বলল, ‘ আপনার বান্ধবী এসেছে। রুমেও এসেছিলো হয়তো আপনার খোঁজেই না পেয়ে চলে গেছে।’ রিশাদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ঈষৎ ঠোঁট টেনে মুচকি হাসলো। তার মনে হলো মেহউইশের এ কথাতে কিছুটা হিংসা মিশ্রিত ছিলো অনেকটা টিপিক্যাল বউদের মত। মন্দ না এমন হিংসা। মেহউইশ সেই হাসি খেয়াল করেই হয়তো রেগে গেছে। নির্জনকে কোল থেকে বিছানায় নামিয়ে কিচেনে চলে গেছে। রিশাদ প্রায় দিনই বাইরে কোথাও গেলে এসেই কফি চায় তাই আজ আর রিশাদের বলার অপেক্ষা না করে কফি বানায় মেহউইশ। কাপড় পাল্টে রিশাদ বাথরুমে ঢুকবে বলে মেহউইশকে ডাকলো, ‘ মেবিশ, আমি বাথরুমে ঢুকছি নির্জন কিন্তু বিছানায় রইলো।’

মিহাদ একটু আগেই একটা ফেসবুক একাউন্টে পেইজ ক্রিয়েট করেছে।অনলাইন সেল পেইজ সেটা। মাইমুনা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর তা বাস্তবায়ন করতে মিহাদ এবং তাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। মিহাদ শুরু থেকেই চায় না রিশাদের টাকা পয়সায় চলতে। কিন্তু বাধ্য হয়ে রিশাদের দেওয়া বাড়িতে থাকতে হচ্ছে, খাওয়া,পরা,পড়াশোনা সবই রিশাদের টাকায়। মাইমুনা যখন মিহাদকে বললেন, ‘ বাবা চল আমরা নিজেরা কোন কাজ করি। নিজেদের কাপড়ের ব্যবসাটা আবার শুরু করি। তুইও পারলে আমায় একটু সহযোগিতা করলি৷ এতে যেটুকু কামাবো ততটুকু দুজনের খাওয়া, পরাটা চললেও ঢের। মিহাদও সাথে সাথে বলল, ‘ হ্যাঁ মা চলো আমরা নিজেরাই কিছু করি। আমারও ভালো লাগে না ওই শয়তান লোকের টাকায় পড়াশোনা করতে।’

‘একদম এভাবে কথা বলবি না মিহাদ।ও তোর চেয়ে বয়সে অনেক বড়।’ ধমকে উঠলেন মাইমুনা ছেলেকে।

‘ যত বড়ই হোক ওই লোক সম্মানের অযোগ্য।’

‘এক থাপ্পড়ে গাল ফাটিয়ে দেব ছেলে। সে তোর বোনের স্বামী সম্পর্কে আর লোকটা যা তার শাস্তি হয়তো সে পেয়েই যাবে আমরা অসম্মান করি বা সম্মান করি সেটা ফ্যাক্ট নয়।তোকে তো মন্দটা শেখাইনি তবে তুই কেন তোর আচরণ মন্দ করবি!’

মায়ের কথা মিহাদের পছন্দ হয়নি৷ সে চুপচাপ তার মায়ের সামনে থেকে উঠে চলে গেল৷

রাগে গজগজ করতে করতেই ডাইনিং টেবিলটাকে গুছাচ্ছে মেহউইশ । কারণে অকারণে থালা বাসন শব্দ করে রাখছে এখান থেকে ওখানে। রেহনুমা কিচেনে দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ্য করেই বেশ অবাক হলেন। এই মেয়ে আজ অব্দি কখনো এমন ঝগড়াটে বউদের মত আচরণ করেনি। আজ কি হলো!

‘কি হয়েছে মেহউইশ এমন রেগে আছো কেন!’

‘আমি আবার কখন রাগ করলাম? রাগই’বা করবো কেন আর কার সাথে?’ স্পষ্ট করে রেহনুমাকে জবাব দেওয়ার পর মেহউইশ নিজেও চমকালো। সে এ কোন স্বরে কথা বলছে! রিশাদের হোটেলের এই ঘরে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা তার বেলকোনি। জায়গাটা যেমন প্রশস্ত তেমন সুন্দর করে সাজানো। সাজানোর ক্রেডিট যদিও মেহউইশের । সে নিজেই গত একমাসে ইনিয়েবিনিয়ে রিশাদকে শুনিয়ে এটা ওটা বলেছে রেহনুমাকে। আর তা শুনে সব ব্যবস্থা রিশাদ করে দিয়েছে। একপাশে কাউচ, অন্যপাশে ম্যাট্রেস বিছানো, উপর থেকে ঝুলানো ছোট ছোট লাইটস, কাঁচঘেরা স্লাইড জানালা। যখন ইচ্ছা কাঁচ সরিয়ে দিলেই সমুদ্রের নোনা হাওয়া এসে আলোয়ানের মত জড়িয়ে নিতে পারে। মেহউইশের রাগ সেই বেলকোনির দিকে তাকিয়েই বাড়ছে। রিশাদ কাউচে হেলান দিয়ে বসে নির্জনকে বুকের উপর রেখেছে। আর তার সামনেই ম্যাট্রেসে হাঁটু মুড়ে তিশমা বসে রিশাদের সাথে হাসিঠাট্টা করছে। রাগটা মূলত এ কারণেই বেড়ে চলছে তার। কেন বাড়ছে তা তার নিজেরও অজানা। খাবার সাজানো হতেই মেহউইশ বলল, ‘ খাবার রেডি ফুপু স্যার, মেডামকে বলুন খেয়ে আমাকে উদ্ধার করতে।’

এবার হয়তো রেহনুমার ধারণা হলো মেহউইশের রাগের কারণ। তার হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা যে ওই দুজনের মায়ায় পড়ে গেছে তা হয়তো সে নিজেও জানে না। রেহনুমার ভালো লাগলো মেহউইশের এই আচরণ। শুরু থেকেই মনে হতো এই মেয়েটা নীলিমার মত প্রেমিকের কাছে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজবে না। সে দ্বায়িত্ব আর সম্পর্কের মূল্য সারাজীবন পাশে থেকে দেবে।

রাতের খাবারে হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়েছে মেহউইশ । রিশাদ খেতে খেতে এটা সেটা তিশমার প্লেটে তুলে দিচ্ছিলো। এরই মাঝে ম্যানেজার সাহেব এসেছিলেন কোন কাজে। তাই রিশাদ তাকেও খেতে বসিয়ে দিলে মেহউইশের বসার জায়গা থাকে না। গোল ছোট টেবিলটাতে একসাথে চারজন মানুষ খাওয়া সম্ভব হয়। আগে থেকেই তিন চেয়ারে রিশাদ,তিশমা আর রেহনুমা বসা ছিলো। বাকি চেয়ারটাতে ম্যানেজারকে বসিয়ে দেয় রিশাদ। মেহউইশের একটু খারাপ লাগলেও তার বেশি খারাপ লাগে তিশমার সাথে রিশাদের আদিখ্যেতা নিয়ে৷ অন্যদিকে ম্যানেজারও প্রচণ্ড বিরক্ত হয় তিশমাকে দেখে। এই মেয়েটা হোটেলে এসেই তাকে আজও অনেক জ্বালিয়েছে। হোটেলে হাজরটা স্টাফ থাকা সত্ত্বেও মেয়েটার সব কাজ তাকে দিয়ে করিয়েছে এমনকি বিচে ঘুরতে যাওয়ার জন্যও তাকে নিয়ে গেছে। খাওয়ার পর্বটা একরকম বিরক্তি আর রাগের মিশ্রণেই শেষ হয়েছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে রিশাদ একটু হাঁটতে বেরুচ্ছিলো। তা দেখে রেহনুমা বলল, ‘মেহউইশকে সাথে নিয়ে যা।’

‘না না আমি ঘরেই থাকি নির্জনের ঘুমানোর সময় হয়েছে। ‘ মেহউইশ আপত্তি জানালো তা শুনে রিশাদ মেহউইশের কোল থেকে নির্জনকে টেনে নিজের কোলে নিলো। যার অর্থ মেহউইশও হাঁটতে বের হতে পারে। মেহউইশ তাই রেহনুমাকে বলল, ‘ ফুপু আপনিও আসুন। ‘

-না রে বাবা, তোরা যা আমি ঘুমাবো।

রেহনুমা নিজের ঘরে ঘুমাতে গেলো। রিশাদ পকেটে নিজের ফোন সাথে মেহউইশের ফোনটাও ঢুকিয়ে নিলো। মেহউইশ খেয়াল করেনি সেটা। রিশাদ ঘর থেকে বের হয়ে মেহউইশকে বলল, ‘ ভালো করে লক করো দরজা।’ মেহউইশ বের হতে গিয়েও দৌড়ে একবার আয়নার সামনে গেল। চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপে অর্ধেক বাঁধা ছিলো হুট করে সেটা খুলে দিলো। হাতের কাছেই ছিলো তার শালটা সেলোয়ার-কামিজ এর ওড়নাটাকে মাথা ঢেকে গলায় পেঁচিয়ে রাখলো। শালটাকে চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে একবার খুঁজলো লিপস্টিক কোথায় তার! শুষ্কতা শুধু তার চিকন পাতার মত ঠোঁট দুটোকেই বেশি শুকিয়ে গেছে। লিপস্টিক খুঁজে পাওয়া মুশকিল এখন তাই নির্জনের জনসন ক্রিমটা সামনে পেয়েই সেটাই একটু ছুঁইয়ে নিলো ঠোঁটে। আজ তার কি হলো কে জানে নিজের মুখশ্রীটাকে পরিপাটি করার শখটা যে কোথা থেকে এলো!

হোটেল ছেড়ে বেরিয়েছে মেহউইশ, রিশাদ। কোলে ঘুমে ঢুলুঢুলু নির্জন বাবার গলা আঁকড়ে ধরেছে। পাশাপাশি হাঁটছে দুজন, পায়ে পা মিলিয়ে চলছে সৈকতে। জোয়ার এসে পানি অনেক উপরে চলে এসেছে। চোখ সওয়া অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে সমুদ্রের বিবাগী হাওয়ায় মন বেসামাল হতে চাইছে কারো কারো। সৈকতে এই রাতের প্রথম ভাগে মানুষের কমতি নেই। মেহউইশ চলতে চলতে গাড় বাঁকিয়ে রিশাদকেও দেখার চেষ্টা করছে। আজ থেকে প্রায় দু’মাস আগে এই লোকটাকে সে জমের মত ভয় পেত আবার সময়ে অসময়ে তাকে খুন করার প্রবল এক ইচ্ছাও জাগ্রত হতো। রাতের অন্ধকার কিংবা দিনের মরা আলোয় তার মনে ইভানকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা তাকে আত্মিকভাবে অসুস্থও করে তুলছিলো। আর আজ বুকের মাঝে ইভানের শূন্যতা থাকা সত্ত্বেও এই লোকটার প্রতি অভ্যাসের এক অদৃশ্য পরত পড়ে গেছে। পারতপক্ষে এখন আর লোকটাকে ভয় পায় না সে। আর নির্জন! নির্জনটাকে তো এখন আর কাছ ছাড়া করারই সাহস হয় না। মায়া,অভ্যাস সবেতেই ছেলেটা জড়িয়ে গেছে। যেই মা আর ভাইকে ছাড়া ছোট বেলা এক রাতও কোথাও থাকা হয়নি সেই তাদেরকেই সামনে থেকে প্রায় দু মাসে দেখা হয় নি। অভ্যাস সবই অভ্যাস। আজ বুঝতে পারছে মানুষ প্রিয় মানুষের মৃত্যুর পর কিভাবে বেঁচে থাকে। বালু ভূমিতে চলতে চলতে তারা কখন যে ঝাউগাছের দিকে চলে এসেছে খেয়াল নেই। রিশাদের ডাকে মেহউইশের ভাবনা থেকে মন সরে। রিশাদের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে নির্জন৷ অনেকটা পথ তো রিশাদ ছেলেটাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে তার হাতে কি ব্যথা লাগছে!

‘নির্জনকে আমার কোলে দিন৷’

‘কেন?’

-এমনি

-প্রয়োজন নেই। তোমার ফোন বাজছে সেটা চেক করো।

‘আমি ফোন নিয়ে আসিনি।’

‘আমার পকেটে বাজছে।’

‘আপনার পকেটে আপনার ফোন বাজছে।’

‘আমার ফোন সাইলেন্ট থাকে না। তোমার ফোন আমার পকেটে ভাইব্রেট হচ্ছে। ‘

-কিন্তু আমার ফোন তো,,,

-‘রাইট পকেটে ফোন আছে বের করো।’ মেহউইশকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রিশাদ দাঁত চিবিয়ে বলল কথাটা। মেহউইশের মনে হলো আজকে তার ভাবনাগুলো চরম ভুল ভাবনা ছিলো। লোকটা কখনও বদলাবে না। ভয়ে ভয়ে রিশাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার পকেটে হাত দিলো মেহউইশ। রিশাদের তপ্ত নিঃশাস মেহউইশের চোখে,মুখে আছড়ে পড়ছে ঠিক যেমন ঢেউ এসে সৈকতে আছড়ে পড়ে।হাওয়া বড্ড মাতলামো করছে নিঃশ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে। মেহউইশের হাত পকেটে যাওয়া পর্যন্তই থেমে গেছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই রিশাদের ঠোঁট স্পর্শ করলো মেহউইশের কপাল।
#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩২
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
উষ্ণতা কপাল ছুঁয়ে মেহউইশের মন দুয়ারেও আছড়ে পড়েছে। রিশাদের ঠোঁটের রেখায় অবাধ্য উত্তেজনা আচমকাই মেহউইশের কপাল ছুঁয়ে দিয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের চোখ সওয়া অন্ধকারে চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠছে তার।ফেনিল ঢেউয়ের মত রিশাদের চুম্বন মেহউইশের অতৃপ্ত দেহে বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে গেল। সে রিশাদের পকেট থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। কলটা প্রথমবার কেটে দ্বিতীয়বার আসতেই শরীর ঝিম মেরে গেল রিশাদের। সে নিজেই নির্জনকে এক হাতে ধরে অন্যহাত পকেটে ঢুকিয়ে ফোনটা বের করলো। অচেনা নাম্বার থেকে কল আসছে দেখে প্রথমে ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড নাম্বারটিকে মুখস্ত করার মত করে দু বার আওড়ালো।ফোনটা মেহউইশের দিকে এগিয়ে দিয়ে সে হোটেলের দিকে হাঁটতে লাগল। পেছন পেছন মেহউইশও চলে গেল তার। ফোনটা কানের কাছে ধরে হ্যালো,কে? কাকে চান! বলেই কল কেটে দিলো। বোঝা গেল রং নাম্বার।

হোটেলে ফিরে রিশাদ আজ কাপড় না পাল্টেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। নির্জনকে কম্বলে পেঁচিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। মেহউইশ আজকাল নিজের অভ্যাসে অনেক পরিবর্তন এনেছে। বলা যায় রিশাদকে অনুসরণ করেই এই পরিবর্তন। এই শীতের রাতগুলোতেও রিশাদ ঘরে ফিরে ঠান্ডা পানিতেই মুখহাত দোয়, ময়েশ্চারাইজার হাতে পায়ে লাগায় আবার চুলেরও খুব যত্ন নেয়। এগুলো দেখে মেহউইশের খুব হিংসে হতো। একটা ছেলে কেন এত যত্ন নিবে তার ত্বকের। এমনিতেই সে সুকুমার মুখবয়বের তার উপর শুভ্ররঙা ত্বক, কোমল পায়ের তালু। মেহউইশ কোন এক রাতে অনুভব করেছিলো রিশাদের পায়ের তালুর এই কোমলতা হঠাৎই তার মনে হলো তার হাতের তালুও এতোটা মসৃণ আর কোমল নয়। সেই থেকেই এই হিংসার উৎপত্তি। এতে তার অভ্যাসে বদল হয়েছে চমকপ্রদভাবে। কিন্তু আজ রিশাদের ঘরে এসে এমন নিস্পৃহতা তার ভালো লাগছে না। একটু আগেও রিশাদকে অন্যরকম লাগছিলো। হাতে পায়ে লোশন মেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু সময় নিজেকে দেখলো সে। বিয়ের পরের পরিবর্তন তার শরীরেও আছে একটুখানি৷ মোটা হয়েছে, চিবুকের নিচ ফুলে গেছে একটু তা খুব বেশি খেয়াল করলেই বোঝা যায়। মেদহীন পেটে কিছুটা চর্বির পরত পড়েছে। এমনটা সে অনেকদিন ধরেই বুঝতে পারছিলো কিন্তু এই পরিবর্তন সে একা নয় তার মাও ধরতে পেরেছিলো। কয়েকদিন আগেই ভিডিও কল করতেই বলেছিলো, ‘ তুই কি একটু মোটা হয়েছিস! ‘

আয়না থেকে সরতে গিয়েই আবার মনে হলো নাকফুল পরলে কেমন লাগবে!

ভোরের আলো ফুটতেই আজ বিতিকিচ্ছিরি ঘটে গেল রিশাদের ঘরে। নির্জন পায়খানা করে ডায়পার নষ্ট করে ফেলেছে। গন্ধ পেয়েই ঘুম ভেঙেছে রিশাদের৷ সে বিছানার চারপাশ চেক করতেই মনে হলো জেগে উঠা নির্জনের গা থেকে গন্ধ আসছে। সন্দেহ দূর করতেই সে নির্জনের ডায়াপার খোলে। প্রতিদিন ছেলেটা নিয়ম করে সকালে কিংবা দুপুরে পায়খানা করে। আজকের এই নিয়ম পরিবর্তনে কিছুটা বিরক্ত হলো যেন রিশাদ। আধবোজা চোখেই সে ডায়াপার পাল্টে নির্জনকে নিয়ে বাথরমে ঢুকলো৷ বিছানা থেকে কয়েক কদমের দূরত্ব তার বাথরুমের তবুও যেন এতটুকু পার হতে রিশাদের শরীরের সবটুকু শক্তি খরচ হয়ে গেল। সে নিঃসাড় শরীরে নির্জনকে ধরে পরিষ্কার করে আবার বিছানায় ফিরতে গিয়ে অনুভব করলো তা পা দুখানি চলছে না। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। চোখ দুটো অন্ধকার হয়ে আসছে বুঝতে পেরেই রিশাদ কুঁজো হয়ে নির্জনকে ফ্লোরে বসিয়ে দিতেই নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। ধপাস করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠলো মেহউইশ। ঘরে আলো জ্বলছে , বিছানায় রিশাদ,নির্জন নেই। বিছানা থেকে নামার আগেই নির্জনের কান্না শুনতে পেল সে। দ্রুত পায়ে বিছানা ছেড়ে সে নির্জনকে কোলে তুলে রিশাদকে দেখলো। হুঁশ নেই মনে হচ্ছে ।ভয় পেয়ে গেল মেহউইশ। নির্জনকে কোলে তোলে রিশাদের গালে হাত রাখতেই চমকে উঠলো। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার মেহউইশ তাকে ডাকালো; সাড়া নেই।

-‘এ্যাই শুনুন, উঠুন। আপনার তো অনেক জ্বর।’ রিশাদের সাড়া নেই অনেকবার ডাকার পরও আবার নির্জনেরও কান্না থামছে না। কি করবে কি করবে না ভেবে না পেয়ে আবারও রিশাদকে ডাকলো। নির্জনকে কোলে রেখে রিশাদকে টেনে তোলা তার পক্ষে অসম্ভব । ভোর হয়ে এসেছে রেহনুমা নিশ্চয়ই জেগে গেছে ভেবে আবার মেহউইশ দরজা খুলে রেহনুমাকে ডাকলো। রেহনুমা এলেও নির্জনকে থামাতে না পেরে মেহউইশ কান্নারত অবস্থাতেই তাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। রেহনুমার সাহায্য নিয়ে রিশাদকে তুলে মেহউইশ বালতিতে করে পানি আনলো। শীত শীত আবহাওয়াতেও মেহউইশ ঘেমে গেল রিশাদকে বিছানার একপাশ থেকে অন্যপাশে সরিয়ে নিতে। সুঠামদেহী, লম্বা চওড়া, অচেতন রিশাদকে একটা মেয়ের পক্ষে একা নড়ানো সত্যিই খুব কষ্টদায়ক। তবুও মেহউইশ নিজ সাধ্যমত তাকে ঠিক করে মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। নির্জনের কান্না যখন বেড়ে দ্বিগুণ তখন মেহউইশ বাধ্য হয়েই রিশাদের ফোনে হাত দিলো। উপায় নেই আর বেহুঁশ রিশাদের আঙ্গুল ছুঁইয়ে ফোন আনলক করলো। কিছুটা ইতস্তত করেই সে ম্যানেজার সাহেবকে কল করে রুমে ডাকলো। ছেলেটা ডিউটি শেষ করে রাতেই নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়েছিলো। বাড়িতে তার মা,বাবা আছে। এত ভোরে কাউকে কিছু না বলে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসা দেখেই ঘাবড়ে গেলেন তারা।

সকাল আটটা নাগাদ রিশাদকে নিয়ে চট্টগ্রাম হাসপাতালে ছুটোছুটি করছে মেহউইশ। সে নিজেই ডাক্তারদের সাথে কথাবার্তা বলছে। ম্যানেজার সাহেব জোর করেই রেহনুমাকে হোটেলে রেখে এসেছে নির্জনকেও তার কাছেই রেখেছে। মেহউইশের কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। ডাক্তার বলছে রিশাদের জ্বর হঠাৎ করে নয় আরো আগে থেকেই ছিলো। মেহউইশ ভাবছে কি করে সম্ভব! এতদিন ধরে তারা একই ঘরে একই বিছানায় থাকছে। কই তার তো কখনও মনে হয়নি রিশাদ একটিবারের জন্যও জ্বরে আর্তনাদ করছে কিংবা একটু দূর্বল হয়ে বিছানায় গা এলিয়েছে! তবে গত রাতে তার চুপচাপ শুয়ে পড়াটা চোখে লেগেছিল খুব৷ ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল অনেকগুলো টেস্ট করাতে হবে হয়তো কিছুদিন হাসপাতালেও থাকতে হতে পারে।

অচেনা শহর,অচেনা পরিবেশ ; মোহউইশ অতিশিক্ষিত না হলেও কিছুটা পড়াশোনা জানা আবার হাসপাতালে কাজের সুবাদে ডাক্তারদের সাথে কথা বলাটাও সহজ। কিন্তু তবুও জড়তায় আছে সে প্রতিমুহূর্তে। রিশাদের অভিভাবকের জায়গাটাতে কে আছে! ভেবে পায় না সে এসময়ে রিশাদের পাশে কার থাকা উচিত। জেবুন্নেসাকে কি কল করবে? রিশাদের বাবা আছে সে না দেখলেও শুনেছিলো। বাবাকে ডাকবে? নাকি ফুপুই যথেষ্ট ! আবার মনে হলো সে নিজেই তো রিশাদের এই মুহূর্তে একমাত্র অভিভাবক , তার স্ত্রী । মন সায় দিলো না মেহউইশের। স্ত্রী বা স্বামী হলেই কেউ কারো অভিভাবক হওয়া যায় না।যেখানে সম্পর্কটাই আজ পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি সেখানে কেউ কারো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া অস্বাভাবিক। রিশাদের জ্ঞান ফিরলেও তার অবস্থা ভালো নয় এ অবস্থায় তার বাবা মাকে জানানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।অনেক ভেবে প্রথমে রেহনুমাকে আনতে ম্যানেজারকে পাঠানো হলো হোটেলে। রিশাদের আঙ্গুলের স্পর্শ নিয়ে ফোন পুনরায় আনলক করে প্রথমেই ফোন করলো রাইমার নাম্বারে। সব শুনে রাইমা বলল একটু অপেক্ষা করতে সে তার আব্বুকে জানাচ্ছে। মেহউইশের তবুও চিন্তা কমলো না সে আবার কল দিলো তার মাকে। মায়ের ফোন ব্যস্ত লাইনে পাওয়া সম্ভব হলো না।

মেহউইশের ভালোবাসার কুঠরিতে রিশাদের জায়গা নেই একটুও অথচ নির্দ্বিধায় ভাবনঘরে সে ছাড়া আর কেউ নেই৷ আশ্চর্যজনক ভাবে পরিস্থিতি মোড় বদলে দিচ্ছে জীবনের তা যেন চোখের সামনে স্পষ্ট মেহউইশের। সারাটা সকাল কাটলো হাসপাতালের এক বদ্ধ কেবিনে রিশাদের পাশে বসে। কখনও জানালায় তাকিয়ে যতদূর চোখ যায় সবুজ পাহাড়ে দৃষ্টি অথবা রিশাদের ঘুমন্ত ফ্যাকাশে মুখে। কাল রাতেও ওই মুখশ্রী ধারালো গাম্ভীর্যে পূর্ণ ছিলো। এক রাতেই যেন সকল গম্ভীরতা সমুদ্রের স্রোতের সাথে মিশে গেছে। মন ভার হয়ে আছে খুব৷ রেহনুমা নির্জনকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছেই আগে জানতে চাইলো রিশাদের অবস্থা । ইমিডিয়েট শুধু ডেঙ্গু টেস্টই করানো গেল। রিপোর্ট দুপুরে দেখবে ডাক্তার এরপরই হয়তো আবার বাকি টেস্টগুলোও করবে। মেহউইশ ভাবছে কিভাবে কি করবে রাইমা তো আর কল দিলো না। টাকা পয়সা বলতে রিশাদের দেওয়া হাজার আটেক টাকা ছিলো মোহউইশের কাছে। ম্যানেজার এসে সে বিপদ থেকেও উদ্ধার করলো। টাকার ব্যবস্থাও হয়ে গেল অথচ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত কারো খোঁজ পেল না৷ রেহনুমা বারবার কল দিচ্ছে তার ভাইকে। নো রেসপন্স।

সকাল সকাল আজ উকিলের সাথে এপোয়েনমেন্ট আছে জেবুন্নেসার। তার সাথে আছে রিহান। মা জানে ছেলে তার সাথে উকিলের কাছে যাবে কারণ মায়ের ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে তার আপত্তি নেই। কিন্তু কেন নেই তা জেবুন্নেসা জানতে পারেনি গত একমাসে অনেক চেষ্টা করে। শুধু জানে তার ছেলে তার সিদ্ধান্তে একটুও দুঃখী নয় এমনকি রিশাদের কাছে রিহান বলেছে সে বিদেশে চলে যেতে চায়। আর মা চাইলে মাকেও সাথে নিয়ে যাবে। এতেই যেন জেবুন্নেসার নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মা বলে মনে হয়েছে। তার ছোট্ট ছেলেটা তাকে সাথে নিতে চাইছে! রিহানের এই চাওয়া যে কতখানি দুঃখমাখা,কতোটা যে বেদনায় ভরপুর তা অজানা রিহানের মায়ের৷ মায়ের জীবনে অতীত জানার পরই সে মনে মনে চাইতো বাবা মরে যাক কিংবা তার জীবন থেকে হারিয়ে যাক দূরে কোথাও। এমন বাবা তার চাই না, প্রাচূর্যে ভর্তি জীবনটাতে সব আছে শুধু তার মায়ের মানসিক শান্তি নেই৷ অর্থ,অহংকার সব আছে কিন্তু তার মায়ের সম্ভ্রম নেই৷ ছেলে হয়ে মায়ের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিকে নিজের মনে জমিয়ে রেখে বেঁচে থাকা বড় কষ্টকর। তার চেয়েও কষ্টকর হিংস্র পশুর ন্যায় বাবা নামক মানুষটার কাছে থাকা। তাই সে রিশাদের কাছে গিয়েছিলো৷ বারংবার রিশাদের পা ধরে বলেছিলো, ‘দাদাভাই আমাকে একটা সুযোগ করে দাও বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার। আমি বড় হয়ে তোমার সব ঋণ শোধ করে দেব। প্লিজ আমাকে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।’ রিশাদ নিজেও বাবার অর্থবিত্তের বলয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক আগে তা জানে না তার ভাই বোন দুটো। সেদিন নিজের বুকে কষ্ট লুকিয়ে ভাইটাকে সে বলেছিলো ‘চেষ্টা করবো সাধ্যমত।’

জেবুন্নেসা উকিলের কাছে আসার আগেই রাইমার ফোন পেল। রিশাদের অবস্থা জানতেই সে রেগে গেল রিশাদকে কেন ঢাকায় আনছে না বলে। জেবুন্নেসার এই রাগের কথা মেহউইশ পর্যন্তও পৌঁছুলো। কিন্তু বাকি রইলো রিশাদের বাবার একটা ফোনকলের৷ রাইমা তার বাবাকে কি জানায়নি!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here