#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-১
ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
কলেজ থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে বিভোরকে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো দেখে একটু অবাক হল পৃথুলা। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বিভোরের সম্মুখে। পৃথুলাকে দেখে নড়েচড়ে দাঁড়াল বিভোর। বলল,
“এতক্ষণে ক্লাস শেষ হল! আমি সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।”
“তুমি এখানে কি করছো?”
“কি আবার করব! তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। পুরো একটা সপ্তাহ তোমার সাথে দেখা হয়নি। তোমাকে কয়েকদিন না দেখলে আমি হাঁপিয়ে উঠি, তুমি জানোনা সেটা?”
বিভোরের কথায় মৃদু হাসল পৃথুলা। বলল,
“তুমি একটা পাগল।”
“হুম। তোমার জন্য। চলো গাড়িতে ওঠো।”
“কেন? কোথায় যাব?”
“আগে রেস্টুরেন্টে যাব। কিছু খেয়ে তারপর তোমাকে নিয়ে ঘুরব।”
“না বিভোর। আমাকে বাসায় যেতে হবে।”
“বাসায় তো কেউ নেই। বাসায় গিয়েও তো একা একা থাকতে হবে। তার চাইতে এইটুকু সময় আমাকে দিলে কি এমন ক্ষতি হবে!”
“তবুও..”
“এক্সকিউজ দিও না। প্লিজ!”
“ঠিকাছে।”
বিভোর গাড়ির দরজা খুলে দিল। পৃথুলা চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে পড়ল। ড্রাইভিং সিটে বিভোর বসে কার স্টার্ট দিল।
“তুমি সবসময় এমন করো কেন বলোতো? আমারও তো ইচ্ছে করে তোমার সাথে কিছু সময় কাটাতে। একটুখানি সময় আমাকে দিলে কি এমন ক্ষতি হবে!”
ড্রাইভ করতে করতে বলল বিভোর। পৃথুলা বলল,
“এইযে দিলাম সময়।”
বিভোর রসিয়ে রসিয়ে বলল,
“হুম সেজন্য আমি ধন্য।”
পৃথুলার দিকে একটা ছোট্ট প্যাকেট এগিয়ে দিল বিভোর। পৃথুলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি এটা?”
“খুলে দেখো।”
পৃথুলা প্যাকেটটা নিয়ে খুলে দেখল, একজোড়া ঝুমকো। হাসি ফুটে উঠল পৃথুলার ঠোঁটের কোণে। ঝুমকোর প্রতি প্রতি ভীষণ দুর্বলতা পৃথুলার। মৃদু হেসে বলল,
“ঝুমকো! আমার জন্য?”
বিভোর পৃথুলার গালে আলতো করে টোকা দিয়ে বলল,
“জ্বি ম্যাডাম৷ আপনার জন্য।”
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাল বিভোর। পৃথুলা গাড়ি থেকে নামলে বিভোর পৃথুলার হাত ধরে রেস্টুরেন্টে ভেতরে যেতে নিল। পৃথুলা বাধা দিয়ে বলল,
“হাতটা ছাড় প্লিজ৷ আমিতো যাচ্ছি।”
বিভোর পৃথুলার হাত ছেড়ে দিল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“এসো।”
পৃথুলার বিভোরের পিছু পিছু রেস্টুরেন্টের পেছনে ঢুকল। রেস্টুরেন্টে মানুষজন তেমন নেই। বেশ কয়েকটা টেবিল খালি পড়ে আছে। বিভোর পৃৃথুলাকে নিয়ে শেষের একটা টেবিলে বসল। ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্য ফ্রাইড রাইস, চিকেন কাবাব আর চিকেন ফ্রাই অর্ডার করল। পৃথুলাকে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার জন্য কি বলব?”
“আমি সাদা ভাত খাব। সাথে ভর্তা।”
“কি ভর্তা?”
“যে কোনো ভর্তা। আলু ভর্তা বা শুটকি ভর্তা।”
বিভোর কপাল ভাঁজ করে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল পৃথুলার দিকে৷ তারপর ওয়েটারকে বলল খাবারগুলো নিয়ে আসতে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে রেস্টুরেন্টের বিল পে করে পৃথুলাকে নিয়ে লেকের পাড়ে গেল বিভোর। একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল দুজন। সময়টা শরৎকাল। আকাশজুড়ে সাদা মেঘের দাপট। মাথার উপরে কড়া রোদ ছড়ানো কটকটে সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। পৃৃথুলা তাকিয়ে আছে লেকের স্বচ্ছ জলের দিকে।
“আন্টি-আঙ্কেল কবে ফিরবেন?”
পানির উপর থেকে চোখ সরিয়ে পৃথুলা তাকাল বিভোরের দিকে। বলল,
“আজ বিকেলেই চলে আসবে।”
হুহু করে বাতাস বইছে। পৃথুলার ফরসা কপালের উপর পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে এলোমেলো হয়ে উড়ছে। বিরক্ত পৃৃথুলা হাত দিয়ে বারবার চুলগুলো সরিয়ে নিচ্ছে।
“থাকুক না, ভালোই তো লাগছে।”
“তোমার কাছে ভালো লাগছে। কিন্তু আমার কাছে বিরক্ত লাগছে। অনেকটা সময় তো তোমার সাথে কাটালাম৷ এবার আমাকে বাসায় দিয়ে আসো প্লিজ।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিভোর বলল,
“ঠিকাছে। ওঠো।”
পৃৃথুলা উঠে দাঁড়াল। আচমকা হুট করে বৃষ্টি নামল। বড় বড় জলের ফোঁটা পড়তে লাগল। চারিদিকে সবার ছুটোছুটি শুরু হল। বিভোরের গাড়িটা কিছুটা দূরে রাখা আছে। গাড়ির কাছে যেতে যেতে ওরা পুরো ভিজেই যাবে। তাই বিভোর পৃথুলার হাত ধরে একটা ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়াল। বিরক্ত হয়ে বিভোর বলল,
“ধ্যাৎ! হুট করে এই বৃষ্টিটা কোথা থেকে এলো!”
“শেয়ালের বিয়ে হবে এখন।”
পৃথুলার কথায় ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল বিভোর। বলল,
“কি?”
পৃথুলা হেসে বলল,
“গ্রামের লোকমুখে একটা কথা প্রচলিত আছে। রোদের মধ্যে বৃষ্টি হলে নাকি শেয়ালের বিয়ে হয়। এইযে দেখ, কেমন তপ্ত রোদ। তার মধ্যে বৃৃষ্টি হচ্ছে। তারমানে এখন শেয়ালের বিয়ের সময়।”
বলে ছাউনির বাইরে হাত বাড়াল পৃথুলা। বৃষ্টির পানিকে দুহাতে আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে পৃথুলার কপাল, চোখ, ঠোঁট, চিবুক। আবেশে চোখ বুঁজে ফেলল সে।
হঠাৎ কাঁধে হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঝট করে চোখ খুলল পৃথুলা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পেছনে। বিভোর নিষ্পলক তাকিয়ে আছে পৃথুলার পানে৷ বিভোরের এমন চাহনি দেখে বিব্রতবোধ করল পৃথুলা৷ চোখ নামিয়ে সামনে তাকাল। আচমকা বিভোর কাছে টেনে নিল পৃথুলাকে। পৃৃথুলা আঁতকে উঠে বলল,
“কি করছো বিভোর?”
বিভোর জবাব দিল না। দুহাতে পেঁচিয়ে ধরল পৃথুলার কোমড়। পৃৃথুলা বিভোরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইল। আর্তনাদ করে বলল,
“বিভোর কি করছো? ছাড় আমাকে।”
বিভোর পাত্তা দিলনা পৃথুলার কথায়। নজর দিল পৃথুলার ঠোঁটের দিকে৷ নিষিদ্ধ ইচ্ছে পূরণ করার বড্ড স্বাদ জেগেছে তার। নিজের ওষ্ঠদ্বয় বাড়িয়ে দিল পৃথুলার জোড়া ঠোঁটের দিকে। পৃথুলার বুঝার বাকি নেই বিভোর কি করতে চাইছে৷ গায়ের সমস্ত শক্তি এক করে সে ধাক্কা দিল বিভোরকে। আচমকা আক্রমনে পৃৃথুলার কাছ থেকে ছিঁটকে পড়ল বিভোর। বিষ্ময় নিয়ে তাকালো পৃথুলার মুখের দিকে৷ পৃৃথুলা ঝাঁঝালো গলায় বলল,
“এসব কি বিভোর? কি করতে যাচ্ছিলে তুমি?”
বিভোরও তেঁতে উঠল। সেও একই মেজাজে বলল,
“বর্তমান যুগের মেয়ে হয়েও তুমি এমন ব্যাক ডেটেড রয়ে গেলে কি করে বুঝিনা আমি। দুই বছরের রিলেশন আমাদের। তুমি আমাকে তোমার হাতটা পর্যন্ত ধরতে দাওনা। একটা চুমুও খেতে দাওনি কখনো। আমার ফ্রেন্ডসরা তাদের গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে লং ড্রাইভে যায়। আর তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব বললেই শুরু হয় তোমার নানান অযুহাত। এটাকে রিলেশন বলে?”
রাগে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলল বিভোর। বিভোরের কথাগুলো মাথা নিচু করে এতক্ষন চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল পৃথুলা। এবার সে মুখ তুলে তাকাল বিভোরের চোখের দিকে। শান্ত গলায় বলল,
“তুমিতো আগে থেকেই জানতে আমি এমন সেকেলে ধাঁচের মেয়ে। তবে কেন আমার সাথে রিলেশনে জড়ালে? আমাদের রিলেশনের শুরুতেই আমি তোমাকে বলেছি, বিয়ের আগ পর্যন্ত আমরা কেবলমাত্র বন্ধুর মত থাকব। তুমিতো তখন সব মেনেই নিয়েছ৷ তবে এখন কেন এসব বলছ?”
“তো কি এমন করেছি আমি? জাস্ট একটা চুমুই তো খেতে চেয়েছি। রুমডেট তো আর করতে চাইনি। একটা চুমু খেলে কি তোমার সতীত্ব নষ্ট হয়ে যাবে? আমার এইটুকু আবদারও পূরণ করতে পারবেনা তুমি?”
“সম্পর্ক শুরুর পূর্বেই তোমাকে নিষেধ করেছিলাম।”
বিভোর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“কপাল করে এমন একটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়েছি আমি। আসলে তোমার মত একটা মেয়ের সাথে প্রেম করাটাই ভুল হয়েছে আমার। ধুর..”
চোখে মুখে বিরক্তি ফুঁটিয়ে বলল বিভোর।
পৃথুলা কিছু বলল না। ওর চোখে জল চিকচিক করছে। বিভোর সেটা দেখেও তোয়াক্কা করল না। বিভোরও এখন বিরক্ত পৃথুলার এই সেকেলে মানসিকতা দেখতে দেখতে।
কিছুক্ষন পর বিভোর নিজেকে সামলে নিল। নতমুখে বলল,
“আচ্ছা স্যরি। বিয়ের আগে চুমুও খাব না। তবে বিয়ের পর কিন্তু কোনো বারণ শুনব না। মনে থাকে যেন। বৃষ্টি থেমে গেছে। চলো বাসায় পৌঁছে দিই।”
বলে গাড়ির দিকে এগোলো বিভোর৷ পেছনে পৃথুলা।
চলবে___