#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২৩
.
এরপর কেটে গেল কয়েকটা মাস। বাহ্যিক দিক দিয়ে পৃথুলার আচরণ অভ্রর প্রতি একই রকম আছে৷ কিন্তু মনের দিক দিয়ে পৃথুলা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে অভ্রর মাঝে। হয়তো পুরোপুরিই ডুবে গেছে।
সময় গড়িয়েছে, উৎস আর প্রত্যাশার বন্ধুত্ব দিন দিন গাঢ় হয়েছে। ওদের কথোপকথন ম্যাসেঞ্জার থেকে মুঠোফোনে এসেছে। উৎস প্রত্যাশার সাথে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চাইতে আরেক ধাপ এগোতে চাইছে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না। এই একটা দিকে উৎস ভীষণ কাঁচা।
“পৃথুলা, তাড়াতাড়ি নাশতা করে রেডী হয়ে নাও। আমি অফিসে যাবার পথে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।”
নাশতা করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল অভ্র।
উৎস ব্রেড চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাবে ভাবি?”
“বাসায় যাব একটু।”
“তোমাদের বাসায়?”
“হুম।”
“ফিরবে কবে?”
“বিকেলেই চলে আসব।”
“বিকেলেই? এতটুকু সময়ের জন্য যাবে কেন? কোনো বিশেষ কারণ আছে কি?”
“নাহ, সে রকম কিছু না৷ আসলে প্রত্যাশার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হবে। মা বলল, আমাকেও সেখানে থাকতে।”
উৎস’র হাত থেকে পাউরুটিটা পড়ে গেল। বিষ্মিত গলায় বলল,
“প্রত্যাশার বিয়ে?”
“হ্যাঁ। বিয়ে ঠিক হয়েছে আরো আগেই। আজ বড়রা কথাবার্তা বলে ডেইট ফিক্সড করবে।”
উৎস’র মাথায় অদৃশ্য বাজ পড়ল। বিয়ে আরো আগেই ঠিক হয়েছে অথচ প্রত্যাশা তাকে কিছুই বলল না। উৎস’র রাগে শরীর কাঁপছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে হনহন করে নিজের বেড রুমে চলে গেল। পেছন থেকে পৃথুলা, আঞ্জুমান উৎসকে ডাকল। উৎস তাতে কর্ণপাত করল না৷
রুমে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডায়াল করল প্রত্যাশার নাম্বারে। বারকয়েক রিং বাজার পর ফোন রিসিভ করল প্রত্যাশা।
“হ্যালো।”
উৎস কোনো ফর্মালিটির ধার ধারল না। বলল,
“হোয়াট ইজ দিজ প্রত্যাশা? কি শুরু করেছো তুমি এসব?”
“আমি আবার কি করলাম?”
“তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তুমি বলোনি কেন আমাকে?”
“জানলে কী করতে?”
“তুমি আমার কথার উত্তর দাও। প্রতিদিনই তোমার সাথে আমার কথা হয়। অথচ এই কথাটা আমাকে বলতে পারলে না?”
“এখন তো জানলে। আজকে বিয়ের ডেইট ফিক্সড হবে। আমি তোমাকে তারিখটা জানিয়ে দেব। আমার বিয়েতে দাওয়াত খেতে চলে এসো, কেমন?”
উৎস’র উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন কেটে দিল প্রত্যাশা। প্রত্যাশা যে রেগে আছে সেটা তার কণ্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে৷ উৎস অবাক। যেই রাগ এখন তার দেখানো উচিৎ, সেই রাগ প্রত্যাশা দেখাচ্ছে। আজব
.
“একটাই মাত্র ছেলে আমার। আমার যা কিছু আছে সবই তো ছেলেরই। আমাদের তেমন কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। তবে আপনারা জামাইকে খুশী হয়ে একটা গাড়ি উপহার দিতে পারেন।”
চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন পাত্রের বাবা। আনিসুল ইসলাম আর মাহিমা বেগম একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন৷
পাশ থেকে পৃৃথুলা বলল,
“আমার বোনকে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হলে আপনার ছেলেকে গাড়ি দিতে হবে?”
“আমার ছেলেকে দেবে কেন বলছো? গাড়ি তো তোমার বোনেরই থাকবে। ওই গাড়িতে তো তোমার বোনই চড়বে। আমার ছেলের যা সবই তো তোমার বোনের থাকবে।”
“মাফ করবেন। যৌতুক দিয়ে আমার বোনকে বিয়ে দেব না।”
ছেলের চাচা বললেন,
“যৌতুক কেন বলছো মা? এটা তো তোমরা উপহার দেবে জামাইকে।”
“আচ্ছা? উপহার বুঝি কেউ চেয়ে নেয়?”
জবাবে ছেলের বাবা বা চাচা কিছু বললেন না। পৃথুলা বলল,
“চা খাওয়া হয়ে গেছে?”
“হু?”
“বলছি চা টা শেষ হয়েছে? তাহলে এবার আসতে পারেন। একটা গাড়ি কিনে দেওয়ার সামর্থ আমার বাবার আছে। কিন্তু দেবে না। বিয়ের আগেই যারা প্রত্যাশার বিনিময়ে গাড়ি চাইছে তারা বিয়ের পর আমার বোনকে কতটা সুখী রাখবে সেটা আমাদের ধারণা হয়ে গেছে।”
এরপর আনিসুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা অনুরোধ করছি, এমন একটা লোভী পরিবারের ছেলের সাথে প্রত্যাশার বিয়ে নিয়ে আর একবারও ভেবো না।”
আনিসুল ইসলাম সায় দিলেন পৃথুলার কথায়। অবশেষে গম্ভীর মুখে পৃথুলাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলের ছেলের বাবা আর চাচা।
বিকেলে প্রত্যাশার নাম্বারে ফোন দিল উৎস৷ প্রত্যাশার বিয়ে হয়ে যাবে এটা সে মানতেই পারছে না। প্রত্যাশা ওয়াশরুমে ছিল তাই শব্দ শুনতে পায়নি। পৃথুলা প্রত্যাশার রুমে ঢুকে দেখল ওর ফোন বাজছে। প্রত্যাশাকে ডেকে বলল,
“প্রত্যুষ তোর ফোন বাজছে।”
ওয়াশরুম থেকে প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,
“কে ফোন করেছে?”
ততক্ষণে ফোন কেটে গেছে। পৃথুলা ফোন হাতে নিয়ে দেখল ‘উৎস’ নাম দিয়ে সেভ করা। ভ্রু কুঁচকে নাম্বারটা দেখল। হ্যাঁ, তার দেবর উৎসই।
প্রত্যাশা তোয়ালে হাতে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। পৃথুলা বলল,
“উৎস তোকে ফোন দিচ্ছে কেন?”
“তোর দেবর?”
“হুম।”
“তার সাথে তো প্রতিদিনই কথা হয়।”
পৃথুলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“প্রতিদিনই?”
“হ্যাঁ, সে তো আমার বন্ধু।”
“বন্ধু! আচ্ছা যাই হোক, আজ তোর ব্যাপারে নেওয়া সিদ্ধান্তটা ভুল নেইনি তো?”
প্রত্যাশা বুঝল পৃথুলা কিসের কথা বলছে৷ সে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“না আপি। তুই যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস।”
তৎক্ষণাৎ প্রত্যাশার ফোনটা আবার বেজে উঠল।
“এতবার ফোন দিচ্ছে কেন? দেখ তো কি বলে।”
পৃথুলা ফোনটা প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে দিল। প্রত্যাশা ফোন রিসিভ করেই বলল,
“বিয়ের দাওয়াত নেওয়ার জন্য ফোন করেছো?”
উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ফাজলামি রাখো।”
তারপর নরম গলায় বলল,
“প্রত্যাশা বিয়েটা কি করতেই হবে? না করলে হয় না?”
“নাহ। করতেই হবে। না করার কারণ আছে কি?”
উৎস জবাব দিল না। প্রত্যাশা বলল,
“চুপ কেন? বলো।”
“আই লাভ ইউ প্রত্যাশা।”
এতদিনেও যে কথাটা বলতে পারল না সেটা আজ এক মুহুর্তেই বলে দিল। প্রত্যাশা টের পাচ্ছে, তার মনজুড়ে অদ্ভুত একটা ভালোলাগা দোল খেয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পর বলল,
“বুদ্ধু, এই কথাটা বলতে এত সময় লেগেছে! আগে বলতে পারোনি?”
“প্লিজ বিয়েটা করো না। আমি পাগল হয়ে যাব।”
প্রত্যাশা হেসে বলল,
“বিয়েটা হচ্ছে না।”
উৎস’র চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বলল,
“কিহ! সত্যি?”
“হুম। বিয়ে হবে না। তোমার দাওয়াত খাওয়ার ইচ্ছেও পূরণ হলো না৷ আহারে!”
“আ’ম সো হ্যাপী প্রত্যাশা।”
“বুঝেছি। আচ্ছা এখন রাখছি। পরে ফোন দেব।”
পৃথুলা এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল প্রত্যাশার দিকে৷ ফোন রাখতেই প্রশ্ন করল,
“তোদের মধ্যে কি চলছে বল তো?”
প্রত্যাশা ইতস্তত করে বলল,
“আসলে আপি, আমি উৎসকে পছন্দ করি।”
পৃথুলা বড় বড় চোখ করে তাকালো প্রত্যাশার দিকে৷
“কিহ? তুই তো আমাকে বলিস নি কখনো!”
“আরেহ, আমরা কি রিলেশনশীপে ছিলাম নাকি যে তোকে জানাব৷ তাছাড়া, আমি উৎসকে পছন্দ করতাম। উৎস আমাকে পছন্দ করে সেটাও জানতাম। কিন্তু বলদটা এতদিন মুখ ফুটে কিছু বলেনি।”
পৃথুলা অবাক হয়ে বলল,
“উৎসকে যেহেতু পছন্দ করিস তাহলে বাবার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়েতে রাজী হলি কেন?”
“বাবার মুখের উপর না করে দিলে বাবাকে কষ্ট দেওয়া হতো। বাবা এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে রাজী হয়েছি। তাছাড়া, উৎস তো এতদিন কিছু বলেনি। তবে আমি মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম বিয়েটা যেন কোনোভাবে আটকে যায়। তাই হলো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আচ্ছা বাদ দে, চা খাবি?”
পৃথুলা বিছানায় বসতে বসতে বলল,
“খাওয়া যায়।”
“একটু বস, আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
দু কাপ চা নিয়ে খোশ গল্পে মেতে উঠল দুই বোন। কথার মাঝে অভ্রর প্রসঙ্গ চলে আসল৷ প্রত্যাশা বলল,
“আচ্ছা আপি, একটা সত্যি কথা বলবি?”
“কী কথা?”
“তোর আর অভ্র ভাইয়ার সম্পর্কটা স্বাভাবিক তো?”
“হুম। কেন?”
“এমনি। আসলে তোদের মধ্যে কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব। তাই মনে প্রশ্ন জাগলো।”
.#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২৪
.
প্রত্যাশার কথার প্রত্যুত্তরে পৃথুলা কিছু বলল না। চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিল। প্রত্যাশা বলল,
“এখন পর্যন্ত আমার দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ অভ্র ভাইয়া। ওনার মত মানুষ আর একটাও হয় না। স্ত্রীকে কি করে ভালবাসতে হয়, সম্মান করতে হয় সেটা ওনার কাছ থেকে শেখা উচিৎ। আর ওই বিভোর! কি একটা বালছালের সাথে প্রেম করলি তুই! তোর ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য একমাত্র অভ্র ভাইয়া। ওই বিভোইররা না। যে মানুষটা তোকে এত ভালবাসে তারও তো তোর ভালবাসা পাবার অধিকার আছে, তাই না? ভালবাসার মূল্য কেবল ভালবাসা দিয়েই দিতে হয়। ওমা! কথা বলতে বলতে চা কখন শেষ হয়ে গেছে টেরই পাইনি। আরেক কাপ খাবি?”
“না।”
প্রত্যাশা কাপদুটো নিয়ে কিচেনে চলে গেল। কয়েকমাস আগে হোটেলে অভ্রর বলা কথাটা মনে পড়ল পৃথুলার। ‘আমি মন বাড়িয়ে তোমার মন ছুঁতে চাই। যেদিন ছুঁতে পারব সেদিনই নাহয় তোমাকে কাছে টানার সাহস দেখাব।’
পৃথুলা বিড়বিড় করে বলল,
“ছুঁয়েছে অভ্র। তোমার মন ছুঁয়ে ফেলেছে আমার মনটাকে।”
ফোন বাজছে পৃথুলার। অভ্র ফোন করেছে। পৃথুলা হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করে কানে ঠেকালো,
“হ্যাঁ, বলুন।”
“পৃথা, আজ কি তোমাদের বাসায় থেকে যাবে?”
“কেন?”
“আসলে অফিসে অনেক কাজ আছে। আমি রাত ন’টার আগে বের হতে পারব না।”
“ও। তাহলে আমি একাই চলে যাই।”
“আরে না। একা আসবে কেন? কাল এসো।”
“না, আজকেই যাব।”
অভ্র হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ঠিকাছে। আমি উৎসকে ফোন দিয়ে বলছি তোমাকে নিয়ে আসতে।”
“উৎস আবার কষ্ট করতে যাবে কেন? আমিই…”
“একা আসতে পারবে, তাই তো? কিন্তু একা আসার দরকার নেই। উৎস গিয়ে নিয়ে আসবে।”
“ঠিকাছে।”
“রাখছি তাহলে।”
“শুনুন!”
“বলো।”
“ফেরার সময় একটু ফুলের দোকানে যাবেন।”
“ফুলের দোকানে কেন?”
“একটা বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবেন।”
“বেলি ফুলের মালা দিয়ে কী করবে?”
“উফ্ এত্ত কথা বলেন কেন আপনি!”
অভ্র হেসে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আনব।”
.
রাত সাড়ে নয়টায় বাসায় ফেরে অভ্র। জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। পৃথুলা খাবার বেড়ে দিয়ে চলে যেতে নেয়। অভ্র জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছ? খেতে বসো।”
“আমার খিদে পেয়েছিল ভীষণ। তাই আগেই খেয়ে নিয়েছি।”
“ওহ।”
পৃথুলা রুমে চলে গেল। খাওয়াদাওয়া শেষে অভ্র বেডরুমের দিকে পা বাড়াল৷ আজ অফিসে প্রচুর ধকল গেছে৷ এখন একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। অভ্র বেডরুমের সামনে গিয়ে আবিষ্কার করল দরজা ভেতর থেকে আটকানো।
অভ্র দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
“পৃথা, পৃথা ঘুমিয়ে পড়েছো?”
ভেতর থেকে পৃথুলা আওয়াজ দিল,
“পাঁচ মিনিট দাঁড়ান।”
“কেন?”
“দরকার আছে।”
“পাঁচ মিনিট আমাকে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?”
“চাইলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসতে পারেন।”
অভ্র ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে সাত মিনিট পর দরজা খুলে দিল পৃথুলা। অভ্র ভেতরে ঢুকেই একটা ঝটকা খেল। পৃথুলার পরনে একটা সোনালি পেড়ে কালো পাতলা জর্জেটের শাড়ি, ব্যাকলেস ব্লাউজ। হাতে কয়েকটা কালো কাচের চুড়ি। কানে কালো পাথরের একজোড়া ঝুমকো। চুলগুলো খোঁপা করা।
কালো অভ্রর প্রিয় রঙ। প্রিয় রঙে এই মেয়েটাকে দেখে চোখ ঝলসে যাচ্ছে অভ্রর। যদিও পৃথুলার মুখে প্রসাধনীর ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু আপাতত ওর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা মেকআপকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে সদ্য ফোটা একটা কালো গোলাপ।
অভ্র যেন পলক ফেলতেও ভুলে গেল। সটান দাঁড়িয়ে রইল, নড়ল না একটুও। পৃথুলা এগিয়ে এসে অভ্রকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর তাকালো অভ্রর দিকে। অভ্র নিজেকে সামলে নিল। এভাবে তাকিয়ে থাকলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলবে। পৃথুলার মতিগতি আজ কিছু বোধগম্য হচ্ছে না ওর।
“আমার বেলি ফুলের মালা কোথায়?”
অভ্র মালাটা এনে পৃথুলার দিকে বাড়িয়ে দিল। পৃৃথুলা মালাটা হাতে নিল না। পেছন ঘুরে বলল,
“খোঁপায় পরিয়ে দিন।”
অভ্র বুঝতে পারছে না পৃথুলার আজ হয়েছে টা কি! পৃথুলা বলল,
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? পরিয়ে দিন।”
অভ্র মালাটা পৃথুলার খোঁপায় পরিয়ে দিল। পৃথুলা অভ্রর দিকে ফিরে বলল,
“কেমন লাগছে আমাকে?”
অভ্র কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল পৃথুলার দিকে। এরপর বলল,
“কি হয়েছে তোমার একটু বলবে প্লিজ?”
পৃথুলা মুচকি হেসে অভ্রর দিকে এগিয়ে গেল। অভ্রর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“ভালবাসি প্রিয়।”
বলেই মুখ গুঁজল অভ্রর বুকে। কথাটা বুঝতে অভ্রর খানিকটা সময় লেগে গেল। বুঝতে পেরে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল বিজয়ের হাসি। দুহাতে জাপটে ধরল পৃথুলাকে। কয়েকমিনিট কাটল এভাবেই, নিরবতায়। কিছুক্ষণ পর অভ্র পৃথুলার মুখটা দুহাতে আঁজলা করে ধরে বলল,
“আজ তাহলে অধিকার ফলানোর সাহসটা দেখিয়েই ফেলি।”
পৃথুলা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল। অভ্র ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিকাছে, তুমি সময় নাও।”
বলে পৃথুলাকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল।
পৃৃথুলা হা করে রইল। মনে মনে ভয়ংকর একটা গালি দিল অভ্রকে। অভ্র পৃথুলার মুখভঙ্গি দেখে অবাক বনে গেল। একটু আগে সে ছিল এক রকম আর এখন অন্যরকম। এই মেয়েজাতটাকে বোঝার সাধ্যি কোনো পুরুষেরই নেই বোধহয়!
অভ্র ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে পৃথা?”
পৃথুলা দাঁত কটমট করে বলল,
“আপনি একটা ব্যাক্কল, মাথামোটা। ‘তুমি সময় নাও পৃথা’। আমি চাইছি আপনার কাছে সময়?”
অভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“তুমি এই কারণে এমন রেগে গেছো!”
পৃথুলা উত্তর দিল না। অভ্র বলল,
“কিন্তু তুমি তো ‘হ্যাঁ’ বলো নি। আমি কি করব?”
“লজ্জার কারণে বলিনি। আর আপনি….। আসছে সাধুপুরুষ। হুহ।”
বলে আলনা থেকে একটা সুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু ওয়াশরুমে ঢোকা হলো না। অভ্র পৃথুলার হাত ধরে কাছে টেনে এক ঝটকায় পৃথুলাকে কোলে তুলে নিল। মৃদু হেসে নেশাতুর কণ্ঠে বলল,
“আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে, হুম? এই সাধুপুরুষ আজ আর সাধুপুরুষ থাকবে না। বীরপুরুষ হয়ে যাবে।”
______
কয়েক বছর পর…..
আজ অভ্রদের বাড়িতে খুশীর আমেজ চলছে। মায়ের আদরের মেয়ে আর ভাইদের পরম স্নেহের একমাত্র বোন অর্থির আজ বিয়ে। সেই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ুয়া ছটফটে পিচ্চি মেয়েটা আজ বউ হয়ে কারো ঘর আলোকিত করবে।
অর্থির হবু বরের নাম প্রহর। ছেলেটা দেখতে সুদর্শন। আচার-আচরণ অমায়িক। প্রহরের মা অর্থিকে দেখার পর বিয়েতে একটু আপত্তি করেছিলেন৷ তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে যেমন ফরসা, ছেলের বউও ফর্সা হবে। তাই অর্থির গায়ের রঙ নিয়ে আপত্তি করেছেন। কিন্তু ছেলের কাছে তার আপত্তি ধোপে টিকল না। প্রহর অর্থিকে ছাড়া আর কোনো মেয়েকে বিয়ে করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাই ছেলের পছন্দের মান রাখতে অর্থির সাথে বিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন তিনি। তবে প্রহরের বিশ্বাস, অর্থি নিজগুণে তার শাশুড়ির মন জয় করে নেবে।
বরযাত্রী এসেছে কিছুক্ষণ আগে। পুরো বাড়িজুড়ে মেহমান গিজগিজ করছে।
প্রহরের মেয়ে কাজিনদের সাথে জম্পেশ আড্ডায় মেতেছে উৎস। পৃথুলা ছোট্ট উশাকে কোলে নিয়ে উৎস’র কাছে গেল।
“এইযে দেবরসাহেব, এখানে বেয়ানদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন, আপনার মেয়ের খবর রেখেছেন কি? নাও তোমার মেয়েকে ধরো।”
উৎস হেসে উশাকে কোলে নিয়ে টুপ করে মেয়ের গালে একখানা চুমু খেল। প্রহরের চাচাতো বোন ইপ্সিতা বলে উঠল,
“ও মাই গড! আপনার মেয়েও আছে! আপনাকে দেখেতো মনে হয় আপনি এখনো বিয়েই করেননি।”
উৎস অসহায় মুখ করে বলল,
“আসলে অল্প বয়সে মায় বিয়া দিয়া দিছে আমারে। তাই এই বয়সেই বাচ্চার বাপ হয়া গেলাম।”
পৃথুলা আর দাঁড়াল না সেখানে। হেসে চলে এলো ওখান থেকে। পূর্ণতাকে কিছু খাওয়াতে হবে। মেয়েটা সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি। সারাক্ষণ দুষ্টুমিতে মেতে থাকে।
.
চলবে____
চলবে___