মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব -২৬ ও শেষ

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২৬/ শেষ পর্ব
.
পৃথুলা বিভোরের উত্তরের অপেক্ষা করল না। বলল,
“উঁহু, ফিরত না বিভোর। প্রিয়া তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে বলেই তোমার কাছে আমার প্রয়োজন অনুভব হয়েছে। ইউ নো হোয়াট বিভোর, আমি তোমার কাছে শুধু প্রয়োজন ছিলাম, আর অভ্রর কাছে ওর প্রিয়জন। আমার চরম দুঃসময়ে তুমি আমার হাত ছেড়ে দিয়েছো আর অভ্র আমার দুঃসময়ে এই পুরো আমিটাকেই আঁকড়ে ধরেছিল। আমি ধর্ষিত হয়েছি বলে আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে কীনা সেটা তোমাকে ভাবতে হচ্ছিল। আর আমি ধর্ষিতা জেনেও অভ্র আমাকে বিয়ে করেছে। আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। আমাকে অন্ধকার থেকে টেনে আলোর পথে এনেছে। ভালবাসা দিয়ে আমার জীবনটা ভরিয়ে তুলেছে। আমার জন্য লড়েছে, আমাকে লড়তে শিখিয়েছে। জীবন যুদ্ধে পরাজিত এই পৃথুলাকে আবার আশার পথ দেখিয়েছে। আমার মরুভূমির মত শুষ্ক জীবনে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছে অভ্র। অভ্রর স্ত্রী আর পূর্ণতার মা ছাড়াও আজ আমার আরেকটা পরিচয় আছে। আমি ডাক্তার পৃথুলা ইসলাম। আর এর পেছনে সমস্ত ক্রেডিট অভ্রর। এখন আমার মনের কোথাও তুমি নেই বিভোর। পুরোটা জুড়ে কেবল অভ্রর বসবাস। অভ্র ওর ভালবাসা দিয়ে আমাকে পুরোটাই দখল করে নিয়েছে। যেখানে অভ্র ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই, তোমারও না।”

শান্তস্বরে কথাগুলো বলে থামল পৃথুলা। বিভোরের বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। ক্ষত বিক্ষত করতে ইচ্ছে করছে নিজেকে। যেই পৃথুলা তাকে এত ভালবাসত, সেই পৃথুলা বলছে তার মনে বিভোরের কোনো অস্তিত্ব নেই। একটা ভুল, শুধুমাত্র একটা ভুলের কারণে বিভোর হারালো তার প্রিয় মানুষটাকে। ইশ্, সময় থাকতে যদি এই মানুষটার কদর করত, তাহলে গল্পটা হয়তো অন্যরকম হতো।

বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বিভোরের। বলল,
“পূর্ণতাকে একটু আমার কোলে দেবে?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।”
পৃথুলা পূর্ণতাকে বিভোরের কাছে দিতে নিলে পূর্ণতা যেতে চাচ্ছিল না। পৃথুলা বলল,
“যাও আম্মু, এটা তোমার আঙ্কেল।”

বিভোর পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে ওর সমস্ত মুখ চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। পূর্ণতা… এটা তো পৃথুলারই অংশ। যেই পৃথুলা একদিন তারই হবার কথা ছিল। কিন্তু নিজের দোষেই হলো না। বিভোরের দু চোখ ফেটে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। পৃথুলা তা দেখে চোখ সরিয়ে নিল। বিভোরকে কাঁদতে দেখে ওর খারাপ লাগছে না, একটুও না।

“অভ্রর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে না আমাকে?”
পৃথুলার দিকে তাকিয়ে বলল বিভোর।
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। পূর্ণতা আম্মু, তোমার পাপাকে ডেকে নিয়ে এসো।”

অভ্র দূরে দাঁড়িয়ে গেস্টদের সাথে কথা বলছিল। পূর্ণতা বিভোরের কোল থেকে নেমে ‘পাপা’ বলে সেদিকে দৌড় দিল। বিভোর ছলছল নয়নে পৃথুলার দিকে তাকাল।
“আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি পৃথুলা। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
পৃথুলা স্মিত হেসে বলল,
“তোমার প্রতি আমার রাগ, অভিমান কিচ্ছু নেই বিভোর। বরং তুমি আমার সাথে সম্পর্ক না রেখে ভালোই করেছো। নয়তো আমি অভ্রকে পেতাম না। অভ্রকে আমার জীবনে পেয়ে আমি ধন্য।”

অভ্র এলো পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে। কাছে আসতেই পৃথুলা অভ্রর ডান হাতটা ধরে মিষ্টি হেসে বলল,
“এই হলো অভ্র। আমার হাজব্যান্ড। আর অভ্র… উনি প্রহরের অফিসের বস। আর আমার কোন এক সময়ের বন্ধু।”
“তাই নাকি?”

অভ্র মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিল বিভোরের দিকে।
“নাইস টু মিট ইউ।”
বিভোর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে হ্যান্ডশেক করে বলল,
“নাইস টু মিট ইউ টু। আপনি অনেক লাকি যে পৃথুলার মত লক্ষী একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন।”
অভ্র হেসে পৃথুলাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আই নো।”

ওদের তিনজনকে একসাথে দেখে বিভোর বুঝল ওরা কতটা সুখী। কষ্টের মধ্যেও বিভোরের ভালো লাগছে এই ভেবে, তার পৃথুলা সুখে আছে। নাহ তার পৃথুলা নয়। সে তো এখন অন্য কারো। বিভোর টের পাচ্ছে তার বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যাথাটা। এই ব্যথাটা এতদিনও ছিল। তবে আজ এখন একটু বেশিই অনুভূত হচ্ছে।

ওর চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে। তাকে এখন কাঁদতে হবে, চিৎকার করে কাঁদতে হবে। সেটা এখানে সম্ভব না। নাহ, এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। শেষবারের মত পৃথুলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো থেকো পৃথা।”
পৃথুলা অভ্রর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
“ভালোই থাকব।”

বিভোর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় পিছু ডাকলেন প্রহরের বাবা।

“কোথায় যাচ্ছেন স্যার?”
“ইয়ে, একচুয়ালি আমার একটা ইমারজেন্সী কাজ পড়ে গেছে। আমাকে যেতে হবে।”
“এখনি যেতে হবে?”
“জি।”
“এ কেমন কথা! আপনি তো এখনো কিছু খেলেন না।”
“এখন খাওয়ার সময় নেই। জরুরী কাজ আছে।”
“এটা তো হতে দেওয়া যায় না স্যার। প্রহরের কত অনুরোধের পর আপনি বিয়েতে এলেন। এখন না খেয়েই চলে যাবেন! এ কেমন করে হতে দেই! আমি কিছু জানি না। আমি বরং প্রহরকে ডেকে দেই। আপনিই বরং ওর সাথে কথা বলে নিন।”
“আপনি এত অস্থির হবেন না আঙ্কেল। আর প্রহর সাহেবকে ডাকারও দরকার নেই। কাজি চলে আসছে। বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। অযথা ওনাকে ডাকার দরকার নেই। আমি আসছি।”
“কিন্তু.”
“প্লিজ। আই শ্যুড গো।”
..

উশার চিৎকার শুনে দৌড়ে প্রত্যাশার রুমে গেল পৃথুলা। পিচ্চি উশা হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছে। পাশেই বসে আছে পূর্ণতা। তার চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি।

পৃথুলা দৌড়ে গিয়ে উশাকে কোলে নিল। পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবু কাঁদছে কেন? তুমি কিছু করেছো?”
পূর্ণতা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“বাবুটা কথা বলে না কেন? আমি একা একাই কথা বলে যাচ্ছি, ও বলে না। তাই চিমটি কেটেছি।”
পৃথুলার মুখ হা হয়ে গেল। বলল,
“কিহ? কথা বলে না বলে তুই ওকে চিমটি কাটবি! ওর এখনো কথা বলার বয়স হইছে যে ও কথা বলবে! তাই বলে তুই ওকে চিমটি কাটবি! পাজি মেয়ে।”

এরমধ্যে প্রত্যাশা ঢুকল রুমে। উশার কান্না ততক্ষণে থেমে গেছে। প্রত্যাশা বলল,
“কী হইছে? আমার পূর্ণতা আম্মাকে বকছিস কেন?”
“কোথায় ছিলি তুই?”
“ছাদে গিয়েছিলাম। উশার ভেজা কাপড়গুলো রোদে শুকাতে দিতে।”
“তুই ছাদে গিয়েছিস আর এদিকে উশা কথা বলে না বলে আমার বান্দরনীটা ওকে চিমটি কাটে।”
প্রত্যাশা পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে বলল,
“খবরদার, আমার আম্মাকে বান্দরনী বলবি না। আমার আম্মাটা অনেক লক্ষী।”
“হইসে, ওকে আর আশকারা দিস না। কোল থেকে নামা। স্কুলে যেতে হবে।”
পূর্ণতা বলল,
“না আমি স্কুলে যাব না।”
পৃথুলা ধমক দিয়ে বলল,
“ফুপ্পির বিয়ে উপলক্ষে এ ক’দিন স্কুলে যাওনি। আর কোনো ফাঁকিবাজি চলবে না৷ এসো।”

পৃথুলা উশাকে প্রত্যাশার কাছে দিয়ে পূর্ণতাকে নিয়ে নিজের রুমে এলো। অভ্র তখন অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল৷ পৃথুলা পূর্ণতাকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে রেডি করে নিজে রেডী হয়ে নিল। তারপর তিনজন একসাথে বেরিয়ে পড়ল।

পূর্ণতাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অভ্র গাড়ি ঘোরালো পৃথুলার হসপিটালের দিকে। প্রতিদিন পূর্ণতাকে স্কুলে আর পৃথুলাকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে অভ্র অফিসে যায়। অভ্রর অফিস আর হাসপাতাল কাছাকাছি। তাই খুব একটা অসুবিধা হয় না।

পৃথুলা বলল,
“কাল যে ছেলেটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম সেই ছেলেটা কে জানো?”
অভ্র ড্রাইভ করতে করতে বলল,
“হুম, বললে তো প্রহরের বস৷ আর তোমার বন্ধু।”
“ওটাই বিভোর।”

অভ্র পৃথুলার দিকে তাকালো। কয়েক সেকেণ্ড পর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ও আচ্ছা।”
“আমি এতদিন ভাবতাম, যদি কখনো বিভোরের সাথে দেখা হয় আমি নিজেকে সামলাতে পারব তো? আমি শক্ত থাকতে পারব তো? কিন্তু জানো, কাল বিভোরকে দেখে আমার সে রকম কোনো অনুভূতিই হয়নি। আর না একটুও খারাপ লেগেছে। ওকে আমার পূর্বপরিচিত ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। তোমার ভালবাসা বিভোরের প্রতি আমার সব অনুভূতি মুছে দিয়েছে অভ্র। মুছে দিয়ে ওর অস্তিত্ব। ভালবাসি তোমায় অভ্র।”

অভ্র মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে পৃথুলাকে কাছে টেনে নিল।
“আই লাভ ইউ পৃথা। আই লাভ মোর দ্যান মি।”
বলে আলতো করে ভালবাসার পরশ এঁকে দিল পৃথুলার প্রশ্বস্ত ললাটে। আবেশে চোখ বন্ধ করে পৃথুলা।
.
সমাপ্ত
যারা পড়েছেন, শেষ পর্বে সবাই মন্তব্য করবেন প্লিজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here