#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১৪
#মৌরিন_আহমেদ
ফ্ল্যাটে ঢুকেই করিম চাচাকে নজরে এলো ধ্রুবের। উনি ওর ঘরটাই সাফ-সুতোর করছিলেন। ঘর ঝাড়ু দিয়ে ঝাড়ু হাতে নিয়ে বের হয়ে যেতেই ওর সাথে দেখা হয়ে গেল ওনার। অবাক চোখে একপলক তাকিয়ে থেকে বললেন,
– শেষ পর্যন্ত আইলেন?.. আমি তো মনে করছি আর আইবেনই না!…
বেশ মধুর ভঙ্গিতে হাসলো ধ্রুব। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বললো,
– আমি তো প্রায়ই এমন হারিয়ে যাই, সেটা কি তুমি জানো না?
চাচা বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। ধ্রুব ছেলেটা এমন সেটা উনি জানেন। গত পাঁচবছরের চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতায় ওর ব্যাপারে অনেক কিছুই জানা হয়েছে তার। ওর কাজ কথাবার্তা, জীবন-যাপন সব কিছু জেনে গিয়েও কেমন যেন একটা অজানা ভাব আসে। সে ওর সম্পর্কে সব জানে অথচ কিছুই জানে না। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
– গত পাঁচদিন ধইরা কোন খোঁজখবর দিলেন না… সেইদিন কলিংবেল টিইপা কই যে গেলেন হদিস পাইলাম না।.. আমারে কইবেন কই ডুব মারছিলেন? আমি কম কইরা হইলেও হাজারবার আপনেরে খুঁজছি….
– কোন গুরুতর কিছু হয়েছে, চাচা? হঠাৎ আমার এমন খোঁজ করলে?
– গুরুতর কিছু কি না জানি না। তয় আপনের চিঠি আইছে… হলুদ খামে…
‘হলুদ খামে’র নাম শুনেই চমকালো ধ্রুব। ও সহজে চমকায় না কিন্তু এখন একটু হলেও চমকেছে। দীর্ঘদিন পর আজ তার ঠিকানায় ‘হলুদ খাম’ এসেছে। মানে এতদিনপর পর তার প্রিয়জন তাকে মনে করেছে। প্রিয়বন্ধু, সহচর!
– চিঠিটা আমাকে দাও, চাচা। আমি ওটা পড়তে চাই।…
– খাড়ান, দিতাছি…
বলেই ঝাড়ু হাতে বেরিয়ে গেলেন করিম চাচা। দু’ একমিনিট বাদেই ফিরে এলেন একটা খাম। হাতে করে। সেটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতেই বললেন,
– রাতের খানা টেবিলে বারছি, খাইবেন না?
ধ্রুব খামটা নাড়াচাড়া করতে করতেই বললো,
– আমি নেই জেনেও রেঁধেছ?.. জানতে নাকি আজ আমি আসবো?
– আপনে তো এমন হুট কইরাই আইসা হাজির হন!.. তাই রোজই রাইন্ধা রাখি…
– ঠিক আছে, তুমি যাও আমি আসছি।
– তাড়াতাড়ি আইয়েন। আবার হারায় যাইয়েন না।
বলেই বিরক্তমুখে প্রস্থান করলেন করিম চাচা। ধ্রুব একপলক চিঠির খামটার দিকে তাকিয়েই বুঝলো এটা কোন অফিসিয়াল চিঠি না। মানে কোন দরকারির তালিকায় এর ঠাঁই নেই। তবুও কেন যেন এটা পড়ার জন্য অন্যরকম এক আগ্রহ কাজ করলো ওর। প্রিয়বন্ধু অনেক দিন পর তাকে স্মরণ করেছে। এটাই তার আগ্রহের মূল কারণ। চিঠিটা নিজের টেবিলের উপর রেখে ওয়াসরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
___________________________________________
অনন্যাদের বাড়িতে এখন হুলস্থূল অবস্থা। যা মূলত লেবু মামাকে ঘিরে। তিনি গত পরশু দিন তার ক্যামেরা আর ব্যাকপ্যাক নিয়ে সেইযে বেরিয়ে গেলেন আর আজ এলেন। তাও আবার বিধ্বস্থ অবস্থায়! বাম হাতটা কনুই অবধি প্লাস্টার করে ফিতে দিয়ে গলার সাথে ঝুলিয়ে রাখা। কপালে ব্যান্ডেজ। এছাড়াও ডান হাতের কব্জিতে, বাম চিবুকে আর ঘাড়ে ছোট খাটো কয়েকটা কাটাও চোখে পড়ছে। বাড়িতে এসেই এমন হুলস্থূল কাণ্ডের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলো না অনন্যা। এই তো দুদিন আগেই মামু, সুস্থ মানুষটা বেরিয়ে গেলেন। আজ তার হলো কী?
ভাইয়ের পুরনো ব্যান্ডেজ গুলো বদলে সেখানে ড্রেসিং করিয়ে নতুন ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন জোহরা বেগম। তারপর নিজে হাতে ভাত খাইয়ে দিয়ে তাকে বিশ্রাম নেবার আদেশ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার চলে যাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল অনন্যা। মাকে বেরোতে দেখেই চট করে ঘরে ঢুকলো ও। মামু তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। কপালের উপর ডান হাতটা রেখে চোখ বুঁজে কি যেন ভাবছেন। হয় তো ঘুমানোর প্রস্তুতি!
– মামা কি ঘুমাচ্ছো?
ইতস্তত করেই প্রশ্নটা করলো। মামা ততক্ষনাত কপাল থেকে হাত সরিয়ে লাফিয়ে উঠলেন,
– এই কে!
– মামু, রিলাক্স। আমি অনন্যা।
ওকে দেখেই শান্ত হয়ে গেলেন মামা। আবারও বিছানার হেড সাইডে হেলান দিতে দিতে ক্লান্ত গলায় বললেন,
– ও, তুই! আয়, আয় বোস।
অনুমতি পেয়ে মামার পায়ের কাছটায় এসে বসলো ও। ধীর কিন্তু উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
– তোমার এ অবস্থা কী করে হলো, মামু?
– আর বলিস না। কি যে কষ্ট সহ্য করে এতদূর এলাম!.. রাস্তা যে এত খারাপ!.. এমনিতেই গা-হাত-পায় কাটা-ছেড়া তারমধ্যে ঝাঁকির রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে বেহাল দশা!..
বোঝাই যাচ্ছে, মামা লম্বা বক্তৃতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একটু আগে কণ্ঠে যে ক্লান্তিবোধ ছিল এখন সেটা নেই। হোস মে আকার জোস হুয়া হ্যা। কিন্তু সেটা করলে তো আর ওর হবে না। ওর হাতে এখন সেই সময় নেই। ও শুধু এসেছে মামার এ অবস্থাহওয়ার মূল কারণ কি সেটা জানতে। এতো লম্বা বক্তৃতা তো ওর দরকার নেই!
– কিন্তু মামু, তুমি রি খাগড়াছড়ি গিয়েছিলে.. সেখান থেকে এ হাল হলো কী করে?
কথার মাঝখানে কথা বললে যে কেউই রাগ করবে। এটা স্বাভাবিক। তাই মামাও খানিকটা ধৈর্যচ্যুত হলেন। বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
– আহ্, শোন তো!
– ঠিক আছে, বল।
চুপসে গিয়ে জবাব দেয় অনন্যা। মামু আবারও বলা শুরু করলেন,
– হ্যাঁ,… আসলে হলো কি সেদিন রিসোর্টে গিয়ে উঠলাম। রাতে থাকলাম। খাবার দিলো বেশ ভালই। পরদিন সকালে আশপাশ ঘুরতে বেরোলাম.. দুপুরে এসে খেলাম রিসোর্টে। এবার ওরা কী খাবার দিলো জানিস? পাহাড়িয়া একটা খাবার… নামটা যেন কী.. মনে পড়ছে না…কিন্তু আসল কথা শোন, খাবারটা যে টেস্টি!..তুই খেলে..
– মামু, তুমি তোমার দীর্ঘ ইতিহাস বলা বন্ধ করে আসল ঘটনাটা বলবে?
বিরক্ত হয়ে উঠল অনন্যা। মামা রেগে উঠে বললেন,
– আমি দীর্ঘ ইতিহাস বলা শুরু করেছি? তার মানে কী? আমি বেশি কথা বলি? বাচাল?
– মা-মু-…. আমি সেটা কখন বললাম?…. আমি তো বলছিলাম…
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি। আর কিছু বলতে হবে না।.. তুই এখন এখান থেকে যা। আমি ঘুমোবো।.. যা.. যা…
বলেই হাত নাড়িয়ে ওকে চলে যেতে ইশারা করলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে গায়ের উপরের কাঁথাটা টেনে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন। অগত্যা অনন্যা বিরক্ত হলেও নরম ভঙ্গিতে ডাকলো,
– মামু!.. ও মামু?.. বাকিটা বলো না…
– বলেছিনা বলবো না?.. তুই যা এখন থেকে।… আমাকে ঘুমোতে দে!..
– মামু!
এরপর চললো কিছুক্ষণ তাদের মামা- ভাগ্নির মান-অভিমানের পর্ব। একসময় অনন্যার জেদের কাছে হার মানলেন মামু। বাহিরে বাহিরে বিরক্তভাব কিন্তু মনে মনে বেশ খুশি হয়েই ওকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন।
ব্যাপার তেমন কিছুই না। মামার সেই মার্কো পোলো সাজার ইচ্ছের জন্যই তিনি গিয়েছিলেন খাগড়াছড়ি। গিয়ে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করবার দরকার ছিল। গেলেন, ঘুরলেন কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়! ছোট্ট একটা পাহাড়ে উঠতে গিয়েই ঘটলো মূল ঘটনা। ট্রেকিং টাইমে পা পিছলে পড়ে গেলেন পাহাড় থেকে। গড়াতে গড়াতে হাত-পা ভাঙচুর, ক্যামেরা চুরমুর! আর এরই মাধ্যমে মামারও পাহাড় ঘোরার সাধ অকালে সমাপ্তিতে পরিণত হলো!
– বুঝলি রে, অনু! অনেক ভেবে দেখলাম, ওসব পাহাড়-টাহারে ঘোরা আমার কাজ নয়। তার চেয়ে ঘরে বসে বই পড়াও অনেক ভালো!
– যাক বুঝলে অবশেষে!.. তোমার বুদ্ধিটাও কিন্তু খারাপ ছিল না। আর্কিওলোজিস্ট হওয়া ভালো। মানুষের উপকারে আসে.. কিন্তু তোমার ওসবে মন না দেয়াই ভালো!..
অনন্যার কথার খোঁচাটা বেশ বুঝতে পারলেন লেবু মামা। ও যে ওনাকে কি বুঝাতে চাচ্ছে তা বেশ স্পষ্ট! তবে এখন সেটা নিয়ে বাড়তি কথা বলার ইচ্ছে নেই ওনার। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তাই হাই তুলতে তুলতে বললেন,
– হয়েছে। যা, এবার ঘুমো গিয়ে…
– আচ্ছা।
সায় জানিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল অনন্যা।
রাতের খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে এলো ধ্রুব। রুমের মেইন লাইট অফ করে দিয়ে বেড সাইড টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলো। হলুদ খামটা নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শু’ল। বুকের নীচে বালিশ দিয়ে কাঁথা খুলে পায়ের উপর ছড়িয়ে দিলো। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা বাইরের আধো আলো তার ঘরে ঢুকছে। বিছানার ওপরে এসে পড়ছে জানালার গ্রিলের বিচিত্র ছায়া। ঘরের ল্যাম্পের আলো আর বাইরের আধো আলো মিলে পরিবেশটা বেশ সুন্দর হয়ে উঠলো।
ঘরের চারদিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হাসলো ও। তারপর খামের উপেরের দিকের অংশটা ছিঁড়ে মুখটা খুললো। সেটা উপুড় করতেই বেরিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত বস্তু। হলুদ রঙের কাগজে ভাঁজ করা চিঠি। ও বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়তে লাগলো। তাতে লেখা,
—————————————————————————————
কিরে কেমন আছিস? বহুদিন হলো কোনো চিঠিপত্তর নেই,
ঘটনা কী? ডুব মারলি কোন পুকুরে? জানিস, তোর এই
নতুন ঠিকানা খুঁজে পেতে আমাকে কি পরিশ্রম করতে
হয়েছে? বাড়ি গেলাম, হেডকোয়ার্টারে গেলাম পাত্তা নেই।
স্বয়ং চিফ স্যারের সাথে কথা বলে তবেই না জোগাড় হলো!
সে স্যার তো বলতেই চাইলেন না। জানিসই তো, চিফ স্যার
আমাকে দেখতেই পারে না। বলে কী না সিক্রেট মিশনের
কথা বাইরের কাউকে বলতে নেই! দেখেছিস, আমাকে বলে
কী না বাইরের মানুষ! ফালতু স্যার! থাক সে কথা। আচ্ছা,
তোর কাজ কদ্দুর বল তো? এখানে ফিরবি কবে? ফিরলে
নিজ দায়িত্বে দেখা করে যাবি কিন্তু! শোন,আর লেখার
সময় নেই।… ক্লাইন্ট এসেছে। ভালো থাকিস, হ্যাঁ?
ইতি
প্রদোষ
————————————————————————————–
চিঠিটা পড়ার পর পরই হঠাৎ কী যেন মনে হলো ওর। চিঠি, হ্যাঁ ওকে চিঠি লিখতে হবে। অনেক জরুরি চিঠি! ও চট করে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ারে হাত ঢুকালো। একটা প্যাড আর একটা কলম বের করে আনলো। ঝকঝকে সাদা একটা কাগজ বের করে লিখতে শুরু করলো তার চিঠি। অফিসিয়াল ইমেইলের পুরাতন ভার্সন!
প্রায় আধঘন্টা পর ধ্রুবের চিঠি লেখা পর্ব শেষ হলো। প্যাড কলম সরিয়ে রেখে সোজা হলো। বুকের নীচের বালিশটা টেনে মাথার নিচে দিলো। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিবে হঠাৎ চোখ গেল জানালার দিকে। বাড়ির ঠিক দুটো বাড়ির পরের দালানটা দেখা যাচ্ছে। তারই পাঁচতলার একটা রুমের ভেতর নজর কাড়লো ওর। থাই গ্লাসের জানালায় আজ পর্দা টাঙানো নেই। জানালার গ্রিলের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বই হাতে নিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। খানিকটা উদাসী উদাসী ভাব। দূর থেকে তাকে দেখেই তার পরিচয় বুঝে ফেললো ধ্রুব। ঘুমে জড়িয়ে যাওয়া চোখে তার দিকে চেয়ে থাকলো। একসময় ঘুমও চলে এলো দু’চোখে তবুও স্বপ্নের ধোঁয়াশায় নজর কাড়লো সেই মেয়েটির!
#চলবে——-