#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_২১
#মৌরিন_আহমেদ
অফিস ক্যান্টিনে মুখোমুখি অবস্থায় বসে আছে বর্ষণ আর প্রদোষ। বর্ষণের সামনে শুধু একটা বার্গার। ও সেটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে খাচ্ছে। আড়চোখে বারবার প্রদোষকে দেখছে। প্রদোষের হাতে একটা পিৎজা। তার সামনে খাবারের উচ্ছিষ্ট রাখা বেশ কয়েকটা প্লেট। যেগুলো কিছুক্ষণ আগে অবধি ভর্তি ছিল নানা রকমের খাবারে। বর্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে তার বন্ধু প্রদোষ কীভাবে, গোগ্রাসে এতসব খাওয়া দাওয়া করছে!
এতক্ষণে সে মোটামুটি প্রদোষের ভুঁড়ি বাড়ানোর সহজ কৌশলটা আন্দাজ করে ফেলেছে ও। সে যে কীভাবে দিনে দিনে নিজেকে ফুটবল বানিয়ে ফেলছে সেটা ও বুঝতেই পারছে না! আধঘন্টা হলো ওরা ক্যান্টিনে বসেছে। এরই মধ্যে কী না ও দুটো পিৎজা, তিনটা বার্গার সাবাড় করে ফেললো?
এভাবে চলতে থাকলে তো ও রাস্তায় বেরতেই পারবে না। রিকশায় উঠলেই তো তার চাকা বাস্ট হয়ে যাবে! ভাবতেই হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল ওর। ফিক করে হেসে উঠতেই ওর দিকে তাকালো প্রদোষ। পিৎজার অংশটা মুখে দিতে গিয়েও থেমে গিয়ে বললো,
– কী রে, হাসছিস যে?
বর্ষণ হাসতে হাসতেই ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোর কথা ভেবেই হাসছি!..
– আমার কথা?
ও অবাক হয়ে জানতে চাইলেই বললো,
– তোর শরীরের যে হাল করেছিস তাতে তো মনে হয় তুই যে কোনো সুমো রেসলার কে চাইলেই প্যারাসিটামলের মতো কুঁত করে গিলে ফেলবি! শোন একটা সার্কাস পার্টিতে জয়েন করে ফেল… বহুত টাকা ইনকাম করতে পারবি!
– আমার এখনকার ইনকাম কী খারাপ? আর এতো ইনকাম করে কি হবে যদি সাধ্যমতো খেতেই না পারি?.. যাব তাক জিউঙ্গি অর খানেমেই মার যাউঙ্গি! হা হা হা!
প্রদোষ হো হো করে হাসতে থাকে। এরই মধ্যে সে তার সামনের পিৎজাটা শেষ করে ফেলেছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে ক্যান্টিনের মামার উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে উঠে বললো,
– মামু, দুই কাপ চা। প্লিজ!
বর্ষণ তাতে অবাক হয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললো। বিস্ময় মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
– আরও দুইকাপ চা? এতো কিছু রাখবি কোন পেটে?
– এই যে এখানে..
নিজের পেটের উপর হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতে জবাব দেয় ও। ওর ভাবভঙ্গিমা দেখে হতাশ হয়ে কপাল চাপড়ায় বর্ষণ। আশাহীন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– বসের ঝাড়ি না খাওয়া অবধি তুই শোধরাবি না, বুঝেছি!
– সে কী আর খাইনি ভেবেছিস? চিফ স্যার আমায় দেখতেই পারে না। দেখলেই চিল্লায়, “তোমার এই হাল কেন? তুমি চাকরি কেমনে করো?” ব্লা ব্লা.. আরে ভাই, আমি চাকরি করি আমার বুদ্ধিতে। তাতে তোর বাপের কি?
প্রদোষ নিজের মতো করে চিফ স্যারের দুর্নাম বলে যেতে থাকে। সাথে প্রকাশ করে নিজের ব্যক্তিগত ক্ষোভ। এদিকে বর্ষণ একটু পর পর ওকে ঈশারা করে কী যেন বলতে থাকে। টেবিলের নিচে পায়ে পায়ে দু’ একবার খোঁচাও মারে। কিন্তু ভুঁড়ি ওয়ালা প্রদোষ ওর ইঙ্গিত বুঝতে পারে না। নিজের মতো বকে যেতেই থাকে।
চিফ স্যারকে নিয়ে নিজের বিশাল বক্তৃতা দেয়া শেষ করে বর্ষণের দিকে তাকায়। ওর শঙ্কিত মুখ দেখে অবাক হয়ে বললো,
– কী রে, তোর আবার কী হলো?
– পি…পিছে দেখ!
– পিছে আবার কোন হা*লায়?
ভ্রু কুঁচকে পেছনে ফিরলো। তাতে যা চোখে পড়লো সেটা দেখেই যেন পিলে চমকে উঠলো ওর। স্বয়ং চিফ স্যার ওরফে যমরাজ ওর দিকে রক্তিম মুখে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একবার স্যার তো একবার বর্ষণের মুখের দিকে তাকায়। বর্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে। ডান হাতটা গলার কাছে এনে ছুরি চালানোর ভঙ্গি করে নিজের জিভ বের করে। এবারের ইঙ্গিত টা বেশ বুঝতে পারে ও। যার মানে হলো, “আব তু গ্যায়া!”
প্রদোষ ধীরে ধীরে পেছনে ফেরে। স্যারের দিকে তাকানোর আগেই একটা শুকনো ঢোক গিলে নেয়। হ্যাবলাকান্ত হাসি দিয়ে বললো,
– ইয়ে… মানে…. স্যার… আসলে, হয়েছে কী…
– শ্যাট আপ!
হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠেন চিফ স্যার। প্রচণ্ড রেগে উঠে বলেন,
– ইউ ব্লাডি ফুল! একজন সামরিক কর্মকর্তা হয়ে বসকে নিয়ে কীভাবে কথা বলতে হয়, জানো না তুমি?.. কীসব কথা বলো তুমি?.. ইউ শুড বি পানিশড ফর ইউর ফুলিশ ওয়ার্ক। ইউ আর সাসপেন্ড ফর আ উইক!
– স্যার, এসব আপনি কী বলছেন? আমি.. আমি…
– শ্যাট আপ! তোমার শাস্তি এখানেই শেষ হয় নি। তুমি অফিসিয়াল কাজ থেকে সাতদিনের সাসপেন্ড হয়েছ কিন্তু তোমার আরও শাস্তি বাকি আছে। এই সাতদিনে তোমার এক্সারসাইজ টাইম দ্বিগুণ করে দেয়া হলো। তোমার ডিউটি টাইম আটটার পরিবর্তে রাত দশটা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হলো।.. অ্যান্ড… অ্যান্ড… ব্রেক টাইমে ক্যান্টিন তোমার জন্য নিষিদ্ধ, গট ইট?
বলে কঠিন চোখে তাকালেন স্যার। প্রদোষ মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,
– স্যার?..
– নো মোর ওয়ার্ডস! ইটস ইউর পানিশমেন্ট। অ্যান্ড ইট স্টার্টস ফ্রম নাও…
বলেই গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেলেন উনি। প্রদোষ কাঁদ কাঁদ চেহারা করে বর্ষণের দিকে তাকিয়ে বললো,
– দেখেছিস, উনি কেমন খাটাস? এমন খাইস্টা লোক আমি আমার বাপের জন্মেও দেখি নি!
– দুঃখ পেয় না বৎস, আসছে বছর আবার হবে!
বলেই হাসতে হাসতে ওর পিঠে চাপড় মারে বর্ষণ। প্রতি উত্তরে দুঃখী দুঃখী চেহারা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো প্রদোষ। তার মুখে এখন প্রদোষের আঁধার বিদ্যমান!
___________________________
ফ্ল্যাটের গোছগাছ করছিলেন করিম চাচা। ধ্রুবের বইপত্রগুলো মুছে মুছে স্তূপ সাজাচ্ছেন। এরপর এগুলোর উপর মোটা দু’ পরত কাগজ দিয়ে মোড়াবেন। তারপর শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে বান্ডিল করে রাখবেন। আগামীকালই বাসা ছেড়ে দেবেন উনি। সকাল সকালই একটা মিনি ট্রাক চলে আসার কথা। এছাড়াও ভারী মালপত্র টানাটানি করতে সাহায্য করার জন্য দু’ জন লেবারও পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলেছে ধ্রুব।
যাওয়ার সময় অবশ্য নিজেই সাথে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু বিশেষ জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় হেড কোয়াটারে যেতে বাধ্য হলো। তাই একা একা সব কাজ সারতে হচ্ছে ওনাকে।
হঠাৎই শার্টের বুক পকেট থেকে ফোনটা বেজে ওঠে ওনার। উনি হাতের ন্যাকড়াটা পাশে রেখে ফোনটা রিসিভ করেন। কানে ধরতেই ওপাশ থেকে শোনা যায় ধ্রুবের গলা। সে বলেছে,
– আসসালামু আলাইকুম, চাচা। কেমন আছ?
– ওয়ালাইকুমাস সালাম। ভালো আছি আমি। বাবাজি, আপনে কেমন আছেন?
– এই তো আছি। তা তোমার গোছগাছ কতদূর? কালকের মধ্যে চলে আসতে পারবে না?
করিম চাচা একমুহুর্ত কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন,
– মনে তো হচ্ছে আসতে পারবো। বাকিটা আল্লাহ ভরসা!..
– ঠিক আছে। চলে এসো কাল। সকাল সকাল লেবারদের পাঠিয়ে দেব।.. ওহ্, হ্যাঁ ভালো কথা। আমার বইগুলো নিয়েছ তো ঠিক করে? দেখ, ফেলে এসো না যেন কোনটা!
ওর বইয়ের চিন্তা দেখে মনে মনে হাসলেন চাচা। তার সব আসবাব থাক বা না থাক তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু একটা বই হারিয়ে গেলেই যেন কলিজা ছিঁড়ে যায়! ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন,
– চিন্তা কইরেন না। আপনার বই সবগুলাই প্যাকেট কইরা ফেলাইছি। সব ঠিক মতনই যাইবো।
– ঠিক মতো আসলেই হলো। আচ্ছা, ভালো থাকো। রাখছি…
– আইচ্ছা।
কলটা কেটে দিতে গিয়েও হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে ওর। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললো,
– চাচা?
ফোনটা রাখতে যাচ্ছিলেন চাচা। ধ্রুবের ডাকটা কানে আসতেই থেমে গেলেন উনি। ফোনটা আবারও কানে ধরে বললেন,
– জ্বে, বলেন।
– ইয়ে… মানে.. চাচা, আমার খোঁজে কী কেউ এসেছিল?
– কই না তো…
কথাটা কানে যেতেই আরও একটু ইতস্তত করলো ধ্রুব। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– কেউ আসে নি?… কোনো মেয়ে…
– জ্বে না। আমি সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। কেউ আইলে নিশ্চয় জানতাম…
হঠাৎ করেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ধ্রুবের। তারমানে ও যা ভেবেছিল তা নয়? অনন্যা ওর খোঁজে আসে নি? কেন? মন খারাপ করে বললো,
– ঠিক আছে।
– কেন কোনো দরকার? কাউকে কিছু বলে দেওন লাগবে?
– ইয়ে মানে… যদি অনন্যা নামে কেউ আসে, তাহলে.. তাহলে…
কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দেয় ও। মনটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেছে। ও তো জানতো অনন্যা ওকে ভালোবাসে। তাহলে? ও কেন একবারও ওর খোঁজে আসলো না? আজ সতেরটা দিন হয়ে গেল ও এলাকায় নেই, এরমধ্যে অনুর কী একবারও ওর কথা মনে হয় নি? একবারও খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না যে ও বেঁচে আছে না মরে গেছে? তারমানে কি দাড়াচ্ছে? অনন্যা ওর কথা ভাবে না? ওকে ভালোবাসে না? ও শুধুই তার নিছক আগ্রহের ব্যক্তি? তাই এতগুলো দিন হয়ে যাওয়ার পরও ওর কোনো খোঁজ নেয় নি?
হঠাৎ করেই খুব অভিমান ভর করে ওর ভেতর। অনুর প্রতি অভিমান। মেয়েটা কেন ওর খোঁজ নিতে এলো না? কেন ওকে ভালোবাসলো না? ও কী জানে না ধ্রুবের মন ছুঁয়েছে সে?
#চলবে——-
[অনেকদিন পর ধ্রুব-অনন্যা লিখলাম। মাথায় কিছুই আসছিল না। পর্ব ছোট হয়েছে। যাই হোক, হ্যাপি রিডিং… 🙂]