#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৩০
#মৌরিন_আহমেদ
অনন্যাকে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন জোহরা। মেয়ে তার মানসিক বিষণ্ণতায় ডুবে আছে। চিকিৎসা না করালে সুস্থ হবে না, ব্যাপারটা বেশ ভালো বুঝেছেন। তাই কাল ওর ওরকম কান্নাকাটি দেখেই ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে নিয়েছিলেন। আর আজ ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এলেন।
ডাক্তার অবশ্য তেমন কিছুই বলেন নি। উঠতি বয়সের মেয়েরা এমন ‘প্রেম-ভালোবাসা’ রোগে আক্রান্ত হয়েই থাকে! এটা চিন্তার কিছু নয়। এটাই ওইসব ডাক্তারদের ধারণা। তবুও মায়ের মন, ডাক্তার দেখিয়েই শান্তি পেলেন!
বিছানার হেড সাইডে হেলান দিয়ে বসে আছে অনন্যা। সামনেই ভাবুক মুখে বসে আছে কানিজ। হাতে অনুর ফোনটা। ডায়ালারে বারবার কাকে যেন কল করেই যাচ্ছে। কলটা ঢুকছে না, বন্ধ দেখাচ্ছে। তবুও ও থামছে না। বারবার ট্রাই করেই যাচ্ছে। একসময় বিরক্ত হয়ে বললো,
– ছেলেটা এমন করবে কেন, অনু? নিখোঁজ যদি হতে চায় তবে একেবারেই হয়ে যাক না.. বন্ধ নাম্বার দিয়ে রহস্য করার কী মানে?
– সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। এমন করলো কেন?
প্রতি উত্তরে কানিজ কিছু বলে না। ফোনটা হাতের সাথে বারি দিতে দিতে নাচায়। ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ পুরোনো কোনো হিসেব মিলিয়েছে এমন ভঙ্গি করে বললো,
– তুই কি কিছু বুঝতে পারছিস?
– কী?
অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন ছোঁড়ে অনন্যা। কানিজ হঠাৎ দ্বিধায় পড়ে যায়। বলবে কি বলবে না সে চিন্তায় মুখটা আনমনা লাগে। অনন্যা আবারও বললো,
– কী রে কী বুঝতে পারবো, বল্?
– ধ্রুব কোনো সন্ত্রাসী নয় তো?.. উগ্রবাদী, সহিংসধর্মী দলের লোক?
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে শোনা যায় কানিজকে। অনন্যা একমুহুর্তের জন্য চমকে ওঠে। বলে,
– তোর এমন কেন মনে হচ্ছে?
– দেখ, উগ্রবাদী, সহিংস আর সন্ত্রাসী দলের লোকদের আচার -আচরণ হয় আলাদা। অদ্ভুদ..
বাকি কথাটা বলার আগে অনুর মুখের দিকে একবার তাকায়। তার চোখে একই সাথে আগ্রহ আর অনাগ্রহ বিদ্যমান। ধ্রুব সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য সে বরদাস্ত করবে না, আবার ওর কথাটাও ও ঠিক শুনবে। চোখ সরিয়ে আবারও বললো,
– ধ্রুব.. যার চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ সবদিক দিয়েই আলাদা। তোর ভাষায় অদ্ভুদ, প্রেমময়… কিন্তু আমার ভাষায় সন্দেহজনক! ওর নামটা নিয়েও আছে জটিলতা, কনফিউশন… যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সেই বাড়িওয়ালা ওর নামটা পর্যন্ত জানে না!.. পরিবারে কেউ নেই। একা একা থাকে। আবার, তুই খেয়াল করে দেখ, এলাকায় র ্যাব নামার পর ধ্রুবকে আর দেখা যায় নি। ও ভার্সিটি এলাকায় যেত, ইফতিদের গ্রেপ্তারের পর ওদিকেও আর যায় নি! তারমানে কি দাড়ায়, অনু? ও ড্রাগ ডিলার, স্মাগলার এই টাইপের কিছু নয় তো?
– তু.. তুই.. চুপ..ক.. কর.. ক.. কানিজ!
কথা আটকে যেতে থাকে অনন্যার।
– অনেক বলেছিস, আর বলিস না! চুপ কর!
তারপর দু’ হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কানিজের কথার পাল্টা জবাবে কোন যুক্তি দেখাতে পারে না। ধ্রুবকে ও চেনে। অনেক ভালো একটা ছেলে। অদ্ভুদ, কিন্তু ভালো মনের মানুষ। অমন একটা ছেলে দেশদ্রোহী হবে কল্পনাও করতে পারে না অনন্যা! অসম্ভব! ওর মনে পড়ে সেদিনের কথা।
তখনো অনন্যা ধ্রুবের সাথে সামনা সামনি কথা বলার সুযোগ করে উঠতে পারে নি দূর থেকেই সবসময় ফলো করতো। একদিন…
রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল ধ্রুব। রাস্তাটায় ফুটপাথ নেই। যেটুকু জায়গা আছে তাও রোড সাইড দোকানগুলোর দখলে। রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই মধ্যখানে চলে যায় ও। রোড সাইডেই একটা বিশাল বড় বিল্ডিংয়ের কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল। সেটার দিকে তাকিয়ে আপন মনে কী যেন ভাবতে থাকে। ওর এই আপনকাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে কে যেন ধাক্কা দেয় ওকে।
ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে পাশেই দাড়িয়ে থাকা একটা ময়লার ভ্যানের সাথে আরেকবার ধাক্কা খায়। ফলে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ভ্যানের উপর!
ঘটনার আকস্মিকতায় আহাম্মক হয়ে যায় ধাক্কা দেয়া লোকটি। মুখ কাঁচুমাচু করতে করতে তাকিয়ে থাকে ধ্রুবের দিকে। ভ্যান থেকে মুখ তোলে ধ্রুব। চেহারায় ময়লার যে আস্তরণ পরেছে তা বাঁ হাতে মুছতে মুছতে লোকটার দিকে একপলক তাকায়। ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,
– তুমি আমাকে ধাক্কা দিলে কেন?
যে লোকটা ধাক্কা দিয়েছিল সে পেশায় একজন রিকশাচালক। পরনে অনেক পুরনো, জীর্ণ শীর্ণ ময়লা পোশাক। গলায় ঘাম মোছার গামছা ঝোলানো। লোকটা কাঁচুমাচু করতে করতে বললো,
– আরেকটু হইলেই তো ওই বাসটা আপনেরে চাপা দিয়া যাই তো!
কথা শুনে রাস্তার দিকে তাকালো ধ্রুব। দেখতে পায় দ্রুতগামী একটা বাস মাত্রই জায়গাটা অতিক্রম করে চলে গেছে।
দূর থেকে ব্যাপারটা দৃষ্টিগোচর হতেই অনন্যা ভাবে, ধ্রুব বুঝি এবারে রিকশাওয়ালার সাথে বিনয় এবং নত ভঙ্গিতে কথা বলবে। খুশি হয়ে এই গরিব লোকটাকে কোন সাহায্য করতে চাইবে। হয় তো রিকশাওয়ালা ব্যক্তিও এমনটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু ও তা করলো না! ওকে এবং রিকশাওয়ালাকে অবাক করে দিয়ে লোকটার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করলো। চিৎকার করে বললো,
– তাই বলে আমায় ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেবে? এত্তবড় সাহস তোমার? ইউ রাস্কেল!
আচমকা এমন ব্যবহার পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন রিকশাওয়ালা লোকটা। থতমত খেয়ে বললেন,
– আ.. আমি.. তো..
– কী “আমি তো, আমি তো” করছো? আমার পাঞ্জাবি যে নোংরা করে দিলে তার ক্ষতিপুরণ কে দেবে, শুনি?.. লন্ড্রি করার টাকা দাও!.
প্রচণ্ড ধমক দিয়ে টাকার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে ধ্রুব। লোকটার মুখটা এমন করুন দেখায় বলার মতো না! সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখায় তার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। ওদের তারপর কী কথা হয় অনু সেটা শুনতে পায় না। শুধু দেখে ধ্রুব বেশ ভাব নিয়ে লোকটার রিকশায় চাপছে। আর উনি আহত ভঙ্গিতে রিকশায় চড়ে প্যাডেলে চাপ দিলেন।
এতটুকু ঘটনা দেখে ধ্রুব সম্পর্কে খারাপ ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও কেন যেন এই ঘটনা নিজের চোখে দেখার পরও বিশ্বাস করতে পারে না অনন্যা। কৌতূহল বোধ করে ঘটনার বাকি অংশ দেখার জন্য। একটা রিকশা নিয়ে ফলো করতে থাকে ওদের। এরপর প্রায় একঘন্টা ধরে রিকশায় করে ঘোরাঘুরি করে ধ্রুব।
শেষে যখন রিকশা থেকে নামে তখন রিকশাওয়ালার চোখ মুখের অবস্থা বেশ করুণ! ঘামে গা ভেজা। গায়ে ক্লান্তি আর বুকের ভেতর অসীম ক্রোধ! হয় তো ভাবছে ধ্রুবের মতো একটা বে’য়া’দব, শয়’তা’ন লোককে বাঁচানো তার জীবনের বিশাল বড় ভুল! ওর জীবন বাঁচানোর মতো বড় একটা কাজ করার পরও যখন সেই ছেলেটাই তার সাথে এতো বাজে ব্যবহার করতে পারে, বা করছে সেটা ভাবনাতীত!
তবে ধ্রুবের মুখে কোনো ক্রোধ বা বিদ্বেষ নেই। সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকায়। কচকচে হাজার টাকার দু’টো বের করে রিকশাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিতে বলে,
– আমার জীবন বাঁচিয়ে কাজটা ভালো করো নি তুমি। আমার মতো মানুষের জীবন বাঁচানো ভালো কাজ না। তবুও বাঁচিয়েছ সেজন্য ধন্যবাদ। তার ওপর রোদে ঘুরে আমায় নিয়ে রিকশা চালানোর জন্য এ টাকাটা নাও। বকশিস নয় এটা তোমার পাওনা!
বলেই রিকশাওয়ালাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সেখান থেকে চলে যায় ধ্রুব। রাস্তা পার হয়ে দ্রুতই মিলিয়ে যায় লোকের ভীড়ে। অনন্যা এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু খুঁজে পায় না। বাধ্য হয়েই ফিরে আসে একা একা।
হ্যাঁ, ধ্রুব অদ্ভুদ। অন্যরকম। কিন্তু ভালো বৈ খারাপ তো নয়! ও ভবঘুরে হতে পারে কিন্তু স্মাগলার নয়! ও তো ধ্রুবকে অনেকদিন ফলো করেছে এর মধ্যে একটা বাজে লোকের সাথে ওঠাবসা তো দূর কথাই বলতে দেখে নি! কখনো স্মোক করতেও দেখে নি। এতো ভদ্র টাইপের ছেলে হবে ড্রাগ ডিলার, স্মাগলার? ও করবে দেশদ্রোহিতা? এ যে অসম্ভব!
তারপরও যদি সত্যি সত্যিই ও জাতীয় কেউ হয়, জঙ্গি সন্ত্রাসবাদে লিপ্ত থাকে তাহলে? অনন্যা তখন কি করবে? ওর অসীম ভালোবাসা তখন কোথায় হারাবে? দু’ হাতে মাথা চেপে ধরে বসে থাকে। যদি সত্যিই ধ্রুব সন্ত্রাসী হয়, তবে ও ঠিক তাই করবে যা ওর করা উচিৎ! এতোদিন যা করতে পারে নি, যা করার কথা ভাবতেও পারে নি সেটাই করবে! ভুলে যাবে ওকে! আর যদি সুযোগ পায়, ধ্রুবকে আইনের আওতায় হস্তান্তর করতেও দ্বিধা করবে না সে। একটুও না!
__________________
আঁধারে ছেয়ে থাকা ঘর। জানালা দরজা সব বন্ধ। সামান্য আলোর ছিটে ফোঁটা নেই। এমন গুমগুমে পরিবেশ করে ঘরে শুয়ে আছে বর্ষণ। গায়ে মাথায় সাদা একটা চাঁদর দিয়ে ঢাকা। পরম নিশ্চিন্তে সে ঘুমাচ্ছে। একরাশ তৃপ্তটার সাথে!
হঠাৎ দরজার কাছে হালকা শব্দ পাওয়া যায়। নব মোচড়ানোর মৃদু শব্দ। তারপরেই কেউ একজন দরজাটা খুলে ফেলে। খুবই ধীরে সন্তর্পনে প্রবেশ করে ঘরের ভেতর। কিছু কী দেখতে পারে সে? নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকা মানবমূর্তি ছাড়া আর কিছুই নজরে আসে না। আসার দরকারও নেই। কারণ তার লক্ষ্য তো ওই ঘুমন্ত মানুষটার প্রাণ নাশ করা!
ধীর পায়ে, টিপে টিপে এগিয়ে যায় লোকটা। কাছে গিয়ে যেই না কোমড়ের খঞ্জরটা বের করেছে, উদ্যত করেছে বিছানায় শুয়ে থাকা বর্ষণের পিঠ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে, অমনি হঠাৎ নড়েচড়ে ওঠে বর্ষণ। পাশ ফিরে লোকটার দিকে মুখ করে শোয়। ঘুমের ঘোরেই চোখ খোলে একবার, আর বন্ধ করে না।
তড়িৎ গতিতে ছুটে যায় হাত, থাবা মেরে বসে অজ্ঞাত লোকটার ছুরি ধরা হাতে। ছুরি ছিটকে পড়ে, বেসামাল হয়ে উল্টে পড়লো লোকটা। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়ে ও। মেঝেতে থাকা লোকটাকে ধরতে যাবে তার আগেই জান নিয়ে ছুটে যায় লোকটা। প্রচন্ড বেগে দৌড়াতে দৌড়াতে রিসোর্টের কোন পাশে যেন হারিয়ে যায়! “ইসস্! ধরতে পারলাম না!” অনেকটা দূর ধাওয়া করার পরও ব্যর্থ হয় বর্ষণ। দাঁত কটমট করতে করতে ফিরে আসে কটেজের রুমে।
#চলবে——-
[চমক লাগছে কী?]