#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৩৯
(শেষ পর্ব)
#মৌরিন_আহমেদ
– “হিমুরা মহাপুরুষ, তাদের বিয়ে করে বন্ধনে আবদ্ধ হতে নেই। কিন্তু ধ্রুবরা ধ্রুব সত্য, প্রেমিক পুরুষ। তাদের বিয়ে করতে বাধা নেই কোথাও!__ আজ ধ্রুব তার অনন্যাকে বিয়ে করবে, ঘরে তুলবে তার প্রাণসী কে! যে অনন্যা, অনেকের মধ্যে এক অনন্যা!__ ”
চিঠিটা পড়েই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে অনন্যার। মনে মনে ভাবতে শুরু করে ধ্রুবের কথা। কিন্তু বেশিক্ষণ সে সুযোগ স্থায়ী হয় না। হঠাৎ কোত্থেকে যেন ছুটে আসে কানিজ। ওকে দেখেই তাড়া দিয়ে ওঠে,
– “একি অনু!.. এখনও রেডি হোস নি কেন তুই?.. শাড়ি, লাগেজ সব অমনেই পরে আছে!.. যা বলছি!.. যা তাড়াতাড়ি!”
কানিজের কথা শুনে ধ্যান ভাঙে ওর। থতমত খেয়ে বললো,
– “আব্.. হ্যাঁ, ক..কী বলছিলি?..”
– “কী হয়েছে তোর, ইয়ার?.. তোর না বিয়ে.. এখনও রেডি হোস নি যে?.. এনি প্রবলেম?..”
– “ইয়ে.. কানিজ, কাজটা ঠিক হবে তো?.. কাউকে কিছু না জানিয়ে…”
– “সেটা তোর আগে ভাবা উচিত ছিল, অনু। এখন সবকিছু করে ফেলে ভেবে কী লাভ? আর তাছাড়া আন্টি তো মত দিয়েছে এই বিয়েতে.. তাহলে আর না জানিয়ে বিয়ে হয় কীভাবে?..বাই দ্যা ওয়ে.. একটা সিক্রেট কথা শুনবি?..”
– “কী?”
আগ্রহী চোখে প্রশ্ন করে অনন্যা। কানিজ দুর্বোধ্য হাসলো। হাসি হাসি চেহারায় বললো,
– “ধ্রুব ছেলেটা কিন্তু ততটাও খারাপ না!.. দুলাভাই হিসেবে তাকে আমার পছন্দ হয়েছে!..”
– “যাক, অবশেষে।..”
ভেবেই মুচকি হেসে বললো অনন্যা। খুশির ঝিলিক খেলে গেলে ওর মুখমণ্ডলের উপর দিয়ে। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
– “আমি জানতাম, জানতাম কানিজ__ একদিন তুই ওকে বুঝবি!.. ও যে খারাপ নয় সেটা অনুধাবন করবি। আজ আমি খুব খুশি, দোস্ত!.. সত্যিই ধ্রুব অনেক ভালো!..”
– “হয়েছে, হয়েছে! আর গুণগান গাইতে হবে না। ভালো বলেছি তাতেই নাই শেষ!.. গুণ শুনতে শুনতে দুনিয়া আন্ধার!..”
মিথ্যে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায় কানিজ। অনন্যা তাতে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
– “তুই আবারও অমন করছিস?.. এই না বললি, ও ভালো?.. এতো দ্রুত পাল্টি খাস কেন?..”
– “আমি অমনই। যাই হোক। যা এখন এখান থেকে। শাড়ীটা পড়ে আয়.. সাজিয়ে দেই, সুন্দর করে!’
-” বজ্জাতের হাড্ডি, হুহ!”
বলেই শাড়ি হাতে নিয়ে দপদপ করে হেঁটে চলে যায় অনন্যা। আর ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে কানিজ। আনমনেই বলে ওঠে,
– “পাগলী একটা! ধ্রুব পাগলী! হা হা হা!..”
______________________
বিকেলের দিকে বিয়েটা পড়ানো হয়ে যায় অনন্যা আর ধ্রুবের। বেশ নির্বিঘ্নে, ঝুট ঝামেলাহীন ভাবে। প্রথমে বিয়ের সাক্ষী হিসেবে লোক আনা নিয়ে কিছুটা জট পেকেছিল কিন্তু ধ্রুব নিজেই সে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করে। কোথা থেকে যেন হাজির করে কয়েকজন সাক্ষী। সবাই নাকি ওর পরিচিত। এই অপরিচিত এলাকায় এসেও তার পরিচিত লোক কীভাবে যে বের করে ফেললো!
– “অনা,…”
বেঞ্চে বসা অনন্যার পাশের জায়গাটা দখল করে ডেকে উঠলো ধ্রুব। অনন্যা ধীর গলায় প্রতি উত্তর করলো,
-” হুম। বলুন।..”
– “আজ আমাদের বিয়ে হয়ে গেল, তাই না?.. আমরা এখন স্বামী- স্ত্রী..”
– “হুম।..”
– “কী হুম হুম করছো, হ্যাঁ? কথা বলছো না কেন?”
চোখ পাকিয়ে শাসনের সুরে বলে ওঠে ধ্রুব। অনন্যা কী বলবে ভেবে পায় না। কেমন যেন একটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। লজ্জিত মুখে বললো,
– “আমার লজ্জা লাগছে!”
– “ওরে আমার লজ্জাবতী বউরে!.. এতো লজ্জা কই পাও তুমি?”
অনন্যা সে কথার প্রতি উত্তর করলো না। মাথা নুইয়ে বসে রইলো। ধ্রুব খেয়াল করলো খুব দ্রুতই গাল দুটো লাল হয়ে আসছে ওর। সাথে কানের লতিও। মানে মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে! কেন যে ও এতো লজ্জা পায়! তবে ওর ভালোই লাগে। লজ্জা পেলে কাশ্মিরী আপেলের মতো লাল হয়ে ওঠে ওর গাল। ইচ্ছে করে টুপ করে মুখে পুরে গিলে ফেলতে!
ওকে আরও একটু লজ্জায় ফেলে দিতে বললো,
– “এমন করে লজ্জা পেও না, অনা। এতোদিন প্রেমিকা ছিলে সহ্য করেছি। কিন্তু এখন বৌ… কখন যে কী করে ফেলবো ঠিক…”
আর কিছু বলতে পারে না। তার আগেই ওর বুকের উপর হামলে পড়ে অনন্যা। তার বলিষ্ঠ দেহের ভাঁজে নিজের লজ্জারাঙা মুখটা লুকিয়ে ফেললো সলজ্জয়। ধ্রুব হাসলো, শব্দ করে হাসলো! হাসির তালে দুলে উঠলো তার শরীর।
কিছুটা সময় এমন নিরবতায় কেটে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর আবারো কথা বলে উঠলো ধ্রুব। বললো,
– “আচ্ছা, আমরা তো বিয়ে করে ফেলেছি, না? তাহলে কানিজ কবে ফিরবে?.. না মানে.. বলছিলাম.. আমাদের বিয়ে হয়েছে, আমরা এখন নববিবাহিত দম্পতি, আমাদের একটা প্রাইভেসি আছে না? ও থাকলে কেমন একটা..”
ধ্রুবের কথা শেষ করতে দেয় না অনন্যা। কেমন যেন মন খারাপের গলায় বললো,
– “ও থাকলে কি খুব ক্ষতি হবে?.. আমরা দুজন তো একসাথে এসেছি.. এখন ও যদি একা ফিরে যায়.. ওর মন খারাপ হবে না?”
– “মন খারাপ হবে?”
প্রশ্ন ছোঁড়ে ধ্রুব। অনন্যা বাচ্চাদের মতো করে বললো,
– “হ্যাঁ, হবেই তো!”
– “ঠিক আছে। ওকেও একটা বিয়ে করে ফেলতে বলো!.. তারপর তোমরা দুই বান্ধুবি মিলে এখানে হানিমুনটা সেরে নিয়ে__যে যার শশুরবাড়ি চলে যেও!..”
ধ্রুবের কথার কোন আগামাথা খুঁজে পায় না অনন্যা। কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়ার মতো করে বললো,
– “দূর! তাই কী হয় না কী!..”
– “না হলে আর কী? ওকে ফিরে যেতে বলো। আমি কিন্তু আমার হানিমুনে ওকে নিয়ে যেতে পারবো না.. এই বলে রাখছি!..”
হুশিয়ার করে ওঠে ধ্রুব। ‘ হানিমুন ‘ কথাটা শুনেই লজ্জায় জড়িয়ে যায় অনন্যা। নত মস্তকে ধীর গলায় বললো,
– “আপনি যে কী সব বলেন না!.. কিন্তু.. ওকে আমি কী করে চলে যেতে বলবো? আমার লজ্জা লাগবে না?.. এ আমি পারবো না। আপনার সমস্যা আপনি সামলান।..”
অনন্যার কথায় মুখটা কেমন কালো করে ফেললো ধ্রুব। তার মানে কী, হ্যাঁ? ধ্রুবের বিবাহিত জীবনে বাগড়া দিতে এখানেই থেকে যাবে কানিজ? তার মিষ্টি বৌয়ের পিছু পিছু থেকে, ওর রোমান্সে ওয়ান এন্ড অনলি বাধা হয়ে দাড়াবে? না, এ কিছুতেই হতে দিবে না সে। কানিজ কে ভাগাতেই হবে এখান থেকে। যে করেই হোক!
🍂
– “মিস. শ্যালিকা, এদিকে এসো তো!..”
ধ্রুবের ডাক শুনে ফিরে তাকালো কানিজ। সন্দেহে কুঁচকে আসে ওর মুখ চোখ। হঠাৎ এই ছেলে ওকে ডাকে কেন? আবার কী কথার প্যাঁচে ফেলে ওকে হেনস্তা করবে? রাগিয়ে দেবে অহেতুক? কাছে এসে বললো,
– “ডাকছিলেন কেন?”
কথার প্রতি উত্তরে হাত বাড়িয়ে কী যেন একটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে। কানিজ লক্ষ্য করে দেখলো জিনিসটা একটা খাম। অবাক চোখে তাকায়। কিন্তু কিছু বলার আগেই ধ্রুব সেটা ওর হাতের ভেতর গুঁজে দিতে দিতে বললো,
– “এই নাও,…”
– “এটা কী?”
খামটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে কানিজ। ধ্রুব মুচকি হাসে। বলে,
– “খুলেই দেখ না!..”
কানিজ কেমন ভ্রু কুঁচকে রেখেই খামটা খুলে দেখে। মুখটা ছিঁড়তেই তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, কচকচে হাজার টাকার বেশ কয়েকটা নোট। কানিজ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তখন ধ্রুব অন্যদিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে বললো,
– “নাও, শ্যালিকা হিসেবে তোমার যে হক ছিল, তা আমি দিয়ে দিয়েছি। এবার শান্তিমত ঘুরো-ফিরো.. আমার আপত্তি নেই! কিন্তু অনাকে কান ভাঙানি দিয়ে, আমার বিবাহিত জীবনে বাগড়া দিতে আসবে না! একদমই না!..”
কানিজ ওর রাগটাকে গায়ে মাখে না। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে,
– “thank you দুলাভাই!”
– “হুম। টাকা পেলে সবাই এমন মধু মেখে কথা বলে!”
বিরক্তিতে কুঁচকে আসে ধ্রুবের মুখ। তবে মনে মনে খুশিও হয়। অবশেষে কানিজ নামক বজ্জাত শ্যালিকার মন জয় করতে পেরেছে সে! এবার আর ওকে কোনোভাবেই ডিস্টার্ব করবে না সে!
__________________
তিন মাস পর…
জয়নাল আবেদীন সাহেবের কেসের রায় দিয়েছে। তার জেল হয়েছে তিন বছরের। যেদিন মামলার শুনানি দিলো সেদিন যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না জোহরা। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল জয়নাল সাহেব টাকা নেন নি। তিনি তেমন মানুষই নন! কিন্তু তার সব বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা কে ছাপিয়ে জজ সাহেব রায় ঘোষণা করলেন। জেল হয়ে গেল তার!
ব্যাপারটা অনুর কানে যখন যায় তখন বেশ নির্বাক ছিল সে। যেন কথা বলতে ভুলে গেছে। তার বাবাকে শুধু একটি প্রশ্নই করেছিল,
-“তুমি কী টাকাগুলো নিয়েছ, বাবা?”
জীবনে প্রথমবারের মতো সেদিন জয়নাল সাহেবের মুখে কোনো গাম্ভীর্যতা ছিল না। তিনি হেসেছিলেন মলিন হাসি। নিজের কন্যার কাছে স্বীকার করেছিলেন সব সত্যতা!
– “টাকাটা আমিই নিয়েছি, অনন্যা। আমিই নিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, ও আমি আত্মসাৎ করি নি।__ আমার পরিচিত এক ব্যবসায়ী ভাইকে টাকাটা আমি ধার দিয়েছিলাম। তার ব্যবসায় খাটানোর জন্য। কথা ছিল তিনমাসের মধ্যেই টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। কিন্তু দেয় নি। হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেছে লোকটা। আমি আমার শেয়ার মার্কেটের ব্যবসা থেকে টাকাটা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। বিরাট বড় লস হয়ে গেছে রে মা! এখন আর সে টাকা ফেরত দেয়ার সাধ্য আমার নেই!”
সত্যিটা শুনে চরম অবাক হয়েছিল অনন্যা। তার চিরকালের ধারণা বদলে গিয়েছিল সেদিন। সে তার বাবাকে যতটা খারাপ লোক ভাবতো তিনি ততটাও খারাপ লোক ছিলেন না! হয় তো গাম্ভীর্যের আড়ালে ঢাকা ছিল তার মায়া-মমতাময় হৃদয়, অনুভূতি ব্যক্ত করতে ছিলেন অপটু। কিন্তু খারাপ বোধ হয় ছিলেন না! ভাবতেই দু’ ফোঁটা জল গড়িয়ে যায় অনন্যার নরম কপোল বেয়ে!
______________________________
দরজা খুলেই অবাক হয়ে যান জোহরা বেগম। দরজায় কে দাড়িয়ে আছে? কে ওরা?! তার আদরের ছোট ভাই লুৎফর ওরফে লেবু না? কিন্তু ওর পাশে ওটা কে? লাল রঙের শাড়ি পরনে, মাথায় ঘোমটা__ লেবু কী বিয়ে করেছে না কী?
বিস্ময়ে বিস্ফোরিত নয়নে প্রশ্ন ছুঁড়লেন ওদের দিকে,
– তোমরা?.. লেবু তুই!
কথার প্রতি উত্তরে লাজুক হাসতে দেখা যায় লেবু মামাকে। ওনার পরনে টকটকে লাল রঙের একটা পাঞ্জাবি। তার বুকের কাছে কালো রঙের সুতোর কাজ করা, সাথে মানানসই সাদা প্যান্ট। চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়িয়ে বিন্যস্ত করা। তার চেহারা যেন আগের চেয়ে আরও বেশি উজ্জ্বল লাগছে! লেবু কী আগের থেকেও সুন্দর হয়ে গেছে?
তার পাশেই দাড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মামার ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে পরেছেন লাল রঙের জমিন আর কালো পাড়ের। সুন্দর একটা শাড়ি। আঁচল টেনে মুখের অর্ধাংশ ঢাকা। তারপরও চেহারার বাকি যে অংশ দেখা যাচ্ছে তাতে মেয়েটি যে অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী তা বুঝতে দেরি হলো না ওনার। ধবধবে ফর্সা তার গায়ের রঙ। এতো সুন্দর মেয়েকে লেবু পেল কোথায়?
ওনাকে অমন চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও লাজুক হাসলেন মামা। মাথা চুলকে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন,
– ইয়ে.. মানে… আপা… আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিবি না?
– আব্.. হ্যাঁ,.. কিন্তু.. কিন্তু ও কে?
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন জোহরা বেগম। মামা আগের মতো চাহনি দিয়েই পাশে দাড়ানো মেয়েটির দিকে তাকালেন। মেয়েটা হালকা করে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় কী যেন বুঝালো। উনি মিষ্টি করে হেসে বললেন,
– আপা, ও হচ্ছে লতা।… চিনতে পারছো না, নাকি?
লতা নামটা শুনেই যেন আরো একধাপ অবাক হয়ে গেলেন জোহরা। আজ কী উনি একের পর এক চমক খেয়েই যাবেন? বিস্ময়ে বললেন,
– “কিন্তু তোদের পোশাকের এই হাল কেন? নতুন বর-বৌ সেজেছিস যে?”
– “বিয়ে করলে একটু সাজগোজ করতে হয় না? তুমি যে কী না.. এসেছি থেকে দরজায় দাড় করিয়ে রেখেছ! ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছ না কেন? ”
– “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঢোক।”
বলেই দরজা থেকে সরে দাড়ালেন উনি। লেবু মামা কিছুটা হতাশ হলেন তার বোনের ব্যবহারে। তার প্রাণ প্রিয় বড় বোন, যাকে তিনি এতো শ্রদ্ধা করেন, এতো ভালোবাসেন, তিনি কী না তার বিবাহিত নববধূকে কোনো আয়োজন ছাড়াই ঘরে তুলছেন? ব্যাপারটা বড়ই দুঃখজনক! যাই হোক, একটা শ্বাস ফেলে তার জীবন সঙ্গিনীকে ঘরে ঢুকতে অনুরোধ করলেন। উনি ঢুকে গেলে নিজেও সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
ভেতরে আসতেই জোহরা বেগম অবাক চাহনি দিয়ে লতার দিকে তাকালেন। ওঁর কাছে এসে মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে দিলেন। ও মা! কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! লাল শাড়ি, আর বধুসাজে একদম খাঁটি বাঙালি নারী লাগছে! রূপ যেন ঝর্নার বারিধারা, উপচে পড়ছে!
জোহরা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন ছোট ভাই আর তার বৌকে। প্রাণ ভরে দোয়া দিলেন তাদের। আচ্ছা, তার মনের অব্যক্ত ইচ্ছের কথা, এরা জানলো কী করে? তিনি তো মনে প্রাণেই চাইতেন লেবু মামা, এই লতা নামক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করুক। আজ তার খুশির দিন, মহা খুশির দিন!
🍂
দুপুরে খাওয়ার পর ড্রইং রুমে একসাথে বসে আছেন লেবু মামারা। জোহরা কথায় কথায় জানতে পারলেন আসলে তখন ওনাদের কিছুই হয় নি। কানিজের বাবা হঠাৎ করে ফোন করে বকাঝকা করার পর মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল লতার। উনি ঠিক করে ফেলেছিলেন বাড়ি ফিরে আসবেন। তারপর চলে যাবেন ইউএসএ। ব্যাপারটা লেবু মামাকে জানাতেই বাধ সাধলেন উনি।
– “এটা কী, আপা?”
– “দলিল!”
– “দলিল? কীসের?”
– “এই বাড়ির। লেবু তোর যখন ছয় বছর বয়স তখন আমার বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পরেই মারা যান আব্বা। তখন থেকেই তুই আমার কাছে মানুষ। তোকে মানুষ করতে যেন কোনোদিন কোনো কষ্ট না হয়, তোকে যেন আমরা আমাদের বোঝা মনে না করি, সেজন্যই তোর নামে আব্বা তার সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। আর আমাকে দিয়ে যান অনেক দামী কিছু গহনা। অবশ্য বিয়ের সময়ই তোর দুলাভাইকে আব্বা এ কথাটা জানিয়েছিলেন। উনি তাতে মানা করেন নি। কিন্তু তারপরও কেন যেন উনি তোকে সহ্য করতে পারতেন না। হয় তো সম্পত্তির সমান বণ্টন হয় নি বলেই!
কিন্তু আমার এতে কোনো আফসোস নেই। বিশ্বাস কর, একটুও আফসোস নেই। আব্বা আমাকে যে গহনা গুলো দিয়েছিলেন তাই দিয়ে তোর দুলাভাই আমাকে এই বাড়িটা করে দেন। তাই মামলার জোরে সব সম্পত্তি চলে গেলেও এটা আছে। আর আমিও এই বাড়িতেই আছি।
তুই হয় তো জানিস না অনন্যার বিয়ে হয়ে গেছে। ওই যে ধ্রুব নামের সেই ছেলেটার সঙ্গে। ওর বিয়ে গেলে ও তো আর কখনোই এ বাড়ির ওয়ারিশ হতে আসবে না। ওর হাসবেন্ডেরই তো অনেক আছে! তাই আমি আমার এই বাড়িটাও তোর নামে লিখে দিয়েছি, লেবু। সারাজীবন তোকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেও আমার মনে হয় না আমি তোর সব চাহিদা পূরণ করতে পেরেছি। কিছু ভুল থেকেই গেছে। যাই হোক, নিজ গুনে সব ক্ষমা করে দিবি।
এই কাগজগুলোতে তোর স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তির দলিল আছে। এতদিন এগুলোর দলিল ছিল তোর দুলাভাইয়ের কাছে। উনি জেলে যাওয়ার সময় ওগুলো আমায় দিয়ে গেছেন। এই নে, এগুলো রাখ!”
– “কিন্তু আপা, এগুলো কেন তুই আমাকে দিচ্ছিস? আমি কখনো তোর কাছে কিছু চেয়েছি? বল্? কখনো কিছু চেয়েছি? এগুলো তুই রাখ, তোর কাছেই থাকবে সব!”
বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন লেবু মামা। লতাও সায় দেন। কিন্তু বাধা মানেন না জোহরা। মলিন হেসে বলেন,
– “না রে, এ জিনিস তোরাই রাখ। আমি ঠিক করেছি এ বছর হজ্জ্বে যাবো। এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পাপ তো আর কম করি নি। আল্লাহ যদি শেষ বয়সে এসে সেই পাপ মোচনের সুযোগ করে দেন! তাই যাচ্ছি। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে ফিরে আসবো– ইনশাল্লাহ। তখন তোর এই বাড়িতে আমাকে একটু জায়গা দিস, ভাই। সামান্য একটু জায়গা দিস!”
❤️
সি-বিচের সামনে একা একা দাড়িয়ে আছে অনন্যা। পরনে আকাশি রঙের একটা গাউন, সমুদ্রের উথাল পাথাল বাতাসের তোপে পরে সমান তালে উড়ছে। সেই সাথে উড়ছে তার খোলা চুল। আছড়ে এসে পড়ছে তার নরম মুখশ্রীর উপর। অনন্যা তাতে বিরক্ত হচ্ছে না। নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে চুপ করে দাড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার সাগর পানে। বাতাসের সংস্পর্শে এসে ভীষণ আরাম লাগছে, প্রাণ জুড়ানো সমীর ছোঁয়ায় বড্ডো হালকা লাগছে।
অনন্যা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সামনের সাগরের দিকে। তার নীল জলরাশির কী সুন্দর রূপ! একপাশে নারকেল গাছের সারি। বাতাসে দোল খেয়ে অদ্ভুত সুন্দর এক সুর সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। অনন্যা কান পেতে থাকে। প্রকৃতির সৌন্দর্যে এতটাই অভিভূত হয়ে পড়ে যে পাশে দাড়ানো লোকটিকে চোখে পড়ে না।
লোকটা মোহময় চাহনিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ওর এলোমেলো চুল, বাতাসে উড়তে থাকা গাউন, মুখের উপর এসে পড়া আকাশের মিষ্টি রোদ__ সব মিলিয়ে ওকে দেখে এক অন্যরকম অনুভূতি জাগছে তার হৃদয়ে। ভালোলাগার আবেশে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। ধ্রুবের মাঝে মাঝে মনে হয়, এই অপরূপ রূপবতী কন্যাটিকে সারাজীবন দেখার পরও বুঝি তার সাধ মিটবে না! তাকে দেখার লোভই ওকে সারাজীবন আচ্ছাদিত করে রাখবে। বিয়ের তিনমাস চলছে তবুও যেন মনে হয় এই তো সেদিন তার সাথে দেখা হলো। সেদিনই কথা হলো প্রথম!
হঠাৎ কী যেন মনে করে ওর খুব কাছে চলে আসে। এতোটাই কাছে যে অনন্যা মুখ ঘুরালেই ওর বুকের সাথে এসে বারি খাবে। হাত বাড়িয়ে ওর কোমড় আঁকড়ে ধরে। একমুহূর্তের জন্য চমকে ওঠে অনন্যা। প্রেম শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে দেহের প্রতি আনাচে কানাচে। ধ্রুবর হাত চলতে থাকে। কোমড়ে স্লাইড করতে করতে হুট করে একসময় শক্ত করে চেপে ধরে ওকে। টান দিয়ে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। ওর অবাধ্য চুলগুলো এসে আছড়ে পড়ে ধ্রুবের মুখের উপর। কিন্তু পাত্তা দেয় না। ওর মায়াময় চেহারার উপর নেশাক্ত চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছোট ছোট চুলগুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দেয়। ওর আচমকা এমন আক্রমনে শিউরে ওঠে অনন্যা। ওর কাজকর্ম কিছুই তার বোধ গম্য হচ্ছে না। হাবার মতো করে বললো,
– “কী করছেন, ধ্রুব?”
-” হুশশ্! চুপ কর, দেখতে দাও!”
মোহ বিশিষ্ট কণ্ঠে জবাব দিলো ধ্রুব। অনন্যা লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে, এই লোকটা যে এত অসভ্য কেন! কাশ্মিরী আপেলের মতো লাল টুকটুকে গাল দুটো নিয়ে বললো,
– “কী করছেন ছাড়ুন না!..আপনি তো বলেছিলেন পাবলিক প্লেসে এমন করবেন না। তাহলে?”
– “এটা পাবলিক প্লেস?”
– “না তে কী? চারিদিকে এতো এতো মানুষ দেখছেন না?…”
কথা শুনে একমুহূর্তের জন্য ওর মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় ধ্রুব। দ্রুত এবং তড়িৎ গতিতে চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে কী যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ কী যেন মাথায় আসতেই দুষ্টু হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– “ঠিক আছে, চলো তাহলে রুমে!.. তোমার যখন এতোই আদর খাবার শখ! কিন্তু পাবলিক প্লেস দেখে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছো, তাহলে রুমেই চলো!..”
বলেই আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না ওকে। কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা লাগায় হোটেলের দিকে। অনন্যা বোকা চোখে তাকায়। সে তো এটা বোঝাতে চায় নি! সে চেয়েছিল পাবলিক প্লেসের বাহানা বানিয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে। কিন্তু এ লোক মহা চালাক! ঠিকই উল্টো বুঝে মানে দাড় করিয়ে ফেলেছে!
হাঁটতে হাঁটতেই অনন্যার নরম কপোলে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় ধ্রুব। মৃদু কন্ঠে বলে ওঠে,
– “তোমার অদ্ভুত সৌন্দর্য আজীবন মন ছুঁয়ে যাবে আমার। সারাজীবন তোমাকে দেখে গেলেও হয় তো কখনোই তৃপ্ত হবে না এই লোভী মন। বারবার দেখতে ইচ্ছে করবে, ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হবে তোমাকে।__ আর তোমার কোমল মনটাকে!__ আমি জানি না, আমি ভালোবাসি কী না তোমাকে। কিন্তু তোমাকে না দেখলে আমি ভালো থাকতে পারি না। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়। মনে হয় আমি মরে যাচ্ছি, চিনচিন করে জ্বলতে থাকে বুকের বাঁ পাশটা!__ তাকে দেখলেই আবার শান্ত হয়ে যায় সব। তার স্নিগ্ধতায় ছুঁয়ে যায় এ মন। তখন আমি নিজের মধ্যে থাকি না। হারিয়ে যাই অন্য কোনো ভুবনে, হাবুডুবু খেতে থাকি তার প্রেমের সাগরে। তার কারণটা কী জানে সে? কারণ একটাই__মন ছুঁয়েছে সে!__”
অনন্যা কী বলবে ভেবে পায় না। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। কারণ__ তার মন ছুঁয়েছে সে!
—————– সমাপ্ত ——————
[ অনেকদিন পর নিজের মন মতো একটা এন্ডিং দিলাম। সত্যি কথা বলতে কী, এই গল্পটা লিখতে গিয়ে অনেক বেশি চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে আমায়। অনেক বেশি প্রেশারের মধ্যে ছিলাম। তাই হয় তো সব জায়গায় সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে লিখতে পারি নি। আর সময় স্বল্পতার কারণে এই পর্বটা রিচেক করাও হয় নি। সেটা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর পুরো গল্পটা কেমন লেগেছে সেটা অবশ্যই জানাবেন। কারণ পাঠকদের মন্তব্য লেখিকাদের লেখার প্রতি আগ্রহ, আর উৎসাহ বাড়ায়। আর লেখার ভুল ত্রুটিও তাতে সংশোধনের উপায় থাকে। তাই বেশি বেশি মন্তব্য করুন। সর্বশেষে বলি, সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আর আমার জন্য দোয়া রাখবেন। খুব দ্রুতই নতুন কোনো গল্প নিয়ে হাজির হবো— ইনশাল্লাহ! আল্লাহ হাফেজ!]