মাই এক্স পর্ব -১৮

অনেকদিন পরে আবার সেই পুরনো রুটিনে ফিরে এলাম। বিশ্বাসই হচ্ছে না, সবকিছু আবার আগের মত হয়ে গেছে। এই কটা মাস যে কি গেল! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। জেদ যে মানুষকে কোথায় নামাতে পারে, সুমনকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। কি পেল সুমন? আমার ভালবাসা পেল? ভালবাসলাম আমি ওকে? এভাবে কাউকে দিয়ে জোর করে ভালবাসানো যায়? এমন না করে যদি আগের মত মন জয় করতে চাইত, কিংবা স্বাভাবিক একটা সম্পর্কও যদি চাইত…জানি না হয়তো…

যাক। যা হওয়ার তা হয়েছে। নতুন করে আবার শুরু করতে হবে। যত দ্রুত সবকিছু ভুলে যাওয়া যায়, ততই ভাল। একটা কথা ভেবে কেমন যেন ভালোই লাগছে। যা হয়েছে তা কিন্তু একদিক দিয়ে ভাবলে বলা যায়, ভালোই হয়েছে। আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়েছি। এই ঝামেলা কেমন করে যেন আমাকে আমার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের কাছে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
যদিও আজ উঠতে ইচ্ছে করছিল না, তারপরও উঠলাম। শাহেদের জন্য আজ নিজ হাতে ব্রেকফার্স্ট করব। অনেকদিন পরে আজ একসাথে টেবিলে বসব। ব্যালকনিতে একসাথে বসে সকালের চা খাব। গতকাল বেশ মজা করে ডিনার খেয়েছে। ওকে দেখে মায়াই লাগছিল। কতদিন পেট ভরে খায়নি, কে জানে? শেলিরা চলে যাওয়ার পরে, অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম। কানাডায় এই কটাদিন কেমন কাটল। কি করল।
এরপরে শুরু হল শাহেদের পালা। শাহেদ সবকিছু জানতে চাইছিল। বললাম। ওকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে ছুটে গিয়েছিলাম সুমনের কাছে। অনেকটাই রাজী হয়ে গিয়েছিলাম, সুমনের শর্তে। ওর সাথে একদিন রিক্সা করে ঘুরতেও বের হয়েছিলাম।
— তারপর?
ওর চোখে ভয়। হয়তো ভাবছে, টিপিক্যাল বাংলা সিনেমার মত ঘটনা ঘটেছে। স্মিত হেসে আশ্বাস দিলাম। বললাম
— তারপর আর কিছু হয়নি।
— মানে?
— মানে আমার প্রাক্তন প্রেমিকের অফার ছিল, আমাকে পুরনো প্রেম সিমুলেট করতে হবে। সেই আগের মত রিক্সা করে ঘুরতে হবে, রেস্টুরেন্টে কেবিনে বসে গল্প করতে হবে, আবার আগের মত ওর প্রেমে পড়তে হবে।
— পাগল নাকি?
— এখন তো তা ই মনে হচ্ছে।
— তুমি কি বললে?
— কি আবার বলব। একদিন গেলাম ঘুরতে।
— গেলে?
— আর কি করার ছিল? তোমার জান বাঁচাতে আমি তখন ওর যে কোন শর্তে রাজী হতাম।
শাহেদ অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকাল। এরপরে শুধু বলল
— তারপর?
— তারপর রেস্টুরেন্টের কেবিনে বসে জানালাম, এভাবে হয় না। তোমাকে ভালবাসা আমার পক্ষে সম্ভব না।
— কি বলল?
— জানাল, আরও অত্যাচার শুরু হবে। প্ল্যান বি একজিকিউট করবে।
এরপরের ঘটনাগুলোও বললাম। কিভাবে সুমন ব্যাংকের ম্যানেজারকে হাতে করে আমাদের ফ্ল্যাট, গাড়ী সবকিছু কেড়ে নিতে চেয়েছিল। বাধ্য করতে চেয়েছিল, যেন আমি ওর শর্তে রাজী হই।
এসব বলছি আর শাহেদের চোখে আতঙ্ক দেখছি। জানতে চাইল
— তারপর?
এবার আমাকে কাহিনী সেন্সর করতে হল। উপায় নেই। প্রমিজ করেছি। কথাগুলো কাউকে বলব না। এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম, শাহেদকে বলা যায়। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। কখন কার সাথে গল্প করতে গিয়ে ব্যাপারটা বলে ফেলবে। তাই… মিথ্যে কিছু বলিনি, জাস্ট কিছু কথা লুকিয়েছি। স্পেশালি যখন ও জানতে চেয়েছিল খোকন ভাই কিভাবে প্রতিশোধ নিল। বললাম,
— সবকিছু আমি নিজেও জানি না। খোকন ভাই সবকিছু বলেননি। শুধু জানি খোকন ভাই তার কন্টাক্ট ইউজ করে অনেক কষ্টে প্রাইম মিনিষ্টারের সাথে দেখা করে। উনাকে সব জানায়। প্রাইম মিনিস্টার প্রথমে বিশ্বাস করেননি। খোকন ভাই যখন বলেন, বিশ্বাস না হয়, আপনি নিজে ইনভেস্টিগেট করে দেখেন। তখন উনি ব্যাপারটায় সায় দেন। এরপরে তিনি ইন্টেলিজেন্সকে দায়িত্ব দেন পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজ নিতে। ইন্টেলিজেন্স জানায়, সব ঘটনা সত্যি। সুমন তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে শায়েস্তা করতে সাদা পোশাকের পুলিশকে ব্যাবহার করে। ওর স্বামীকে গুম করে। সব শুনে ভয়ানক রেগে যান।
শাহেদ জানতে চায়
— তারপরে?
যদিও জানি কি হয়েছে, তারপরও ব্যাপারটা লুকাই। মিথ্যে বলা ছাড়া উপায় ছিল না। খোকন ভাই বলে দিয়েছিলেন, ব্যাপারটা হাইলি কনফিডেনশিয়াল, কেউ যেন না জানে। আরও একটা রিকোয়েস্ট করেছিল, প্রেসে যেন না যাই। প্রাইম মিনিস্টারের প্রেস্টিজ ইস্যু। ব্যাপারটা জানাজানি হলে বিচ্ছিরী সিচুয়েশান হবে। বলেছিল, ‘বুঝতেই তো পারছো। অপজিশান পার্টি ব্যাপারটা নিয়ে তুলকালাম করে ফেলবে।’ ভেবে দেখলাম, খোকন ভাইয়ের কথায় যুক্তি আছে। কে তাঁর নাম ইউজ করে কি করে বেড়াচ্ছে, প্রাইম মিনিস্টারের পক্ষে এতো খোঁজ রাখা তো সম্ভব না। তাই ব্যাপারটায় তাই সম্মতি দিই। শাহেদ আবার জানতে চাইল
— এরপরে কি হল?
মিথ্যে কথাটা বললাম।
— প্রাইম মিনিস্টার কি অ্যাকশান নিয়েছিলেন সঠিক জানি না। খোকন ভাই শুধু বলেছিলেন, সুমন আর কোনদিন ফিরবে না।
— একথার মানে কি?
— ক্লিয়ার করে কিছু বলেনি খোকন ভাই। জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে কেবল একটা রহস্যময় হাসি দিয়েছিল। তবে এরপরে আর কোন ঝামেলা সুমন করেনি।
শাহেদ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মনে হল। বাট ওর চেহারা দেখ মনে হচ্ছে, মন থেকে সুমনের ভয় এখনও যায়নি। আমি বলে চললাম
— খোকন ভাইয়ের কাছে আমি তখন তোমার ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম । জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি বেঁচে আছ কি না। উনি বলতে পারেননি। শুধু বলেছিল, চেষ্টা করছি। তুমি কাউকে এখনও কিছু বল না। ঐ যেভাবে বিদেশে ট্রেনিংয়ে গেছে বলে চালাচ্ছো, সেভাবেই চালাও। ডেফিনিট কিছু জানতে পারলে, জানাব। কাউকেই তাই ব্যাপারটা বলিনি।
শাহেদ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পায়চারী করল। এপরে বলল
— আর্মি আর পুলিশে আমারও কিছু পরিচিত লোক আছে। দেখি ট্রাই করে, কিছু জানা যায় কি না।
ভয় পেয়ে গেলাম। অনেক কষ্টে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। এনিয়ে বেশি ইনভেস্টিগেট করতে গেলে দেখা যাবে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে বিচ্ছিরী একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। ব্যাপারটা থামান দরকার। বললাম
— কি ঘটেছে, ডিটেলস খোকন ভাই আর কিছু বলতে পারেননি। শুধু বলেছেন, ভেতরের খবর আমি নিজেও জানি না। ডিজিএফআই শুধু এটুকু জানিয়েছে, সুমন আর কোনদিন কাউকে ডিস্টার্ব করবে না।
ভেবেছিলাম একথা শুনে শান্ত হবে। কিছুটা হল, বাট ভয় এখনও যায়নি মনে হচ্ছে। মাথা দুদিকে নেড়ে নিজের ফ্রাস্ট্রেশান প্রকাশ করল। এরপরে বলল
— স্যরি।
অবাক হলাম। জানতে চাইলাম
— তুমি স্যরি হবে কেন?
কেমন হতাশ একটা মুখ করে আমার দিকে তাকাল। বলল
— তোমাকে প্রটেক্ট করতে পারিনি। তোমার বিপদে পাশে থাকতে পারিনি।
স্মিত হাসলাম। বোঝাবার চেষ্টা করলাম।
— এমন একটা সমস্যায় আমরা সাধারণ মানুষরা কি বা করতে পারি?
ওপর নীচে মাথা ঝুকিয়ে ব্যাপারটা মেনে নিল। তবে আর তেমন কিছু বলল না। আবার পায়চারী শুরু করল। ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পায়চারী করার পরে শাহেদ আমার দিকে তাকাল। বলল
— কি দেখছো?
— তোমার টেনশান। বস তো। বলছি তো টেনশানের আর কিছু নেই।
শাহেদ বসল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— জানি না কি হবে, বাট এদেশে আর থাকছি না। কানাডায় চলে যাব। সব কিছু সেট করে এসেছি।
— কি বলছো?
— ঠিকই বলছি। এই পলিটিক্যাল পার্টির ক্যাডারদের দেশে আর এক মুহূর্ত না।
শাহেদকে শেষবারের মত বোঝাবার চেষ্টা করলাম। বললাম
— বলছি তো আর কিছু হবে না। ট্রাস্ট মি।
— যদি হয়?
— নট পসিবল।
— হোয়ায় নট পসিবল?
নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। হাইলি কনফিডেনশিয়াল কথাটা নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম।
— বিকজ হি ইজ নো মোর। প্রাইম মিনিস্টারের নির্দেশে, হাইলি সিক্রেট এক এনকাউন্টারে সুমনকে মেরে ফেলা হয়।

চলবে…

-রাজিয়া সুলতানা জেনি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here