#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৪
একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ! মধ্য পাড়া নিবাসী,মধ্য পাড়া নিবাসী। জনাব ওলিদূন আজাদ সাহেব এর কনিষ্ঠ কন্যা জুইঁ আজাদ কালরাত ১ ঘটিকায় ইন্তেকাল করিয়াছেন।ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্না-ইলাইহি রজিউন।মরহুমার জানাজা আজ বাদ জুমাআ অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত জানাজায় আপনারা সকলে আমন্ত্রিত।
মসজিদের মাইকিং জুইঁর মায়ের কর্ণপাত হতে ই দ্বিতীয় বারের মতো তিনি মূর্ছা গেলেন।কয়েকজন মহিলা এসে ধরাধরি করে তাকে বিছানায় এলিয়ে দিলেন। ঘরময় মেয়েলি চাপা কান্না পরিবেশ কে বিষিয়ে তুলেছে। পাশের রুম থেকে কয়েকজনের মিলিত কোরআন তেলাওয়াতের সুর ভেসে আসছে।কাঠের খাটিয়াটাতে শয়নরত লাশের পাশে থাকা আগরবাতি আর কিছুক্ষণ আগে ছিটিয়ে দেয়া গোলাপজলের তীব্র সুগন্ধি আবহাওয়া কে আরও গুমোটরূপ দান করছে।
বাড়ির ড্রইংরুম থেকে শুরু করে প্রতিটা রুমের কোণায় কোণায় আজ আত্মীয় স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশির ভিড় জমেছে।
কঠোর ওলিদূন আজাদও আজ বাকশূন্য হয়ে দৃষ্টি মাটিতে রেখে কাঠপুতুল এর ন্যায় স্তবদ্ধ হয়ে বসে আছেন।তার শ্বাস প্রশ্বাসের দরুন বারবার কাধ হালকা করে ওঠা নামা করছে।
সন্তান প্রতিটা মা বাবার কাছে ই প্রিয়।মা বাবা পাগল হলেও তারা মা বাবা ই হন।সন্তান ও যদি বদ্ধ উন্মাদ হয় তারপরও সেই সন্তান মা বাবার কাছে কলিজার টুকরো ই হয়।তারা হয় মায়ের নাড়িছেড়া ধন আর বাবার কাছে আবদার করার রাজকন্যা। সেই রাজকন্যা ই যদি বাবার চোখের সামনে সাদা কাফন নামক বস্ত্র গায়ে জরিয়ে খাটিয়ার ওপর শ্বাস ক্রিয়া বন্ধ করে শুয়ে থাকে তাহলে যেকোন বাবাই বাকশূন্য হতে বাদ্ধ হবে।যতই সে কঠোর হোক না কেন।মেয়ের খবর শোনা মাত্র ই ওলিদূন আজাদ যেন বোবা হয়ে গিয়েছেন।অতি শোকে নাকি হয় পাথর। তার বেলায়ও এই কথা টা নির্দ্বিধায় প্রযোজ্য বলে মনে হচ্ছে।
কাল রাতে…
জুইঁ আলআবির দেয়া রকর্ডারটা বুকে জড়িয়ে নিতে ই বিকট শব্দে জুইঁর কানে তব্দা লেগে যায়।কিছু বুঝতে পারার আগেই ঠিক বুকের মধ্যখানে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে।ধীরে ধীরে সারা শরীর জুড়ে ব্যাথা অনুভব হতে থাকে।এটুকু সময়ের মধ্যে ই জুইঁ নিজেকে সিটের থেকে নিচে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।ঝনঝন শব্দে গাড়ির কাচ গুলো ভেঙে যায়।যন্ত্রণায় কাতর চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। চারদিক থেকে আর্তনাদ আর হাহাকারের প্রতিধ্বনি ভেসে আসে জুইঁর কানে। জুইঁর মুখ দিয়ে ও বের হয় আর্তনাদের গোঙানি।ডান হাতের রেকর্ডার টা দুর্বল শক্তি দিয়ে ই চেপে ধরে। কি ঘটেছে তা জুইঁ উপলব্ধি করতে পেরেই মুখ দিয়ে জপতে থাকে-“লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”।
জুইরঁ চোখ মেলে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই ধীরে ধীরে নিজ ইচ্ছেয় চোখটা বুজে নিল।চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে পুরুষ মানুষের একজোড়া চোখ জুইঁর মস্তিষ্কে বিচরণ করতে লাগলো।কানে তার এখনো রেকর্ডার এর কিছু কিছু কথা বাজছে।জল ভরাট চোখের দুকার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরলো জল।একে একে বিগত দশদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা একের পর এক এসে ধাক্কা দিতে লাগলো জুইঁর মস্তিষ্কে।জুইঁর পুরো শরীর অবশপ্রায়।অনেক কষ্টে রকর্ডারের বাটন টা আরেকবারের মতো চেপে ধরলো।সঙ্গে সঙ্গে সেই অতি পরিচিত কন্ঠে কিছুক্ষণ আগের কথা গুলোই পুনরায় বাজতে লাগলো।এতো চিৎকার চেচামেচির মধ্যে হঠাৎ একে একে প্রিয়জনের চেহারা ভাসতে লাগলো।বাবার সেই কড়া কড়া শাসন গুলো মনে পড়তেই জুইঁর ঠোঁট কিঞ্চিৎ পরিমাণে প্রসারিত হলো।তবে এই প্রসারণ বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারল না।মুহূর্তের মধ্যে ই দ্বিতীয় বারের মতো আরেকটা বিকট শব্দ!সঙ্গে সঙ্গেই খুব জোরে ধাক্কা লাগলো যে গাড়ি তে জুইঁ ছিল। এবার জুইঁ মাথায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল।নিথর দেহের কালো হিজাব পরিহিত মাথা থেকে গড়িয়ে পরতে লাগলো উষ্ণ লাল রঙা রক্ত।সেই রক্তে লাল হলো নিথর দেহটার মুখমন্ডল।
সব ঘটনার প্রতক্ষ্য সাক্ষী হলো মিসেস পারভীন, সিরাজ সাহেব ড্রাইভার আশরাফুল আর চায়ের দোকানের চাওয়ালা সহ অপরিচিত আরও দু একজন লোক।যারা দোকানটায় বসে বসে চা পান করছিল। চোখের সামনে ই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আলআবিদের গাড়িটাকে দ্রুতগতির যাত্রীবাহী একটি বাস এসে ধাক্কা দেয়।এই রোডে রাতের বাসগুলো বেপরোয়া ভাবে চলাচল করে। ড্রাইভার এর অসাবধানতায় আলআবিদের গাড়ির সঙ্গে ওই বাসটার ধাক্কা লাগে।তবে গাড়িটা ব্রেকফেল ছিল যার জন্য পুরো দোষ ড্রাইভারকেও দেয়া যায় না। শত চেষ্টা চালিয়েও ড্রাইভার ব্রেক করতে পারেনি।দুর্ঘটনা এপর্যন্ত হলেও চলতো কিন্তু ঘটনা টা এপর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি।জুইঁ কে গাড়ি থেকে বের করার আগ মুহূর্তেই অপর পাশ দিয়ে উচ্চ গতি সম্পন্ন আরেকটি মালবাহী ট্রাক এসে দ্বিতীয় বার ধাক্কা দেয় ছোট্ট প্রাইভেট কার টিকে।
ক্ষনিকের মধ্যে এতো বড় দূর্ঘটনার জন্য কেউ কখনোই আগে থেকে প্রস্তুত থাকে না।ওখানে থাকা মানুষ গুলোও প্রস্তুত ছিল না। বাসে থাকা যাত্রীর মধ্যে আহত সংখ্যা ১২ জনের মতো।নিহত সংখ্যা ৬ জন।ঘটনা আসে পাশে ছড়িয়ে পরতেই সামনের হসপিটাল থেকে সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স আসতে শুরু করে।এম্বুলেন্স এর সেই সাইরেন পরিবেশ কে আরও ভয়ংকর রূপ দেয়।একদিকে স্বজন হারানো বেদনাদায়ক চিৎকার আর হাহাকার অন্য দিকে এম্বুলেন্স এর সেই হৃদয় কাঁপানো সাইরেন আর রক্ত রাঙা কিছু লাশ।
সিরাজ সাহেব কাঁপা হাতে আতঙ্কে ছেয়ে যাওয়া কন্ঠে আলআবি কে কল করেন। “বাবা তুই তারাতাড়ি আয়।” কম্পিত গলায় এ কথা টুকু বলেছেন। এই তো ঢের।গলা দিয়ে কথা বের হতে চাচ্ছিল না।ড্রাইভার আশরাফুল সিরাজ সাহেব এর থেকে ফোনটা নিয়ে কিছু একটা বলে আবার ফিরিয়ে দিলেন ফোনটা। সিরাজ সাহেবের কর্ণকুহুর হলো না আশরাফুলের বলা কথা।
মিসেস পারভীন এম্বুলেন্সে বসে অঝোর ধারায় কেঁদে যাচ্ছেন। সামনেই জুইঁর নিথর দেহ।দক্ষ বিবেকের সঙ্গে আশরাফুল সবটা সামলাতে ব্যস্ত।
একপায়ে একটা হুডতোলা সেন্ডেল।অপর পা খালি।পড়নে থ্রী-কোয়াটার এর একটা কালো প্যান্ট।গায়ের ধুশোর রঙের শার্টের বোতামের ঠিক নেই।বুকের প্রথম দুই বোতাম রেখে তৃতীয় বোতাম থেকে শার্ট আটকানো।শার্টের শেষ প্রান্তে চোখ দিলেই এপাশ ওপাশ যে ছোটবড় টা ঠিক আন্দাজ করা যায়।হাতার বোতাম গুলোও খোলা। চোখে মুখে তার আতঙ্ক। রয়েছে কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়।বারবার হসপিটালের বারান্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হন্তদন্ত হয়ে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই ধরে কি যেন বলছে।
আঠাশ-উনত্রিশের এই যুবকটার এই হাল দেখে চল্লিশোর্ধ নার্স রুকাইয়া বেগমের বড্ড দয়া হলো।আজকের এক্সিডেন্টের দরুন অনেকে কেই এখানে
আনা হয়েছে। রুকাইয়া বেগম ধারণা করে নিলেন এই যুবকও হয়তো বা প্রিয়জনের দুঃসংবাদে ছুটে এসেছে এখানে।তিনি এগিয়ে গিয়ে যুবকের সামনে দাঁড়িয়ে পরলেন।আলআবি নার্স বেশে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটিকে দেখা মাত্র ই ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলো…
–আমার মায়াবিনীকে দেখেছেন? ও এখানেই।এখানেই আছে।
তারপর নিজের কাঁধের কাছে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল…
–এই এতটুকু। আমার কাঁধ অব্দি।দেখেছেন ওকে?
রুকাইয়া বেগমের অনুভূতি স্নায়ু তাকে কিছুটা কষ্টের অনুভূতি প্রেরণ করল।তার মস্তিষ্ক নিঃসন্দেহে বলছে তার সামনে এক প্রেমিক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে………….
[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক।গল্পের সকল প্রকার চরিত্র, উক্তি কাল্পনিক।অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]