#মুনেম_ভাই(শেষ পর্ব)
#কুরআতুল_আয়েন
বিছানায় শরীর টা এলিয়ে দিয়ে আছে মুনেম।কোনোমতে অফিস টা শেষ করে রুমে এসে ঢুকেছিলো।সেইভাবেই শুয়ে আছে।হাসিবের কাছ থেকে ঝিনুকের চলে যাওয়ার কথাটা শোনার পর থেকেই মুনেমের কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে।ভিতর টা কি রকম শূন্য অনুভব করছে।আজকে সারাদিন নীলা কাছে থাকা সত্ত্বেও মুনেম একটিবারও নীলার সাথে ভালো করে একটা কথাও বলে নি।এমনকি অফিসের কারোর সাথে না।চুপ করে নিজের ডেস্কে বসে অফিসের কাজগুলোতে মনোনয়ন করেছিলো তাও মুনেমের চোখের সামনে বারবার ঝিনুকের কান্নারত মুখটা ভেসে উঠছিলো।
চোখ দুটো বন্ধ করে আধমরা হয়ে শুয়ে আছে মুনেম।মাথাটা খুব ধরেছে তার।কড়া লিকারের একটা চা খাওয়া উচিত।নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে বিছানা থেকে উঠে পড়লো মুনেম।সোজা এইভাবেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।সোফার কাছে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো।রান্নাঘরে রায়জাদা সিকদার কে কাজ করতে দেখে ক্লান্ত গলায় বললো,
–“মা!কড়া লিকার দিয়ে একটা চা দাও তো।”
রায়জাদা সিকদার সবেমাত্র ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে রেখেছেন রাতের জন্য।ছেলের কথা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন।ছেলেকে এমন অগোছালো দেখে অনেকটাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।খুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন মুনেমের দিকে।মুনেমের পাশের সোফাটায় বসে পড়লেন।কিছুটা চিন্তিত গলায় বললেন,
–“কিছু হয়েছে তোর মুনেম?কখনো তো দেখি নি অফিস থেকে এসে অফিসের কাপড়চোপড় পড়ে থাকতে।তুই তো এসেই আগে ফ্রেশ হয়ে নিস।আর আজকে তোর মুখটা কেমন শুকনো লাগছে।”
মুনেম কিছুটা উশখুশ করছে।খুব ইচ্ছা করছে সব কথা মায়ের সাথে খোলসা করে বলতে।কিন্তু,কোথাও একটা বাঁধা কাজ করছে।তাই কিছুক্ষণ চুপ করে বললো,
–“মা!অপরাধ বোধ কি মানুষের পিছু ছাড়ে না?”
মুনেমের কথাটায় রায়জাদা সিকদার মনে হয় আরো একটু চিন্তিত হয়ে গেলেন।অবশ্য ছেলের মুখে হঠাৎ করে এমন একটা কথা শুনে চিন্তা হওয়ারই কথা।চিন্তাটা বাহিরে প্রকাশ করলেন না রায়জাদা সিকদার।শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
–“কোনো অপরাধ করে যদি তার মনের ভিতর অপরাধ বোধ কাজ করে তাহলে তাকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।সেই কাজের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে।”
মুনেম আর কিছু বলে না।বসা থেকে উঠে পড়লো।মনে মনে ভাবছে কীভাবে ক্ষমা চাইবে ঝিনুকের কাছে।সেটার সুযোগ কি আদোও সে পাবে!
————————–
আরো কেটে গেলো কয়েকটা দিন।ভিতরে ভিতরে অনেকটা জখম হয়েছে মুনেমের।বারবার শুধু ঝিনুকের কান্নারত মুখটা ভেসে উঠে।আর,তখনই ভিতরটা কেমন ঝড়ের মতো তোলপাড় হয়ে যায়।আবার,ঝিনুকের ভালোবাসি কথাটা মনে পড়তে নিজের অজান্তেই মুচকি মুচকি হেসে ফেলে মুনেম।এই কয়েকটা দিনে নীলার সাথে তেমন একটা কথা হয়নি।বলতে গেলে মুনেম ইচ্ছা করেই নীলাকে কোনো ফোন বা টেক্সট দেয়নি।নীলা মাঝেমধ্যে দিলেও মুনেম শুধু হু হা করে রেখে দিতো।কেন,জানি কয়েকদিন যাবত ধরে মুনেমের কাছে নীলাকে তেমন একটা ভালো লাগেছে না।আগের মতো কথা বলতেও ভালো লাগে না।মুনেম বুঝে পায় না কি এমন কারণে নীলাকে এখন তার ভালো লাগে না।আগে তো নীলাতেই মেতে থাকতে পছন্দ করতো।তাহলে কি নীলা শুধু মুনেমের মোহ!ছিলো।ভাবতেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো মুনেম।আজকে শুক্রবার তাই বাসায় বসে বোরিং দিন যাচ্ছে তার।এখন কাজের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে মুনেম।না হলে,শুধু ঝিনুকের কথা মনে পড়ে তার।এই কয়েকদিনে হাসিব অনেকবার বলেছে মুনেমকে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য।কিন্তু,মুনেম একবারও ওই বাসায় যাওয়ার সাহস পায়নি।তার কারণ দুটোই,এক.কিছুতেই ওই বাসার মানুষগুলোর সামনে দাঁড়াতে পারবে না।নিজেকে খুব ছোট ছোট লাগে তার।তার জন্যই তো ওই বাসার মানুষগুলো থেকে ঝিনুক আলাদা হয়ে গিয়েছে।দুই.ওই বসায় যাওয়া মানে ঝিনুককে উপলব্ধি করা।যা মুনেমের জন্য ইদানীং খুব কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।তবুও মনে মনে ভেবে নিয়েছে আজকে সেইসবের সম্মুখীন হবে সে।হঠাৎ করে ফোনে মেসেজের শব্দ পেয়ে মুনেম ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো।মেসেজ টা ওপেন করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে পরক্ষণেই মুনেমের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো।মেসেজ টা ছিলো নীলার।সামনের শুক্রবার নীলার বাগদান।আর,নীলা তার নিজ ইচ্ছাতেই এতে রাজি হয়েছে।আরো একটা কথা ছিলো,মুনেমের প্রতি নীলার শুধু ভালোলাগা ছিলো এর বেশি কিছু না।মুনেমের মন টা শান্তির ছোঁয়ায় ভরে গিয়েছে।নিজের উপর আরো একটা অপরাধ বোধ কাজ করছিলো নীলাকে নিয়ে।এতোদিন নীলার সাথে তার এডাল্ট কথোপকথন,খুনসুটি এইসব তার মধ্যে আরো একটা অপরাধ বোধ জাগাচ্ছিলো।নিজেকে কেমন একটা নিচুস্তরেরও লাগছিলো।মানুষের ভুলগুলো একটা না একটা সময় ঠিকই ভোগায়।তখন শুধু মনে হয়,এই কাজ টা যদি না করতাম তাহলেই ভালো হতো।নীলার ম্যাসেজ টা পেয়ে মুনেমের মনের অপরাধ বোধের বোজা টা খানিকটা কমে এসেছে।ফোনটা হাতে নিয়ে নীলার ম্যাসেজের বিপরীতে মুনেম লিখতে শুরু করলো,
–“আমারও মোহ ছিলে তুমি নীলা।তোমার প্রতি আমার শুধু ভালোলাগাটাই কাজ করেছে।এই ভালোলাগাটাকেই এক সময় আমি অনেকটা গভীরে চিন্তা করে ফেলেছিলাম।আর তুমি যে আমার মোহ তা আমি একজনের দ্বারা বুঝতে পেরেছি।কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে আমি তাকেই অনেক কটূ কথা শুনিয়েছি।তবে তাকে পেলে আমি তার কাছ থেকে প্রথমে সরি বলে নিবো।যাই হোক!তোমার নতুন জীবনের পথচলার জন্য অনেক অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা রইলো।”
ম্যাসেজ টা পাঠিয়েই বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মুনেম।এখন তৈরি হয়ে হাসিবদের বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিবে।
প্রায় ত্রিশ মিনিটের মতো হয়ে গিয়েছে মুনেম হাসিবদের বাসায় এসেছে।সোফার রুমে ঢুকতেই প্রথমে দেয়ালে টাঙানো ঝিনুকের ছবিগুলোর দিকে চোখ পড়েছে।কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সোজা হাসিবের রুমে চলে আসে।হাসিব বারান্দার চেয়ারটায় মুনেমকে বসিয়ে দিয়ে চা করার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশ্য গিয়েছে।চামেলি তালুকদার খুব মনমরা হয়ে থাকেন ঝিনুক চলে যাওয়ার পর থেকেই।আর,দিনদিন উনার শরীরে অসুখের বাসা বাঁধছে।একদিন এইটা হলে তো আরেকদিন ওইটা দেখা দেয়।মুনেম বারান্দার চেয়ারটায় ঠিকই বসে আছে কিন্তু তার মন পড়ে আছে হাসিবের লক খোলা ফোনটায়।খুব ইতস্তত বোধ হচ্ছে তার ফোনটা নিবে কি নিবে না।অনেক কিছু ভেবে চিন্তা করে হাসিবের ফোনটা হাতে তোলে নিলো।একবার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো হাসিব আসছে কিনা।হাসিবের দেখা না পেতেই একপ্রকার দ্রুত গতিতে কল লিস্টে গিয়ে ঝিনুকের নাম দিয়ে সার্চ করলো কিন্তু ফলাফল শূন্য।এমনকি বোনু নাম দিয়েও করেছে।তাও ফলাফল শূন্যই এসেছে।একরাশ হতাশা নিয়ে ফোনটা রেখে দিলো মুনেম।তার একটু পরে হাসিব দু’কাপ চা নিয়ে রুমে এলো।এককাপ মুনেমের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।নিজের চায়ের কাপ টা বারান্দার কার্ণিশে রেখে দিয়ে ফোনটা হাতে তোলে নিলো।ভিডিও কল করলো মামীকে।মামীকে ফোন দেয়া মানে ঝিনুকের সাথে কথা বলতে পারা।
মুনেম আনমনে চায়ের গরম কাপে চুমুক বসালো।সাথে সাথে তার জিহবা টা পুড়ে গিয়েছে।মুখে থাকা গরম চা টা কোনো মতে গিলে নিলো।এতে মনে হচ্ছে শ্বাসনালীও যেনো পুড়ে গিয়েছে।কিছুক্ষণ পর আবারও সাবধানতার সাথে চায়ের কাপে চুমুক বসালো।
–“হ্যাঁ মামী ঝিনুককে ফোনটা দাও!”
ঝিনুকের নাম টা শুনতেই মুনেম কিছুটা চমকে উঠলো।পরক্ষণেই মন টা এক ভালোলাগার সুপ্ত অনুভূতিতে ভরে উঠলো।আবার সেই সাথে অস্থিরতা।অস্থিরতা আর খুশি দুটোই মিলে মুনেমের মনের ভিতর এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে।যা কাউকে বুঝানোটাই মুশকিল।
–“কিরে ঝুনঝুনি কেমন আছিস?”
ফোনের অপাশে ঝিনুক কিছুটা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে হাসিবের দিকে।মুখটা কিছুটা অভিমানীর সুরে বললো,
–“ঝিনুক বলো ভাইয়া।ঝুনঝুনি শুনলে কেমন ছোট বাচ্চা ছোট বাচ্চা ফিল হয়।”
হাসিব হেসে উঠে।ফোনের অপাশ থেকে ঝিনুক ও হেসে উঠে।ঝিনুকের কন্ঠস্বর টা মুনেমের কানে পৌঁছতে সে চোখ দুটো বুজে নিলো।বারান্দার কার্ণিশে মাথাটা ঠেকিয়ে রয়েছে।মুখে মুচকি হাসির রেখা।তার মনটা খুব উশখুশ করছে ঝিনুকে দেখার জন্য।কিন্তু হাসিব তার সোজাসুজি বসায় দেখার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না।মুনেম কিছুটা অস্থিরতায় উঠে দাঁড়ালো।সারারুম জুড়ে পায়চারি করছে কিন্তু একবারও হাসিবের পাশে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে না।
হাসিব আপনমনে ঝিনুকের সাথে কথা বলে যাচ্ছে আর হাসাহাসি করছে।হুট করেই ফোনের স্ক্রিনে সময়টা দেখে মায়ের ওষুধ খাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়।হাসিব ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তুই একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি।মাকে ওষুধ টা দিয়ে আসছি।তুই কিন্তু লাইনে থাকবি।”
ফোনের অপাশ থেকে ঝিনুক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।হাসিব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।ফোন টা নিয়ে মুনেমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–“তুই একটু কন্টিনিউ কর।আমি এখনেই আসছি।”
মুনেম মনে হয় হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে।তার মনের ভিতর অনেক উত্তেজনা কাজ করছে।উত্তেজনা নিয়েই ফোনের দিকে তাকালো।ঝিনুকের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে।এতোদিনের কষ্টের একটু সুখের দেখা পাচ্ছে।কিন্তু কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।কতক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে।
ঝিনুক ফোনের অপাশে মুনেম নামের ব্যাক্তিটিকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু সেইদিনের ওই কথা গুলো মনে পড়ে যায় তার।মনে পড়তেই ভিতরটা কেমন মরাকান্নার মতো আহাজারি করে উঠলো।নিজেকে মুনেমের সামনে ঠিক রাখাটা তার জন্য খুব দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।তাই আর না পেরে ফোন কেটে দিলো ঝিনুক।ফোন কেটে দিয়েই ভিতরের কান্না গুলো একপশলা বৃষ্টির মতো ঝরতে শুরু করলো।
মুনেমর হঠাৎ করেই চোখের কার্নিশ ভিজে উঠলো।চোখ গুলো কেমন তার ঝাপসা হয়ে আসছে।জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাতে থাকা ফোনটা বিছানার উপর রেখে দিয়ে ঝিনুকদের বাসা থেকে বের হয়ে আসলো।ভরদুপুরের এই কড়া রোদের মধ্যে দিয়ে এলোমেলো পায়ে নাম না জানা এক অজানা পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
—————————————————————————–
সময়ের সাথে সাথে অনেকগুলো দিন,মাস কেটে গেলো।সাথে কেটে গেলো প্রায় ছয়টা বছর।এই ছয়টা বছরে মুনেমের মনে ঝিনুক অনেকটাই জায়গা করে নিয়েছে।অপরাধ বোধ থেকে কখন যে মুনেম ঝিনুককে ভালোবেসে ফেলেছ তাও বুঝে উঠতে পারেনি।ভালোবাসা জিনিসটা খুবই অদ্ভুত।কেউ গানের কন্ঠ শুনে ভালোবেসে ফেলে আবার কেউ অপরাধ বোধ থেকে ভালোবেসে ফেলে।নীলার বিয়ে হয়েছে প্রায় দুই বছরের মতো।নীলা তার স্বামীর সাথে বেশ খুশি।তাদের দুজনকে একসাথে দেখলে মুনেমের অনেক ভালো লাগে।এমনকি নিজের পাশে তখন ঝিনুককে কল্পনা করে।ওইদিনের পর থেকে মুনেম একবারও ঝিনুককে দেখতে পায়নি।
অন্যদিকে,ঝিনুক নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মুনেম কে ঠিকই ভুলতে পারেনি।বরং,মুনেম তার মনে দিনের পর দিন,মাসের পর মাস,বছরের পর বছর আরো জায়গা করে নিয়েছে।সেই আগের চঞ্চল ঝিনুক আজকে অনেকটা শান্ত হয়ে গিয়েছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী নিয়ে পড়াশোনা করছে।আজ অনেক দিন পর ঝিনুক তার সেই চেনা পরিচিত শহর টায় আসবে।যেখানে তার বেড়ে উঠার গল্প।সেই শহরে তার ভালোবাসার মানুষটা রয়েছে।অবশ্য,এতোদিন মা,বাবা ভাইয়ারা এসে তাকে দেখে গিয়েছে।এইসব ভাবতে ভাবতে ঝিনুক বাসে উঠে পড়লো।গন্তব্য সেই ছোটবেলার শহর।
নিজের ডেস্কে বসে আছে মুনেম।হাতে কিছু ফাইলপত্র।হাসিব খুব দ্রুত এগিয়ে এসেছে তার নিজের ডেস্কে।মুনেমের পাশের ডেস্কেটাই হাসিবের।হাসিব ডেস্ক থেকে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে।মুনেম হাসিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“কিরে!তোর কি হলো?কোথাও যাচ্ছিস।”
–“ঝিনুক আসছে।তাই আজকে ছুটি নিয়েছি।আর শোন!তুইও চলে আসিস বিকেলে।”
মুনেমের চোখে হাসির ঝিলিক।সোনালী রোদ্দুরের মতো খুশিটা ঝিলিক মেরে উঠছে।ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।আজকের দিনটা তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন।নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে এতোগুলো বছর পর দেখতে পাবে।নিজের চেয়ার টায় মাথাটা এলিয়ে দিয়ে মনে মনে বিরবির করে বলতে লাগলো,এবার কোনো ভুল হতে দিবো না।ঝিনুকের কাছ থেকে ক্ষমাও চেয়ে নিবো আর নিজের মনের কথাটাও বলে দিবো।
————————–
রাতের খাবার খেয়ে নিজের রুমে আসছিলো ঝিনুক।দুপুরের দিকেই চলে আসে বাসায়।অনেকদিন পর পরিবারের সবাইকে কাছে পেয়ে ঝিনুক যেনো কথার ঝুড়ি খুলে দিয়েছিলো।সবার সাথে মুনেমও ছিলো।কিন্তু ঝিনুক তেমন একটা পাত্তা দেয়নি।নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেই ঝিনুক মুনেমকে ইগনোর করেছে।তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঝিনুক।দরজা খোলে নিজের রুমের দরজার সামনে মুনেমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকটা থতমত খেয়ে যায়।কিছু না ভেবেই উল্টো দিকে দৌড়তে শুরু করলো।ঝিনুক কিছুটা আগাতেই মুনেম খপ করে ঝিনুকের হাত ধরে রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।ঝিনুক ভয়ে অনেকটাই জমে গিয়েছে।গোলগোল চোখ করে চেয়ে আছে মুনেমের দিকে।মুনেম ঝিনুকের চাহনি টা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে পরমুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিলো।আচমকাই ঝিনুককে নিজের সাথে চেপে ধরলো।ঝিনুক যেনো আরো একটু জমে গিয়েছে।মুনেমের বুকে হাত দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই পারছে না।মুনেম ঝিনুকের মতিগতি পরোক্ষ করে নিজের মুখটা ঝিনুকের মুখের সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলো।এতে ঝিনুক আমতাআমতা করে বললো,
–“মুনেম ভাই আগাবেন না প্লিজ।কি এমন হলো আপনার হঠাৎ করে।”
মুনেম কিছুটা ভ্রুকুঁচকে বললো,
–“ভাই বললা কেন?”
ঝিনুক কিছুটা সরু চোখে বললো,
–“ভাইকে তো ভাই এই বলব তাই না।হাসিব ভাইয়ার বন্ধু মানে আমারও ভাই।”
মুনেমের ছাদের ওইদিনের কথাগুলো মনে পড়ে যায়।মনে পড়তেই মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো তার।কিছুটা অপরাধীর সুরে বললো,
–“ওইদিনের জন্য কি ক্ষমা করা যায় না আমায়।আমি খুব ভুল করেছি তোমার সাথে।অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি,যার জন্য আমি অনেকটাই অনুতপ্ত।যেগুলো আমাকে অনেকটাই বিষাদে ভরে দিয়েছে।”
ঝিনুক মুখটাকে ঘুরিয়ে জবাবে বললো,
–“পাগল,ছাগল আর কি ক্ষমা করবে।আর আমার আপনার উপর কোনো রাগ নেই।”
কথাটা বলেই ঝিনুক নিজের থেকে মুনেমকে ছাড়িয়ে নিয়েছে।গুটিগুটি পায়ে বিছানায় এসে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো।মুনেম অসহায় চোখে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ তার পানিতে টলমল করছে।আর না পেরে মুনেমও দ্রুত গতিতে ঝিনুকের কাছে এগিয়ে এসে জাপটে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।ঝিনুকের শরীরটা মনে হয় কারেন্টের শক খেয়েছে।ঝিনুক মুনেমের থেকে সরে আসতে নেয়।কিন্তু মুনেম কিছুতেই ছাড়ে না বরং আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।ঝিনুক কিছুটা ভয়ার্ত গলায় বললো,
–“মুনেম ভাই এইসব কি করছেন আপনি।আমরা অবিবাহিত এইভাবে এক বিছানায় শোয়া টা ঠিক হচ্ছে না।প্লিজ আপনি সরুন আমার থেকে।আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে।”
মুনেম ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ঝিনুকের দিকে।যা দেখে ঝিনুকের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো।মুনেম কিছুক্ষণ ছলছল চোখে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে ঝিনুকের গলার ভাজে মুখ ডুবিয়ে দিলো।এমন হওয়ায় ঝিনুক মুনেমের শার্টের পিছন দিকটা খামচে ধরে ফেললো।গলায় মুখ ডুবিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
–“আমি তোমাকে ভালোবাসি ঝিনুক তুমি কি বুঝতে পারছো না।ওইদিন কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছি একদম মাথায় কাজ করেনি।আমি বুঝতে পেরেছি তোমার সাথে আমি খুব অন্যায় করেছি।প্লিজ আমি অনুতপ্ত ঝিনুক।আমি তোমাকে একমুহূর্তের জন্য হলেও হারাতে চাই না।আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
ঝিনুকের মনের অভিমান কমে গিয়েছে।খুব ভালোলাগা কাজ করছে তার মনে।মুনেমের মুখের থেকে ভালোবাসি কথাটা যেনো তার কানে এখনো বাজছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ সে।ঝিনুক কিছুটা আমোদিত গলায় বললো,
–“আমি আপনাকে আর ভালোবাসি না।আমি আর একজনকে ভালোবাসি।কয়েকদিন পর তাকেই বিয়ে করবো আমি।”
মুনেম চট করে মাথাটা তুলে ফেললো।রাগান্বিত চোখ নিয়ে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে আছে।চোয়াল শক্ত করে বললো,
–“আবার বলো কি বললা?”
–“আপনি কি কানে শুনেন না মুনেম ভাই।বলছি আপনাকে আমি ভালোবাসি না।আমি আরেকজন কে ভালোবাসি আর তাকেই বিয়ে করবো।”
ঝিনুকের কথা শেষ হতে না হতেই মুনেম ঝিনুকের উপর উঠে বসলো।এক হাত দিয়ে ঝিনুকের হাত দুটো বিছানায় চেপে ধরলো।আরেক হাত দিয়ে গলা থেকে জামাটা টান মেরে অনেকটা নিচে নামিয়ে ফেললো।ঝিনুকের ফর্সাযুক্ত বুকটায় কিছুক্ষণ ঠোঁট বুলিয়ে বড়সড় একটা কামড় বসিয়ে দিলো।কামড়ের প্রকোপ একটু জোরে হওয়াই ঝিনুক দাঁতে দাঁত চেপে অস্পষ্ট স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো “মুনেম ভাই”।মুনেমের এতে কোনো হুশ নেই।বেশকয়েকটাই কামড় বসিয়েছে মুনেম ঝিনুকের ফর্সা বুকটায়।কিচ্ছুক্ষণ থেমে গিয়ে কামড় গুলোতে আলতো করে ঠোঁট চেপে ধরলো।ঝিনুক যেনো আর সহ্য করতে পারছে না।চোখ বেয়ে তার পানি পড়ছে।মিনিট দশেক পর মুনেম ঝিনুকের উপর থেকে সরে আসলো।বিছানা থেকে নেমে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বললো,
–” আমার ভালোবাসার চিহ্ন বসিয়ে দিয়েছি তোর বুকে।এবার দেখবো কি করে তুই চলে যাস আমার কাছ থেকে।আর,কয়েকদিনের মধ্যেই তোকে আমি নিজেরও করে নিবো।”
বলেই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো মুনেম।
ঝিনুক মুনেমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো”ব্যাডা রাক্ষস”।পরক্ষণেই মুখে লজ্জার হাসি ফুটে উঠলো।
তার একসপ্তাহের মধ্যেই মুনেম অনেকটা জোর করে ঝিনুককে বিয়ে করে ফেললো।পরিবারের সবাই রাজি হলেও এতো তাড়াতাড়ি বিয়েটা ঠিক মানতে চায় নি।তাও,মুনেম একপ্রকার নাছোড়বান্দা হয়েই বিয়ে করেছে।ঝিনুক কিছু বলার সাহস পায়নি।তবে মনে মনে তার খুব ভয় হচ্ছে।না জানি বিয়ের পর মুনেম তার সাথে কি করে বসে।দু পরিবার মুনেমের পাগলামিতে রাজি হয়ে আজকেই মুনেম আর ঝিনুকের চার হাত এক করে দিয়েছে।
এখন রাত প্রাত ১২ টা।ঝিনুক মুনেমের রুমে বসে আছে।রুমের চারপাশ টা চোখ বুলাচ্ছে বারবার।এরি মাঝেই মুনেম দ্রুত গতিতে রুমে এসে ঢুকে দরজা টা লাগিয়ে দিলো।ঝিনুকের পাশে এসে শরীর ঘেঁষে বসলো।মাছি তাড়ানোর ভঙিমা করে বললো,
–“দেখলা কিভাবে তোমাকে বিয়ে করে নিলাম।বলেছিলাম না তুমি আমার হবে।”
ঝিনুক মুখটা বাঁকিয়ে বললো,
–“দেখছি মুনেম ভাই।”
–“কি দেখলা”
–“আপনার পাগলামো মুনেম ভাই।”
–“এই কথায় কথায় এতো ভাই ভাই করছো কেন।তোমার স্বামী আমি।আগে তো ভাই বলতা না।আগে তো নাম ধরে বলতা।”
–“আগের ঝিনুক এখন আর নেই।আর,আপনাকে আমি ভাইয়েই বলবো।”
মুনেম কিছুটা তেড়ে এসে বললো,
–“তুমি বুঝতে পারছো আমাকে ভাই বললে আমাদের সন্তানরা আমাকে মামা বলবে।”
–“তাতে আমার কিছুই হবে না মুনেম ভাই।আমাকে মা ডাকলেই হলো।”
মুনেম একপ্রকার রাগেই ঝিনুককে বিছানার সাথে চেপে ধরলো।রাগান্বিত গলায় বললো,
–“আমি বাবা হতে চাই বুঝছিস।মামা না।”
–“উফফ!আপনি এতো খাড়ুশ কেন মুনেম ভাই।কিভাবে চেপে ধরে আছেন।”
–“তুই আবার আমাকে ভাই বললি।”
–“আরো বলব।মুনেম ভা–”
তার আগেই মুনেম ঝিনুকের ঠোঁট দুটো চেপে ধরে।ঝিনুক অনেক নাড়াচাড়া করছে।এতে মুনেম রেগে গিয়ে ঝিনুককে আর একটু চেপে ধরলো।ঝিনুক আর না পেরে মুনেমের ভালোবাসায় মেতে উঠলো।
—————————————
বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে ঝিনুক।কোলে তার সাড়ে পাঁচ মাসের বাচ্চা।তার আর মুনেমের বিয়ের একবছরের মাথায় তার কোলজুড়ে তাদের টুকটুকে ছেলে মাহিম আসে।মুনেম অফিস করে বাকিটা সময় তার ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে কাটায়।ঝিনুক নিজেকে অনেক সুখী মনে করে।মুনেমকে পাওয়া তো সে ছেড়েই দিয়েছিলো।কিন্তু,ভাগ্যের জোরে আজ মুনেম তার।তবে ঝিনুক মুনেমকে অনেকটা জ্বালায়।নিজের ছেলে মনে হয় এতোটাও জ্বালায় না।ঝিনুক এখনো মুনেমকে ভাই বলে ডাকে।এমনকি মুনেমকে দেখিয়ে নিজের ছেলেকেও বলে উঠে “মামা বলবা” বুঝছো আব্বু।ছোট বাচ্চা মাহিম কিছুই বুঝে না।শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
মুনেম বাহির থেকে এসে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলো।ফ্রেশ হয়ে সেও ঝিনুকের সামনে বসে পড়লো।ঝিনুকের কোল থেকে মাহিমকে নিয়ে গাল দুটোতে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললো,
–“আমার বাবাটা।আমাকে বাবা বলো তো সোনা।আর শুনো মা যদি তোমাকে মামা বলতে বলে তুমি কিন্তু মামা বলবে না।”
ছোট বাচ্চা মাহিম মুনেমের কথার আগামাথা কিছুই বুঝছে না।শুধু হাত মুখে দিয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে।ঝিনুক মুনেম কে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“ছোট এখনো আমার বাচ্চা।আপনার কথায় কিছু বুঝতে পারছে না।তবে আমি ওকে মামা বলাই শিখাবো।মা আমি আমার কথাই শুনবে।”
মুনেম অসহায় চোখ করে তাকিয়ে বললো,
–“বউ এমন করিস না।বাবা বলা শিখাবি প্লিজ।”
–“আপনি আসলেই একটা হাবাগোবা মুনেম ভাই।আপনাকে যদি আমি ভাই ডাকি তাহলে তো আমার বাচ্চা আপনাকে মামাই বলবে।”
–“বাচ্চাটা আমারও ঝিনুক”
–“তাতে কি ও মামাই বলবে।”
–“না ঝিনুক”
–“হ্যাঁ মুনেম ভাই।”
তাদের মধ্যে এইসব নিয়ে বলতে গেলে একপ্রকার ঝগড়া লেগে গিয়েছে।দুজনের মধ্যে অনেকটাই কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছে।দুজনের কথার কাটাকাটি দেখে অবুজ মাহিম ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো।সাথে সাথে দুজনের ঝগড়া থেমে গেলো।দুজনেই লেগে পড়লো মাহিমের কান্না থামাতে।
সমাপ্ত