#মেঘফুল_ফুটলো_মনে
#পর্ব – ০৭
#লেখনিতেঃ আবরার আহমেদ শুভ্র
রাত দু’টো বাজে। ওটি করে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে ফুয়াদ। তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিলো বিদায় সে নিজেই দরজা আনলক করে বাড়ীতে প্রবেশ করলো। কিন্তু বসার ঘরের ছোফায় কোনো রমনীকে শুয়ে থাকতে দেখে চমকে গেলো সে। হাতঘড়িতে একবার সময় দেখে আর একপলক সেই রমনীর দিকে তাকালো সে। রাত ২টা ১৭ বাজে এখন! তার জানা মতে কেউ বসার ঘরে ঘুমানোর কথা নয়৷ কারণ বাড়ীতে যে কয়টা রুম আছে তাতেই সকলের ঘুমের ব্যবস্থা সঠিকভাবেই হওয়ার কথা। তবু কেন এই রমনী এখানে শুয়েছে সেটা চিন্তা করতে করতে কয়েক কদম এগিয়ে গেলো তার দিকে। কাছ থেকে দেখে চিনতে অসুবিধা হলো তার। অধরের কোণে হাসিটা চওড়া হলো ফুয়াদের। হা সে সত্যিই দেখছে, তানজিম শুয়ে আছে ছোফায়৷ কিন্তু সে এখানে কেন শুয়েছে সেটা একদমই বুঝতে পারলো না ফুয়াদ। কিছুক্ষণ চেয়ে দেখার পর তানজিমকে নিন্মস্বরে ডাক দিলো সে,
–তানজিম, উঠ! তুই এতো রাতে বসারঘরে কি করছিস?
ঘুমু ঘুমু চোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির দিকে তাকাতেই তার ঘুম উবে গেলো। পিছনের দেয়ালে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল। তারপর শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠল,
–আসলে ফুয়াদ ভাই আ্ আমি আ্ আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ক্ কখন এলেন আপনি?
সদ্য ঘুম ভেঙে যাওয়া তানজিমের দিকে চেয়ে দেখলো সে। কেমন একটা অদ্ভুত মায়া আর নেশা বিরাজমান তার মুখশ্রীতে। তানজিমের কথায় অবাক হলো সাথে মনে মনে ভালোলাগা শুরু করলো এই ভেবে যে, কেউ একজন তার অপেক্ষার প্রহর গুনছে। তার আসার অপেক্ষায় আছে। তবে হালকা রাগ দেখিয়ে বলে উঠল,
–মামনী কোথায়? আমি তো মামনীকে বলেই ছিলাম আমি বাইরে থেকে ডিনার করে আসবো। তাছাড়া আমার এক্সট্রা চাবি আছে সেটি দিয়েই বাসায় প্রবেশ করতে পারবো। কারো অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া মামনী জেগে থাকলেই তো পারতো।
–আসলে ভাইয়া আপনি জানেনই মামনী আজ সারাদিন কতো ব্যস্ততার মাঝে ছিলো। তাছাড়া সব কাজ করে তিনি ভীষণ টায়ার্ড তাই আমি উনাকে জোড় করেই ঘুমুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। অবশ্য তিনি আমাকে মানা করেছিলেন অনেক কিন্তু আমি শুনিনি।
–আচ্ছা বেশ, রাত অনেক গভীর হয়েছে। যা রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পর। আমি আমার রুমে যাচ্ছি।
–আপনার ডিনা..
তানজিমকে কথা শেষ করতে না দিয়ে,
–ম্যাডাম আপনার এই বিষয়ে চিন্তা করতে হবে না, কজ আমি লেইট হবে ভেবে রেস্তোরাঁ থেকে ডিনার সেরে নিয়েছি। সো, আপনি এখন ঘুমাতে যান। … বলে আগেই নিজেই নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে।
ফুয়াদের যাওয়ার দিকে একমনে তাকিয়ে রইল তানজিম! তার মুখ থেকে ‘ম্যাডাম’ ডাকটা শুনে ভীষণরকমে অবাক হলো সে। কেন যেন বেশ ভালোই লাগলো ম্যাডাম ডাকটা তার। হাসিমুখে সেও ফাইজার রুমে চলে গেলো ঘুমাতে।
এতোক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে তানজিম ফুয়াদের কথোপকথন শুনছিলো তানিম। কতোটা বেহায়া হলে এমন করতে পারে মানুষ সেটা হয়তো তার অজানাই থেকে যাবে। ঘরে স্ত্রী থাকা সত্বেও যে ব্যক্তি তার প্রাক্তনের দিকে আবারও ঝুঁকতে চাই সে নিঃসন্দেহে খুব বাজে আর নিম্ন মনমানসিকতার মনুষ্য। তানজিম আর ফুয়াদকে একসাথে এতোটা কাছাকাছি দেখে রাগে শরীর তিরতির করে কাঁপতে লাগলো তানিমের।
–কই আমিও তো অফিস থেকে আসতাম তখন। কখনও তো আমার জন্য এতো রাতে অপেক্ষা করিস নি তুই তানজু! তবে আজ কেন ফুয়াদের জন্য এতো রাত অব্দি অপেক্ষা করতে হলো তোকে? বল কেন? তাহলে কি ওরা একজন অন্যজনের মায়ায় আটকে যাচ্ছে? আমি নতুনত্বের আশায় মূল্যবান কিছু হারিয়েছি? হা, আজ আমার ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই হয়তো একে একে তিনটে জীবন বেসামাল হয়ে গেছে। …বলে রাগে গজগজ করতে করতে দেয়ালে স্ব শব্দে ঘুসি মারলো সে।
সে জানেনা ঠিক কেন তার এমন লাগছে দুজনকে একসাথে দেখে। কেন তার এতোটা কষ্ট হচ্ছে আজ! তবে সে এখন হারে হারেই টের পাচ্ছে খুবই মূল্যবান কিছু হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে। যেটা হয়তো তার আর কখনও পাওয়া হবে না। অনুতাপের আগুনে জ্বলছে সে আজ!
______
সকালের মিষ্টি সোনালী রোদ্দুর এসে পড়েছে তানজিমের মুখশ্রীতে। তাতেই ঘুম ভেঙে গেছে তার! এতো দেরি করে উঠলো ভেবে নিজের প্রতি রাগ হলো তার! পরক্ষণেই মনে পড়ে গতকাল রাতের কথা। তাতে নিজের প্রতি রাগটা উবে গেলো। পাশে চেয়ে দেখলো সারাহ্ নেই। মনেমনে উপলব্ধি করতে পারলো সবাই নিশ্চয়ই এখন নিচে আছে৷ তাই সে দ্রুতই ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো।
সিঁড়ি দিয়ে নামতেই তার সাথে প্রথমেই চোখাচোখি হলো ফুয়াদের। নিচে নেমে দেখলো সবাই একসাথেই বসে আছে। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে যেই না তানিমের দিকে তাকাবে তখনই সে দেখলো তানিম অসহায়ের মতো মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘৃণায় মন বিষিয়ে উঠল তার। এখনও তার আশেপাশে তানিমের উপস্থিতিও একটা ঘৃণ্য আস্ফালনের সৃষ্টি করে। সে আর চাই না তার জীবনের কোনো কাপুরুষের ছায়া! তাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার ফুফি রূপশা খানম বলে উঠল,
–তানজু মা, ব্রেকফাস্ট করতে আয়। টেবিলে গিয়ে বোস আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
সেও মাথা নাড়িয়ে টেবিলে গিয়ে বসলো। খানিক বাদে তার ফুফি নাস্তা নিয়ে এলো। হালকা কিছু খেয়ে উঠে গেলো সে।
–কিরে উঠে গেলি যে? দুধচা খাবি না? ওটা না তোর ফেবারিট?… নাস্তার টেবিল থেকে উঠতেই তার ফুফি তাকে কথাটা বলল।
–না, ফুফি এখন ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ পরে নাহয় খাবো।
–আচ্ছা বেশ। চুলায় আছে তোর যখনই ইচ্ছে হয় গরম করে খেয়ে নিস।
–আচ্ছা।… বলে সে সারাহ আর তানভিনের মাঝে গিয়ে বসে পড়ল।
এতে করে খানিকটা ব্যথা পেলো সারাহ। ধুম করে তানজিমের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো সে। সারাহ-র দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো সে। দাঁতে দাত চেপে বলে উঠল,
–এই সারার বাচ্চা তুই আমাকে কি মারলি কেন?
–তা কি আর তোরে স্বাদে মারছি মুটকি? এভাবে মাঝখানে বসলি কেন? বললেই তো হতো। আমার পা’টা ভেঙে দিলি তো? এখন এই পঙ্গুত্বের কারণে ধ্রুব ভাই আমাকে আর বিয়ে করবে না।
–বেশ করেছি, ধ্রুব ভাই তোরে বিয়ে না করলে আমাকে করবে? তুই নাহয় তাকে জামাই ডাকার বদলে দুলাভাই ডাকিস। তাহলেই তো হয়ে গেলো! তাই না?
–তোকে তো। না না কিছু করবো না তোকে। তুই তো আবার ভালো মেয়ে। আচ্ছা ভালো করে বোস তো বোন। আর সারাহ মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল,
–দেখবি তোর জামাই হবে কালা উগান্ডার পোলাপানের মতো। খালি আমার জামাইয়ের দিকে নজর দেস। বেয়াদব মাইয়া।…. বলে তানজিমের দিকে তাকিয়ে একটা ক্লোজআপ মার্কা হাসির উপহার দিলো সে৷
রাগে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ কুল হয়ে কথা বলাটা কেন যেন সুবিধার লাগলো না তানজিমের। সে মনেমনে উপলব্ধি করতে পারলো,
–ইয়ে লাডকি ইতনি আচ্ছি কেসে হ্যায়? জারুর, ডালমে কুছ কালা হ্যায়! সাবধানে থাকতে হবে।
–কি ভাবছিস?
সারাহ-র কথায় চমকে উঠলো সে। পরক্ষণেই বলে, ‘না তেমন কিছু না। বলে আবারও দুই বান্ধবী একে অন্যের সাথে রাজ্যের কথা জুড়ে দিলো।
কিন্তু একজোড়া চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তানজিমেই স্থির হয়ে আছে! সদ্য ঘুম থেকে উঠা ফোলা ফোলা চোখেই যেন তার সৌন্দর্য দ্বিগুণ করেছে! হা ফুয়াদেরই চক্ষুজোড়া তানজিমের দিকে স্থির হয়ে আছে। আপন মনে সে বিড়বিড় করে উঠল,
–এই সময়টা যদি থেমে যেত, তোমারই কাজল কালো চোখের নেশায় মাতোয়ারা হয়ে যেতাম আমি।
#চলবে~
[