মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব -১৮

#মেঘফুল_ফুটলো_মনে
#পর্বঃ- ১৮
#লেখনীতেঃ আবরার আহমেদ শুভ্র

গোধূলিলগ্নে সূর্য প্রায় পশ্চিমের বুকে হেলে পড়েছে। সন্ধ্যা নেমেছে ধরনীর মাঝে কিয়দংশ পূর্বে। পাখিরা সব আপন নীড়ে ফিরেছে দল বেঁধে। আর থেমে থেমে বাতাস বইছে বিস্তীর্ণ ধরনীর মাঝে! আকাশের মাঝে খুব সুন্দর করে একফালি দুধেল হলুদাভ চন্দ্রের দেখা মিলেছে। সাথে শতশত তারার মেলা।

খোলা আকাশের নিচে উদাস মনে দাঁড়িয়ে আছে ফুয়াদ। আপন মনে ভাবছে অতীতের কথাগুলো! আজ প্রায় পঁচিশ টা দিন পার হলো তানজিমের সুস্থতার। অথচ সে নামেই মাত্র সুস্থ! সে সুস্থ হলেও তার শরীর আর মনে বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই এই সুস্থতার। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে সে। কখনও কোনো প্রশ্নের জবাব সঠিক করতে দিতে পারে না। কেমন যেন ভাবলেশহীন উদাসীন আর মুমূর্ষু হয়ে থাকে সে। সারাক্ষণ দুষ্টমির মাঝে মাতিয়ে রাখে যে মেয়ে তার এমন পরিস্থিতি বাড়ীর কেউই মেনে নিতে পারছে না। নীরব নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন থাকে রওশন প্যালেস। অবশ্য তানজিমের সবধরনের দেখাশোনা ফুয়াদ নিজেই করছে। শুধুমাত্র নারীসুলভ জড়তা-সংকোচ আছে এমন কাজগুলো তানভিনই করছে। আজ তানজিমের চেক’আপের শেষ দিন। আজই জানা যাবে তার শরীরের অবশিষ্ট উদাসীনতার মানে কি সেটা। অবশ্য তানজিমের চেক’আপের জন্য একজন স্পেশালিষ্ট রাখা হয়েছে। সেই সাথে সে একজন সাইকোলজিস্টও বটে। অবশ্য সেটা সকলের অজানা থাকার জন্যই ফুয়াদ এই বিষয়টি গোপন করেছিলো।

কিয়ৎ মুহুর্ত আগে সেই স্পেশালিষ্টকে বিদায় দেয়ার মুহুর্তেই ঘটে গেছে আরেক বিস্মিত কাহিনী। যেটা সকলকে বেশ অনেকখানিই চমকে দিয়েছে। সকলের রিয়েকশনেই এমন বিস্ময় প্রকাশ পাচ্ছে। অবশ্য সেরকমই কিছু ঘটবে বলে মনে হয়েছিল ফুয়াদের। তাই তো সে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করতে এমন উপায় অবলম্বন করেছে।

— ফুয়াদ এইসবের মানেটা কি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে কি একটু বুঝিয়ে বলবি?

সকলের মাঝে ফাইজার এমন প্রশ্নে হালকা হাসলো সে। যার মানে তার সব প্লানিং সাকসেসফুলি হয়েছে। কিন্তু ফাইজা এর কিছুই বুঝতে পারে নি।

— সব ক্লিয়ার না করলে বুঝবি না। গিভ মি টেন মিনিট টু এক্সপ্লেইন দিইজ, ওকে? বিকজ, এই সব কিছুই প্লানিং মাফিকই হয়েছিলো। যার মাস্টার মাইন্ড ছিলো মেঝো মামার বেস্ট ফ্রেন্ড ওয়াহিদ মুরাদ আংকেল।

অবাক হলো উপস্থিত সকলে। যাকে তারা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করতো সবসময় সেই এই হত্যার কালপ্রিট! ফুয়াদের কথায় চিড়া ভেজালো ধ্রুব।

— শুধু তাই নয়! তার সাথে আরও একজন ছিলেন। জানেন কে ছিলেন সে? অবশ্য সেটা অবাকেরই বিষয় সাথে।হয় তো খারাপও লাগতে পারে। তবুও আমায় বলতে হবে সেটা। তিনি হলেন সারাহ-র বাবা তুহিন আংকেল। হা আমার হবু শ্বশুর মশাই।

এবারে আগের চেয়েও বেশি অবাক হলো সকলে। বিশেষ করে সারাহ-র মা সুলতানা। ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। যাকে নিয়ে সে আদর্শ স্বামী হিসেবে গর্ব করতো সেই তাকে এতো বড় ধোঁকা দিলো? কিছুতেই মানতে পারছে না সে। সারাহ-র নিজের ও ঘৃণা হচ্ছে বাবা নামক এই পাষাণ মানুষটার প্রতি। নিজেকে কোনো মতে সামলাতে চেষ্টা করছে সে।

তারই মাঝে ধ্রুব আবারও বলে উঠলো,

— আর আমরা আরও একটি সত্যি জানতে পেরেছি সেটা হলো, তানজিমের মা – বাবা নিয়ে! ফুয়াদের মেঝো মামা আর মামি তানজিমের আসল বাবা মা। আর নাবিল আংকেল আর শায়লা আন্টি তানজিমের সম্পর্কে ছোট চাচা চাচি হয়। আই থিংক আপনারা এখব সত্য স্বীকার করবেন।

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো নাবিল আরমান। চোখ জোড়া তার টলমলে! অধর জোড়া শীত কাঁপানো কাঁপছে তার। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন তিনি,

— হা, আমরা এতোদিন ধরে তানজিমের বাবা মায়ের ভূমিকা পালন করে আসছি। কারণ, সে আমার ভাইয়ের মেয়ে হলেও আমাদেরও কোনো অংশে কম নয়। আমার মেয়ে তানভিনের মতোই সেও আমার মেয়ে। তাকে তানভিনের মতোই লালন করেছি। কখনোই জানতে দিই নি যে আমরা তার বাবা মা নয় তার চাচা চাচি। কারণ, সে কষ্ট পাবে বলে! তার দুই বছর বয়স ছিলো তখন! সেদিন নাহিদ ভাইয়া আর তাইমা ভাবি খুন হয়েছিলো সেদিন তানজুকে জড়িয়ে ধরে কতোক্ষণ কেদেছিলাম জানা নেই আমার। একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন। সেদিন থেকে শপথ নিয়েছিলাম তাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসবো। এরপরই আমাদের ছোট্ট কুড়েঁঘরে আগমন ঘঠেছিলো তানভিনের। তাই কখনও এই সত্য তার কানে পৌছাইতে দিই নি আমরা। এই ছোট্ট মনে কতটুকুই কষ্ট বা সে সহ্য করতে পারতো? আমরা তাকে নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিলাম আর বাসবো যতোদিন বেঁচে থাকবো। তাই আমরা প্রমিজ করেছিলাম এই সত্যিটা কখনোই তাকে বলবো না। জানি না কতোটুকু ভালোবাসা দিতে পেরেছি তাকে তবে সবচেয়ে বেশি তাকেই আমরা বেসেছি।

বলে হুহু করে কেঁদে উঠলেন নাবিল আরমান। সাথে একই রুমে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ। নিরব নিস্তব্ধ রুমের সকলের ধ্যান ভাঙলো কাঁচের কিছু ভাঙার শব্দে। ঘুরে থাকালো সে দিকে সকলে। সকলের চোখেমুখে ভয়ের দেখা দিলো।

কাঁপা পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলো সে রুমের ঠিক মধ্যিখানে। একবার চোখ বুলালো সকলের দিকে। বিশেষ করে ফুয়াদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। তারপর নাবিল আরমানের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

— বাবা, কেন এতোদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিলো এসব কথাগুলো? আমার কি অধিকার ছিলো না বাবা মায়ের পরিচয় পাওয়ার? আমি যাদের বাবা মা বলে জানতাম তারাই আজ আমাকে ধোঁকা দিলো? গোপন করলো আসল বাবা মায়ের পরিচয়?

তানজিমের কথায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন নাবিল আরমান। মাথা নিচু করে রইলেন তিনি। কিছুই বলার ভাষা নেই তার। নিরবে কেঁদে মেঝেতে চেয়ে রইলেন তিনি।

আবারও নিরব হয়ে গেলো চারপাশ। খানিকক্ষণ পরে কাঁধে কারো হাত পরতেই চমকালেন নাবিল আরমান। কাধ ঘুড়িয়ে সেদিকে তাকালেন তিনি। তানজিমকে দেখে আবারও মাথা নিচু করতেই দু’হাতে নাবিল আরমানকে তার দিকে ফিরালো সে। কঠিন স্বরে বলে উঠলো,

— বাবা, তোমার মাথা উঁচু করে থাকতে হবে সবসময়ই। যেই কাজটা তুমি করেছিলে না সেটা অন্য কেউ হলে তার ঠিক উল্টো পথে এগিয়ে নিতো সম্পর্কটাকে। তুমি আমার সেরা বাবা। যেই কথাটা আমি এতোটা দিন তোমায় বলতে পারিনি সেটা আজ বলছি, আই লাভ ইউ বাবা। আই লাভ ইউ। অনেক ভালোবাসি বাবা তোমাকে।

বলে নাবিল আরমানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো সে। সাথে কাঁদছে তিনি আর পরিবারের সকলে। বাদ বাকি নেই কেউই। হঠাৎ ফুয়াদ বলে উঠলো,

— আপনারা কান্না থামাবেন? আর আমাদের আরও অনেক কিছু জানার আছে। আর তানজিম তুই এখানে না থেকে রুমে গিয়ে রেস্ট কর। তোর প্রপার রেস্ট এর প্রয়োজন।

ফুয়াদের কথাকে পাত্তা না দিয়ে একপাশে দাড়িয়ে রইলো সে। যা দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলো,
— আমি বোধহয় কথাটা কোনো জড়বস্তুকে বলেছি। যে অনূভুতি শূন্য! বা যার কান দিয়ে বলা কথাগুলোর কিছুটাই পৌঁছায় না।

এবার অন্য কান্ড করলো তানজিম। সোজা শায়লা বেগমের পাশে গিয়ে কাঁধে হেলান দিয়ে বসে পড়লো সে। তা দেখে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো তার। প্রচন্ড কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলে উঠলো,

— তোর সাথে কিছু পার্সোনাল কথা আছে আমার, আই মিন আমাদের সেদিনকার ব্যপারে।

— তো সেটা এখানেই জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।

তানজিমের ঝটপট উত্তরে হতবুদ্ধি হয়ে গেলো সে। দ্রুত নিজেকে সামলে বলে উঠলো,

— বেশ এখানেই বল। কে ছিলো সেদিন? কারা তোর উপর আঘাত করেছিলো?

বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকলো তানজিম। হঠাৎ অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

-মৃন্ময় ভাইয়া, ফাইজা আপুর দেবর।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here