#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৫
নিভু নিভু চোখে অবলোকন করতেই ধ্রুবের ক্লান্তিমাখা মুখ নজরে এলো। ঘুমের রেশ ভেবে নড়েচড়ে উঠলাম। আরেকটু তলিয়ে গেলাম ঘুমে। এখানে ধ্রুবের উপস্থিতি হাস্যকর ব্যাপার। মাথায় স্পর্শ পেলাম। এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ। ব্যাঘাত ঘটল ঘুমের। তড়িগড়ি করে উঠে বসলাম। ধ্রুব গালে হাত রেখে সামনের টেবিলের উপর বসে আছে। দ্রুত দৃষ্টি আশেপাশে নিবদ্ধ করলাম। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। বাইরে থেকে চাঁদের ঝাঁপসা আলো ভেতরে প্রবেশ করছে। মিটিমিটি তারা জ্বলছে। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। দেয়ালে কোনো ঘড়ি দেখতে পেলাম না। ফোন খুঁজতে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলাম। জায়গা থেকে উঠার পূর্বেই ধ্রুবের ফোনের স্ক্রিন চোখের সামনে ভেসে উঠল। হঠাৎ তীব্র আলোতে সংকুচিত হল চোখ। আমার ঘুমন্ত ছবি ওয়ালপেপারে সেভ করা। এলোমেলো চুলগুলো, জায়গা এটাই। নিশ্চয় কিছুক্ষণ পূর্বে তুলেছেন। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ৩:২২ এ.এম। আচ্ছা কতক্ষণ হয়েছে তিনি এসেছেন। সত্যি এসেছেন তিনি। কোথায় ছিলেন এতগুলো দিন।
নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ভারসাম্য হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার বুকের মধ্যিখানে। গলা জড়িয়ে রাখলাম। অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, “এতক্ষণে এসেছেন আপনি, কোথায় গিয়েছিলেন? কত ভয় পেয়েছিলাম আমি?”
অকস্মাৎ আক্রমণে ভরকে গেলেন তিনি। এলোমেলো হয়ে টেবিলের উপর শুয়ে পড়লেন। হুট করে একহাত পিঠে রাখলেন। আশ্বাসের ভঙ্গিতে বললেন, “কুল, কুল শ্রেয়াপাখি। শান্ত হও। কাঁদে না। এইতো এসেছি আমি। কান্না থামাও। কান্না না থামালে আমি কিন্তু চলে যাবো।”
ক্ষান্ত হওয়ার বিপরীতে বেড়ে গেল কান্নার গতি। শার্ট আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছি। ধ্রুব নিরাশ হলেন। উপায় খুঁজলেন না। অন্য উপায় অবলম্বন করলেন।কপালের চুলগুলো সরিয়ে চুমু দিলেন স্বযত্নে। ঘোর লাগা কণ্ঠে বললেন, “আমাকে দেখার স্বাদ, এই জীবনে মিটবে না।”
আমি লজ্জানত হলাম। তার দেওয়া কথায় লজ্জা মিশ্রিত হয়ে তার বুকেই মুখ গুঁজলাম। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক নেই, বেড়ে চলেছে। ডিপডিপ, ডিপডিপ, ডিপডিপ করছে। পরম শান্তি অনুভব করলাম। আকাশের চাঁদকে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলাম। কোনো আলো যাতে স্পর্শ করতে না পারে আমাদের।
ধ্রুব হাত পা ছড়িয়ে টেবিলের উপর শুয়ে পড়েন। তার সাথে মিশে থাকার ফলে আমাকেও থাকতে হল টেবিলে। মাঝামাঝি সাইজের টেবিল। হাঁটুর পরের অংশ টেবিলের বাইরে ঝুঁলে আছে। কাত হয়ে শুয়েছি বলে টেবিলের ভেতরেই আছি।
ধ্রুব একটু নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললেন, “রাঙামাটি গিয়েছিলাম। শুধু মা জানত। তোমাকে জানালে চিন্তা করতে, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করতে না। তাই বারণ করেছি। রাহাতকেও বলিনি। ঐ শা’লার ঠোঁট পাতলা। তোমাকে বলবে না, কিন্তু বাবুইকে বললে। বাবুই আবার তোমার কাছে লিক করবে।”
অস্ফুট স্বরে বললাম, “যাওয়াটা কি খুব জরুরি ছিল?”
“যাওয়াটা জরুরি ছিল কি-না জানিনা। কিন্তু তোমাকে স্পেস দেওয়াটা জরুরি ছিল।”
আমি অবুঝের মত মাথা নেড়ে চুপ হয়ে গেলাম। অতিবাহিত হল কিছু প্রিয় মুহুর্ত। হঠাৎ ধ্রুব বললেন,
“এবার আমাকে খুলে বলো সবকিছু।”
অবুঝ স্বরে বললাম, “কোন সবকিছু?”
“তুমি এখানে কী করছ?”
স্নিগ্ধ গলায় বললাম, “আমি দু’দিন ধরে এখানে কাজ করছি। আমি আপনার আর মামার গণ্ডি পেরিয়ে রোজগার করতে চাই।”
“ভালো কথা। রোজগার করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু আমি অন্য কথা জিজ্ঞেস করছি।”
বুঝতে পারলাম তার কথার ধরন। কিন্তু তোয়াক্কা করলাম না, প্রসঙ্গ পাল্টে নিলাম।
ধ্রুবের বাক্য থামতেই বলতে শুরু করলাম, “বিকেলের দিকে শরীরটা ভালো লাগছিল না, একটু বসেছিলাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি জানিনা না। কেউ ডেকেও দেয়নি।”
বিরক্ত হলেন অতিশয়। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “আমি এটার কথা জিজ্ঞেস করিনি, ভার্সিটিতে কী হয়েছে সেটা জানতে চাইছি।”
অবিলম্বে যাতনার সূচনা হল। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। চুপসে গেলাম আমি। ধ্রুবকে সন্নিকটে পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম কথাটা। নতজানু হয়ে রইলাম। প্রত্যুত্তর না পেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন ধ্রুব, “কিছু জিজ্ঞাসা করছি কিন্তু..
প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, “ক-কই, কিছু হয়নি তো..
আমার কথা থামার পূর্বেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন ধ্রুব, “আগেরবার মিথ্যা বলার কারণে চড় দিয়েছিলাম, এবার একই ভুল করবে না নিশ্চয়ই, করলেও পরিনতি ভালো হবে না।
তাছাড়া আমি সবটাই জানি, তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছুক।”
অস্পষ্ট স্বরে বলি, “জানেনই যখন, আবার প্রশ্ন করেছেন কেন? আচ্ছা আপনাকে কে বলেছে?”
ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কেন তাকে নোবেল দিবে?”
“না, ধন্যবাদ দিতাম।”
“লাইব্রেরীয়ান বলেছে। তিনি পুরোটা সময় ছিলেন না, পরে এসেছেন। তার ভাষায় শুনেছি, এবার তুমি বলো।”
“এবার তুমি বলো” শেষের উক্তিটা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করলেন ধ্রুব। কেঁপে উঠলাম মুহূর্তে। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করলাম, “ওরা আমাকে ভেঙে দিয়ে ধ্রুব। ভেঙে দিয়েছে। কত ছাত্র-ছাত্রী ছিল। সবার সামনে আপনার আর আমার সম্পর্কটাকে বাজেভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘পতিতা’ শব্দটা মানানসই বললেও কম হয়ে যাবে। আমাদের পবিত্র সম্পর্কটা কি এই তকমা পাওয়ার যোগ্য? আপনার দোষ আর দিবো না, সব আমার দোষ। সবকিছু জন্য আমি দায়ী।”
ধীরে ধীরে কালকে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা বলতে শুরু করলাম।
ধ্রুব বুকে জড়িয়ে নিলাম আমায়। শান্তনা দিয়ে বললেন, “নিজেকে দোষারোপ করোনা। সব ঠিক করে দিবো আমি। আর কাঁদতে দিবো না। সকাল হতে দাও।”
___
গাড়ি থামল ভার্সিটির মেইন গেটের থেকে কিছুটা দূরত্বে। এখনও সময় হয়নি ক্লাসের। তবে ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচল। আশেপাশে সন্দিহান চোখে চেয়ে নামলেন গাড়ি থেকে। কাঁচ লাগানোর ফলে বাইরে থেকে ভেতরের অংশ দেখা যাচ্ছে না।
দরজা বন্ধ না করেই গম্ভীর গলায় বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমি একহাত ঘোমটা টেনে বেরিয়ে এলাম। সবাই হাঁটা থামিয়ে একবার আমাদের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। ধ্রুবের তেজের কারণে সরাসরি তাকানোর সাহসে কুলাচ্ছে না। কালকের ঘটনার নিয়ে সবাই অবগত। ডানহাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের হাত গুঁজে নিলেন। গলার নিচের ঘামটুকু মুছে পা বাড়ালেন। হাতে টান পড়াতে আমার পাজোড়াও গতিশীল হল। হাত ছাড়াতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। ক্যাম্পাসের দিকে গিয়ে সবাইকে ডাকলেন। মাহি ও তার বন্ধুরা নেই। তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন মাহি ও তার বন্ধুরা আসলে যাতে ধ্রুবের সাথে দেখা করে। আঁখি আর প্রিয়াকে আমার দায়িত্ব দিলেন। অতঃপর আমাকে রেখেই চলে গেলেন ভিতরে।
আমি ক্লাসে গেলাম না। বসে দাঁত দিয়ে নক ছোট করার প্রতিযোগিতায় নামলাম। কিছুক্ষণ পর মাহি ও তার বন্ধুরা এল। ধ্রুব স্যারকে খবর পাঠানো হল। চারিদিকে ফিসফিসানি শুরু হল। ধ্রুব স্যারের আগমনে থেমে গেল সবকিছু। কথার ধরন একই রেখে স্বাভাবিক তালে বললেন, “যাওয়ার সময় টি.সি. নিয়ে যেও।”
একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাকের সুরে বলে, “কীসের টি.সি. স্যার?”
“আমার বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার বলে মনে করছি না, তবুও বলছি, ‘গতকালের জন্য।’ তোমাদের জায়গা নেই এখানে। এটা পড়াশোনার জায়গা কাউকে ছোট করার জায়গা নয়।”
মাহি নত কণ্ঠে বলে, “স্যার আমরা বুঝতে পারছি, কেন আমাদের টি.সি. দেওয়া হবে। আচ্ছা, আমরা কি কোনো মিথ্যা বলেছি? সত্যি কথা বলার কোনো অধিকার আমাদের নেই?”
ধ্রুব স্যার সৌজন্য হাসলেন। কাউকে তাচ্ছিল্য করার জন্য এই হাসিই যথেষ্ট। কপাল কুঁচকে বললেন, “সত্য বলার অধিকার সবার আছে। তুমি সত্য না-জেনেই একজনকে হেয় করছিলে। তোমার উচিত ছিলনা, আমার আর চড়ুইয়ের সম্পর্কটা আগে জেনে মন্তব্য করার?
আর পাঁচটা বৈবাহিক সম্পর্কের মত আমি আর চড়ুই স্বামী স্ত্রীর অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ।”
চমকে উঠলাম আমি। ভেবেছিলাম অন্য কোনো উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন কারণ তিনিই বিয়ের কথাটা লুকিয়েছেন।
উৎকণ্ঠিত হল পরিবেশ। সবার দৃষ্টি আমার পানে নিবদ্ধ। গমগম আওয়াজ শোনা গেল। ভার্সিটির ক্রাশ ধ্রুব স্যার বলে কথা। হুট করে বিয়ের কথাটা মেনে নিতে অসুবিধে। তড়িঘড়ি করে মাহি বলে, “স্বামী স্ত্রী? আপনারা বিবাহিত আর কেউ সেটা জানে না।”
ত্যাড়া জবাব দিলেন, “প্রথমত, এখন কেউ বিয়ে করলে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে করতে হবে না-কি? আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার পাবলিকলি আনতে চাইনি, তাই লুকিয়ে রেখেছিলাম। দ্বিতীয়ত, স্যারেদের মধ্যে অনেকেই জানে। তৃতীয়ত, সেদিন অনেক কিছু করার পরেও ছেড়ে দিয়েছিলাম। চতুর্থ, তুমি মেয়ে না হলে আমার সামনে আস্ত থাকতে না। তবে ছেড়েও দিচ্ছি না।”
ধ্রুব কড়া গলায় শাসিয়ে নিয়ে গেল ওদের। #মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৬
“ধ্রুব স্যার তোর হাসব্যান্ড, ও.মাই.গড। আমি একদমই ভাবতে পারছি না। তুই এই কথাটা আমাদের থেকে লুকিয়েছিস, কেমনে পারলি দোস্ত।”
হতাশাগ্ৰস্থ কণ্ঠে বলে আঁখি। আমি দূর্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। না, আমার সহ্য হচ্ছেনা। ওদিকে ধ্রুব মাহিদের নিয়ে গেল আর ফিরল না, কী হলো সেটাও জানতে পারছি না। চিন্তায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এখানে আবার এদের তদন্ত চলছে। আমাকে টুলে বসিয়ে গোল করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আমি বিরক্ত প্রকাশ করে উঠে গেলাম। সেখানে গিয়েই দেখতে হবে। চাইলেই কী যাওয়া যায়? টেনে চেয়ারে বসালো আমায়। প্রিয়া কর্কট কণ্ঠে বলে, “কী সমস্যা তোর। কিছু জিজ্ঞাসা করছি তো। একপা বাড়ালে ঠ্যাং ভেঙে বসিয়ে রাখব।”
ফোড়ন দিয়ে বললাম, “বসিয়েই তো রেখেছিস, এবার ঠ্যাঁ ভাঙাই বাকি আছে।”
তারিফ প্রশ্ন করল, “আমরা ভাঙি আর স্যার আমাদের ঠ্যাং ভাঙুক। সত্যি করে বলতো, ধ্রুব স্যারের সাথে তোর বিয়ে কবে হল?”
এর মাঝেই একদল ছেলে-মেয়ে ঢুকে গেল লাইব্রেরীতে। দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে ইশারা করছে। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বলছে কিছু। কানে এলো কিছু কথা। সামনের মেয়েটা আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বলে, “ঐমেয়েটা ধ্রুব স্যারের ওয়াইফ।”
আরেকটা মেয়ে নাক ছিঁচকে বলে, “না এর সাথে ধ্রুব স্যারকে একদম মানাবে না। কেমন একটা গাইয়া গাইয়া টাইপ।”
আরেকজন বলছে, “ওদের বিয়ে হয়েছে কবে? ধ্রুব স্যার দেশে ফিরেই ভার্সিটিতে জয়েন করেছে। তখন তো মনে হয়নি তারা পরিচিত।”
গায়ে লাগল কথাটা। তেজ দেখিয়ে বললাম, “লাইব্রেরীতে কতগুলো মাছি ঢুকেছে, ভনভন করছে। মাছিগুলো তাড়িয়ে দরজা ভিড়িয়ে দে নিরব।”
নিরব সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। মেয়েগুলো বেজায় ক্ষেপেছেন। দ্বি’মত পোষণ করার পূর্বেই বিনাবাক্যে প্রস্থান করল। শান্তিপূর্ণ শ্বাস নিলাম। চেয়ার ভেবে ভর দিলাম সম্পূর্ণ। মুহূর্তের মাঝে ভুলে গেলাম টুলের কথা। বিনিময়ে টুল উল্টে পড়লাম মেঝেতে। ঘর্ষণ সৃষ্টি হল মেঝেতে। মাথার পেছন অংশে আঘাত পেলাম। পিঠে আলতো ঘর্ষণ লাগল। পুড়ে উঠল জায়গাটা। আমি উবুত হয়ে পিঠ ধরলাম। কাতরাচ্ছি ক্রমাগত। তৎক্ষণাৎ ধ্রুব উপস্থিত হলেন। আমার এরুপ অবস্থা দেখে ছুটে এলো। গালে মৃদু শব্দে চপল দিয়ে বিষণ্ণ গলায় ডাকল। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় নির্বাক আমি। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সবকিছু অবলোকন করছি। ধ্রুবের বিষণ্ণময় কণ্ঠ কর্ণকুহরে হানা দিলেও সাড়া দিতে ব্যর্থ হলাম। ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন করতে পারলাম না। বন্ধুরা এগিয়ে আসার প্রয়াস করলে ধ্রুব বারণ করলেন। নিজেই প্রচেষ্টা করলেন। ধরে ধরে উঠে বসালেন হেলান দিয়ে। পিঠের ক্ষত তীব্র আকার ধারণ করেছে। হেলান দেওয়া ছাড়াই বসলাম। তিক্ত কণ্ঠে বললেন, “একটু সাবধানে বসবে না। সবসময় ছটফট ছটফট করো। বেশি লেগেছে?”
অস্বস্তি নিয়ে বললাম, “না, জাস্ট পিঠে।”
প্রত্যুত্তর দেওয়ার পরক্ষণেই অন্য প্রশ্ন টানলেন, “পড়লে কী করে?”
টেনে টেনে জবাব, “হঠাৎ মাথাটা ধরে গেছিল। সামলাতে পারিনি, তার আগেই।”
মাথার প্রসঙ্গ টেনে অতিশয় ভুল করলাম। দ্রুত তার ডানহাতটা কপালে ঠেকালেন। এপিঠ ওপিঠ করে জ্বর মাপার চেষ্টা করলেন হাতের সহায়তায়। আমি সৌজন্য হাসলাম। চোখে অজস্র ভীতি। ধ্রুবের চোখের ভাষা অনুভব করতে পারলাম। “ভালো আছেন?”
ভ্রু কুঁচকে ধ্রুব বললেন, “কালকের ঘটনার পর বাড়িতে যাওনি। ফুড কমপ্লেক্সে ছিলে। তা খাওয়া-দাওয়া করেছ?”
এই ধারণাই করেছি। আপনাআপনি হাত চলে গেল মুখে। সরল মুখশ্রী করে দাঁত দিয়ে নখ ছোট করার প্রয়াস করলাম।
“নখ খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করিনি, অন্যকিছু খেয়েছ কি-না সেটা? নখে জীবাণু থাকে, ওগুলো খেলে এমনিতেই শরীর খা’রাপ করবে। তুমি বসো, আমি দেখছি কী পাওয়া যায়।”
ধ্রুব বলেই উঠে দাঁড়ালেন। অশান্ত মন নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরক্ষণেই ভয়ংকর ঝামেলা ঘাড়ে ঝুটল। ধ্রুবের চেয়েও কড়া হয়েছে বন্ধুমহল। বুকে হাত গুঁজে সন্দিহান স্বরে বলে, “মাথা ঘুরল কেন তোর? সত্যি করে বল।”
না বোঝার স্বরে বললাম, “মাথা কেন ঘুরে, কখন ঘুরে আমি বলব কীভাবে? আমি কি ডাক্তার?”
প্রিয়া প্রশ্ন করল, “এবার বল, তোদের বিয়ে কবে হয়েছ?”
“যে সপ্তাহে শুক্রবার নেই।” এড়িয়ে।
“মানে তোদের বিয়ে হয়নি। ধ্রুব স্যার মিথ্যা বলেছে, কিন্তু স্যার তো মিথ্যা বলেনা। আচ্ছা স্যার তোকে চুমু খেয়েছে?”
“হ্যাঁ।” সংক্ষিপ্ত জবাব।
“তোরা একসাথে ছিলি কখনো?”
“হ্যাঁ। কয়েকদিন ছিলাম। উনি ছুটি নিয়েছিলেন-না তখন। একসাথে গিয়েছিলাম এবং একসাথেই ছিলাম।”
হতাশাগ্রস্থ কণ্ঠে বলে আঁখি, “দোস্ত তুই প্রেগন্যান্ট না তো?”
হতভম্ব হলাম। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। এই সামান্য কথাটা জিজ্ঞেস করতে এত কথার পাহাড় সাজিয়েছিল। দমে গেল সবাই। আঁখি কপাল চাপড়াতে লাগল। তার ভারাক্রান্ত মন। ধ্রুব স্যারের পেছনে লাইন দেওয়ার পরেও কাজ হয়নি।
অতিবাহিত হল দু’মাস। বদলে গেছে সবকিছু। আমার আর ধ্রুবের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই। বেশ বদলে গেছে। ভার্সিটিতে যাওয়া আসা চলতে থাকে কিন্তু ধ্রুবের সাথে কথা হয়না। শা’স্তি দিচ্ছি তাকে। এতগুলো বছর অবহেলার করার জন্য। বাবুইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। একটা কথা তো বলাই হয়নি।
আজ শুক্রবার। রাহাত স্যারের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের তোরজোর চলছে।
ধ্রুব নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে, এতেই সন্তুষ্ট আমি। কিন্তু তার মা রমিলা অসন্তুষ্ট নয়। তাকে এড়িয়ে চলা, আমাকে অবহেলা করার জন্য বিয়ের বন্দোবস্ত করেছে। শেষ পর্যন্ত তার ছেলে কী করে, সেটাই দেখতে চান।
চারিদিকে উৎসব মুখর পরিবেশ। পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব দিয়ে ভর্তি বাড়ি। ফুলের হালকা সাজ, গায়ে হলুদের শাড়ি। তার উপরে লাল হলুদের মিশ্রণে গামছা জড়ানো। মুচকি হেসে গাঁদা ফুল গাছের পাশে দাঁড়ালাম। ফটোগ্ৰাফার ছবি তুলে দিলেন। বন্ধু আঁখি আর ধ্রুবের চাচাত বোন আঁখিকে নিয়ে ছবি তুললেন। আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল ধ্রুবের পানে। পড়নে হলুদ পাঞ্জাবি। চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে এগিয়ে এলো আমার পানে। ঈর্ষা জাগল ঈষৎ। বউ অন্যের হয়ে যাচ্ছে, তার এত সাজ কীসের? আশ্চর্য! পকেট থেকে শুকনো বেলি ফুলের মালা বের করলেন। অনেক আগের দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মৃদু হেসে বললেন, “সেদিন তোমার মাথায় গাদা ফুলের মালা গুঁজে দিছে দিয়েছিলাম-না, তখন এটাও কিনেছিলাম। নিজের কাছে যত্নে রেখে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সময় করে গুঁজে দিবো, তা আর হবে না। এখনই গুঁজে দেই।”
অনুমতির প্রয়োজন বোধ করলেন না। নিজেই যত্নসহকারে খোঁপায় ফুল গুঁজলেন। হেসে বললেন, “খুব সুন্দর লাগছে, মা-শা-আল্লাহ। তবে পায়ে আলতা নেই কেন? শুধু মুখে ময়দা মাখলেই চলবে, পা’কে একটু সাজাতে হবে তো না-কি!
শুভ কামনা আগামী জীবনের জন্য।”
কাগজে মোড়ানো আলতার বোতলটা এগিয়ে দিল বড় চাচির কাছে। তিনি অবিলম্বে ব্যস্ত হলেন আলতা পড়াতে। আমাকেও বাধ্য করলেন। আলতায় হলুদ হলুদ রং ফুটে উঠল। তবে তীক্ষ্ণ নয়। হলুদের অনুষ্ঠান ভেবে অগ্ৰাহ্য করলাম।
যেভাবে ধপাধপ পা ফেলে এসেছিলাম তেমনি ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলেন। একটু দূরে গিয়ে গোল করে দাঁড়ালেন। প্রিয়া, নিরব, আঁখি, তৌফিক এমনকি দাদিমাও আছেন সেখানে। কৌতুক দমাতে না পেরে সেদিকে অগ্ৰসর হলাম। ধ্রুব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “দেখ, প্লান যাতে কিছুতেই ফ্লপ না করে। তাহলে কিন্তু সব শেষ।”
“আচ্ছা স্যার।” সবাই একসাথে।
“এখানে স্যার ডাকার প্রয়োজন নেই। কেমন জানি লাগে। ভাইয়া বলেই ডেকে।”
“আচ্ছা, স্যার [ ধ্রুব বিস্ফোরিত চোখে তাকাতেই] ভাইয়া..
আমিও পেছন থেকে বললাম, “আচ্ছা, ভাইয়া। তো কীসের প্লান?”
“তোমার বিয়ের..
হলুদের জন্য ডাক পড়ল। প্রথম হলুদ মামুনিই ছোঁয়ালেন। অতঃপর এক এক করে সবাই ছুঁয়ে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। হলুদে ‘হলুদ গাছের’ চাষ করলাম।
ঘরে আনা হল। একদল লোক হুরমুড়িয়ে চলে এলো। আমাকে ওয়াশরুমের দিকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“ভাবী তোমরা দুইজন আহো শুধু। এত ছোট ওয়াশরুমে এত মানুষ আটত না। এত কইরা কইলাম, বাইরেই গোসলটা সেরে ফেলতে, শুনলই না। একসাথে দুই মাইয়ারে গোসল করান যাইত, এখন এক এক কইরা।”
“আপনারা কেন গোসল করাবেন?” একরোখা প্রশ্ন।
“বিয়ের গোসলে একটু নিয়ম আছে। তুমি একা পারবনা মা, আমাদের লাগবে। ভাবী আসো।”
বললে বলতে জোরপূর্বক আমাকে ঠেলে ঢুকল তারা। এই গোসল সেরে বের হতে হতে পাঁচটা বাজল। আমি পুরাতন একটা জামা পড়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। এখন হালকা লাগছে। বাইরে সবাই আনন্দ করছে। গ্ৰামের চাচিরা রং নিয়ে একে অপরের গায়ে ছুঁড়ছে।
[মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ইনশাআল্লাহ]