‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশ’
-জান্নাত খান
পর্ব-২|
[১৮+ এলার্ট!গল্প লিখতে যেয়ে অপ্রাসঙ্গিক শব্দ বা প্রেমের মুহুর্ত ফুটাতে যেয়ে যদি চটি নামে আখ্যায়িত করা হয়,তাই আগে থেকে সতর্কতা বানী দেয়া হলো।’]
.
-‘আমি তোমার বাবা।একটু থাম মা।’
রাগিবের মমতাময়ী কন্ঠস্বরে মেয়েটা এতোক্ষন যে তুফান চালাচ্ছিলো ছোটাছুটি করে তা নিমিষেই থেমে গেলো।রাগিব নার্সকে বললো,
-‘আপনি ওর ব্যান্ডেজ খুলুন!’
নার্স বললেন,
-‘সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকতে হবে।’
রাগিব মাথা ঝাকিয়ে বললো,
-‘ফাস্ট।’
নার্স খুব দ্রুত ভাবে চিৎকার দিয়ে বললো,
-‘১০১ নাম্বার কেবিনের পেসেন্ট জ্ঞানে আসছে।উনি হাইপার হয়ে গেছেন!জলদি আসুন।’
বেশকিছুক্ষন পর নার্স ডাক্তার নিয়ে কেবিনে আসলো।সাথে পিছনে ক্লিনিকের ওয়ার্ডবয়।ট্রে তে করে তারা নিয়ে এসেছে ব্যান্ডেজ কাটার বিভিন্ন জিনিসপত্র।মেয়েটা হাতড়ে যেনো কিছু খুজছেঁ।ডাক্তার বললো,
-‘রিল্যাক্স ডিয়ার!কিছুক্ষন পরই তোমার ব্যান্ডেজ খুলে দেয়া হবে।’
মেয়েটা কিছু বললো না।ডাক্তার যেই না মেয়েটার হাত ধরেছে,ওমনে ছিটকে সরিয়ে দিলো।মনে হচ্ছে ওই স্পর্শটায় তাকে খুবলে খাচ্ছে।আবারো এলোপাথাড়ি ভাবে ছোটাছুটি শুরু করে দিলো।অশান্ত হয়ে উঠছে।রাগিব দ্রুত ভাবে এগিয়ে আসলো আর বললো,
-‘মা এইভাবে ছোটাছুটি করে না।দেখো কেও ছুবে না তোমাকে।তুমি এই দেখো শান্ত হও।প্রিন্সেস তো বাবা’র কথা শুনে তাই না।এই যে তোমার বাবা হাত ধরেছে।’
রাগিব এইভাবে তার মেয়েকে শান্তনা দিতে লাগলো।মেয়েও কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলো রাগিবের কথায়।রাগিব ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘আমি ধরে আছি।আপনি ধীরেসুস্থে ব্যান্ডেজ খুলুন ডাক্তার।’
ডাক্তার মাথা ঝাকিয়ে বাকিদের ইশারা করলো।সবার সাহায্য নিয়ে ডাক্তার ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করলো।ব্যান্ডেজ একটা পার্ট খুলছে যখন রাগিবের ধুকপুকানি ততটায় বেড়ে উঠছে।মেয়ে’র হাত শক্ত করে ধরে আছে।আস্তে কয়েকমিনিটের মাঝে মুখের এবং হাতের ব্যান্ডেজ খোলা হলো।রাগিব চোখ বন্ধ করে আছে।কেন যেন তার সাহসটুকু জুটছে না তাকাবার।
ডাক্তার বললো,
-‘ইট’স ডান মিস্টার রাগিব।লুক এট হার।’
ডাক্তারের আওয়াজে বুকটা ধড়াস করে উঠলো।সমস্ত শরীর ঝিনঝিন করে কাপঁছে রাগিবের।কাপাঁ কাপাঁ চোখে তাকিয়ে দেখছে।দেখার সাথে বুকের মাঝ থেকে তার চাপা একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে গেলো।চোখভর্তি জল তার। মেয়ে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।সেই চেহারা!সেই দাম্ভিকতা। সেই তেজ।সেই কড়া কড়া ছাই রঙের চোখ।
রাগিবের ধ্যান ভাঙলো মেয়েটির কথায়।মেয়েটা বলছে,
-‘কে তুমি?আমি এখানে কেন?এটা কোথায়?আমি বা কে?’
এইভাবে নানান প্রশ্ন করতে করতে মেয়েটার অস্থির হয়ে গেছে।রাগিব শান্ত চোখ নিয়ে দেখছে।তার শব্দ গুলো মনে হচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা বেডে বসে কেমন পাগলামি করতে লাগলো তখনই ডাক্তার নার্সকে ইশারা করলো মেয়েটিকে ইঞ্জেকশন দেয়ার।ওয়ার্ডবয় রা যখন ধরতে যাবে মেয়েটিকে,সেই মেয়েটি চিৎকার দিয়ে বলে,
-‘ধরবেন না কেও।আপনারা আমাকে স্পর্শ করলে মনে হয় কেও এসিড ছুড়ছে।দয়া করুন কেও ছুবেন না।’
এমন নানান বিলাপ করতে লাগলো সে।কিন্তু এরকম উত্তেজনা করলে আরো সমস্যা হবে।চিৎকারে কানে মনে হচ্ছে তালা লাগছে।সবাই মিলে বাধ্য হয়ে তাকে ধরলো।নার্স ইঞ্জেকশন পুশ করে দিলো।নার্স ইঞ্জেকশন পুশ করার সাথে মেয়েটা বেহুশ হয়ে গেলো।সে জ্ঞান হারাতে হারাতে বললো,
-‘কেও ছুইয়ো না আমাকে।কেন বুঝোনা তোমরা?তোমরা আমাকে ছুলে আমার যে খুব কষ্ট হয়।মনে হচ্ছে শরীর টাকে কেও ছিড়ে খাচ্ছে।ছুইয়ো না আমাকে তোমরা।’
এইভাবে বিড়বিড় করতে করতে মেয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।সবাই স্বস্তির হাফ ছাড়লো।রাগিবের বুকে তীরের মতো বিধেছে মেয়েটির বলার কথা।চোখে পানি তার। দেয়ালের সাথে ঠেস মেরে দাড়িয়ে আছে সে।ভরশূন্য লাগছে নিজেকে।শক্তিটুকু নেই যে দাড়াবে কথা বলবে।ডাক্তার বাহিরে যাওয়ার সময় বলে গেলো,
-‘কাম ইন টু মাই কেবিন মিস্টার রাগিব।’
রাগিব মুখ চেয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে।বুকটা অসহ্য ব্যাথা করছে।কিভাবে সে সম্মুখীন হয়ে দাড়াবে মেয়েটার।কিভাবে বলবে সে তার সাথে কি হয়েছিলো।নিজেকে গোলকধাঁধার প্রানী মনে হচ্ছে।মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে।আশেপাশে কি হচ্ছে তার মাথায় ঢুকছে না।তার মন আর মস্তিষ্কে একটাই কথা চলছে,
-‘তাকে পারতেই হবে সবকিছু।’
.
ডাক্তারের কেবিনে ঢুকছে রাগিব।চোখমুখ মুছে ফ্রেশ হয়ে যায় সে ডাক্তারের কাছে।রাগিব দরজার বাহিরে থেকে বললো,
-‘মে আই কাম ইন?’
ডাক্তার বললো,
-‘প্লিজ কাম।’
রাগিবকে ঢুকতে দেখে ডাক্তার তার কেস স্টাডি করা বন্ধ দিয়ে চশমা টা খুলে চোখ কচলে নিলো।তিনি রাগিবকে ইশারায় বসতে বললেন।রাগিব গুটিশুটি মেরে চেয়ারে বসলো।ডাক্তার কিছুক্ষন রাগিবের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর বললো,
-‘আমি এখন যা বলবো তা দয়া করে মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।আর বুঝার চেষ্টা করবেন।’
রাগিব মুখ উঠালো।তারপর মাথা ঝাকালো।
ডাক্তার বললো,
-‘ফার্স্ট অফ অল দিস ইজ এ রেইপ কেস।আপনি যখন উনাকে এখানে আনেন উনার ৮৫% এরও বেশি শরীরটা ক্ষতবিক্ষত।জরায়ুমুখের বিভিন্ন ধারালো ছুড়ি চালিয়ে তার সেন্সিটিভ জায়গাটা নষ্ট করে দিয়েছে।তার মাথায় সম্ভবত খুব জোরে লোহা জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করেছিলো তারা।শরীরের প্রতিটা অংশে বিভিন্ন কামড় আর আচড়ের দাগ।তলপেটে লম্বা দাগ ও ছিলো।বলতে গেলে পুরো শরীর টাকে কেও খুবলে ছিড়ে খেয়েছে।’
ডাক্তার এইসব বলার পর থামলো।এদিকে ডাক্তারের কথা শুনে রাগিবের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পরছে।রাগিবের দিকে নিজেও চোখে জল নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ডাক্তার।
ডাক্তার নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আবারো বলা শুরু করলো,
-‘আপনাকে এইসব বলার কারন আপনি উনার পিতা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন আমাদের কাছে।অনেক রেইপ কেস দেখেছি আমি আমার চুয়ান্ন বছর জীবনে কিন্তু এতোটা নির্মম ভাবে কেও কাওকে রেইপ করবে এটা দেখি নি।আমি জানি না আপনি উনাকে কার চেহারা দিয়েছেন।সে বয়সে ২৪ বছরের মেয়ে হলেও তার মস্তিস্ক এখন ছয়বছরের মেয়ের।তার সাথে যা হয়েছে সে হয়তো মনে রাখে নি কিন্তু যে কেও তাকে স্পর্শ করলে তার পুরোনো অতীত মনে পরে যাবে।আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম আপনি উনাকে স্পর্শ করলে শান্ত হয় উনি কিন্তু বাকিরা করলে কেমন করে দেখেছেনই তো।৮৫%ড্যামেজ আর সেই সাথে তিনবার প্লাস২সার্জারির ফলে তার মেমোরি পুরোপুরি ড্যাম হয়ে গেছে। অর্থাৎ তার কিছুই মনে নেই।যার ফলে সে কিছুই চিনতে বা জানতে পারছে না।’
রাগিব উঠে যেয়ে ডাক্তারের পা ধরে বললো,
-‘প্লিজ আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে দেন।আপনার পায়ে ধরছি!’
রাগিব এইভাবে নানান আকুতিভরা কন্ঠে ডাক্তারকে বলতে লাগলো।ডাক্তার লজ্জা পেয়ে বললো,
-‘প্লিজ আমাকে লজ্জা দিবেন না মিস্টার রাগিব।আপনি অনেক শক্ত মনের মানুষ।দুই বছর ধরে দেখছি আপনাকে।প্লিজ বসুন।’
ডাক্তার রাগিবকে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।পানি এগিয়ে দিয়ে খেতে বললো তাকে।রাগিব পানি খেয়ে মুখ মুছলো।
ডাক্তার বললো,
-‘আপনার করনীয় হবে আপনার মেয়েকে নতুন নাম দেয়া।নতুন ভাবে বাচঁতে শিখাতে হবে।নতুনভাবে চলতে শিখাতে হবে।বড় মেয়েকে আবারো হাতে ধরে শিখাতে হবে।মেয়েকে এই জাহিল দুনিয়ার সাথে পরিচয় করাতে হবে।শেখাতে হবে বাচঁতে হলে লড়তে হবে।শিখাতে হবে জানাতে হবে।জীবন টা খেলনা নয়।তার বাচাঁ হায়াতে আছে বলে এতো নির্মম কিছুর পরও আল্লাহ তাকে বাচিয়ে রেখেছে।তাকে বাচঁতে হবেই।’
রাগিবের মাথায় একটাই কথা চলছে,
-‘তাকে পারতেই হবে।তার মেয়ের জন্য করতেই হবে।জয় হতেই হবে এই জাহিল দুনিয়ার নতুন খেলায়।’
চলবে
[আজকের পর্ব লিখতে যেয়ে নিজেই কান্না করে দিসি আমি]