#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#সাতাশ
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
প্রয়াসের বাবা আজ অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন। তার মা আজ স্বামীকে কিছুতেই ছাড়তে চাইলেন না। কিন্তু স্বামীর জেদের কাছে তাকে হার মানতে হলো। মন সায় না দিলেও যেতে দিলেন।
আরিফুর রহমান, মিনু বেগমকে হাসি মুখে আশস্ত করেন, তিনি নিজের খেয়াল রাখবেন। তাকে নিয়ে যেনো চিন্তা না করে।
আরিফুর রহমান গাড়িতে বসে আছেন। আজকে তার মনও যেতে চাইছে না, কিন্তু আজকের কাজটা খুবই গুরুত্বপুর্ন তাই যেতেই হবে। আসার সময় মিনু বেগমের মন খারাপ দেখে তার মন ও খারাপ হয়ে গেছে।
মিনু বেগম তাকে বড্ড ভালবাসে তিনি তা বুঝতে পারেন।অনেক দ্বায়িত্বশীল আর যত্নবান মিনু বেগম। ভাগ্য করে এমন স্ত্রী পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে তিনি যখন মিনু বেগমকে দেখেন তখন তার ভাই আলতাফ রহমানের উপর যে রাগ করেছিলেন তার জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবেন। সেদিন যদি আলতাফ বিয়ে না করতো তাহলে হয়তো মিনু আমার স্ত্রী হতো না।
★★★
সনি অনেকদিন বাসা থেকে বের হয়না। আজ রহিমের সাথে দেখা করতে এসেছে। রহিম অনেকদিন ধরে বলছে দেখা করতে।
রহিম দাড়িয়ে আছে সনির জন্য কলেজ গেইটে।
সনি এগিয়ে যায় হাসি মুখে, “কিরে কেমন আছিস?”
“এইতো ভালো। তুই?”
“হুম, ভালো আছি।”
“আর কেউ আসেনি?”
“না, আর কাউকে বলিনি।”
“আচ্ছা চল, অনেকদিন ফুচকা খাইনা। আজ তুই ফুচকা খাওয়া।”
“আমার কাছে টাকা নাই। তাছাড়া তুই কি আমার কাছে টাকা জমা রাখছিস?”
“কেন জমা রাখা লাগবে কেন? এইটা আমার অধিকার।”
“কিসের অধিকার, আমি তোর কি?”
তুই আমার..! বলতে গিয়েও বললো না সনি।
কথা ঘুরিয়ে বলে, “চল দাড়িয়ে কথা না বলে হাঁটি।”
আস্তে করে রহিম বলে, “চল।”
রহিম ভেবেছিলো আজকে অন্তত সনি তাকে ভালবাসি বলবে। কিন্তু.!
“কিরে রহিম কি ভাবছিস?”
“কিছু না।”
“কাল রেজাল্ট দিবে কি করবি তারপর?”
“ইচ্ছে আছে অনার্স করার। দেখা যাক কি হয়!”
“তুই স্কলারশিপের জন্য আবেদন করবি না?”
“জানিনা, দেখা যাক।”
“তুই করবি”
সনি বলে, “হুম করবো।”
“যদি স্কলারশিপ পেয়ে যাস,মনে রাখবি আমাকে সনি?”
কি জানি রাখতে পারি, আবার না-ও রাখতে পারি।”
এমন উত্তরে রহিম অনেক আহত হলো। সাথে অভিমান ও হলো। মনের ভেতরে অনেক ভাবনা উঁকি দিতে লাগলো।
অন্যদিকে সনি আড় চোখে তাকায় রহিমের দিকে।আর মুখ টিপে হাসে। হয়তো সে বুঝতে পারছে রহিমের মনে কি চলছে।
★★★
সকাল ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে। সাবার সাথে সবচেয়ে বেশি কথা হয় বন্ধুদের মাঝে। বাড়ি থেকে সকালকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে কিন্ত সে জানিয়ে দিয়েছে এখন সে বিয়ে করতে পারবে না। এখন বয়স সাতাশ চাকরি করে। বিয়ে করার উপযুক্ত সময় তারপরও কেন যেন বিয়ে করতে মন সায় দিচ্ছে না। তবে সাবার বিয়ের কথা শোনার পর থেকে কিছু একটা অনুভব করে সাবার জন্য। তবে তা কখনো পাত্তা দেয়নি।ভেবেছে হয়তো এতো বছরের বন্ধু বিয়ে হয়ে যাবে শুনে খারাপ লাগছে। কিন্তু আজকাল একটু বেশিই মিস করে সাবাকে।
শশী ও তো বন্ধু কই তাকে তো এতোটা মিস করে না! সাবার বিয়ের আর একমাস বাকী।
সুচির পরিবার থেকে তাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। মধ্যেভিত্ত পরিবার সুচিদের। বাবা নেই, এক ভাইয়ের আয়ে সংসার চলে। তাই তার মা চায় তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু সুচির অনেক স্বপ্ন সে পড়ালেখা করবে। তাছাড়া সে ভালবাসে রাহাতকে। রাহাত তার ক্লাসমেট। প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক দেরি। এখন পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে সবদিক থেকে সমস্যা। সুচির আজ খুব কষ্ট হচ্ছে বাবাকে খুব মিস করছে।যদি বাবা থাকতো তাহলে হয়তো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়ার কথা ভাবতো না। সব মিলিয়ে খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে তার।
“আসলে আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের খুব বেশী স্বপ্ন দেখতে নেই। কারণ, অভাব আর প্রয়োজনের কাছে সব স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে হয়। বিয়ে নামক শব্দটার কাছে সব শেষ করে দিতে হয়। বাকিটা জীবন কাটাতে হয় সেই ভাঙ্গা মন নিয়ে। অথচ উপরে ভালো থাকার অভিনয় করে যেতে হয়।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের স্বপ্ন দেখাই উচিত নয়। কারণ তাদের জীবন যায় মানিয়ে নিতে নিতে!
রোদ এসেছে রাহাদের বাসায়। রিফাত মেঘলা সবাই এসেছে।প্রয়াস ও এসেছে। আজকে বারবিকিউ পার্টি করবে তারা। আর দুই পরিবারকে নিয়ে কথা বলবে। রোদের মাথা ব্যাথা করছে। রাহা তার শ্বশুরবাড়ি তাই রাহার রুমে ঢুকে একটু রেস্ট নিতে এসেছে। কারণ এদিকটা নিরিবিলি। ওইদিকে সব ভাইবোনেরা হইচই করছে।
রোদ এসে রাহার বারান্দায় দাঁড়ায়। সন্ধ্যা নেমে আসছে, হালকা বাতাস বইছে, চারদিক খুব সুন্দর লাগছে। রোদের বারান্দায় আসায় অনেকটা আরাম লাগছে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিচ্ছে এমন সময় পেছন থেকে কেউ তার চোখ ঢেকে ধরে। রোদ এই স্পর্শ কার জানে।
তাই আদুরে গলায় বলে, “প্রয়াস।”
অনেকদিন পর রোদের মুখে নিজের নাম শুনে মনের ভেতর অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে প্রয়াসের। অনেক শান্তি লাগছে তার।
রোদের পাশে দাড়াতে দাড়াতে বলে, “তুমি সবসময় কিভাবে বুঝে যাও যে আমি?”
রোদ আলতো করে হেসে বলে, “সিক্রেট!”
প্রয়াস ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে, “সিক্রেট? তা ম্যাডাম সিক্রেট কি বলা যায় না?”
“উঁহু!” তারপর দুজন কিছুক্ষণ চুপ!”
প্রয়াস বলে, “রোদ!”
“হ্যাঁ, বলো না?”
“আমার ভয় করছে কেন যেন। জানিনা সব ঠিক কবে হবে?
রোদ প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “আমি জানিনা কি হবে। তবে এটা জানি তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। যাই হয়ে যাক। তোমাকে আমার চাই।”
প্রয়াসের কানে যেন নুপুরের ঝংকারের মত শোনা যাচ্ছে। রোদ কখনো এতোটা আবেগ দিয়ে কিছু বলে না। বরাবর সব কিছু চেপে রাখে। আজ খোলাখুলি এই কয়েকটা কথা যেন তপ্ত মরুভূমিতে একফোঁটা শিশির বিন্দুর স্বাদ পেলো। এই কয়েকদিনের দুশ্চিন্তা যেন মুহূর্তেই উবে গেলো।
“আমাদের সবার জীবনে এমন কেউ থাকে যার কাছে আসলে মন আর মস্তিষ্কের সব রকম রক্তক্ষরণ মুহুর্তেই উবে যায়।মন ভরে যায় প্রশান্তিতে।”
আজকের এই মুহুর্তে ঠিক এমনই মনে হচ্ছে প্রয়াসের। মনের ভেতর যে অসহ্য যন্ত্রনা লুকিয়ে ছিলো তা যেন রোদের এই কয়েকটা ম্যাজিক্যাল শব্দে চলে যায়।আর রেখে যায় মনের গহীনে অদ্ভুত কিছু অনুভূতি যা কোন শব্দে প্রকাশ করা যায় না। যায় শুধু অনুভব করা।
রোদ বারান্দায় গোল যে সোফা আছে সেটায় গিয়ে বসে। প্রয়াসকে ইশারায় বুঝায় পাশে বসতে। প্রয়াস ও বাধ্য ছাত্রের মত রোদের পাশে বসে।সন্ধ্যা নামার এই মুহুর্তটা রোদের খুব প্রিয়। প্রায় সে এই মুহুর্তটা একা একা ছাদে কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনুভব করে। আজ ওইসব দিনের চেয়ে একটু বেশি ভালো লাগছে কারণ আজ পাশে আছে সেই আকাঙ্ক্ষিত মানুষটি।
দুজনের দৃষ্টি আকাশের দিকে।প্রয়াস রোদের হাত মুঠোয় নিয়ে নেয়। তখনও রোদের দৃষ্টি আকাশ পানে। কোনরকম চমকালো না রোদ প্রয়াসের স্পর্শে। যেন সে জানে ঠিক এই মুহুর্তে এই কাজটি প্রয়াস করবে। রোদের দৃষ্টি আকাশে আর প্রয়াসের দৃষ্টি রোদে।
আচমকা রোদ প্রয়াসের কাঁধে মাথা রাখে। প্রয়াস একটু চমকায় কিন্তু কিছুই বলেনা। শুধু মনের অজান্তে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয়, “পাগলি!”
★★★
রিফাত আর প্রয়াস বসে আছে এক পার্কে। তাদের প্ল্যান মোতাবেক কাজ করলে তারা সিউর তাদের বাবা আর চাচার মাঝে সব দূরত্ব ঘুচে যাবে।
এসব নিয়ে কথা বলতেই প্রয়াসের ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে আব্বু!
অপরপ্রান্ত থেকে কেউ বলছে, “এই ফোনটা যার তার এক্সিডেন্ট হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে চলে আসুন।” লোকটি ঠিকানা দেয়।
প্রয়াসের হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। তার মস্তিষ্ক একদম ফাঁকা লাগছে তার। কি হবে এবার? কিছু হবেনা তো আব্বুর?
হাসপাতালের কেবিনে বসে আছেন আল মাহমুদ রহমান। একটু আগে আরিফুর রহমানের জ্ঞান ফিরেছে। এতোবছর পর ছোট ভাইকে সামনে দেখে বুকের ভেতর পুরনো অনেক ব্যাথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু তিনি শক্ত থাকার ভাব করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন।
আল মাহমুদ রহমান মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে। তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছে। কোন একটা অদ্ভুত কারণে তাকাতে পারছেনা ভাইয়ের দিকে। এতোগুলো বছর পর দেখা হওয়ায় হয়তো সাহস হচ্ছে না তাকাতে।
শেষ যখন দুই ভাইয়ের দেখা হয়েছিলো দুজনের মাথার চুল ছিলো কালো। শরীর ছিলো তরতাজা। কিন্তু আজ ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে কতগুলো বছর হয়ে গেছে কালো চুল সাদা হয়ে গেছে। শরীরের চামড়া কিছুটা ঝুলে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে।
ইশ! কতগুলো বছর চলে গেলো। কেন এমন হলো??
কেন এর আগে ভাইয়ের কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে নিলেন না।তাহলে হয়তো এতোগুলো বছর জীবন থেকে হারিয়ে যেতো না।
আরিফুর রহমানের মনেও একই কথা ভাসছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তার ছোট ভাইটির চুলে পাক ধরেছে। শরীরে বয়সের চাপ পড়েছে। জীবন কত কঠিন!
জীবনে এই রাগ, ইগো ক্ষোভ মানুষের জীবন থেকে কতকিছু কেড়ে নেয়। ভালবাসা, সম্পর্ক, স্নেহ, মায়া,মমতা,সব কেমন যেন হেরে যায় এই ইগো নামক শব্দটার কাছে!
কেন আমরা মানুষ জাতি এমন?
আমরা তো সৃষ্টির সেরা জীব।আমাদের উচিত সবাইকে ক্ষমা করে দেয়া।ভালবাসাকে ইগোর চেয়ে বেশী মূল্য দেয়া। তারপরও কেন আমরা অন্যকে ক্ষমা করতে পারি না? কেন ভালবাসাকে ভুলের উর্ধ্বে জায়গা দিতে জানি না! আমরা যে শ্রেষ্ঠ তার প্রমাণ দিতে জানি না।
আমাদের এই একটু ইগোর জন্য আমাদের জীবন থেকে কত যে মূল্যবান সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় তা আমরা বুঝতে ঠিকই পারি! কিন্তু ততদিনে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় মুল্যবান সম্পর্ক আর সময়।
আরিফুর রহমান প্রয়াসের নাম ধরে ডাকছেন আর বলছেন, “এই ভদ্রলোক এখানে কি করছে? উনাকে এখান থেকে চলে যেতে বলো প্রয়াস, প্রয়াস, এই প্রয়াস?
প্রয়াস সহ সবাই বাইরে দাড়িয়ে আছে। কেউ ভেতর আসেনি, কারণ তারা দুইভাইকে একা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু বাবার ডাকে ভেতরে আসে প্রয়াস।
“বাবা তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেনো? তোমার শরীর খারাপ করবে।”
আরিফুর রহমান শান্ত হয়ে যান। আচমকাই আল মাহমুদ ভাইয়ের হাত চেপে ধরে হাতের উপর শুয়ে কান্না করতে থাকেন। আরিফুর রহমানে ঘটনার আকস্মিকতা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে। হঠাৎ তার কলিজার টুকরা ছোট ভাইয়ের কান্না তার বুকের ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রনা করতে থাকে।
আরিফুর রহমান বলেন, “এতোগুলো বছর পর কেনো আসলি? আমিতো নিজেকে শক্ত করে নিয়েছি। আবার আমাকে কষ্ট দিতে এসেছিস? আআআমি” এতোটুকু বলে তিনি আর কিছু বলতে পারলেননা।
সব কথা ধলা ফাঁকিয়ে গলায় আটকে গেছে।কান্না করতে থাকেন নিশব্দে। মাঝে মাঝে কান্নার ধমকে হেচকি উঠে। কান্নার ধমকে সারা শরীর কাঁপছে।
আল মাহমুদ রহমান একটা কথাই বলেন, মাফ করে দাও ভাই।মাফ করে দাও?”
আরিফুর রহমান ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরেন। আল মাহমুদ রহমান ভাইয়ের বুকের উপর গিয়ে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদেন।
প্রয়াস বাইরে থেকে সবাইকে ভেতরে আসার ইশারা করে। সবার চোখে জল মুখে হাসি। এতোবছর পর সব মান অভিমানের পালা শেষ হলো তাহলে! আজ সবাই বুঝতে পারছে এই দুজন মানুষের উপরে রাগের ভেতর কতটা ভালবাসা স্নেহ চাপা পড়ে ছিলো দুজনের জন্য! দুজন কত ভালবাসে দুজনকে। কতটা মিস করেছে দুজন দুজনকে! আর এই ভালবাসার গভীরতা কতটুকু তা আজ উপস্থিত সবাই বুঝে গেলো।
রোদ তার মায়ের পাশে দাড়ানো ছিলো। আজ রোদের মনে অনেক শান্তি বিরাজ করছে। আজ শুধু দুটি পরিবারের মিলন হলো না। আজ রোদ আর প্রয়াসের ভালবাসা পূর্নতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেলো। তাদের নিজ থেকে আর কোন কষ্ট করতে হলো না দুই পরিবারের মিল করাতে। এসব ভেবে রোদের মুখে বারবার হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। প্রয়াসের দিকে একবার তাকাতেই রোদ বুঝতে পারলো প্রয়াস এতোক্ষন তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। চোখাচোখি হতেই প্রয়াস রোদকে চোখ মেরে দিলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় রোদ একটু ভড়কে যায়।চারপাশে তাকিয়ে দেখে, কেউ দেখছে কি না?
যখন বুঝতে পারে কেউ দেখেনি।তখন সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
আর প্রয়াসের দুষ্টুমিতে মনের খুশী আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়।
★★★
সুচি আর রাহাত বসে আছে পাশাপাশি। সুচিকে গতকাল দেখে গেছে পাত্রপক্ষ। তাদের পছন্দ হয়েছে সুচিকে। সুচি পছন্দ হওয়ার মতো মেয়ে।
পরীক্ষায় ‘এ’ গ্রেড পেয়ে দুজনে পাশ করেছে। এখন ভর্তি হওয়ার সময়। এই সময় যদি বিয়ে হয়ে যায় পড়াশোনা হবে না।
দুজনে চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু দুটি মনেই কি ভিষণ যন্ত্রনা হচ্ছে তা চুপ থেকে দুজন অনুভব করছে। এটাই হয়তো ভালবাসা।
কাঠের বেঞ্চিতে রাখা সুচির হাতের উপর হাত রাখে রাহাত। রাহাতের হাতের স্পর্শ পেতেই সুচির সব কষ্ট কান্না হয়ে বেড়িয়ে এলো। কান্নার ধমকে সুচির শরীর কাঁপছে। সুচির কান্না দেখে রাহাতও কান্না করে দেয়।
সুচি রাহাতকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা অবস্থায় দুজনেই কাঁদছে।দুজনের মনে ভালবাসা বন্ধুত্ব হারানোর ভয় ঝেঁকে বসেছে। সুচি বা রাহাত কোনদিন বুঝেনি এর আগে যে তারা একে অপরকে কতটা ভালবাসে।
“কেউ যখন সবসময় কাছে থাকে বুঝা যায়না সে ঠিক কতটা আপন, কতটা কাছের! দূরে যেতে চাইলে বুঝা যায়।”
রাহাত আর সুচির অবস্থা সেরকমই এখন। দুজন চাইলেও এখন বিয়ে করতে পারবেনা। দুজনই সমবয়সী। রাহাত মাত্র ইন্টার পাশ করেছে। এমন সময় একজন মেয়ের বিয়ে দিলেও। একজন ছেলেকে বিয়ে করাতে নারাজ আমাদের সমাজ।কারণ মেয়েদের বিয়ে হতে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়না। কিন্তু ছেলেদের হয়। আর একজন বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দিতে কোন পরিবারই চায় না। এইজন্য কত ভালবাসার সমাপ্তি ঘটে যায় কে তার খবর রাখে।
কান্না থামিয়ে সুচি হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছে বলে, “রাহাত তুই আমাকে ভুলে যাবি।কারণ আমরা চাইলেও এক হতে পারবো না। তুই যত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে যাবি ততই তোর জন্য ভালো।”
রাহাত এই কথা শুনেই রেগে যায়। কপাল কুচকে বলে, “ভুলে যাবো? তুই এটা আমার সাথে করতে পারিস না?”
“আমি কিছুই করছিনা। আমার পরিবার আমার বিয়ে দিচ্ছে। আমি কি করবো?”
রাহাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “ঠিক বলেছিস তুই বিয়ে করছিস না। তুই তো কচি খুকি! আরে তোরা মেয়েরা এমনই!”
সুচি কথাটা শুনে রেগে যায়। সে রাহাতকে হারানোর ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর রাহাত তাকে দোষ দিচ্ছে!!
সুচি বলে, “ঠিক আছে তুই এখন আমার পরিবারের কাছে গিয়ে বলবি আমাকে বিয়ে করবি। পারবি বলতে?
তুই এখনও পড়াশোনা শেষ করিসনি। তোর হাতে আমাকে কোনদিন আমার পরিবার দিবে না।আমি কি করবো তুই বল?”
রাহাত এবার আরও রেগে গিয়ে বলে, “তোরা মেয়েরা এমন কেন? প্রেম করার সময় বেকার ছেলের সাথে করবি। আর বিয়ের সময় প্রতিষ্ঠিত ছেলে খুজিস! এতো স্বার্থপর কেনো তোরা? তুই দেখিসনি আমি তোর সাথে একই ক্লাসে পড়ি। আমি বেকার?”
“তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমিতো জানতাম না আমার পরিবার এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবে। ভেবেছি তুই আর আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করবো। এখন পরিস্থিতি বিপরীত দিকে।আমি কি করবো বলে দে?”
“কিছু করতে হবেনা তোকে, বিয়ে কর গিয়ে।”
সুচি রাহাতকে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, “প্লিজ রাগ করিসনা।কিছু একটা কর। আমি তোকে খুব ভালবাসি। তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।” কান্নার গতি আরও বেড়ে গেছে সুচির।
রাহাতের বুকের সাথে লেপ্টে আছে সে। কিন্তু রাহাত ঠায় দাড়িয়ে আছে। সুচিকে ধরছে না। কিন্তু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। সুচির চুল ভিজে যাচ্ছে রাহাতের চোখের পানিতে।
রাহাতের কোন কথা শুনতে না পেয়ে, সুচি অনেক্ষণপর রাহাতের বুক থেকে আলগা হয়ে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে রাহাতের দিকে। কিন্তু রাহাতের দৃষ্টি তখন মাটিতে। সুচি অনেক সময় পর রাহাতের চুপ থাকা দেখে, আস্তে আস্তে পেছাতে থাকে। অনেকটা দূরত্বে গিয়ে দৌড় দেয়।
ততক্ষণে রাহাত হাটুগেড়ে মাটিতে বসে জোরে চিৎকার করে কান্না করে পাগলের মত। মুখ থেকে একটা বাক্য বের হয় অস্ফুটে “সুচি!”
★★★
আরিফুর রহমান এখন একদম সুস্থ। বাড়িতে নিয়ে আসা হয় উনাকে। আল মাহমুদ রহমান সারাক্ষণ ভাইয়ের সেবা করেন।দুই পরিবারের সবাই খুশী উনাদের ভালবাসা দেখে।
এদিকে রোদ প্রয়াসের ভালবাসার দিনগুলো ভালো কাটতে লাগলো। দুজনে আজকাল বেশী কাছে থাকতে পারে।
দেখতে দেখতে রোদের স্কলারশিপের জন্য পরীক্ষা চলে আসে।পরীক্ষার জন্য দিনরাত এক করে পড়ালেখা করছে রোদ।
পরীক্ষা দিয়ে এসে বাসায় একটু রেস্ট নেয়। এমন সময় প্রয়াস আসে রোদদের বাসায়। রোদের মা অনেক স্নেহ করেন প্রয়াসকে।
রোদ তখন নিজের রুমে ঘুমাচ্ছিলো। প্রয়াস রোদের মাকে বলে, “রোদের পরিক্ষা কেমন হয়েছে মেঝো মা?”
“এই কয়দিন পড়ার জন্য ঘুমাতে পারেনি। আজ এসেই ঘুমিয়ে গেছে। রুমে আছে যাও না ডেকে জিজ্ঞেস করো?”
প্রয়াস ইতস্ততভাবে বলে, “না ঠিক আছে, ঘুমোক।”
রোদের মা বলে, “যাও ডেকে দাও।অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে নাস্তা করতে ডাকো।” বলেই রান্না ঘরে চলে যান তিনি।
প্রয়াস ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রোদের রুমের দিকে। যত এগুচ্ছে তত বুকের ভেতরকার শব্দ বেড়ে যাচ্ছে। প্রথমবারের মত যাচ্ছে রোদের রুমে।
রুমের সামনে আসতেই,চোখে পড়ে রুমের সামনের একটা বড় বড় অক্ষরে লেখা কাগজ টানানো।
লেখা আছে “রোদের নীল রাজ্যে স্বাগতম”
নীল রাজ্যে দেখে প্রয়াস একটু ভড়কে যায়। রোদ প্রায় সব কিছুর কথা বলেছে তাকে। কিন্তু রুমের এই ব্যাপারটা বলেনি কখনো। অবশ্যই একদিন বলেছে তার কাছে তার রুম স্বর্গ।
এবার নীল পর্দা ভেদ করতেই দেখতে পায়। রুমের সামনে দরজা নেই। থাই গ্লাস দেয়া, অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তার রঙও নীল।
রুমে প্রবেশ করতেই খেয়াল করলো চারপাশের দেয়াল নীল।নীল দেয়ালে কয়েকটি নীল আর সাদার মিশ্রণে সিনারি টানানো। যা রুমের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে লক্ষ গুনে।বিছানার চাদর সব নীল। ড্রেসিং টেবিল নীল। ড্রেসিং টেবিলের চারপাশে সাদা রঙের ফেয়ারি লাইট জ্বালানো।
বিছানার সাইড টেবিলে একটা সাদা রঙের লাইট। সব মিলিয়ে পুরো রুম যেন স্বর্গ!
এবার চোখ যায় বিছানায় ঘুমানো রোদের দিকে। বাচ্চাদের মতো স্নিগ্ধ লাগছে।
প্রয়াস বিছানার পাশে বসে রোদের মুখের উপর পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে আলতো করে সরিয়ে দেয়। রোদের ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার দিতে নিলে প্রয়াস মুখ চেপে ধরে।
আস্তে করে বলে, “তুমি এখানে?”
“হুম দেখতে এলাম।”
“কি দেখতে এলে?”
“মেজো মাকে।”
রোদ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, “ওহ আর আমি ভাবলাম আমাকে! আচ্ছা থাক।”
“থাকবে কেনো বলে ফেলো?”
প্রয়াস বলে, “নাস্তা করতে ডাকছে আমার শ্বাশুড়ি। তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
“উঁহু আমি খাবো না।”
“আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। পরীক্ষা কেমন হলো?”
“অনেক ভালো হয়েছে।”
“দেখা যাবে কত ভালো হয়েছে।”
“দেখো” রোদ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
প্রয়াস তার দিকে ফিরিয়ে বলে, “তোমাকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে রোদ! খুব, খুব!
চলবে