মেঘের আড়ালে বৃষ্টি পর্ব -৩০

#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#ত্রিশ

#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

বর্তমান

সন্ধ্যা নেমে আসছে, চারদিকে শীতল বাতাস বইছে। সেই বাতাসে উড়ছে রোদের চুল। কফি হাতে নিয়ে আসে সুচি আর সনি। রোদের পাশে রাখা সোফায় বসে। রোদের দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দেয়। রোদ কফি নিয়ে আবার তাকিয়ে থাকে আকাশ পানে।

“কি সুন্দর লাগছে পরিবেশটা তাই না রোদ?”

“হুম অনেক, একটু বেশীই সুন্দর।”

সনি সুচি ও স্কলারশিপ পায়। তাই তারা রোদের পরের দিন আসে আমেরিকায়।
সেদিন রাহাতের সাথে দেখা করে এসে সুচি দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিলো অনেক।

তার ভাইয়া বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে উনার স্ত্রীকে কি হয়েছে সুচির। উনার স্ত্রী সব খুলে বললে। উনি সাথে সাথে কল দিয়ে বিয়ে ভেঙে দেন। একমাত্র বোনকে তিনি পড়ালেখা করাবেন। সেই যাইহোক। বাবা নেই বলে কোন আফসোস করতে দিবে না সুচিকে।

এরপরের সপ্তাহে স্কলারশিপের খবর আসে। চলে আসে আমেরিকা সুচি।

রোদ কফির মগে চুমুক দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সনির ফোন ভেজে উঠে।

রোদ বলে, “রহিম?”

“হ্যাঁ রে। অনেকদিন কথা হয় না। আজ কথা বলবো বলে কথা দিয়েছি।”

“দাড়া ভিডিও কল দেই আমরা সবাই কথা বলবো।”

রোদ বলে, “তোরা কথা বল সমস্যা নাই।”

সনি কল দেয় রহিমকে।

রহিম বলে, “তুই সর রোদ কই?”

সনি মুখ ভেংচি দিয়ে বলে, “বাহ গার্লফ্রেন্ড রেখে জাস্ট ফ্রেন্ড ভালো তো, ভালো না!”

রহিম একটা দীর্ঘ হাসি দেয়।

রোদ আর সুচি হাসে ওদের বাচ্চামি দেখে।

রোদ সালাম দেয় রহিমকে।

“কিরে দোস্ত কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই?”

“আমিও ভালো আছি।”

“তুই কি অফিস থেকে ফিরছিস?”

“হুম কিভাবে বুঝলি?”

“ফর্মাল ড্রেসআপ দেখে।”

“তুই আগের মতই আছিস।” রহিম হাসে দীর্ঘ হাসি।

“দোস্ত খুব মিস করি তোদের, আর দেশকে। মানুষ যখন নিজের মাতৃভুমি ছেড়ে কোথাও যায় তখন বুঝে কেমন লাগে।”

“তোরা সবাই তো পড়া শেষ করে ফেলেছিস। এখন কি ফিরে আসবি না?”

রোদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”সনি, সুচি চলে যাবে।”

“তুই আসবি না?”

রোদ বাঁকা হাসে। সেই হাসির কারণ জানে রহিম।

“জানি না দোস্ত।সনির জন্য রহিম অপেক্ষা করছে। সুচির জন্য রাহাত, আর আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে না। তাহলে কেন যাবো?”

রহিমের কাছে এই প্রশ্নের জবাব সত্যি নেই। তাই কথা এড়াতে বলে, “তোর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো যে রাতুল সে তো আমেরিকায় কি খবর তার?”

“বিয়ে করেছে এখানে কিছুদিন আগে। বাঙালি এক মেয়ের সাথে ভালবেসে বিয়ে করেছে। আমিও গিয়েছিলাম বিয়েতে। অনেক সুখে আছে দুজন।”

“তোর পরিবার জানে?”

“না, জানেনা। আমিই রাতুলকে বারন করেছি। এখন রাতুল আর আমি খুব ভালো বন্ধু। এখানে আসার পর অনেক চেষ্টা করেছি রাতুলকে নিজের মনে জায়গা দিতে। কিন্তু পারি নি। রাতুল ও সেটা বুঝতে পারে। তারপর সে বিয়ে করে। আমিও মুক্ত হই। এখন প্রায় আসে। কথা হয়।”

রহিম বলে, “তোর জন্য আন্টি আঙ্কেল অনেক কাঁদে। তোকে খুব মিস করে রোদ। আমি প্রায় গিয়ে দেখে আসি। এখন ব্যাংকে চাকরি হওয়ার পর একটু সময় কম হয়। ব্যাংকারদের জীবন কেমন জানিস তো!
রিফাত ভাইয়ার মেয়েটা দেখতে তোর মত একদম।”

“জানি দোস্ত। আমিও খুব মিস করি। কিন্তু কি করবো যাওয়ার সুযোগ ছিলো না।জানিস রিফাত ভাইয়ার মেয়েকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। ছোট ছোট হাত পা গুলো টেনে দিতে ইচ্ছে করে।”

রহিম গাড় কন্ঠে বলে, “চলে আয় না রোদ। কতবছর একসাথে আড্ডা দেই না। তোর গান শুনিনা। তোর আবৃত্তি শুনি না। জীবনে আমরা এতো মানুষ তোকে ভালবাসি সেটা কিছুই না? ওই একজন সব হয়ে গেলো? যার জন্য তুই আমাদের সবাইকে কষ্ট দিচ্ছিস!
আমি কিছু শুনতে চাই না, আমাদের বিয়ে তোকে ছাড়া হবে না। তুই না আসলে সনিকে পাঠাবি না। আমি বিয়ে করবো না সনিকে।”

রোদ নরম হাসে,সুন্দর সেই হাসি। যাতে এই গোধূলীতেও রোদের ঝলকানি আছে। আছে শুভ্রতা!

রহিম রোদের হাসি দেখে বলে, “আমি সিরিয়াস রোদ। এটাই ফাইনাল। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। তুই তোর সিদ্ধান্ত জানাস।”

এতোক্ষন রোদ আর বাকি বান্ধবীরা ভেবেছে রহিম দুষ্টুমি করেছে। এখন তারা সিউর রহিম খুব সিরিয়াস।

বান্ধবীরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।

রোদ অনেক বুঝায় রহিমকে রহিম। বুঝতে চায়নি কিছুই।

সনি ফোন নিয়ে কথা বলে অনেক্ষণ। সুচি, রোদ বারান্দায় বসে আছে এখনো। রোদ গভীরভাবে কিছু ভাবছে। সুচি চেষ্টা করছে সেটা বোঝার। রোদকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে।

রাহাতের কলে হুস ফিরে সুচির। কথা বলা শুরু করে।

রহিমের সিদ্ধান্তের কথা জানায়।

রাহাত ও তাই বলে রোদ না আসলে বিয়ে হবে না।

রোদ পড়ে যায় মহা চিন্তায়। ভাবে সবাই তাকে এতো ভালবাসে। শুধু ওই একজন বাদে। আচ্ছা আমার কি কম আছে যাতে প্রয়াস ভালবাসতে পারলো না! হয়তো সত্যি কিছু কম আছে। যা প্রয়াসের চাওয়া মত হয়নি। তাই হয়তো ছেড়ে গেছে।

কেমন আছে প্রয়াস? রিমিকে নিয়ে সুখে আছে,নিশ্চয়ই। বিয়ে করেছিলো?
হুম করেছে হয়তো। এতোগুলো বছর কি বসে আছে নাকি। তাছাড়া ভালবাসার মানুষ থাকতে দেরি সয় নাকি? অবশ্যই বাবা মা অনেক বার বলতে চেয়েছেন প্রয়াস ভাইয়ার কথা। রোদ শুনেনি সেই কথা। প্রতিবার এড়িয়ে গেছেন। এই ভেবে যে যদি তার সংসার স্ত্রী নিয়ে কিছু বলে তাহলে সইতে পারবেনা সে।

সুচি সনি কথা শেষ করে এসে বসে আবার রোদের পাশে। রোদ তখনও বসে আছে।

সনি, সুচিকে দেখে রোদ বলে, “তোরা আমাকে ব্লাকমেইল করছিস?”

না বান্ধবী। ভালবাসি তোমায় খুব তাই ভালবাসা প্রকাশ করতেছি। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। তোমাকে জোর করতে চাই না। এবার তুমি ঠিক করো। তুমি কি চাও?”

রোদ চুপ করে আছে।

অনেকটা সময় কেটে যায় নিরবতায়।

সুচি বলে, “প্রয়াস ভাইয়াকে এখনো ভালবাসিস খুব তাই না রোদ? মিস করিস তাই না?”

রোদ আলতো হেসে বলে, “জানিনা ভালবাসি কিনা! শুধু জানি এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার কথা মনে পড়ে। ঘুম থেকে উঠলে তার কথা মনে পড়ে।

একটু একা থাকলেই সে এসে মনে ভীড় করে। তার স্মৃতি হাসায়, কাঁদায়,যন্ত্রনা দেয়। এমন কেন হয় বল তো তোরা। যে মানুষটা আমাকে ভুলে গেছে তাকে কেনো আমি ঘৃনা করতে পারি না? কেন সে মনের ভেতর গেঁথে থাকে সবসময়!
সে যেন আমার জীবনে “এক আকাশ মেঘের আড়ালে বৃষ্টির মতো”

যে বৃষ্টি দেখা যায় না। ছোঁয়া যায় না।
সে ও যেন আমার আকাশের সেই বৃষ্টি। মনের গভীরে যে বৃষ্টি জমিয়ে রেখেছি।যাতে মন চায় ভিজে যেতে কিন্তু পারি না।কারণ সেই বৃষ্টি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আর তাতে আমার ভেজা হলো না।”

“এখনো এমন মানুষকে তুই ভালোবাসতে পারিস কি করে? যে তোকে ঠকিয়েছে?তোর ঘৃনার ও যোগ্য না সে।” সনি কিছুটা রেগে বলে।

রোদ আলতো হেসে বলে, “ভালওবাসা হচ্ছে এমন যখন কেউ তোর হৃদয় ভেঙে দেয়। অবাক বিষয় হচ্ছে এমন!
তুই সেই ভাঙা হৃদয়ের টুকরোগুলো দিয়েও ওই মানুষটাকে ভালোবাসিস।”

“আমি হয়তো তেমনই একজন।”

“তুই কল দিয়েছিলি প্রয়াস ভাইয়াকে?”

“প্রথম প্রথম দিতাম, নিজেকে মানাতে পারতাম না তাই। অনেক টেক্সট করতাম।কিন্তু সেই কল বা টেক্সটের উত্তর না পেয়ে আরও বেশী কষ্ট পেতাম। আস্তে আস্তে কল দেয়া কমিয়ে দিতে থাকি, তার সাথে কমে যায় আমার চাওয়া ও। কমে যায় আমার কষ্ট, যা আমি উত্তরের প্রতিক্ষায় থাকার সময় পেতাম।
জানিস সেই সময়গুলোতে অন্য কেউ ফোন করলেও আমি ভাবতাম বুঝি প্রয়াস। কিন্তু যখন দেখতাম অন্য কারো কল তখন কি যে কষ্ট হতো বুঝাতে পারবো না।”

*একটা জিনিস শিখেছি জীবনে এক্সপেকটেশন যত কম, কষ্ট তত কম।কেউ যদি তার এক্সপেকটেশন জিরো লেভেলে নিয়ে আসতে পারে সেই জীবনে সফল। আর তার সাথে যুক্ত সবগুলো সম্পর্ক সফল।*

সনি বলে, “তোকে দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। এতো কিছুর পরও তুই একটা মানুষকে কিভাবে ভালবাসতে পারিস। চল না আমরা দেশে যাই। তুই না হয় কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে চল। আবার চলে আসিস।”

রোদ বলে, “গেলে যদি আসতে না দেয় আব্বু আম্মু।”

সনি বলে, “তোকে যে আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে সে যদি সত্যি আটকায় তাহলে আমাদের চেয়ে বেশী খুশী কেউ হবে না।”

রোদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, কেন আটকাবে? দিত্বীয় পত্নী করার জন্য? সরি দোস্ত এই আমি ভালো আছি। নিজের বরকে কারো সাথে ভাগ করার মত এতো উদার আমি নই।” বলেই রোদ হাসে।

সাথে হাসে সনি, সুচি।

জীবন কত কঠিন তা শুধু তারাই বুঝে যাদের জীবনে কাছের মানুষ দূরে সরে যায়।

রোদের দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সেই অশ্রু বিরহের, সেই অশ্রু তীব্র যন্ত্রনার। তীব্র অপেক্ষার। সেই অশ্রু ভালবাসার মানুষের উপেক্ষার অশ্রু!

সনি সুচি দুজন রোদকে জড়িয়ে ধরেছে এই চারটা বছরে তারা রোদের প্রতিটি যন্ত্রনার সাক্ষী! প্রতিটি জেগে থাকা ছটফট করা রজনীর সাক্ষী। কতটা তীব্রভাবে কেউ কাউকে ভালবাসতে পারে তা রোদকে দেখলে তারা বুঝতে পারে। হয়তো এমনভাবে তারা তাদের ভালবাসার মানুষদের ও ভালবাসতে পারেনি।

রোদ বন্ধুদের কথা ভেবে কান্না জড়িত গলায় বলে,টিকিট কেটে নে। আমরা সামনের ফ্লাইটে যাবো। তবে কাউকে বলতে পারবি না যে আমারা দেশে ফিরছি।এমনকি রহিম, রাহাতকেও না। রাজি হলে বল। নয়তো” একথা শেষ করার আগেই দুই বান্ধবী চিৎকার দিয়ে উঠে খুশীতে।

রোদের মুখে অনেকগুলো চুমু খায় আনন্দে।

রোদ বলে, “গাইজ তোমরা আমার ইজ্জত লুটে নিচ্ছো কিন্তু। আমার স্বামী তো আমায় চরিত্রহীন ভাববে।” বলে রোদ দুষ্টুমির চোখে হাসে।

রোদের এই কথা শুনে সনি,সুচি আবার দুগালে দুটো চুমু খায়।

রোদ গাল মুছতে মুছতে বলে, “ছিঃ তোরা যে গে হয়ে যাচ্ছিস বাসায় জানে? রহিম, রাহাতের কি হবে! আহারে আমার বেচারা বন্ধুরা।” বলেই রোদ সনি সুচিকে চোখ মেরে।

খোপা করা চুল ঝাকড়া দিয়ে দুহাতে বলে, “চল খেয়ে নিবি। কয়দিন পর বিয়ে করবি, রাত জাগলে ডার্ক সার্কেল পড়বে।

সনি সুচি দুজনে হেসে আবার জড়িয়ে ধরতে গেলে রোদ লাফ দিয়ে পেছনে গিয়ে বলে, “নো,নো,নো,একদম না। খেতে এসো। দেশে গিয়ে বয়ফ্রেন্ডদের ইজ্জত লুটে নিও। আমার না!”

সবাই একসাথে হেসে উঠে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here