#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
#চৌত্রিশ
প্রয়াস বাসায় ফিরে বারান্দায় বসে নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের মনের কষ্ট কমাতে চেষ্টায় আছে। প্রয়াস খুব একটা সিগারেট না খেলেও রোদের কথা মনে হতেই সেই সিগারেট নিয়ে বসে। মানুষ বলে নিকোটিনের ধোঁয়ায় নাকি মনের যন্ত্রনা ভুলা যায়? কিন্তু প্রয়াস এটা কখনও ভাবতে পারে না। কারণ সে এই কয়েক বছরে অনেক ধরনের নেশার সাথে যুক্ত হয়ে দেখেছে। কোন নেশাই রোদের নেশা ছাড়াতে পারে না। রিমি একবার এসে উঁকি দিয়ে দেখে গেছে প্রয়াসকে।
রিমি জানে রোদকে দেখে এসে আজ প্রয়াস অনেক চেষ্টা করবে রোদকে ভুলার কিন্তু এও জানে রিমি প্রয়াস কিছুতেই পারবে না রোদকে ভুলতে।
মাঝে মাঝে রোদকে খুব হিংসে হয়রিমির। আজকালকার প্রেমে যখন একজন অন্যজন থেকে দূরে সরে যায়। তখন ভুলতে বেশী সময় নেয় না। আর তার উপর যদি রিমির মত একটি মেয়ে সবসময় তার কাছাকাছি থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, রিমি এতো সুন্দর হয়ে ও প্রয়াসের মন আজ পর্যন্ত জয় করতে পারেনি।
মানুষ বলে প্রকৃতি শূন্যস্থান খালি রাখে না।
কিন্তু এই চারটি বছরে রিমি বুঝতে পেরেছে এই কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ এতো চেষ্টা করেও রিমি পারেনি রোদের শূন্যস্থান পূরন করতে! বরং বারবার এটা বুঝেছে রোদের জায়গা কতটা পাকাপোক্ত! বুঝতে পারে রোদের জায়গায় কেউ কখনও বসতে পারবে না। বুঝতে পারে রোদের জায়গা আদৌ কোনদিন শূন্য ছিলোই না!
রোদ তো প্রয়াসের শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে মিশে আছে তাকে কি করে সরাবে রিমি!
রিমি কান্না চোখে চলে যায় সেখান থেকে।
রাহেলা বেগম প্রয়াসের কাছে আসে। প্রয়াস বুঝতে পারে রাহেলা বেগম তার সাথে কথা বলতে এসেছে।
প্রয়াস মায়ের দিকে না তাকিয়ে বলে, “মা আমার এখন ভালো লাগছে না কথা বলতে।তুমি চলে যাও।”
রাহেলা বেগম ছেলের হাত ধরে কাদেঁন।
প্রয়াস বলে, “এখন কেঁদে কি হবে মা? এখন তো সব শেষ!”
রাহেলা বেগম ছেলের হাত ধরে বলেন, “বাবা সেদিন আমি যদি তোকে বারন না করতাম আজ তুই রোদকে নিয়ে সুখে সংসার করতি। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি আমার প্রতিহিংসার আগুনে শেষ হয়ে যাবে তোদের ভালবাসা!
আমি জানি সবকিছুর জন্য তুই আমাকে দায়ী করিস।আমি নিজে ও আমার ভুল স্বীকার করছি।
জানিস বাবা আমার বিয়ে প্রথমে ঠিক হয়েছিলো তোর বাবার সাথে না, রোদের বাবার সাথে। যেদিন থেকে আমি জেনেছি আমার বিয়ে হবে আল মাহমুদের সাথে সেদিন থেকে আমি তাকে স্বামী ভেবে স্বপ্ন দেখে এসেছি। একজন কিশোরীর তার বিয়ে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে আমিও দেখেছি। তোর বাবা আমদের বিয়ের কথা বলে আসার সময় আল মাহমুদের একটা ছবি দিয়ে এসেছিলো। সেই ছবি নিয়ে আমি প্রতি রাতে ঘুমাতে যেতাম। কতশত স্বপ্নে বিভোর ছিলাম আমি! কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন বেশী দিন স্থায়ী হলো না। তাসের ঘরের মত ভেঙে গেলো কিছুদিনের মধ্যে। আমি শুনলাম আল মাহমুদ বিয়ে করে ফেলেছে অন্য কাউকে। সেদিন আমি যে কতটা যন্ত্রনা পেয়েছিলাম। তা শুধু আমি জানি। একদিকে স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রনা অন্যদিকে। ফিরিয়ে দেয়ার অপমান এই দুয়ে মিলে আমার মনে জন্ম নিলো ক্রোধের। মনে হলো আমাকে উপেক্ষা আর অপমানেত জবাব আমি দিবো। তাই তোর বাবাকে বিয়ে করে আমি এই বাড়িতে আসি। কিন্তু আসার পর জানতে পারি, আল মাহমুদ এই বাড়িতে থাকে না।তাই হতাশ হই। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিলো আমি পাবো কোনো না কোনো সুযোগ। একদিন পেয়ে ও গেলাম। যখন জানতে পারি রোদ আর তোর সম্পর্কের কথা। তখন মনে হলো, মিনুকে আর আল মাহমুদকে শাস্তি আমি দিতে পারবো। আমি যে যন্ত্রনা পেয়েছি সেই একই যন্ত্রনা যদি তার মেয়ে পায় তাহলে তো মন্দ হয় না। আমার মনে জেগে উঠে এই আকাঙ্ক্ষা কোন না কোনভাবেই তাদের কষ্ট দিতে হবে। আর তাই হয়। আমি রোদের বাবাকে না পেয়ে যে কষ্ট পেয়েছি। সেই কষ্ট রোদ পেয়েছে তোকে না পেয়ে। এটা ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে যেতো। আমার এতো বছরের প্রতিক্ষার শেষ হয়। আর আমি জিতে যাই।
কিন্তু আজ বুঝতে পারছি আমি কখনো জিততে পারিনি।
বরং হেরে গেছি। আগে হেরেছি রোদের মায়ের কাছে। আজ হারলাম রোদের কাছে!
হিংসা কখনো ভালো কিছু আনতে পারেনা। বরং সব ভালোকে শেষ করে দেয়।আমি বুঝতে পারিনি অন্যের মেয়েকে কষ্ট দিতে গিয়ে আমার ছেলে কতটা কষ্ট পেয়েছে। সেদিন তোকে আমি কসম দিয়েছিলাম তুই যদি রোদের সাথে সম্পর্ক রাখিস আমি আত্নহত্যা করবো। তুই লক্ষী ছেলের মত মায়ের কথা শুনলি!নিজের ভালবাসা ত্যাগ করে দিলি! আর আমি কেমন মা যে তোর কষ্টটা একবারও বুঝতে পারিনি। আমার জন্য রিমির জীবনটা ও নষ্ট হয়ে গেলো। আজ আমার নিজের উপর ঘৃনা হচ্ছে। আমি হেরে গেলাম। হেরে গেলাম আমি।” কান্নায় ভেঙে পড়েন রাহেলা বেগম।
প্রয়াস বলে, “যখন কারো আশা ইচ্ছে ভেঙে যায়,
তখন সে ব্যাক্তির মন ক্রোধে ভরে যায়।
আর যে মানুষটিকে সে এর জন্য দায়ী মনে করে,
তাকে শাস্তি দিতে চায়। কিন্তু আমাদের ইচ্ছে বা আশা ভেঙে হওয়া কি সবসময় কি কারো অপরাধে হয়?
ইচ্ছে অপূর্ন থাকা অনেক কারনে হতে পারে। কিছু ইচ্ছা আল্লাহর বিধানের জন্যে ভেঙে যায়, আর কিছু ইচ্ছে নিয়তির জন্য! আবার কিছু ইচ্ছেই এমন যে যা কখনও পূরন হওয়ার মতই না। পরিস্থিতি বিচার না করে কাউকে অপরাধী ভাবা কখনও ন্যায় নয়! এটাতো প্রতিশোধ!
ন্যায়ের আধার তো ক্ষমা, ভালবাসা!
আর প্রতিশোধের আধার রাগ, অহংকার, হিংসা! হৃদয়ে ভালবাসা, আর ক্ষমা ধারণ না করে কাউকে শাস্তি দেয়াটা আরও বড় অন্যায় নয় কি মা? নিজে বিচার করে দেখো?
তুমি যদি সেদিন প্রতিশোধ না নিয়ে ভালাবাসা দিয়ে সবটা বিচার করতে তাহলে সবাই ভালো থাকতো মা। এতো গুলো জীবন হয়তো শেষ হয়ে যেতো না। মা আমাদের সকলের মনে রাগ হয় কিন্তু সেই রাগ যদি আমরা নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখতে না পারি তবে ধ্বংস নিশ্চিত!
আর তোমার মনে জমে থাকা রাগ আজ আমাদের জীবন শেষ করে দিলো মা!চাচ্চুতো সেজো আম্মুকে ভালবেসে বিয়ে করেছে। তিনি যদি তোমাকে বিয়ে করতেন আর সারাজীবন সেজো আম্মুকে মনে রেখে দিতেন। তুমি কি সুখী হতে মা? সেটা তো প্রতারণা হতো মা।
যে কাজটা তুমি আমার আব্বুর সাথে করে এসেছো। মনে অন্যজনকে রেখে আমার আব্বুকে ভালবাসার অভিনয় করে গেছো! যদি চাচ্চু বা সেজো আম্মু তোমার মন ভাঙার শাস্তি পায় তবে তো তোমার ও পাওয়া উচিত। আমার আব্বুর মন ভাঙার অপরাধে! আমার আব্বুর সাথে প্রতারনার অপরাধে!”
প্রয়াস কথাগুলো বলেই সামনে তাকাতেই দেখতে পায় তার আব্বু আরিফুর রহমান দাড়িয়ে আছেন! প্রয়াসের বুকের মাঝে ভয় জেগে উঠে। সে বুঝতে পারে বড় ঝড় উঠতে চলেছে। সে ঝড় কাকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ জানেনা!
আরিফুর রহমান আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাড়িয়ে চলে যান নিজের ঘরে।দরজা বন্ধ করে বসে পড়েন ফ্লোরে। তার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে।তিনি জানেন না। এই অশ্রু কিসের জন্য?
যার সাথে এতোগুলো বছর ভালবেসে সংসার করেছেন সে উনাকে ভালবাসেনি কখনও এই জন্য নাকি এতোগুলো বছর ঠকে যাওয়ার জন্য?তাহলে কি রাহেলা এতোদিন আমার সাথে সুখে থাকার অভিনয় করে গেছে!কোনদিন ভালবাসেনি আমায়! তার মনে সর্বদার জন্য ছিলো তারই ছোট ভাই!আর রোদ আর প্রয়াসের জীবন নিয়ে রাহেলা বেগম যে কাজ করছে সেটা কি! এই অপরাধের কোন ক্ষমা হয়? নিজের স্বার্থ আর প্রতিশোধের জন্য কেউ এতোটা নিচে নামতে পারে?
নিজের সন্তানের ভালবাসা পর্যন্ত শেষ করে দিতে পারে কি করে?
সব প্রশ্ন যেন আরিফুর রহমান সাহেবের মাথায় বুকে অসহ্য যন্ত্রনার সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে রাহেলা বেগমের অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। এই এতোগুলো বছর সংসার করে তিনি যে তার স্বামীকে ভালবেসে ফেলেছেন। সেই কথা কি বিশ্বাস করবে আরিফুর রহমান?
★★★
সবাই খাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে যায়।
এইদিকে রোদ সনি, সুচি,রহিম,আর রাহাতকে ডেকে নিয়ে গেলো আবার ছাদে। বন্ধুরা কেউ বুঝতে পারছে না। রোদ কেনো তাদের আবার ছাদে নিয়ে আসে!
রোদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বান্ধবীদের জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকে।অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে শুধু হাসছে না।তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে! কিন্তু কারণ কেউই জানেনা!
রাহাত বলে, “দোস্ত বান্ধবীদের জড়িয়ে ধরলি। আর বন্ধুদের ধরলি না। এটা কেমন বিচার?”
বান্ধবীরা সবাই এবার একযোগে হাসে।
রোদ কিছুক্ষন জোরে দম নিয়ে বলে, “দোস্ত প্রয়াস ইচ্ছে করে আমাকে ছাড়ে নি। তার মা মানে আমার বড় আম্মু বলেছে বলে আমাকে ছাড়ছে। প্রয়াস আমাকে ভালবাসে এখনো। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে রোদ।আমার ভালবাসা মিথ্যে নয়। আমি ভুল মানুষকে ভালবাসি নি। এই চারটি বছর আমি যেমন প্রয়াসের জন্য কষ্ট পেয়েছি। প্রয়াস ও পেয়েছে আমার জন্য কষ্ট। প্রয়াস শুধু আমার শুধু আমার!”
রোদের কণ্ঠে কেমন সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে।বন্ধুরা সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারে।
রোদ দু’হাত উপরে তুলে আকাশের দিকে মুখ করে ঘুরতে থাকে। আর মুখে বলতে থাকে প্রয়াস আমাকে ভালবাসে।প্রয়াস আমাকে ভালবাসে।
বন্ধুদের সবার মুখে হাসি কত বছর এভাবে মন খুলে হাসতে দেখেনি রোদকে।এতোটা খুশী হতে কবে দেখেছে রোদকে তারা ভুলে গেছে!
রহিম বলে, “সবই বুঝলাম দোস্ত কিন্তু তাহলে প্রয়াস ভাইয়া রিমিকে কেনো বিয়ে করলো?”
এই কথাটি কানে যেতেই রোদের মুখে অন্ধকার নেমে আসে।
রোদের এখন মনে পড়ে আসলেই তো রিমিকে কেনো বিয়ে করে প্রয়াস?বিয়েটা যদি তার মায়ের আদেশে করেও। ওই বাচ্চাটা সেটা কি করে এলো? প্রয়াস রোদকে এখনো যদি ভালবাসে? তাহলে রিমির বাচ্চার বাবা কি করে হতে পারলো?
না আর চিন্তা করতে পারছে না।রোদ মাথায় অসহ্য ব্যাথা করছে।একটু আগের মনে জায়গা করে নেয়া সুখটুকু মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেলো।
প্রয়াসের সাথে দেখা করতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি সব প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে। আর এভাবে বসে থাকা যাবে না।
রোদ ঠিক করে কালই প্রয়াসের সাথে দেখা করবে। উত্তর চাই সব প্রশ্নের উত্তর!
চলবে…