মেঘের আড়ালে বৃষ্টি পর্ব -৩৫

#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি

#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
#পঁয়ত্রিশ

সনি, সুচির বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। সনি, সুচি, রহিম,রাহাত একসাথে এসেছে রোদকে খবরটা দিতে।

বন্ধুরা এসেই মিনু বেগমকে বলে, “আন্টি রোদ কোথায়?”

“আছে বাবা, রোদ ওর ঘরে আছে। কাল থেকে বের হচ্ছে না। বলতেছে মাইগ্রেনের ব্যাথা করছে তাই খাবার ঘরে গিয়ে দিয়ে এসেছি। চোখ মুখ ফোলা কি হয়েছে আমার মেয়েটার? কেমন অশান্ত দেখায় আসছে পর্যন্ত। সনি, সুচি মা তোমরা তো একসাথে ছিলে তোমরা কিছু জানো?”

এই প্রশ্নে বন্ধুদের কিছুটা বিচলিত দেখালো। একে অপরের মুখ দেখাদেখি করে বলে, “না আন্টি কিছু হয়নি আসলে ওর মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠলে। এমন দেখায়। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা দেখছি।”

বন্ধুরা এসে দেখে রোদ বালিশের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।

রহিম,রাহাত,দরজার সামনে দাড়িয়ে সনি, সুচিকে ইশারা করে তাদের আগে যেতে।

সনি,সুচি রোদের দুকাঁধে হাত দেয়ায় রোদ কিছুটা চমকে উঠে।
পেছন ফিরে দেখে বন্ধুদের। পাশে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে উঠে বসে।
রহিম,রাহাত ভেতরে আসে।

রহিম রোদের মাথায় ঘাট্টা মেরে বলে, “কিরে তুইতো দেখছি দেবদাস হয়ে গেছিস?”

রোদ নরম হাসে।

সনি বলে, “ছেলেদের দেবদাস বলে। আর তুই মেয়েকে বলছিস? আজব তো!”

রহিম বলে, “তুই এতো ঝগড়াটে কেন? কেন যে তোর মত দজ্জাল মেয়েরে বিয়া করতে যাইতেছি আল্লাহ জানে!” রহিমের চোখে মুখে দুষ্টুমির ভাব।

সনি বলে, “ঠিক আছে আর তিনদিন পর আমার বিয়ে। কিন্তু সেটা এখন আমি ক্যানসেল করে দিলাম। করলাম না তোরে বিয়া! কি হবে তোর মত রহিম্মারে বিয়া না করলে?”

রোদ বলে, “তিনদিন পর বিয়ে? ওয়াও গ্রেট দোস্ত তো বিয়ে তোদের!কনগ্রেচুলেশন বোথ অফ ইউ!”

সুচি বলে, “শুধু তাদের করলে হবে আমাদের করা লাগবে না?”

“মানে একইদিনে বিয়ে?”

সনি বলে, “হ্যাঁ দোস্ত।”

“ওয়াও দোস্ত একসাথে বেস্টুদের বিয়ে হবে মজাই আলাদা!”

সনি বলে, “যদি তোর বিয়েটা ও হয়ে যেতো আমাদের সাথে।”

রোদের মুখে অন্ধকার নেমে আসে। চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।
বন্ধুরা বুঝতে পারে এই জলের কারণ।

রাহাত বলে, “প্রয়াস ভাইয়ার সাথে দেখা করেছিস?”

“না রে অনেক কল দিলাম। টেক্সট দিলাম। উত্তর দেয়নি। আমার জীবনটা এমন কেন বলতে পারিস? প্রয়াস কেনো এমন করছে?
আমার বুকে মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। বলতে পারিস কি করলে এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবো?
ভালবাসা এমন কেনো! আমি তাকে মনে করে ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যাচ্ছি হয়তো সেও! কিন্তু আমার মুখোমুখি কেনো হচ্ছে না?
তবে কি সে বিয়ে করছে রিমিকে সেই জন্য আমাকে ফেইস করতে চাইছে না।”

রাহাত কিছু বলতে যাবে এমন সময় মেঘলা আসে রুমে।

বলে, “আপু বড় আব্বু, আর বড় আম্মু এসেছে তোমার সাথে কথা বলতে ডাকছে তোমায়।”

রোদের বুকে ধুকপুকানি বেড়ে যায়।কেনো এসেছে তারা?
বন্ধুরা সবাই মিলে যায় ড্রয়িং রুমে।

আরিফুর রহমান কিছুটা সময় রোদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

তারপর বলেন, “আমার কাছে আয় মা।”

রোদ উনার পাশে গিয়ে বসে। ইতিমধ্যেই রুমে সবাই এসে বসেছে।রোদের মনে কিছু একটার আশংকা করছে।

আল মাহমুদ রহমান বলেন, “কি হয়েছে বড় ভাই? কোন সমস্যা আমাদের সবাইকে একসাথে ডাকছো যে?”

আরিফুর রহমান সাহেব একে একে উনার স্ত্রীর কথা বলতে থাকেন। রোদ আর প্রয়াসের সম্পর্কের কথা ও। রিফাত আগে থেকেই সব জানতো তাই খুব একটা অবাক সে না হলেও উপস্থিত বাকিরা অনেক অবাক হয়।

মিনু বেগম মেয়ের কাছে গিয়ে বলেন, “তোর মনে এতো ঝড় বয়ে গেছে আর তুই আমাকে বলিস নি পর্যন্ত!”

এতোক্ষনে রোদের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনবরত। মাথা নত করে বসে আছে।

আল মাহমুদ রহমান বলেন, “ভাবী তোমার এতো রাগ আমাদের উপর জানতাম না। তুমি যে আমাদের উপর প্রতিশোধ নিবে সেটাও জানতাম না। আমার ছোট মেয়েটা এতোগুলো বছর কষ্ট পেয়েছে। কাউকে বলতে পর্যন্ত পারেনি। শুধু তোমার জন্য। আমরা তো সব ভুলে গেছি কত আগে। তুমি সব মনে রেখে দিয়েছো এতোদিন!”

রাহেলা বেগম কিছুই বলেন নি। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অপরাধীর মত।আর কি বলার থাকতে পারে উনার। উনার করা অন্যায় আসলেই অনেক বড়।

আরিফুর রহমান, “রোদের বাবাকে বলেন, আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোদ আর প্রয়াসের বিয়ে হোক। এই এতোগুলো বছর আমাদের ছেলে মেয়েগুলো কষ্ট পেয়েছে। আর যাতে কোন কষ্ট না পায় ।তাই আমি চাই তাদের বিয়েটা হয়ে যাক।য

রোদ সাথে সাথে বলে, “অসম্ভব বড় আব্বু। আমি এক মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের ক্ষতি করতে পারবো না। রিমি আর তার বাচ্চাকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবো না।”

রোদের একথা শুনে আরিফুর রহমান চমকানোর ভঙ্গিতে বলেন, “রিমি আর তার বাচ্চার অধিকার! তাদের কিসের অধিকার প্রয়াসের উপর?”

এবার রোদের বুকের ভেতরকার ধুকপুকানি বেড়ে যায়। তার মানে রিমির সাথে বিয়ে হয়নি প্রয়াসের?

রোদ কাঁপা গলায় বলে, “রিমি আপুর সাথে প্রয়াস ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে তাই এটা কোনদিন সম্ভব না।”

আরিফুর রহমান সাহেব বলেন, “রিমির সাথে প্রয়াসের কোন বিয়ে হয় নি। কি বলতেছিস তুই মা? আর বাচ্চাটা ও প্রয়াসের না।”

আরিফুর রহমান বলেন, “রিমিকে বিয়ে করার জন্য প্রয়াসকে আমি অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু প্রয়াস রাজি হয়নি। কারণটা আমি জানতাম না। রাহেলা ও অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি রাজি করাতে।
তারপর আমি দেখে রিমিকে বিয়ে দিয়েছি। রিমি সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে চাইলে ও ভাগ্য তার সহায় হলো না।
রিমি যখন ৫মাসের অন্তসত্বা তখন তার স্বামী এক্সিডেন্টে মারা যায়। তারপর রিমিকে আমি আমাদের বাড়ি নিয়ে আসি। রিমিকে আমি বিয়ে দিয়েছি তাই আমি অপরাধবোধে ভুগছি।
তারপর ও অনেক চেষ্টা করেছি প্রয়াসকে বুঝিয়েছি রিমিকে বিয়ে করতে প্রয়াস রাজি হয়নি। আমি তখন জানতাম না প্রয়াস রোদকে ভালবাসে।”

আল মাহমুদ রহমান সাহেবের এইকথা গুলো শুনে রোদের মনের ভেতর এক আকাশ সুখের পায়রা নেমে আসে। তারা ডানা মেলে উড়তে থাকে মনের আকাশে। যে দিনটির জন্য সে অপেক্ষা করেছে আজ কি সেইদিন। প্রয়াস শুধু তার! শুধু রোদের। মনের ভেতর কথাটা বারবার বাজতে থাকে।
রোদ আর এক মুহুর্তে সেখানে না থেকে দৌড়ে চলে যায় নিজের রুমে। বন্ধুরা ও তার পিছু পিছু যায়।

রোদ সনি সুচিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এই কান্না দুঃখের নয়, এই কান্না সুখের।রোদের বুকের ভেতর সুখ সুখ অনুভব করছে। এই যেন তপ্ত মরুভূমিতে এক ফোঁটা জল প্রাপ্তির স্বাদ। শুস্ক মরুভূমি যেমন এক ফোঁটা জলের আশায় দিন পার করে। ঠিক তেমনভাবে রোদের শুস্ক মন আজ এতোগুলো বছর অপেক্ষার পর জলের স্বাদ ফেলো। ভালবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা করা সহজ কাজ নয়। অনেকটা সাধনা করতে হয়। আর যুগে যুগে এটা প্রমাণ হয়েছে যে অপেক্ষার ফল অতি মিষ্টি হয়।

রোদের জীবনে ও তাই হয়েছে। আজ সে সকল সুখ পাবে যা তার প্রাপ্য, যা তার অধিকার!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here