মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ১৩

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ তেরো

-” হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়ার? কেনো এসেছ এখানে? কি চাই তোমার? কথা বলছো না কেন? ড্যাম ইট!” রাফসান গাড়ির স্টিয়ারিং এ ঘুষি দিয়ে বললো। তার আজ সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ। অকারণে রাগ হচ্ছে খুব। নিজের ওপর সে যারপরনাই বিরক্ত। এজন্য কোনো দলবল ছাড়া শুধু আবিরকে নিয়ে বের হয়েছিল যাতে কিছুক্ষনের জন্য সব চিন্তা ভাবনা গুলো দূরে থাকে। কিন্তু এই মেয়েকে দেখে তার রাগ আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কেনো তা সে জানে না। তারপর তুলতুল চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। রাফসান আবার চিল্লিয়ে বলে-

-” সমস্যা কি তোমার? কথা বলছো না কেন? এখানে কেনো এসেছ আমি জিজ্ঞাস করেছি।”

তুলতুল তারপরও কিছু বললো না। তার ভয় করছে কি দিয়ে কি বলে ফেলবে রাগে তখন এই গুন্ডা আর তাকে আস্ত রাখবে না। কিন্তু কথা গুলো শুনতেও খারাপ লাগছে। কিন্তু তুলতুলের কিছুই করার নেই। বাইরে হয়তো ঐ বান্দর রনি গাড়ি থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। তুলতুল বের হলেই সে আক্রমণ করবে। এতোক্ষণে মনে হয় অন্য শয়তান গুলোকেও ফোন করে আসতে বলেছে। এখন গাড়ি থেকে নামলেই বিপদ। তুলতুল রনির স্বভাব সম্পর্কে জানে। তাদের এলাকার একটি মেয়ের সাথে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। মেয়েটি রনির হাত থেকে বাঁচতে একটা মোটা গাছের পেছনে লুকিয়েছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ পরে কোনো সারা শব্দ না পেয়ে যখন মেয়েটি বেরিয়ে আসে তখন দেখে রনির সাথে আরো কয়েকজন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে শয়তানি হাসি। মেয়েটিকে হেনস্তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারে নি এলাকার কিছু লোকজন ওখান দিয়ে যাওয়ার জন্য। তারাই এগিয়ে আসে। কিন্তু ঐ ঘটনার পর এলাকার লোকজন মেয়েটিকে অকারণে কথা শুনাতো। তার বাবা-মাকেও কথা শুনতে হতো। চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করতো। যারা প্রকৃত দোষী তাদের কিছুই হলো না। শুধু শুধু মেয়েটাকে কোনো দোষ ছাড়া কথা শুনাতো। সাহায্য না করে উল্টো আরো মানসিক ভাবে অত্যাচার করতো।

তুলতুল জানে রাফাসান খারাপ হলেও তার চরিত্র ততটা খারাপ না। এখানে বসে থাকলে হয়তো দেখা গেলো রাফসান রাগে তাকে মেরে দিল। কিন্তু বাইরে গেলে তার চরিত্রে দাগ লাগবে। তার মা- বাবাকে খারাপ কথা শুনতে হবে। এর থেকে এখানে বসে মরে যাওয়াই তুলতুলের কাছে ঠিক মনে হলো।

রাফসান আবারও তুলতুলকে একই প্রশ্ন করে যখন উত্তর পেল না তখন আবার চিৎকার করে বলতে শুরু করে-

-” এই সমস্যা কি তোমার? বারবার কেনো বিরক্ত কর আমায়? তোমাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম। দেখতে তো মনে হয় ভাজা মাছ উল্টো খেতে পারো না। ইনোসেন্ট লুক নিয়ে থাকো। কিন্তু তুমিও অন্য সবার মতো গায়ে পড়া স্বভাবের। যেখানে সেখানে এসে ঝুলে পড়। বাচ্চা একটা মেয়ে দেখে এতদিন ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু না ভুল করেছি। এখন কোলে উঠে বসছো পরে দেখা যাবে আঠা নিয়ে এসে গলায় ঝুলে পড়েছো।”

এটুকু শুনে তুলতুল ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। এতোক্ষণে চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছিল আর এখন জোরেই কান্না করছে। রাফসান তাকে এতো খারাপ ভাবে। গায়ে পড়া মেয়ে? এটা শুনে তার আত্মসম্মানে লেগেছে। কতটা খারাপ ভাবে এই লোক তাকে? অথচ নিজে যে খারাপ এটা দেখে না। তুলতুল নাক টেনে রাফসানের দিকে তাকালো।

রাফসান এতোক্ষণে তুলতুলের চেহারা ভালো করে দেখলো। এতক্ষণ তো মাথা নিচু করে রেখেছিল। চোখ গুলো কান্নার কারণে লাল হলে ফুলে গিয়েছে, গালে চোখের পানি লেপ্টে আছে, গালের একপাশে কিছু চুল লেপ্টে আছে পানির কারনে,নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। রাফসান কিছু মূহুর্ত তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল। সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল কিন্তু তুলতুলের মুখ দেখে কিছু না বলে ওভাবেই তাকিয়ে ছিল। পরমুহূর্তেই মনে পড়ে সে তুলতুলকে কি বলেছে রাগের মাথায়। শিট বলে সে অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে। রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা বলে দিয়েছে। সে জানে তুলতুল ঐ ধরনের মেয়ে না। অন্তত দেখে তাই মনে হয়েছে। আবার মেয়েটি খুব বেশি সেনসেটিভ ও। এর জন্য মেয়েটির মধ্যে অনেক খারাপ প্রভাব ফেলবে। সে না চাইতেও বারবার আঘাত করে ফেলে। রাফসান তুলতুলের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তুলতুল নাক টেনে বলতে শুরু করে

-” আমি বারবার কেন আপনার সামনে পড়ি জানি না। আপনার সাথে দেখা না হলে সবচেয়ে বেশি আমি খুশি হবো। একটা গুন্ডার সাথে এতো দেখা হওয়া ভালো না। কখন দেখা যাবে টুস করে মেরে দিবে। কিন্তু কিভাবে যেন হয়ে যায়। আর আপনি আমাকে গায়ে পড়া মেয়ে বলছেন কেন?” তুলতুল একটু থেমে আবারও গাল থেকে চোখের পানি মুছে নাক টেনে বলে

-” আর আপনি নিজেকে কি মনে করেন হ্যা? যে সব মেয়েরাই আপনার গলায় ঝুলে পড়বে। নিজেকে দেখেছেন আয়নায়? খাম্বা একটা, কি লম্বা বাপরে। চুলগুলো যেন কাকের বাসা,যদিও সিল্কি মনে হয় কিন্তু আউলা ঝাউলা। চেহারায় সবসময় রাগী ভাব করে থাকে। গন্ডার একটা।দেখলেই ভয় করে মনে হয় লাফ দিয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু আফসোস আমি এটা পারি না। আপনি আবার বলছেন গলায় ঝুলবো? কিছু সংখ্যক মেয়েরা আপনাকে হ্যান্ডুস বলে চিল্লায় দেখে একদম হিরো হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তারা জানে না আপনি একটা ভিলেন। আমি জানি। আর আমাকেই বলছেন আপনার গলায় ঝুলে যাবো কখনো না। এরথেকে আম্মু বলেছে রিকশাওয়ালার সাথে ঠিক করে দিবে তার গলায় ঝুলে যাবো,তাও আপনার গলায় না মনে রাখবেন। হুহ।”

রাফসান এই কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তুলতুলের দিকে। রাফসান ভেবেছিল একটু ভালো করে কথা বলবে কিন্তু তার আগেই তুলতুল টরটর করে এগুলা কি বললো? সে গন্ডার? খাম্বা? তার চুলগুলো কাকের বাসা? ওহ মাই গড! বেশির ভাগ মেয়েই তার হাইট, সিল্কি চুল, বডি আর চেহারার সৌন্দর্য দেখে আকৃষ্ট হয়ে পিছে পরতো। সে খারাপ এটা জানার পরও। এড়িয়ে গেলোও পিছে পড়ে থাকতো। আজ সকালে যেমন একটা পড়েছিল। হঠাৎ ঐ মেয়েকে মনে করে তুলতুলকে সে ঝেড়ে ফেলে। সে নিজেও নিজেকে আকর্ষণীয় মনে করে। সবাই তাকে দেখে কিছুটা না অনেকটাই আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু এখন তুলতুলের কথা আর বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে তার ধারণা কিছুটা ভুল। তার কি এখন মেয়েটার ওপর চরম রাগ করা উচিত? নাকি শুট করে দেওয়া উচিত? আর নয়তো আরেকটা দশাশই থাপ্পড় দেওয়া দরকার এই কথা শুনে। যে মেয়েটা তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছে। কিন্তু তার এখন কোনোটাই করতে মন চাইলো না।

রাফসান হঠাৎ করেই তুলতুলের দিকে ঝুঁকে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিল। তারপর গাড়ি স্টার্ট দেয়। আর বাইরে থাকা আবিরকে চিল্লিয়ে বলে

-” আবির তুই চলে যা। আমি ঠিক সময়মত সেখানে পৌঁছে যাবো।”

তুলতুলের যেন নিঃশ্বাস আটকে গিয়েছিল এমন অবস্থা। সে বাইরে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। তারপর রাগী চোখে রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসান গাড়ির স্পিরিট বাড়িয়ে দেয়। তুলতুলের মনে হলো সে হাওয়ায় গতিতে যাচ্ছে। কাচ নামানো, এজন্য বাতাসে ওড়না উড়ে যেতে চাইছে। এত দ্রুত গতিতে চলার জন্য বাইরের গাছগুলোও শাঁই শাঁই করে অস্পষ্ট ভাবে পেছনে যাচ্ছে। তুলতুলের বুক ধড়ফড় করছে। একটা থেকে বেরিয়ে আরেকটা। তুলতুল রাফসানের একহাত ঝাঁকিয়ে জোরে বলে

-” এই আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? গাড়ি থামান। আয়ায়া..”

-” আপনি এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন? বইরা হয়েছেন? থামান গাড়ি।”

-” সামনে অনেক গাড়ি এক্সিডেন্ট করবেন। আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। আমাকে নামিয়ে দিয়ে আপনি যত ইচ্ছা ততো জোরে গাড়ি চালান। আমার যায় আসে না কিন্তু আমাকে নামিয়ে দিন।” তুলতুল রীতিমতো চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। তাকে যেন নামিয়ে দেওয়া হয়। সে এতো তাড়াতাড়ি মরতে চায় না। তার কতো স্বপ্ন রয়েছে। কিন্তু রাফসান একমনে ফুল স্প্রিরিটে গাড়ি চালাচ্ছে।

-“গাড়িতে কেনো উঠে ছিলে?” রাফসান শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো।

-“আমি কি স্বাদে উঠেছিলাম? একেই বলে আকাশ থেকে পড়ে খেজুর গাছে আটকে পড়া।”

-“চুপ যা বলছি তার উওর দাও। বেশি বাড়াবাড়ি করলে খবর আছে। আর কি খেজুর গাছ, খেজুর গাছ করছো। কানের নিচে দেব একটা আর উল্টা পাল্টা কথা বললে।” রাফসান ধমক দিয়ে বললো। সে এখন একটু স্প্রিরিট কমিয়েছে।

-” আমাকে একজন তাড়া করেছিল” তুলতুল মিনমিন করে বললো।

-” একজনের ভয়ে আরেকজনের গাড়িতে উঠেছো। গাড়িতে থাকা লোকটি যদি আবার খারাপ হতো তখন?” রাফসান ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো।

-” ইয়ে মানে আবির উনাকে গাড়ি থেকে বের হতে দেখেছিলাম। তো সেদিন তো ওনার কথায় আপনার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। দেখেতো ভালোই মনে হয়।” তুলতুল দাঁত কেলিয়ে বললো।

-” একদম দাঁত কেলাবে না ভেঙে দেব। আবিরকে তোমার কোন এঙ্গেল থেকে ভালো মনে হয়? আর এখন তো আবির নেই তোমাকে বাঁচাবে কে? হুম ”

-” দেখুন..

-” তোমাকে দেখার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। এখন বলো কে তাড়া করছিল? আর কেনো তাড়া করছিল? ডিটেইলস বলো।”

-” নাম রনি। আমাদের এলাকায় থাকে। মন্টুদের দলের একজন। আমাকে আর দিয়াকে প্রায়ই উত্যক্ত করতো। আজ একা ছিলাম তাই আমার সাথে অসভ্যতামি করছিল। গা ঘেঁষে চলছিল। তাই আমি কয়েকটা মার দিয়েছি। কিন্তু আবার লাঠি নিয়ে তেড়ে আসছিল তাই আপনার গাড়িতে উঠেছি। নাহলে আমার বয়েই গিয়েছে আপনার গাড়িতে উঠতে।”

রাফসান কিছু না বলে আবার গাড়ির স্প্রিরিট বাড়িয়ে দেয়। তুলতুল মানা করছে কিন্তু শুনছে না। তুলতুল হঠাৎ দেখে সামনে দুটো বড় গাড়ি আসছে। রাস্তাটায় জায়গা অনেক কম। যদি সাবধানের সাথে গাড়ি চালায় তাহলে হয়তো ক্রস করা যাবে। কিন্তু রাফসানের গাড়ির চালানোর ধরন দেখে তুলতুলের মনে হচ্ছে এখনই গাড়ি দুটো এই গাড়িকে পিষে ফেলবে। তার মনে হচ্ছে আজই সে মরে যাবে এই গুন্ডার জন্য। গাড়ি কাছাকাছি গেলে তুলতুল রাফসানকে খামচে ধরে চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here